আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/যথার্থবাদিতা ও অকুতোভয়তা
যথার্থবাদিতা ও অকুতোভয়তা
প্রসিদ্ধ সাহসী চতুর্থ এলনজো, যৌবনকালে পোর্ত্তুগালের রাজসিংহাসনে অধিরূঢ় হয়ন। তিনি সাতিশয় মৃগয়াসক্ত ছিলেন, এবং মৃগয়ার আমোদেই, সমস্ত সময় অতিবাহিত করিতেন। আপনারা সম্পূর্ণ আধিপত্য করিতে পারিবেন, এই অভিপ্রায়ে, তদীয় প্রিয়পাত্রেরা, মৃগয়ার গুণকীর্ত্তন করিয়া, তাঁহাকে মৃগয়াতে উৎসাহিত করিতেন। মৃগযাব অনুরোধে, তিনি নিয়ত অরণ্যে অবস্থিতি করিতেন, রাজকার্য্যে একেবারেই মনোযোগ দিতেন না, তাহাতে রাজ কার্যনির্ব্বাহ বিষযে বিলক্ষণ বিশৃঙ্খলা ঘটিতে লাগিল।
কিছুদিন পরে, গুরুতর কার্য্যবিশেষে অনুরোধে, তাঁহাকে রাজধানীতে উপস্থিত হইতে হইল। তাঁহার উপস্থিতির পূর্ব্বে, রাজ্যের প্রধান লোকেরা ও রাজমন্ত্রীরা, সভবনে সমবেত হইয়া, তদীয় আগমনের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। তিনি, সভাভবনে প্রবিষ্ট ও সিংহাসনে উপবিষ্ট হইয়াই, একমাস অরণ্যে থাকিয়া, মৃগয়ার আমোদে, কেমন সুখে কালযাপন করিয়াছেন, আহলাদে উম্মওপ্রায় হইয়া, তাহার সবিশেষ বর্ণন করিতে লাগিলেন; যে কার্যের অনুরোধে, তাঁহাকে রাজধানীতে আসিতে হইয়াছে, তাহার একবারও উল্লেখ করিলেন না।
তাঁহার বাক্য সমাপ্ত হইলে, এক অতি প্রধান সম্ভ্রান্ত লোক দণ্ডাযমান হইলেন, এবং বলিলেন, রাজসভা ও রণক্ষেত্র রাজাদেব নিমিত্ত নিরূপিত হইয়াছে, বন জঙ্গল তাঁহাদের নিমিত্ত অভিপ্রেত নহে। গৃহস্থ লোক, আবশ্যক কার্যে দৃষ্টি না রাখিয়া, কেবল আমোদে কাল কাটাইলে, তাহাদেরই অনিষ্ট হইয়া থাকে, কিন্তু রাজারা, রাজকার্য্যে জলাঞ্জলি দিয়া, কেবল আমোদে আসক্ত হইলে, দেশস্থ সমস্ত লোকের অনিষ্ট হ্য়, আপনি মৃগয়াস্থলে যে ক্ষমতা প্রকাশ করিযাছেন, তাহা শুনিবার নিমিত আমরা এখানে আসি নাই, কোনও গুরুতব কার্য্যের অনুরোধেই আসিযাছি। মহারাজের প্রজাদের যে ক্লেশ ও দুরাবস্থা ঘটিয়াছে, যদি তাহার প্রতিবিধানে মনোযোগী ও যত্নবান্ হন, তবেই তাহারা আপনকাব অনুগত ও আজ্ঞাবহ হইয়া থাকিবে, নতুবা—এই পর্যন্ত শুনিয়াই ক্রোধে অধৈর্য্য হইয়া, রাজা বলিলেন, নতুবা কি করিবে? রাজার ক্রোধ দর্শনে, কোনও অংশে শঙ্কিত না হইয়া, সেই সম্ভ্রন্ত ব্যক্তি দৃঢ়বাক্যে বলিলেন, নতুবা, তাহারা রাজধর্ম্ম প্রতিপালন করেন, এরূপ কোনও ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাইবার চেষ্টা দেখিবে।
এই কথা কর্ণগোচর হইবামাত্র, এলনজোর কোপানল প্রজ্জ্বলিত হইযা উঠিল। তখন তিনি, তোমরা আমার যে অবমাননা করিলে, অবিলম্বে তাহার সমুচিত প্রতিফল দিতেছি, এই বলিযা, সভাগৃহ হইতে বহির্গত হইলেন, কিন্তু, কিয়ৎক্ষণ পবেই, নিতান্ত শান্তিমূর্তি হইয়া, সভাগৃহে প্রবেশ করিলেন, এবং সাদর সম্ভাষণ পুবঃসব সেই সন্ত্রান্ত ব্যক্তিকে বলিলেন, আপনি যাহা বলিলেন, আমি তাহার মর্ম্মগ্রহ করিতে পারিয়াছি। বাস্তবিক, যে ব্যক্তি, রাজা হইয়া, প্রজার হিতসাধনে যত্নবান্ না হইবে, প্রজারা কখনই তাহার অনুগত থাকিবে না। আমি ধর্ম্মসাক্ষী করিয়া, সর্বসমক্ষে প্রতিজ্ঞা কবিতেছি, আজ অবধি, অর আমি মৃগয়া বা অন্যবিধ ব্যসনে, ক্ষণকালের জন্যও আসক্ত হইব না, অনন্যমনাঃ ও অনন্যকর্ম্মা হইযা, সৰ্বপ্রযত্নে রাজকার্যসম্পাদনে তৎপর হইব, প্রাণান্তেও এই প্রতিজ্ঞাব লঙ্ঘন করিব না।
এই প্রতিজ্ঞাবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, রাজসভায সমবেত সম্রান্তগণ ও অমাত্যবর্গ আহলাদসাগরে মগ্ন হইলেন, এবং আশীৰ্বাদপ্রয়োগ পূর্ব্বক, রাজাকে ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন। রাজা, সেই দিন অবধি, মৃগয়া প্রভৃতি সর্ব্ববিধ ব্যসনে বিসর্জ্জন দিযা, দিবারাত্র, রাজকার্য্যসম্পাদনে নিবিষ্টচিত্ত হইলেন, একদিন একক্ষণের জন্যও, সে বিষয়ে অযত্ন বা উপেক্ষা করেন নাই। ফলতঃ, তিনি রাজ্যের যেরূপ মঙ্গলবিধান ও প্রজাবর্গের যেরূপ হিতসাধন কবি গিয়াছেন, পোর্ল্ড গাল-দেশে কখনও কোনও রাজা সেরূপ করিতে পাবেন নাই।