আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/যতো ধর্ম্মস্ততো জয়ঃ
জর্ম্মন্ সাগরের উপকূলে এক সমৃদ্ধিশালী জনপদ আছে। কিছু কাল পূর্ব্বে, ঐ জনপদে সাবিনস নামে এক যুবক ছিলেন। এই যুবক সমৃদ্ধবংশসম্ভূত। তিনি যেরূপ অসাধারণগুণসম্পন্ন ছিলেন, সচরাচর সেরূপ দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহার প্রতিবেশিনী অলিন্দানাম্নী এক কামিনী অলৌকিকরূপলাবণ্যপূর্ণা ও অসামান্যগুণসম্পন্না ছিলেন। ক্রমে ক্রমে, উভয়েরই অন্তঃকরণে প্রণয়সঞ্চার হইলে, সাবিনস্ যথানিয়মে অলিন্দার পাণিগ্রহণ করিলেন। এইরূপে দম্পতিভাবে সম্বদ্ধ হইয়া, উভয়ে মনের সুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন।
কিন্তু অবিচ্ছিন্ন সুখসম্ভোগে কালহরণ করা অল্প লোকের ভাগ্যে ঘটিয়া থাকে। অন্যশুভদ্বেষিণী ঈর্ষ্যা, কিয়ৎ কালের নিমিত্ত তাঁহাদের সুখে কালহরণ করিবার দুরতিক্রম প্রত্যূহ হইয়া উঠিল। ঐ স্থানে এরিয়ানানাম্নী অপর এক কামিনী ছিলেন। তাঁহার সহিত সাবিনসের সন্নিহিতকুটুম্বসম্বন্ধ ছিল। এরিয়ানা বিলক্ষণ সুরূপা, সাতিশয় সমৃদ্ধিশালিনী, স্বভাবতঃ প্রফুল্লহৃদয়া, সদ্বিবেচনাপূর্ণ ও দয়াদাক্ষিণ্যাদিসদ্গুণসম্পন্না ছিলেন। তাহার একান্ত বাসনা ছিল, সাবিনসের সহধর্ম্মিণী হইয়া সুখে কালযাপন করিবেন। কিন্তু সাবিনস্, অলিন্দার পাণিগ্রহণ করাতে, তাঁহার সে বাসনা বিফল হইয়া গেল। তদ্দ্বারা তাঁহার হৃদয় ঈর্ষ্যাকলুষিত ও বিদ্বেষদূষিত হইল। ঈর্ষ্যার কি অনির্বচনীয় মহিমা। তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ প্রফুল্লহৃদয়তা ও দয়াদাক্ষিণ্যাদি গুণ অন্তর্হিত হইল। তিনি ঈর্ষ্যার বশীভূত ও বিদ্বেষবুদ্ধির অধীন হইয়া, অনবরত এই চিন্তা করিতে লাগিলেন, কিরূপে তাঁহাদের অনিষ্টসাধন করিতে পারিবেন, এবং কিরূপেই বা তাঁহাদের বিযোগসংঘটন করিয়া দিবেন। উভয়ের মধ্যে অলিন্দার উপরেই তাঁহার সমধিক আক্রোশ জন্মিয়াছিল কাবণ, অলিন্দা না থাকিলে তাঁহাব সাবিনসের সহিত পবিণয়- সংঘটনের আর কোনও প্রতিবন্ধক ছিল না।
কিছুদিন পরেই, এরিয়ানাব মনস্কামনা পূর্ণ হইবার বিলক্ষণ সুযোগ ঘটিয়া উঠিল। দীর্ঘকাল ব্যাপিয়া, অপর এক ব্যক্তির সহিত সাবিনসের বিবাদ চলিতেছিল। ঐ বিবাদে তাঁহার পরাজযের কিছুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। দৈববিড়ম্বনায় উহার এরূপে নিষ্পত্তি হইল যে, সাবিনসের সর্ব্বস্বান্ত হইয়া গেল। এতদিন তিনি বিলক্ষণ সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তি বলিযা গণনীয় ছিলেন, এক্ষণে একবারে নিতান্ত নিঃস্ব হইয়া পড়িলেন। এরিযানার যে তাঁহার উপর মর্ম্মান্তিক রোষ ও দ্বেষ জন্মিযাছিল, এপর্য্যন্ত তিনি তাহার বিন্দুবিসর্গও অবগত ছিলেন না। তিনি জানিতেন, এরিয়ানা তাঁহার অতি আত্মীয়, এজন্য এই দুঃসময়ে তাঁহার নিকট আনুকূল্য প্রার্থনা করিলেন। এরিয়ানা আনুকূল্য প্রদানে সম্মত হইলেন না। তদ্দর্শনে সাবিনস্ বিস্তর অনুযোগ ও ভর্ৎসনা করিলেন। তখন এরিয়ানা বলিলেন, তুমি যদি আমার মতানুসারে চল, এবং আমি যে প্রস্তাব করিব তাহাতে সম্মত হও, তাহা হইলে আমি তোমার হস্তে সর্ব্বস্বসমর্পণ করিব, এবং যাবজ্জীবন তোমার আজ্ঞানুবর্ত্তিনী হইযা চলিব। আমার প্রস্তাব এই, তুমি অদ্যাবধি অলিন্দা সংস্রব পরিত্যাগ কর।
সর্বস্বান্ত হওয়াতে, সাবিনস যার পর নাই দুরবস্থায় পড়িয়াছিলেন, যথার্থ বটে, কিন্তু তিনি সুশীল, সচ্চরিত্র, সদ্বিবেচক ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন, এবং অলিন্দাকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। তিনি অর্থলোভে পত্নীপরিত্যাগে সম্মত হইবার লোক ছিলেন না, এজন্য ঘৃণা ও রোষ প্রদর্শন পূর্ব্বক, এরিয়ানার প্রস্তাবে অমত ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করিলেন। এরিয়ানা তাহাতে অবমানিত বিবেচনা করিয়া, যৎপয়োনাস্তি কুপিত হইলেন, এবং তদবধি সাবিনসের সহধর্ম্মিণী হইবার প্রত্যাশায় বিসর্জ্জন দিয়া, যাহাতে তাঁহাদের উচ্ছেদসাধন করিতে পারেন, সর্ব্ব প্রযত্নে তাহারই চেষ্টা ও অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। পূর্ব্বে সাবিনসের পিতা, এরিয়ানার পিতার নিকট ঋণগ্রহণ কবিয়াছিলেন। তিনি তাহার পরিশোধ করিয়া যান নাই। ইতঃপূর্ব্বে সে বিষয়ের কোনও উল্লেখ ছিল না। কিন্তু এরিয়ানা, কি সাবিনস্, কেহই এ পর্য্যন্ত ঐ ঋণের বিষয় কিছুমাত্র অবগত ছিলেন না। সদ্ভাব থাকিলে, এরিয়ানা কদাচ ঐ ঋণের আদায়ের চেষ্টা পাইতেন না। কিন্তু, এক্ষণে উল্লিখিত ঋণের সন্ধান পাইয়া, তিনি বিচারালয়ে সাবিনসের নামে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। সাবিনস্, ঋণপরিশোধে অসমর্থ হওয়াতে, কারাগাবে নিক্ষিপ্ত হইলেন। তাঁহার প্রেয়সী অলিন্দা, স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হইযা, তাঁহার সহিত কারাগাবে প্রবেশ করিলেন।
এরূপ অবস্থায় অনেকেরই চিত্তবৈকল্য ও বুদ্ধিবিপর্য্যয় ঘটিয়া থাকে, এবং সাতিশয় সুখসম্ভোগের অবস্থায় সহসা দুঃসহ ক্লেশভোগ ঘটিলে, প্রায় সকলেই শোকাকুল ও ম্রিয়মাণ হয়। কিন্তু সাবিনস ও অলিন্দা, সচ্ছন্দচিত্তে ও অবিচলিত সদ্ভাবে কালহরণ করিতে লাগিলেন, একদিন, একক্ষণের জন্য তাঁহাদের বিষাদ বা অসন্তোষের লক্ষণ ঘটে নাই। উভযেই উভয়কে সুখী ও সচ্ছন্দচিত্ত করিবার নিমিত্ত, প্রাণপণে যত্ন ও প্রয়াস করিতেন। কখনও কখনও সাবিনস্ অলিন্দার কষ্ট-দর্শনে ক্ষুব্ধ হইয়া আক্ষেপ প্রকাশ করিতেন। কিন্তু অলিন্দা বলিতেন, অয়ি নাথ, তুমি অকারণে আক্ষেপ করিতেছ কেন? যদি আমি তোমার সহবাসসুখে বঞ্চিত না হই, তাহা হইলে যত দুরবস্থা ঘটুক না কেন, আমি অণুমাত্র অসুখবোধ করিব না। যতদিন আমার এরূপ বিশ্বাস থাকিবে, আমার উপর তোমার স্নেহের ও অনুরাগের বৈলক্ষণ্য ঘটে নাই, ততদিন কোনও কারণেই আমার চিত্তবৈকল্য বা কষ্টবোধ হইবে না, এবং যত দিন তোমার প্রেয়সী বলিয়া আমার অভিমান থাকিবে, ততদিন সম্পত্তিনাশ, বন্ধুবিচ্ছেদ বা অন্যবিধ কোনও কারণে আমি কিছুমাত্র দুঃখবোধ করিব না। অলিন্দার এইরূপ বাক্যবিন্যাস শ্রবণে মোহিত ও পুলকিত হইয়া, সাবিনস্ অশ্রুবিসর্জ্জন করিতেন।
সর্বস্বান্ত ঘটিবার পরেও, তাঁহাদের যৎকিঞ্চিৎ যাহা সংস্থান ছিল, কিছুদিনের মধ্যেই তাহা নিঃশেষিত হইল, সুতরাং সকল বিষয়েই তাঁহাদের দুঃখের একশেষ ঘটিল। তাঁহারা তাহাতে অণুমাত্র বিষাদ বা অসন্তোষ প্রদর্শন করিলেন না। অল্পদিন হইল, তাঁহাদের যে সন্তান জন্মিয়াছিল, সেইটিকে অবলম্বন করিয়া, তাঁহারা নিরুদ্বেগচিত্তে কালহরণ করিতে লাগিলেন। যাহা হউক, এই সময়ে তাঁহাদের দুঃখের অবধি ছিল না, এবং কত কালে সেই দুঃখের অবসান হইবে, তাহারও স্থিরতা ছিল না।
একদিন অপরাহ্ণসময়ে, তাঁহাদের পুত্রটি ক্রীড়া করিতেছে, এবং তাঁহারা উভয়ে প্রফুল্লচিত্তে ও উৎসুকনয়নে, তাহার ক্রীড়ানিরীক্ষণ করিতেছেন, এমন সময়ে, সহসা এক ব্যক্তি তাঁহাদের সম্মুখবর্ত্তী হইল, এবং অনুচ্চস্বরে তাঁহাদিগকে বলিতে লাগিল, অদ্য দুই দিবস হইল এরিয়ানার মৃত্যু হইয়াছে, মৃত্যুকালে তিনি বিনিযোগপত্র দ্বারা, আপন সর্বস্ব এক আত্মীয় ব্যক্তিকে দান করিয়া গিয়াছেন। ঐ আত্মীয় ব্যক্তি এক্ষণে উপস্থিত নাই, কার্য্যোপলক্ষে দূরদেশে আছেন। কিঞ্চিৎ ব্যয় করিলে, ঐ বিনিযোগপত্র অনায়াসে আপনাদের হস্তগত ও অগ্নিসাৎ হইতে পারে, তাহা হইলে আপনারা তাঁহার সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হইতে পারেন, কারণ, ঐ বিনিযোগপত্রের অসদ্ভাব ঘটিলে, আপনারাই সর্ব্বাগ্রে অধিকারী।
সাবিনস্ ও অলিন্দা, এই ধর্ম্মবিদ্বিষ্ট প্রস্তাব শ্রবণগোচর করিয়া, যৎপরোনাস্তি ঘৃণাপ্রদর্শন কবিলেন, সাতিশয় অসন্তোষ ও রোষ প্রদর্শন পূর্ব্বক প্রস্তাবকারীকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন, এবং এরিয়ানার মৃত্যুসংবাদশ্রবণে সাতিশয় শোকাকুল হইয়া, বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। বস্তুতঃ, এরিয়ানার মৃত্যু হয় নাই, তিনি, সাবিনস্ ও অলিন্দার মনের ভাবপরীক্ষার্থে, ছলনা করিয়া ঐ লোককে ঐরূপ বলিতে পাঠাইয়া দেন। তিনি স্থির করিয়াছিলেন, ইহারা যেরূপ দুরবস্থায় পড়িয়াছে, এই প্রস্তাব শুনিলে অবশ্য তদনুযায়ী কার্য্য করিতে সম্মত হইবে। বিশেষতঃ, আমা হইতে তাহাদের কারাবাস ঘটিয়াছে, সুতরাং আমার মৃত্যু শুনিলে, নিঃসন্দেহ তাহাদের আহ্লাদ জন্মিবে। তিনি, পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থিতি কবিতেছিলেন, সুতরাং স্বকর্ণে ও তাঁহার প্রেরিত প্রতিনিবৃত্ত লোকের মুখে সবিশেষ সমস্ত শ্রবণ করিয়া, তাঁহাদের প্রতি তাঁহার অতিশয ভক্তি জন্মিল, এবং যে বিদ্বেষবুদ্ধির অধীন হইয়া এতদিন তাঁহাদিগকে কষ্ট দিয়াছিলেন, তাহা এককালে অন্তর্হিত হইল। এরূপ সুশীল ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদিগকে অকারণে অবমানিত করিযাছি, ও যারপরনাই কষ্ট দিয়াছি, ইহা ভাবিয়া তিনি যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ ও লজ্জিত হইলেন।
তখন এরিয়ানার হৃদযে স্বভাবসিদ্ধ দয়াদাক্ষিণ্যপ্রভৃতি সদগুণসমুদয় পুনরায় আবির্ভূত হইল। তিনি, অশ্রুপূর্ণলোচনে সেই গৃহে প্রবেশ করিয়া, আকুলবচনে পূর্ব্বকৃত নৃশংস আচরণের নিমিত্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করিলেন, এবং উভয়কেই স্নেহভরে আলিঙ্গন করিয়া, প্রবলবেগে বাষ্পবারিবিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন। সাবিনস্ ও অলিন্দা সেই দিবসেই কারামুক্ত হইলেন। এরিয়ানা, বিনিয়োগপত্র দ্বারা তাঁহাদিগকে স্বীয় সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নির্দ্ধারিত করিয়া রাখিলেন, এবং যাহাতে তাঁহারা আপাততঃ সুখে ও সচ্ছন্দে কালযাপন করিতে পারেন, তাহারও ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। তাঁহারা এইরূপে সকল ক্লেশ হইতে মুক্ত হইয়া, পরম সুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন। কিছুদিন পরেই এরিয়ানার মৃত্যু হইল। অন্তিম সময়ে তিনি এই কথা বলিয়া যান যে, ধর্ম্মপথে থাকিলে অবশ্যই সুখ, সম্পত্তি ও সৌভাগ্যলাভ ঘটে, ধার্ম্মিক ব্যক্তিকে যদিও কোনও কারণে আপাততঃ কষ্টভোগ করিতে হয়, কিন্তু যদি তিনি ধর্মপথ হইতে বিচলিত না হন, চরমে জয়লাভ স্থির সিদ্ধান্ত।