আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/চাতুরীর প্রতিফল

চাতুরির প্রতিফল

আমেরিকার অন্তর্বর্ত্তী মিশৌরী নদীর তীরে, আদিমনিবাসী অসভ্যজাতির অধিষ্ঠিত যে প্রদেশ আছে, কিয়ৎকাল পূর্ব্বে, তথায় য়ুরোপীয় লোকের প্রায় যাতায়াত ছিল না। একদা এক য়ুরোপীয় বণিক্‌, নানাবিধ দ্রব্যসামগ্রী লইয়া সেই প্রদেশে বাণিজ্য করিতে গিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গে অনেক বন্দূক ও বারুদ ছিল। তিনি, কিছুদিন তথায় অবস্থিতি করিয়া, তত্রত্য লোকদিগকে বন্দুক ও বারুদের ব্যবহার শিক্ষা করাইলেন। তাহারা মৃগয়াজীবী, বন্দুক ও বারুদ দ্বারা মৃগয়ার পক্ষে বিলক্ষণ সুবিধা দেখিয়া, ব্যগ্র হইয়া তাঁহার নিকট হইতে সমুদয় কিনিয়া লইল, এবং তাহার বিনিময়ে, তত্রত্য উৎপন্ন বস্তু পর্য্যাপ্ত পরিমাণে প্রদান করিল। বণিক্‌, স্বদেশে প্রতিগমন পূর্ব্বক, সেই সমস্ত বস্তু বিক্রয় করিয়া, যথেষ্ট লাভ করিলেন।

 কিয়ৎদিন পরে, এক ফরাসি বণিক্‌, ভূরি পরিমাণে বারুদ লইয়া, সেই প্রদেশে ব্যবসায় করিতে গেলেন। তত্রত্য লোকেরা পূর্ব্বে যে বারুদ লইয়াছিল, তাহা তৎকাল পর্য্যন্ত নিঃশেষিত হয় নাই। সুতরাং তাহারা আর বারুদ লইতে সম্মত হইল না। ঐ ব্যক্তি, বারুদ দিয়া বিনিময়লব্ধ দ্রব্যের বিক্রয় দ্বারা বিলক্ষণ লাভ করিব, এই প্রত্যাশায়, ব্যয় ও পরিশ্রম স্বীকার করিয়া সেইস্থানে গিয়াছিলেন। এক্ষণে, সম্ভাবিত লাভবিষয়ে হতাশ হইয়া, তিনি এই বিবেচনা করিতে লাগিলেন, কি উপায়ে বারুদগ্রহণে ইহাদের প্রবৃত্তি জন্মাইব। অবশেষে, তিনি এক উপায় উদ্ভাবিত করিলেন, এবং, তত্রত্য লোকদিগকে সমবেত করিয়া, কথাপ্রসঙ্গে বলিলেন, তোমরা বারুদের ব্যবহার করিয়া থাক, কিন্তু বারুদ কি পদার্থ, তাহার কিছুমাত্র জান না, শুনিলে চমৎকৃত হইবে। উহা আমাদের দেশের শস্যবিশেষ, বৎসরের অমুক সময়ে ভূমিতে বপন করিলে, অন্যান্য বীজের ন্যায়, যথাকালে ফলপ্রদান করে।

 এই কথা শুনিয়া, সমবেত লোকসকল চমৎকৃত হইল, এবং একবার শস্য জন্মাইতে পারিলে, আমাদের আর য়ুরোপীয়দের নিকট হইতে ক্রয় করিবার আবশ্যকতা থাকিবে না, এই বিবেচনা করিয়া, বহুবিধ দ্রব্যের বিনিময় দ্বারা, তাঁহার নিকট হইতে সমস্ত বারুদ লইল, এবং নির্দ্দিষ্ট সময় উপস্থিত হইলে, যত্নপূর্ব্বক, ক্ষেত্রে তৎসমুদয়ের বপন করিতে লাগিল। য়ুরোপীয় বণিক্‌, এইরূপ চাতুরী করিয়া স্বদেশে প্রতিগমনপূর্ব্বক বিনিময়লব্ধ দ্রব্যসমূহের বিক্রয় দ্বারা যথেষ্ট লাভ করিলেন।

 মিশৌরীয় লোকেরা, ক্ষেত্রে বারুদের বপন করিয়া ভূরি পরিমাণে ফললাভ প্রত্যাশায় অশেষবিধ যত্ন করিতে আরম্ভ করিল, এবং চারা জন্মিলে, পাছে বন্য জন্তুতে নষ্ট করিয়া যায়, এই আশঙ্কায় সতর্ক হইয়া, অহোরাত্র ক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। বহুদিন অতীত হইল, তথাপি চারা নির্গত হইল না। তখন অনেকের মনে এই সন্দেহ উপস্থিত হইল, হয় ত সে ব্যক্তি প্রতারণা করিয়া গিয়াছে। কিন্তু যখন শস্যের নির্দ্দিষ্ট সময় অতীত হইয়া গেল, অথচ অঙ্কুর পর্য্যন্ত অবলোকিত হইল না, তখন তাহারা প্রতারিত হইয়াছি বলিয়া নিশ্চিত বুঝিতে পারল, এবং প্রতিজ্ঞা করিল, আর কখনও আমরা য়ুরোপীয়লোকের সহিত ব্যবহার বা তাহাদের কথায় বিশ্বাস করিয়া কোনও কার্য্য করিব না।

 যথেষ্ট লাভ হওয়াতে ফরাসি বণিকের বিলক্ষণ লোভ জন্মিয়াছিল। কিন্তু এই চাতুরীর পর আর মিশৌরী যাইতে আর সাহস হইল না। তিনি অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, অবশেষে অশেষবিধ দ্রব্যসামগ্রী সমভিব্যাহারে দিয়া, আপন ব্যবসায়ের অংশীকে তথায় পাঠাইয়া দিলেন, বলিয়া দিলেন, আমি তাহাদের সঙ্গে এই চাতুরী করিয়া আসিয়াছি, সাবধান, যেন তাহারা তোমায় আমার অংশী বা আত্মীয় বলিয়া জানিতে না পারে।

 অংশীর নিকট হইতে এই উপদেশ লইয়া, সে ব্যক্তি মিশৌরীতে উপস্থিত হইলেন। তত্রত্য লোকেরা আনীত দ্রব্যসমুদয়ের দর্শনার্থ জাহাজে যাতায়াত করিতে লাগিল। ফরাসি বণিক্‌, পরিচয়প্রদান-বিষয়ে সবিশেষ সাবধান হইয়াছিলেন। কিন্তু তত্রত্য লোকেরা কোনও প্রকারে বুঝিতে পারিল, যে ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে চাতুরী করিয়া গিয়াছে, এ তাহার প্রেরিত ও আত্মীয়, কিন্তু তাহার নিকট কোনও কথাই ব্যক্ত না করিয়া, কতিপয় দিবস ভাবগোপন করিযা রহিল। তাহারা গ্রামের মধ্যস্থলে এক স্থান নিরূপিত করিয়া দিলে, বণিক্, সমুদয় দ্রব্য তথায় অবতীর্ণ করিলেন।

 যে সকল লোক পূর্ব্ব প্রতারিত হইযাছিল, তাহারা আপনাদের অধিপতির অনুমতিগ্রহণ পূর্ব্বক দলবদ্ধ হইয়া, এককালে ফরাসি বণিকের দ্রব্যালয়ে উপস্থিত হইল, এবং এক মুহূর্ত্তর মধ্যে তাঁহার সমুদয় দ্রব্য বলপূর্বক উঠাইয়া লইয়া স্ব স্ব আলয়ে প্রস্থান করিল। তদ্দর্শনে তিনি কিয়ৎক্ষণ হতবুদ্ধি হইয়া রহিলেন, অনন্তর অধিপতির নিকটে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, আপনকার প্রজারা অতি অন্যায়াচরণ করিয়াছে, বিনিময়ে কোনও দ্রব্য না দিয়া, আমার সমস্ত বস্তু বলপূর্ব্বক উঠাইয়া আনিয়াছে, আপনি তাহাদের সমুচিত শাসন করুন, ও আমার ন্যায্য প্রাপ্য দেওয়াইয়া দেন।

 এই অভিযোগ শ্রবণগোচর করিয়া, অধিপতি গভীরভাবে এই উত্তরপ্রদান করিলেন, আমি অবশ্যই যথার্থ বিচার করিব, এবং তোমাকে তোমার প্রাপ্য দেওয়াইব, কিন্তু কিছুদিন অপেক্ষা করিতে হইবে। একজন ফরাসি বণিক, আমার প্রজাদিগকে পরামর্শ দিয়া, বারুদের বপন করাইযাছে। শস্য জন্মিলেই ঐ বারুদ লইয়া, তাহারা মৃগয়া কবিতে আরম্ভ করিবে, মৃগয়ালব্ধ যাবতীয় পশুচর্ম্ম, তোমার দ্রব্যের বিনিময়ে, তোমায় দেওয়াইব।  বণিক্, অধিপতির এই বাক্যের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, আমাদের দেশে বারুদের বপন করিলে শস্য জন্মিয়া থাকে, কিন্তু এখানকার ভূমি তাদৃশ শস্যের উৎপাদনের উপযুক্ত নহে, সুতরাং আপনকার প্রজারা যে বারুদের বপন করিযাছে, তাহাতে শস্য জন্মিবার সম্ভাবনা নাই। আপনি অনুগ্রহ করিয়া, আমার প্রাপ্যদানের আদেশ প্রদান করুন। যে ব্যক্তি এদেশে বারুদ-বপনের পরামর্শ দিয়াছিল, সে ভদ্রলোক নহে, সে আপনকার প্রজাদের সহিত চাতুরী করিয়া গিয়াছে। আমি নিরপরাধ, অন্যের অপরাধে, আমার দণ্ড করা বিধেয় নহে।

 এই কথা শুনিয়া অধিপতি কিঞ্চিৎ কুপিত হইয়া, এইমাত্র উত্তর দিলেন, যদি তুমি আপন মঙ্গল চাও, অবিলম্বে আমার অধিকার হইতে চলিয়া যাও। ফরাসি বণিক, বিষন্ন হইয়া, এই ভাবিতে ভাবিতে প্রস্থান করিলেন, সেবার চাতুরীতে যত লাভ হইয়াছিল, এবার অন্ততঃ তাহার চতুর্গুণ ক্ষতি হইল, এবং চিরকালের জন্য এরূপ এক লাভের পথ রুদ্ধ হইযা গেল। যাহা হউক, আমরা সভ্য, অসভ্য জাতির নিকট বিলক্ষণ নীতিশিক্ষা পাইলাম।