আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/কৃতজ্ঞতার পুরস্কার

কৃতজ্ঞতার পুরস্কার

 ইংলণ্ড দেশে, ফিটজউইলিযম্ নামে এক ব্যক্তি স্বীয় বুদ্ধি, ক্ষমতা ও পরিশ্রমের গুণে বিলক্ষণ অর্থোপার্জ্জন করিয়াছিলেন। তিনি অতিশয় কৃতজ্ঞ, দয়াশীল, তেজীয়ান্, ন্যায়পরায়ণ ও অকুতোভয় ছিলেন। সামান্য অবস্থার লোক হইয়াও, তিনি যে প্রভূত অর্থের উপার্জ্জনে সমর্থ হইয়াছিলেন, সর্ব্বপ্রধান রাজমন্ত্রী কার্ডিনেল উলজির দয়া ও অনুগ্রহই তাহার প্রধান কারণ। স্বভাবসিদ্ধ কৃতজ্ঞতা গুণের আতিশয্যবশতঃ তিনি ঐশ্বর্য্যশালী হইয়াও, আন্তরিক ভক্তি সহকারে, মহোপকারক উলজির যথেষ্ট সম্মান করিতেন।

 তৎকালীন ইংলণ্ডের অধীশ্বর, অষ্টম হেনরি, সাতিশয় উদ্ধতস্বভাব ও অবিমৃষ্যকারী পুরুষ ছিলেন। তিনি কোনও কারণে কূপিত হইয়া, সবিশেষ অবমাননা পূর্ব্বক, উলজিকে মন্ত্রিত্বপদ হইতে বহিষ্কৃত করেন। এইরূপে অপদস্থ ও অবমানিত হইয়া, তিনি সকলের অবজ্ঞাভাজন হইযাছিলেন। পাছে রজার কোপে পতিত হইতে হয়, এই আশঙ্কায়, কেহ কোনও বিষয়ে, তাঁহার কোনও আনুকূল্য করিতেন না। ফিটজ্ উইলিযম্ তাঁহার পদচ্যুতি ও অবমাননার বিষয় অবগত হইয়া, যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলেন, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিযা, সাতিশয় আক্ষেপপ্রকাশ পূর্ব্বক, তাঁহাকে নরখেমটন নামক স্থানে লইয়া গেলেন, এবং ঐ স্থানে মিল্টন নামে, যে স্বীয় পরম রমণীয় বাসস্থান ছিল, তাঁহাকে তথায় রাখিয়া, যথোচিত ভক্তি ও সম্মান সহকারে তাঁহার পরিচর্যা করিতে লাগিলেন।

 এই বিষয় কর্ণগোচর হইলে, ইংলণ্ডেশ্বর, ফিটজ্ উইলিয়ামের উপর যৎপরোনাস্তি কুপিত লইলেন। তদীয় আদেশ অনুসারে, তিনি রাজসভায আনীত হইলে, ইংলণ্ডেশ্বর, সাতিশয় রোষপ্রদর্শন পুরঃসর, কর্কশ বচনে বলিলেন, তোমার এত বড় আস্পর্দ্ধা যে, তুমি এক রাজবিদ্রোহীকে আপন আলয়ে লইয়া গিয়া, আমোদ আহলাদ করিতেছ। বাজার রোষ দর্শনে কিঞ্চিম্মাত্র ভীত বা চলচিত্ত না হইয়া, তিনি অতি বিনীত বচনে নিবেদন করিলেন, মহারাজ, আমি আপন আলয়ে লইয়া গিয়া কার্ডিনেলের যে পরিচর্য্যা করিতেছি, রাজভক্তির অসদ্ভাব তাহার কারণ নহে, আমি তাঁহার নিকট অশেষ প্রকারে যে প্রভূত উপকার প্রাপ্ত হইয়াছি, ইহা কেবল তজ্জন্য সামান্য কৃতজ্ঞতাপ্রদর্শন মাত্র।

 এই হেতুবাদ কর্ণগোচর হইলে, ইংলণ্ডেশ্বর, অধিকতর কুপিত হইয়া বলিলেন, সে আবার কি? ইংলণ্ডেশ্বর, উত্তরোত্তর, অধিকতর কুপিত হইতেছেন দেখিয়া, পাছে তিনি তাহাঁকে রাজভক্তিহীন ভাবেন, এই ভয়ে ও ভাবনায় অভিভূত হইয়া, ফিটজ্ উইলিয়ম, অঞ্জলিবন্ধন পূর্ব্বক, অশ্রুপূর্ণ লোচনে, বিনীত বচনে বলিলেন, মহারাজ, আমি সামান্য অবস্থার লোক হইয়াও, বিলক্ষণ ঐশ্বর্য্যশালী হইয়াছি, কার্ডিনেলের অনুগ্রহ ও সহায়তা ব্যতিরেকে, কখনই আমার এ উন্নত অবস্থা ঘটিত না; সুতরাং আমি তাঁহার নিকটে দুর্ভেদ্য কৃতজ্ঞতাশৃঙ্খলে বদ্ধ আছি। তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞতাপ্রদর্শন না করিলে, আমি ভদ্রসমাজে হেয় ও অশ্রদ্ধেয়, এবং ধর্ম্মদ্বারে পতিত হইব, কেবল এই ভয়ে ও এই বিবেচনায়, অবসর পাইয়া, তাঁহার প্রতি যথাশক্তি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনে প্রবৃত্ত হইযাছি।

 তদীয় প্রশংসনীয উত্তরবাক্য শ্রবণে, নিরতিশ্য় প্রীত ও প্রসন্ন হইযা, ইংলণ্ডেশ্বব, স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্যভাব বিসর্জ্জন দিয়া, তৎক্ষণাৎ সিংহাসন হইতে অবতীর্ণ হইলেন, এবং নিকটে গিয়া আন্তরিক অনুরাগ সহকারে, তাঁহার করগ্রহণ পূর্ব্বক বলিলেন, এরূপ কৃতজ্ঞতার যথোচিত পুরস্কার হওয়া সর্ব্বতোভাবে উচিত ও আবশ্যক। তুমি সর্ব্বাংশে প্রশংসনীয়, প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তি। আজ অবধি, তুমি একজন রাজকর্মচারী নিযুক্ত হইলে, আমার আর যে সকল কৰ্মচারী নিযুক্ত আছেন, কৃতজ্ঞতা কাহাকে বলে, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই তাহা অবগত নহেন, তোমায তাঁহাদিগকে কৃতজ্ঞতা শিখাইতে হইবে। বলিতে কি, তোমার অদৃষ্টচর আচরণ দর্শনে ও অশ্রুতচর বচন শ্রবণে, চমৎকৃত ও আহলাদে পুলকিত হইয়াছি।

 এইরূপে, স্বীয় আন্তরিক ভাবপ্রকাশ করিয়া, ইংলণ্ডেশ্বর, সেই মুহূর্ত্তে, সেই ক্ষেত্রে, ফিটজ্ উইলিয়মকে নাইট্[১] উপাধিপ্রদান পূর্ব্বক, রাজমন্ত্রীর পদে প্রতিষ্ঠিত করিলেন।

  1. নাইট্- উপাধিবিশেষ। অসাধারণ ক্ষমতাপ্রকাশদর্শনে অথবা অন্য কোনও কারণে, রাজারা ব্যক্তিবিশেষকে এই মাননীয় উপাধি দিয়া থাকেন। যাঁহারা এই উপাধি পান, তাঁহাদের নামের পূর্ব্বে সর এই শব্দটি ব্যবহৃত হইয়া থাকে, যথা, সর্ আইজাক নিউটন্, সর্ উইলিয়ম জোন্স্ ইত্যাদি।