আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/ঐশিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস

ঐশিক্ ব্যবস্থায় বিশ্বাস

একটি দুঃখী বালক অল্প বয়সে পিতৃহীন ও মাতৃহীন হইয়াছিল। সে পিতা মাতার একমাত্র সন্তান। তদীয় ভরণপোষণের ভারগ্রহণ করেন, তাহার এরূপ কোনও আত্মীয় ছিলেন না। আহার প্রভৃতি সমস্ত আবশ্যক বিষয়ে তাহার ক্লেশের পরিসীমা ছিল না। কিন্তু, তাহার বুদ্ধি ও বিবেচনা বিলক্ষণ ছিল। সে স্থির করিয়াছিল, আমি প্রাণান্তে পরের গলগ্রহ হইব না, পরের গলগ্রহ হওয়া অপেক্ষা অনাহারে প্রাণত্যাগ করা ভাল। যথাশক্তি পবিশ্রম করিয়া, যাহা পাইব, তাহাতেই কোনও রূপে আপন ভরণপোষণ সম্পন্ন করিব।

 একদিন এই দীন বালক শুনিতে পাইল, অমুক ব্যক্তির একটি অল্পবয়স্ক পুরিচারকের প্রয়োজন হইয়াছে, তিনি লোকের অন্বেষণ করিতেছেন। এই কথা শুনিয়া, অতিশয় আহ্লাদিত হইযা, সে, ঐ ব্যক্তির নিকটে উপস্থিত হইল, এবং জিজ্ঞাসা করিল, মহাশয়, আপনকার কি একটি অল্পবয়স্ক পরিচারকের প্রযোজন হইযাছে? যদি সেরূপ প্রযোজন হইয়া থাকে, অনুগ্রহ করিয়া, আমায় নিযুক্ত করুন। সে ব্যক্তি বলিলেন, এক্ষণে আমার ওরূপ পরিচাবকের প্রয়োজন নাই। বালক শুনিয়া, হতাশ্বাস হইয়া, ম্লান-বদনে দণ্ডায়মান রহিল।

 সে ব্যক্তি বালকের মুখ ম্লান দেখি দুঃখিত হইলেন; এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার কি কোথাও কর্ম্ম জুটিতেছে না? তখন বালক বলিল, না মহাশয়, আমি অনেক চেষ্টা দেখিতেছি, কিন্তু কোথাও কিছু হইতেছে না। একটী স্ত্রীলোক আমায় বলিয়াছিলেন, আপনকার লোকের প্রয়োজন হইযাছে, সেই জন্য আপনকার নিকটে আসিয়াছিলাম। এখন বুঝিতে পারিলাম, তিনি সবিশেষ না জানিই ওরূপ বলিয়াছিলেন।

 বালকের ভাব দর্শনে, তদীয় অন্তঃকরণে বিলক্ষণ দয়ার উদয় হইল। তখন তিনি আশ্বাস প্রদানের নিমিত্ত কহিলেন, তুমি হতোৎসাহ হইও না। এই কথা শুনিয়া, বালক প্রফুল্লচিত্তে বলিল, না মহাশয, যদিও আমি অশন বসন প্রভৃতি সর্ব্ববিষযে, সাতিশয় ক্লেশ পাইতেছি, তথাপি একদিনের জন্যও হতোৎসাহ হই নাই। সম্পূর্ণ আশা আছে, আমি অচিরে কোনও স্থানে নিযুক্ত হইয়া, আপন ক্লেশ দূর করিতে পারিব। দেখুন, এই পৃথিবী অতি প্রকাণ্ড স্থান। ঈশ্বর এই পৃথিবীর কোনও স্থানে অবশ্যই আমার জন্য কোন ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন, এ বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আমি কেবল সেই ব্যবস্থায় অন্বেষণ করিতেছি।

 এক ডাক্তার, কিঞ্চিৎ দূরে অলক্ষিতভাবে অবস্থিত হইয়া, এই কথোপকথন শুনিতেছিলেন। তিনি বালকের মুখে এই সকল কথা শুনিয়া, সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন; এবং তৎক্ষণাৎ তাহার সম্মুখবর্তী হইয়া বলিলেন, ওহে বালক, তুমি ঠিক বলিয়াছ, আমার সঙ্গে আইস, আমি তোমায় নিযুক্ত করিব, আমার, তোমার মত পরিচারকের প্রযোজন আছে। এই বলিয়া, তিনি সেই বালককে আপন আলয়ে লইয়া গেলেন, এবং তাহাকে যে সকল কর্ম্ম করিতে হইবে, সে সমুদয় বলিয়া দিলেন। বালক, এই রূপে নিযুক্ত হইয়া, যথোচিত যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে কার্য্য করিতে লাগিল, একদিন একক্ষণের জন্যও আলস্য বা ঔদাস্য করিল না। তদ্দর্শনে ডাক্তার, যার পর নাই প্রীতিপ্রাপ্ত হইযাছিলেন।