অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/অধ্যায়: সতেরো
ছোটবেলা থেকেই হিন্দুরা পুরাণের গল্প, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প, অবতারদের গল্প একনাগাড়ে শুনতে শুনতে ও পড়তে পড়তে একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করি আত্মা অমর। মৃত্যুতেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। আমরা আবার জন্মাই। আমাদের মধ্যেই কেউ কেউ পূর্বজন্মের স্মৃতি উদ্ধার করতে পারে। এদেরকেই বলি জাতিস্মর।
মুসলিম বা খ্রিস্টান ধর্ম যেহেতু পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না, তাই
তারা ছোটবেলা থেকেই এমন এক পরিবেশে মানুষ হয়,
যেখানে পুনর্জন্মের কোনও স্থান নেই। সুতরাং
বড় হয়ে ওঠার পর তাদের কাছে
পুনর্জন্ম এক অবাস্তব চিন্তা।
পরামনোবিজ্ঞানীরা জন্মান্তরে বিশ্বাস করেন। পূনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্ধ-বিশ্বাসের ওপর।
কিছু পরামনোবিজ্ঞানী দাবি করেন, তারা সম্মোহন করে সম্মোহিত ব্যক্তির স্মৃতিকে পিছোতে পিছোতে শূন্য বয়স এবং জন্মলগ্ন অতিক্রম করে তার পূর্বজন্মের দিনগুলোতেও নিয়ে যেতে পারেন।
মনোবিজ্ঞান মনে করে কোনও একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে সম্মোহন করে তার হারিয়ে যাওয়া শৈশবের কিছু স্মৃতিকে আবার উদ্ধার করা সম্ভব। কারণ সম্মোহিত ব্যক্তির বেশ কিছু শৈশব স্মৃতি মস্তিষ্ক কোষে সঞ্চিত থাকে। যে-ভাবে স্মৃতি সঞ্চিত থাকে কম্পিউটারে। কম্পিউটারকে ঠিকমতো চালিয়ে যেমন সঞ্চিত স্মৃতি উদ্ধার করা সম্ভব, ঠিক তেমনি করেই সম্মোহনের সাহায্যে মানুষের অতীতের কিছু সঞ্চিত অথচ চাপা পড়ে থাকা স্মৃতিকে উদ্ধার করা সম্ভব।
মনোবিজ্ঞান সম্মোহনের সাহায্যে অতীত স্মৃতি উদ্ধারের তত্তকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু পূর্বজন্মের স্মৃতি উদ্ধারের তত্ত্বকে কখনই মেনে নেয়নি।
পরামনোবিজ্ঞানীদের কথামত আত্মার শরীরও নেই, মস্তিষ্কও
নেই। মস্তিষ্ক না থাকলে মস্তিষ্ক কোষও নেই। মস্তিষ্ক
কোষ না থাকলে স্মৃতি জমা থাকার প্রশ্ন নেই।
পূর্বজন্মের স্মৃতি উদ্ধারেরও প্রশ্ন নেই।
ধরা গেল, কোনও ব্যক্তিকে সম্মোহিত করে তার মধ্যে যদি এই ধারণা সঞ্চারিত করা যায় যে, তিনি গতজন্মে রামবাবু ছিলেন। একুশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন শ্যামাসুন্দরীকে। থাকতেন শ্যামপুকুরে। দুই ছেলে ও এক মেয়ের নাম ছিল যথাক্রমে হলধর, গুণধর ও লক্ষ্মী। চাকরি করতেন কলকাতা পুলিশে। একবার হাত ভেঙেছিল, আর একবার নাক। লক্ষ্মীর জন্মের পর একটা প্রমোশন পেয়েছিলেন একান্ন বছর বয়সে। প্রাণ গিয়েছিল ডাকাতের গুলিতে।
এইবার কিছু সাক্ষী-সাবুদের সামনে লোকটিকে আবার সম্মোহিত করে তার গত জন্মের বিষয় জানতে চাইলে তিনি মস্তিষ্কে সঞ্চারিত রামবাবুর কথাই বলে যাবেন।
ধরে নিলাম সম্মোহন করতে জানেন। তিনি যদি জাতিস্মরতা প্রমাণে জন্য কোনও মৃত ব্যক্তির বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে কোনও সম্মোহিত ব্যক্তির মস্তিষ্কে ‘সাজেশন’ পাঠিয়ে তথ্যগুলো সঞ্চারিত করলেন। পরবর্তীকালে লোকটিকে সম্মোহিত করে সঞ্চারিত তথ্যগুলোতেই আবার বলিয়ে নিতেই পারেন। সুতরাং, এখানে একটা বিরাট ফাঁকির সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। সম্মোহনের সাহায্যে একজনকে জাতিস্মর বলে হাজির করার ফাঁকি।
সাধারণত দু-ধরনের জাতিস্মর দেখা যায়। এক: মানসিক রোগী। দুই: প্রতারক। সম্মোহন করে একজনের মস্তিষ্কে কোনও মৃতব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন ঘটনার তথ্যাদি ঢুকিয়ে না দিলেও দেখা যায় কিছু কিছু মানুষ হঠাৎ দাবি করেন, তাঁর পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা চালালে দেখা যাবে তথাকথিত পূর্বজন্মের মানুষটির জীবনের অনেক তথ্যই সত্য। এর কারণ ভূতে পাওয়া বা ঈশ্বরের ভরের মতই জাতিস্মর একটা মানসিক রোগমাত্র। সাধারণভাবে জাতিস্মরের দাবিদার মানসিক রোগীর অল্পবয়স্ক, কল্পনাপ্রবণ এবং আবেগপ্রবণ। এঁদের মস্তিষ্ককোষের স্থিতিস্থাপকতা বা সহনশীলতা এবং যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা কম। সামাজিক, পারিবারিক ও পরিবেশগত কারণে পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। কোনও একজনের মৃত্যু ঘটনা তাঁদের বিশেষভাবে নাড়া দেয়। ঐ মৃতব্যক্তি ও তার বাড়ি, পরিবেশ, পরিবার, শৈশব, কর্মক্ষেত্র, পোশাক, মুদ্রাদোষ ইত্যাদি বিষয়ে একনাগাড়ে ভাবতে থাকলে, বিশেষ কিছু মস্তিষ্ককোষ বারবার উত্তেজিত হতে থাকে। এর ফলে অনেকসময় মস্তিষ্ককোষে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। তখন সে বিশ্বাস করে ফেলে আমিই ওই মৃত ব্যক্তি ছিলাম। এই সময় তথাকথিত জাতিস্মরের মা-বাবা যদি ভ্রান্ত ধারণার শিকার না হয়ে মনোরোগ চিকিৎসকের সাহায্য নেন, তবে রোগী তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।
আবার অনেকসময় সন্তানকে বিখ্যাত করার তাগিদে অথবা কোনও ধনীর সম্পত্তির লোভে কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছায় প্রমাণ করতে চান তাঁদের সন্তান বাস্তবিকই জাতিস্মর। বিখ্যাত হবার জন্য মা-বাবাই মৃতের তথ্য জেনে সন্তানকে সমস্ত তথ্য দিয়ে তাকে জাতিস্মরের ভূমিকায় অভিনয় করান।