আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/দয়া ও সদ্বিবেচনা (২)

দয়া ও সদ্বিবেচনা

 ইংলণ্ডদেশের প্রসিদ্ধ কবি শেনষ্টোন কোনও স্থানে যাইতেছিলেন। পথের দুই পার্শ্বে জঙ্গল, এরূপ স্থানে উপস্থিত হইলে, সহসা এক ব্যক্তি, জঙ্গল হইতে বহির্গত হইয়া, তাঁহার সম্মুখে পিস্তল ধরিয়া বলিল, আপনকার সঙ্গে যে টাকা আছে, আমায় দেন, নতুবা এখনই গুলি করিয়া, আপনকার প্রাণসংহার করিব। শেনষ্টোন্ চকিত হইয়া, এক দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। তখন সে বলিল, আপনি আমার মত দরিদ্র নহেন; টাকার জন্য এত ভাবিতেছেন কেন? যদি প্রাণ বাচাইবার ইচ্ছা থাকে, টাকা দেন, বিলম্ব করিবেন না। শেনষ্টোন, টাকা বহিষ্কৃত করিয়া, তাহাকে বলিলেন, ওরে হতভাগ্য, এই টাকা লও, এবং যত শীঘ্র পার, পলায়ন কর। সে ব্যক্তি টাকা লইয়া, পিস্তলটি জলে ফেলিয়া দিল, এবং তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্রস্থান করিল।

 শেনষ্টোন সঙ্গে একটি অল্পবয়স্ক পরিচারক ছিল। তিনি তাহাকে বলিলেন, তুমি অপরিজ্ঞাত রূপে, ঐ লোকটিব পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাও; এবং ও কোন্ স্থানে থাকে, তাহা দেখিযা আইস। পরিচারক, দুই ঘণ্টার মধ্যে, প্রভুর নিকটে প্রত্যাগমন করিল, এবং বলিল, ও ব্যক্তি হেলসওয়েলে থাকে। আমি তাহার বাটীর দ্বারে দণ্ডায়মান হইষা, কপাটস্থিত ছিদ্র দ্বারা, দেখিতে পাইলাম, সে টাকার থলিটি তাহার স্ত্রীর সম্মুখে ফেলিয়া দিল, এবং বলিল, আমি ইহকালে ও পরকালে জলাঞ্জলি দিযা, এই টাকা আনিয়াছি, লও, তৎপরে, দুটি পুত্রকে ক্রোড়ে লইয়া, তাহাদিগকে বলিল, তোমাদের প্রাণরক্ষার্থে, আমি আপনার সর্বনাশ করিলাম। এই বলিযা, নিতান্ত শোকাকুল হইয়া, সে ব্যক্তি রোদন করিতে লাগিলেন।

 এই কথা শুনিযা, শেনষ্টোন্ সে ব্যক্তির স্বভাব, চরিত্র ও অবস্থার বিষয়ে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, এবং জানিতে পারিলেন, সে মজুরী করিযা দিনপাত করে, অবস্থা নিতান্ত মন্দ, পরিবার অনেকগুলি, কিন্তু পরিশ্রমী ও সৎস্বভাব বলিয়া, সকলের নিকট পরিচিত। এ সমস্ত অবগত হইযা, শেনষ্টোন্ বিবেচনা করিলেন, ইহার স্বভাব ও চরিত্রের যেরূপ পরিচয পাইতেছি, তাহাতে এ অপকর্ম করিবার লোক নহে। নিতান্ত নিরুপায় হইয়াই, ইহাকে দস্যুবৃত্তি অবলম্বন করিতে হইযাছে, যাহাতে, ইহার পরিবাবের ভরণপোষণ সম্পন্ন হইতে পারে, এরূপ উপায় কবিয়া দিলে, ইহাকে দুশ্চরিত্র হইতে হয় না। অতএব, তাহার এবটা ব্যবস্থা করা আবশ্যক।

 এই স্থিব করিযা, তিনি, অবিলম্বে, তদীয় আলয়ে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র সে বিষন্ন বদনে, তাঁহার চরণে নিপতিত হইল, এবং অপূর্ণ লোচনে, কাতর বচনে, ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে লাগিল। তদীয় ঈদৃশ ভাব দর্শনে, শেনষ্টোনের অন্ত করণে অতিশয় দয়া উপস্থিত হইল। তখন তিনি, তাহাকে ভূতল হইতে উঠাইয়া, অশেষ প্রকারে, তাহার সান্ত্বনা করিলেন, অশ্বাসপ্রদান পূর্ব্বক, তাহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া, আপন আলয়ে উপস্থিত হইলেন, এবং যাহাতে সে অনায়াসে পবিবারের ভরণপোষণ সম্পন্ন করিতে পারে, এরূপ এক কর্মে নিযুক্ত করিযা দিলেন। তদবধি, আর কখনও, সে, দস্যুবৃত্তি বা অন্যবিধ কোনও দুষ্কর্মে প্রবৃত্ত হয় নাই।