আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/প্রত্যুপকার (২)



প্রত্যুপকার

আলি ইবন্ আব্বস্ নামে এক ব্যক্তি, মামুন্ নামক খলীফার প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন, আমি একদিন অপরাহ্ন, খলীফার নিকটে বসিযা আছি, এমন সময়ে, হস্তপদবদ্ধ এক ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখে নীত হইলেন। খলীফা, আমার প্রতি এই আজ্ঞা করিলেন, তুমি এ ব্যক্তিকে, আপন আলয়ে লইয়া গিযা, রূদ্ধ করিয়া রাখিবে, এবং কল্য আমার নিকটে উপস্থিত করিবে, তদীয় ভাব দর্শনে স্পষ্ট প্রতীতি হইল, তিনি ঐ ব্যক্তির উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইযাছেন। আমি তাঁহাকে আপন আলয়ে আনিয়া, অতি সাবধানে রুদ্ধ করিয়া রাখিলাম, কারণ, যদি তিনি পলাইয়া যান, আমায় খলীফার কোপে পতিত হইতে হইবে। . কিযৎক্ষণ পরে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসিলাম, আপনকার নিবাস কোথায়? তিনি বলিলেন, ডেমাস্বাস্ আমার জন্মস্থান, ঐ নগরের যে অংশে বৃহৎ মসজিদ্ আছে, তথায় আমার বাস। আমি বলিলাম, ডেমাস্কস্ নগরের, বিশেষতঃ যে অংশে আপনকার বাস, তাহার উপর, জগদীশ্বরের সতত শুভ দৃষ্টি থাকুক। ঐ অংশের অধিবাসী এক ব্যক্তি, এক সময়ে, আমায় প্রাণদান দিয়াছিলেন।

 আমার এই কথা শুনিয়া, তিনি সবিশেষ জানিবার নিমিত্ত, ইচ্ছা প্রকাশ করিলে, আমি বলিতে আরম্ভ করিলাম, বহু বৎসর পূর্ব্বে, ডেমাস্কসের শাসনকর্ত্তা পদচ্যুত হইলে, যিনি তদীয় পদে প্রতিষ্ঠিত হন, আমি তাঁহার সমভিব্যাহারে তথায় গিযাছিলাম। পদচ্যুত শাসনকর্ত্তা, বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া আমাদিগকে আক্রমণ করিলেন। আমি প্রাণভয়ে পলাইয়া, এক সম্ভ্রান্ত লোকের বাটীতে প্রবিষ্ট হইলাম, এবং গৃহস্বামীর নিকটে গিযা, অতি কাতর বচনে প্রার্থনা করিলাম, আপনি কৃপা করিযা আমার প্রাণবক্ষা করুন। আমার প্রার্থনাবাক্য শুনিয়া, গৃহস্বামী আমায় অভয়প্রদান করিলেন। আমি তদীয় আবাসে, এক মাস কাল নির্ভয়ে ও নিরাপদে অবস্থিতি করিলাম।

 একদিন আশ্রয়দাতা আমায় বলিলেন, এ সময়ে অনেক লোক বাগদাদ যাইতেছেন। স্বদেশে প্রতিগমনের পক্ষে আপনি ইহা অপেক্ষা অধিক সুবিধার সময় পাইবেন। আমি সম্মত হইলাম। আমার সঙ্গে কিছুমাত্র অর্থ ছিল না, লজ্জাবশতঃ আমি তাঁহার নিকট সে কথা ব্যক্ত করিতে পারিলাম না। তিনি, আমার আকার প্রকার দর্শনে, তাহা বুঝিতে পারিলেন; কিন্তু তৎকালে কিছু না বলিয়া, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন।

 তিনি আমার জন্য যে সমস্ত উদ্যোগ করিয়া রাখিয়াছিলেন, প্রস্থান দিবসে তাহা দেখিয়া, আমি বিস্ময়াপন্ন হইলাম। একটি উৎকৃষ্ট অশ্ব সুসজ্জিত হইয়া আছে, আর একটী অশ্বের পৃষ্ঠে খাদ্যসামগ্রী প্রভৃতি স্থাপিত হইযাছে, অর, পথে আমার পরিচর্যা করিবার নিমিত্ত, একটি ভৃত্য প্রস্থানার্থে প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। প্রস্থানসময় উপস্থিত হইলে, সেই দয়াময়, সদাশয় অশ্রয়দাতা, আমর হস্তে একটি স্বর্ণমুদ্রার থলি দিলেন, এবং আমাকে যাত্রীদের নিকটে লইয়া গেলেন, তন্মধ্যে যাহাদের সহিত তাঁহার আত্মীয়তা ছিল, তাঁহাদের সঙ্গে আমার আলাপ করিযা দিলেন। আমি আপনকার বসতিস্থানে এই সমস্ত উপকার প্রাপ্ত হইযাছিলাম, এজন্য পৃথিবীতে যত স্থান আছে, ঐ স্থান আমার সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয়।

 এই নির্দ্দেশ করিয়া, দুঃখপ্রকাশ পূর্ব্বক আমি বলিলাম, আক্ষেপের বিষয় এই, আমি এ পর্য্যন্ত সেই দয়াময় আশ্রয়দাতার কখনও কোন উদ্দেশ পাইলাম না। যদি তাঁহার নিকট কোনও অংশে কৃতজ্ঞতাপ্রদর্শনের অবসর পাই, তাহা হইলে, মৃত্যুকালে আমার কোনও ক্ষোভ থাকে না। এই কথা শুনিবামাত্র, তিনি অতিশয় আহলাদিত হইয়া বলিলেন, আপনকার মনস্কাম পূর্ণ হইযাছে। আপনি যে ব্যক্তির উল্লেখ করিলেন, সে এই। এই হতভাগ্যই আপনাকে, এক মাস কাল, আপন আলযে রাখিয়াছিল।

 তাঁহার এই কথা শুনিয়া, আমি চমকিয়া উঠিলাম, সবিশেষ অভিনিবেশ সহকারে, কিয়ৎক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া, তাঁহাকে চিনিতে পারিলাম, অহিলাদে পুলকিত হইয়া, অশ্রুপূর্ণ নয়নে আলিঙ্গন করিলাম, তাঁহার হস্ত ও পদ হইতে লৌহশৃঙ্খল খুলিয়া দিলাম, এবং, কি দুর্ঘটনাক্রমে তিনি খলীফার কোপে পতিত হইযাছেন, তাহা জানিবার নিমিত্ত নিতান্ত ব্যগ্র হইলাম। তখন তিনি বলিলেন, কতিপয় নীচ প্রকৃতি লোক ঈর্ষ্যাবশতঃ শত্রুতা করিয়া, খলীফার নিকট আমার উপর উৎকট দোষারোপ করিয়াছে, তজ্জন্য তদীয় আদেশক্রমে হঠাৎ অবরুদ্ধ ও এখানে অনীত হইযাছি, আসিবার সময স্ত্রী, পুত্ত্র, কন্যাদিগের সহিত দেখা কবিতে দেয় নাই, সহজে নিষ্কৃতি পাইব, আমার সে আশা নাই, বোধ করি, আমার প্রাণদণ্ড হইবে। অতএব, আপনার নিকট বিনীত বাক্যে আমার প্রার্থনা এই, আপনি অনুগ্রহ করিয়া, আমার পরিবারবর্গের নিকট এই সংবাদ পাঠাইয়া দিবেন। তাহা হইলেই আমি যথেষ্ট উপকৃত হইব।  তাঁহার এই প্রার্থনা শুনিয়া আমি বলিলাম, না, না; আমি একমুহূর্ত্তের জন্যও প্রাণনাশের আশঙ্কা করিবেন না, আপনি এই মুহূর্ত্ত হইতে স্বাধীন হইলেন, এই বলিয়া, পাথেয স্বরূপ সহস্র স্বর্ণমুদ্রার একটি থলি তাহার হস্তে দিয়া বলিলাম, আপনি অবিলম্বে প্রস্থান করুন, এবং স্নেহাস্পদ পরিবারবর্গের সহিত মিলিত হইয়া, সংসারযাত্রা সম্পন্ন করুন। আপনাকে ছাডিয়া দিলাম, এজন্য আমার উপর খলীফাব মর্মান্তিক ক্রোধ ও দ্বেষ জম্মিবে, তাহার সন্দেহ নাই, কিন্তু যদি, আপনার প্রাণবক্ষা করিতে পারি, তাহা হইলে সে জন্য আমি অণুমাত্র দুঃখিত হইব না।

 আমার প্রস্তাব শুনিয়া তিনি বলিলেন, আপনি যাহা বলিতেছেন, আমি কখনই তাহাতে সম্মত হইতে পারিব না, আমি এত নীচাশয় ও স্বার্থপর নহি যে, কিছুকাল পূর্ব্বে, যে প্রাণের রক্ষা করিযাছি, আপন প্রাণরক্ষার্থে, এক্ষণে সেই প্রাণের বিনাশের কারণ হইব। তাহা কখনই হইবে না। যাহাতে খলীফা আমার উপর অক্রোধ হন, আপনি দযা করিয়া, তাহার যথোপযুক্ত চেষ্টা দেখুন; তাহা হইলেই আপনাকর প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা হইবে; যদি আপনকার চেষ্টা সফল না হয়, তাহা হইলেও, আমার আর কোনও ক্ষোভ খাকিবে না।  পরদিন প্রাতঃকালে, আমি খলীফার নিকটে উপস্থিত হইলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সে লোেকটি কোথায়, তাহাকে আনিয়াছ? এই বলি, তিনি ঘাতককে ডাকাইয়া, প্রস্তুত হইতে আদেশ দিলেন। তখন আমি তাঁহার চরণে পতিত হইয়া, বিনীত ও কাতর বচনে বলিলাম, ধর্মাবতার, ঐ ব্যক্তির বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে, অনুমতি হইলে সবিশেষ সমস্ত আপনকার গোচর করি। এই কথা শুনিবামাত্র, তাহার কোপানল প্রজ্বলিত হইযা উঠিল। তিনি রোষরক্ত নয়নে বলিলেন, আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, যদি তুমি তাহাকে ছাডিয়া দিয়া থাক, এই দণ্ডে তোমার প্রাণদণ্ড হইবে। তখন আমি বলিলাম, আপনি ইচ্ছা করিলে, এই মুহূর্ত্তে আমার ও তাঁহার প্রাণদণ্ড করিতে পাবেন, তাহার সন্দেহ কি। কিন্তু, আমি যে নিবেদন করিতে ইচ্ছা করিতেছি, কৃপা করিয়া তাহা শুনিলে, আমি চরিতার্থ হই।

 এই কথা শুনিয়া, খলীফা, উদ্ধত বচনে বলিলেন, কি বলিতে চাও, বল। তখন, সে ব্যক্তি, ডেমাস্কস্ নগরে, কি রূপে আশ্রযদান ও প্রাণরক্ষা কবিয়াছিলেন, এবং এক্ষণে আমি তাঁহাকে ছাড়িয়া দিতে চাহিলে, আমি অবধারিত বিপদে পড়িব, এজন্য তাহাতে কোনও মতে সম্মত হইলেন না; এই দুই বিষয়ের সবিশেষ নির্দ্দেশ করিয়া বলিলাম, ধর্মাবতার, যে ব্যক্তির এরূপ প্রকৃতি ও এরূপ মতি, অর্থাৎ যে ব্যক্তি এমন দয়াশীল, পরোপকারী, ন্যায়পরায়ণ ও সদ্বিবেচক, তিনি কখনই দুরাচার নহেন। নীচপ্রকৃতি পরহিংসক দুরাত্মারা, ঈর্ষাবশত, অমূলক (দাষারোপ করিয়া, তাহার সর্ব্বনাশ করিতে উদ্যত হইযাছে, নতুবা, যাহাতে প্রাণদণ্ড হইতে পারে, তিনি এরূপ কোনও দোষে দূষিত হইতে পারেন, আমার এরূপ বোধ ও বিশ্বাস হয় না। এক্ষণে আপনার যেরূপ অভিরূচি হ্য়, করুন।

 খলীফা, মহামতি ও অতি উন্নতচিত পুরুষ ছিলেন। তিনি এই সকল কথা কর্ণগোচর করিয়া, কিয়ৎক্ষণ মৌনবিলম্বন করিয়া রহিলেন, অনন্তর, প্রসন্নবদনে বলিলেন, সে ব্যক্তি (য এরূপ দয়াশীল ও ন্যায়পরায়ণ, ইহা অবগত হইয়া, আমি অতিশয আহলাদিত হইলাম। তিনি প্রাণদণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইলেন। বলিতে গেলে, তোমা হইতেই তাঁহার প্রাণরক্ষা হইল। এক্ষণে তাঁহাকে অবিলম্বে এই শুভ-সংবাদ দাও, ও আমার নিকটে লইয়া আইস।

 এই কথা শুনিয়া, অহিলাদসাগরে মগ্ন হইয়া, আমি সত্বর গৃহে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক, তাঁহাকে খলীফার সম্মুখে উপস্থিত করিলাম। খলীফা, অবলোকনমাত্র, প্রীতি-প্রফুল্ল লোচনে, সাদর বচনে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, তুমি যে এরূপ উচ্চ প্রকৃতির লোক, তাহা আমি পূর্ব্বে অবগত ছিলাম না। দুষ্টমতি দুরাচারদিগের বাক্য বিশ্বাস করিয়া, অকারণে তোমার প্রাণদণ্ড করিতে উদ্যত হইযাছিলাম। এক্ষণে, ইহার নিকট তোমার প্রকৃত পরিচয় পাইয়া, সাতিশয় প্রীতি প্রাপ্ত হইয়াছি। আমি অনুমতি দিতেছি, তুমি আপন আলয়ে প্রস্থান কর। এই বলিয়া, খলীফা, তাঁহাকে মহামূল্য পরিচ্ছদ, সুসজ্জিত দশ অশ্ব, দশ খচ্চর, দশ উষ্ট্র, উপহার দিলেন, এবং ডেমাস্কসের রাজপ্রতিনিধির নামে এক অনুরোধপত্র ও পাথেয় স্বরূপ বহুসংখ্যক অর্থ দিযা, তাঁহাকে বিদায় করিলেন।