আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/অমায়িকতা ও উদারচিত্ততা
অমায়িকতা ও উদারচিত্ততা
হলষ্টন্ নগরে, রূশিয়া রাজ্যের এক দল অশ্বারোহী সৈন্য থাকিত। ঐ সৈন্যদলের বার্ নামক অধ্যক্ষ, সাতিশয় কার্যদক্ষ ও অসাধাবণ ক্ষমতাপন্ন বলিয়া, বিলক্ষণ খ্যাতিলাভ কবিয়াছিলেন। কিন্তু, তিনি, কোন্ দেশে, কোন্ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাহা কেহই জানিত না। লুসম্ নামক নগরে অবস্থিতিকালে, তিনি যেরূপ আত্মপরিচয় দিয়াছিলেন, তাহাতে ব্যক্তিমাত্রেই চমৎকৃত ও আহলাদিত হইযাছিলেন।
এক দিন সৈন্যসংক্রান্ত কর্মচারিগণ ও আর কতক গুলি ভদ্র লোক, তদীয় আলয়ে আহার করিবার নিমিত্ত, নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। ঐ নগরে এক ব্যক্তি সামান্য ব্যবসায় অবলম্বন পুর্ব্বক কথঞ্চিৎ জীবিকানির্ব্বাহ করিতেন। সেনাপতি বার্ এক সহকারী কর্ম্মচারী দ্বারা, ঐ ব্যক্তিকে বলিয়া পাঠাইলেন, আজ অমুক সময়ে আপনি সস্ত্রীক, আমার আবাসে আসিবেন।
সেনাপতি কি জন্য আহবান করিলেন, তাহা বুঝিতে না পারিয়া, তিনি অতিশয় ভয় পাইলেন। তাঁহার আদেশ লঙ্ঘিত হওয়া উচিত নহে, এই বিবেচনায, তিনি সস্ত্রীক, তদীয় আলয়ে উপস্থিত হইলে, সেনাপতির সম্মুখে নীত হইলেন। সেনাপতি, তাঁহাদের দিকে দৃষ্টিসঞ্চারণ করিয়া, বুঝিতে পারিলেন, তাঁহারা অতিশয় ভয় পাইযাছেন। তখন তিনি সাদর সম্ভাষণ পূর্ব্বক অভযদান করিয়া বলিলেন, আমি, কোনও দুষ্ট অভিপ্রাযে, আপনাদের আহ্বান করি নাই। আমি কোনও প্রকারে অত্যাচার বা অসদ্ব্যবহার করিব, আপনারা ক্ষণকালের জন্যও, সে আশঙ্কা করিবেন না, আপনাদের সহিত বিশিষ্টরূপ আলাপ করা আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। অদ্য আমি আপনাদিগকে আহার করাইব। আপনারা, নির্ভয় ও নিরুদ্বেগ হইযা, উপবেশন করুন। এই বলিয়া, তিনি তাঁহাদিগকে আপন সমীপে উপবেশিত করিলেন, এবং নিয়তিশয় সদয়ভাবে, তাঁহাদের সহিত নানা বিষযে, কথোপকথন করিতে লাগিলেন।
আহারের সময় উপস্থিত হইল। সেনাপতি তাঁহাদিগকে আপনার নিকট বসাইলেন; সাতিশয় যত্ন ও আদর পূর্ব্বক, আহার করাইলেন; এবং তাঁহাদের পবিবারসংক্রান্ত নানা কথা জিজ্ঞাসিতে লাগিলেন। সে ব্যক্তি বলিলেন, আমার পিতা, সামান্য ব্যবসায় দ্বাবা, জীবিকানির্ব্বাহ করিতেন, আমি তাঁহার জ্যেষ্ঠ সন্তান, আমার দুইটী সহোদর ও একটা ভগিনী আছেন। সেনাপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, এই দুই ভিন্ন অপনকার কি আর সহোদর নাই? তিনি বলিলেন, না মহাশয, এক্ষণে, আমার অব সহোদর নাই। আমার আর একটি সহোদর ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি সৈনিক দলে প্রবিষ্ট হইবাব নিমিত্ত, অতি অল্প বয়সে, বাটী হইতে প্রস্থান করিয়াছেন। তিনি অদ্যাপি জাীবিত আছেন কি না, বলিতে পারি না, কারণ, তদবধি আর তাঁহার কোনও সংবাদ পাওয়া যায় নাই।
অত্যুচ্চপদারূঢ় সেনাপতিকে, এক সামান্য দোকানদারের সহিত, সাতিশয় সদয় ভাবে, কথোপকথনে অবিষ্ট (দখিয়া, তাঁহার অধীন সৈন্যসংক্রান্ত কর্মচারীরা চমৎকৃত হইলেন। সেনাপতি, তাঁহাদের ভাব বুঝিতে পারিয়া, বলিলেন, হে ভ্রাতৃগণ, সর্ব্বদা শুনিতে পাই, আমি কোন দেশে, কোন্ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, এ বিষযে তোমৱা সতত অনুসন্ধান কবিযা থাক, কিন্তু, এ পর্যন্ত কৃতকার্য্য হইতে পার নাই। এজন্য, আজ আমি তোমাদিগকে জানাইতেছি, এই নগর আমার জন্মস্থান, ইনি আমার জ্যেষ্ঠ সহোদর। এই কথা শুনিয়া, সকলে বিশেষতঃ তাঁহারা স্ত্রীপুরুষে, বিস্ময়াপন্ন হইলেন। অনন্তর, সেনাপতি, নিরতিশয় স্নেহ ও সমাদর সহকারে, আলিঙ্গন করিয়া, স্বীয় জ্যেষ্ঠ সহোদরকে বলিলেন, অপনকার (য সহোদর নরলোকে বিদ্যমান নাই বলিয়া, বোধ করিয়াছন, আমি আপনকার সেই সহোদর। কল্য আমরা সকলে আপনকার আলয়ে আহার করিব। এই বলিয়া, তিনি তাঁহাদের স্ত্রীপুরুষকে, সবিশেষ সম্মানপূর্ব্বক, বিদায় দিলেন, এবং, যাহাতে তদীয় আলয়ে আহারক্রিয়া, সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, তাঁহার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করিয়া দিবার নিমিত্ত, আদেশপ্রদান করিলেন।
এইরূপে আত্ম-পরিচয় প্রদান করিয়া, মহামতি সেনাপতি, স্বীয জ্যেষ্ঠ সহোদবের সাংসারিক ক্লেশে, সর্বতোভাবে নিবারণ কবিলেন। তদবধি, তাঁহার জ্যেষ্ঠ সৰ্বত্র মান্য হইয়া, সুখে ও স্বচ্ছন্দে সংসারযাত্রা সম্পন্ন করিতে লাগিলেন। সেনাপতিব ঈদৃশ ব্যবহার দর্শনে চমৎকৃত হইয়া, তত্রত্য সমস্ত লোক, মুক্ত-কণ্ঠে সাধুবাদপ্রদান করিয়াছিলেন।