আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/সংসারে নম্র হইয়া চলা উচিত
সংসারে নম্র হইয়া চলা উচিত
আমেরিকা মহাদ্বীপে বেঞ্জামিন্ ফ্রাঙ্কলিন নামে এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অসাধারণ বুদ্ধিমান, বিখ্যাত বিদ্বান, বিলক্ষণ কার্য্যদক্ষ ও রাজনীতিবিষযে বহুদর্শী ছিলেন, এবং কি স্বদেশে, কি বিদেশে, অসাধারণ ব্যক্তি বলিয়া পরিগণিত হইয়াছিলেন। যখন তাঁহার বয়স অল্প, সে সময়ে, তিনি, ডাক্তার কটন্ মেথরের নিকট একটি উপদেশ পাইয়াছিলেন; ঐ উপদেশের উল্লেখ করিয়া, তদীয় পুত্র ডাক্তার সামুয়েল্ মেথরকে ১৭৮১ খৃষ্টাব্দে ১২ই মে, পাসিনামক স্থান হইতে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহার মর্ম্ম নিম্নে নির্দ্দিষ্ট হইতেছে।
১৭২৪ সালে আমি আপনার পিতার সহিত শেষ দেখা করি, তৎপরে আর আমার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। কিয়ৎক্ষণ কথোপকথন কুরিয়া, আমি তাঁহার নিকট বিদায় হইলাম। প্রস্থানকালে তিনি আমায় একটি পথ দেখাইয়া দিলেন, এবং বলিলেন, “এই পথটি সোজা, এই পথ দিয়া গেলে, অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে বাটী হইতে বহির্গত হইতে পারিবে”। এই পথটি অল্প- পরিসর, মধ্যস্থলে মাথার উপব একটি কড়িকাঠ ছিল। আমি ঐ পথ দিয়া চলিলাম। আপনকার পিতা আমার পশ্চাৎ আসিতেছিলেন। এই সমযেও আমরা কথোপকথন করিতেছিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে, আপনকার পিতা, ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, মাথা নীচ কর, মাথা নীচ কর। কি জন্য তিনি ব্যস্ত হইযা ওরূপ বলিলেন, তৎকালে তাহা বুঝিতে পাবিলাম না। কিঞ্চিৎ পরেই কড়িকাঠে আমার মাথা ঠোকা গেল। তখন, কেন তিনি মাথা নীচ করিতে বলিয়াছিলেন, তাহার মর্ম্মগ্রহ করিতে পারিলাম।
আপনকার পিতা অতি মহাশয় লোক ছিলেন; কোনও একটা উপলক্ষ হইলেই, অল্পবয়স্ক ব্যক্তিদিগের হিতার্থে যত্নপূর্ব্বক উপদেশ দিতেন। কড়িকাঠে আমার মাথা ঠোকা গেল দেখিয়া, তিনি সাতিশয় দুঃখপ্রকাশ করিলেন, এবং এই উপলক্ষ করিয়া, আমায় বলিলেন, দেখ, তুমি যৌবনদশায় উপনীত হইযাছ। অতঃপর তোমায় সংসারযাত্রা সম্পন্ন করিতে হইবে। “সংসার অতি বিষম স্থান, অসাবধান ও উদ্ধত হইয়া চলিলে, পদে পদে বিপদে পড়িতে হয়। অতএব, সাবধান ও নম্র হইয়া চলিবে, মস্তক উন্নত করিয়া চলিলে, সর্ব্বদা এইরূপ আঘাত পাইতে হইবে”।
এই নিরতিশয় হিতকর উপদেশবাক্য শ্রবণ অবধি, সর্ব্বক্ষণ আমার হৃদয়ে জাগরূক রহিয়াছে। ইহা দ্বারা আমি অশেষ প্রকারে উপকার প্রাপ্ত হইয়াছি। যখন দেখিতে পাই, কোনও ব্যক্তি অহঙ্কারে মত্ত হইয়া, মস্তক উন্নত করিয়া, উদ্ধতভাবে চলেন, এবং তজ্জন্য পদে পদে অপদস্থ, অবমানিত ও বিপদ্গ্রস্ত হয়েন, তখন এই উপদেশবাক্যের মহিমা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। ব্যক্তিমাত্রেরই এই উপদেশবাক্যের অনুসরণ করা সর্ব্বতোভাবে উচিত ও আবশ্যক।