আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/নিঃস্পৃহতা ও উন্নতচিত্ততা
নিঃস্পৃহতা ও উন্নতচিত্ততা
আমেরিকা দেশে ইংবেজদিগের এক উপনিবেশ স্থাপিত হইয়াছিল। ক্রমে ক্রমে অনেক ইংরেজ তথায় গিয়া বাস করিয়াছিলেন। এই উপনিবেশ, ইংলণ্ডের রাজশাসনের অধীন ছিল। ইংলণ্ডে, রাজা ও প্রজার পরস্পর যেরূপ সম্বন্ধ, আমেবিকার উপনিবেশবাসী প্রজাবর্গেরও ইংলণ্ডের রাজার সহিত সেইরূপ সম্বন্ধ ছিল। ফলতঃ, এই উপনিবেশ ইংলণ্ড্রাজ্যেব অংশস্বরূপ পরিগণিত হইত।
উপনিবেশবাসী প্রজাবর্গ ইংলণ্ডের রাজশাসন প্রণালীতে অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। অনেক বিষয়ে তাঁহাদের উপর অবিচার ও অত্যাচার হইতেছিল। সমস্ত অবিচার ও অত্যাচার, ক্রমে ক্রমে অসহ্য হইয়া উঠিল। উপনিবেশবাসীরা প্রতিজ্ঞা করিলেন, ইংলণ্ডের অধীনতা হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীন হইবেন, অর্থাৎ ইংলণ্ডের সহিত আর কোনও সংস্রব না রাখিয়া, উপনিবেশের রাজশাসনকার্য্য আপনারাই সম্পন্ন করিবেন। এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশিত হওয়াতে, উপনিবেশবাসীরা ইংলণ্ডে রাজবিদ্রোহী বলিয়া পরিগণিত হইলেন। বিদ্রোহশান্তির নিমিত্ত ইংলণ্ড হইতে বহুসংখ্যক সৈন্য প্রেরিত হইল। উভয় পক্ষে ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল। অবশেষে, উপনিবেশবাসীরা সম্পূর্ণ জয়লাভ করিলেন এবং সর্ব্বতোভাবে স্বাধীন হইয়া, আপনারা উপনিবেশের রাজশাসনকার্য্য সম্পন্ন করিতে লাগিলেন।
যখন এই উপলক্ষে ইংলণ্ডের সহিত উপনিবেশের প্রথম বিরোধ উপস্থিত হয়, তখন উপনিবেশবাসীরা সমবেত হইয়া, আপনাদিগের মধ্য হইতে কতিপয় উপযুক্ত ব্যক্তিকে সর্ব্বসাধারণের প্রতিনিধি স্থির করিয়া, একটা প্রতিনিধিসমাজের স্থাপন ও ঐ সমাজের উপর সমস্ত কার্য্যনির্ব্বাহের ভারার্পণ করেন। প্রতিনিধিরা সমাজে সমবেত হইয়া, সর্ব্ববিষয়ের সবিশেষ সমালোচনা পূর্ব্বক সমস্ত কার্য্য সম্পন্ন করিতেন।
এই প্রতিনিধি-সমাজের সভাপতি সেনাপতি বীড্সাহেব, যার পর নাই ধর্ম্মশীল ও দেশহিতৈষী ছিলেন, সবিশেষ যত্ন, আগ্রহ ও অভিনিবেশ সহকারে কার্য্যনির্ব্বাহ করিতেন। তাঁহার সভাপতিত্ব সময়ে বিবাবদনিষ্পত্তির নিমিত্ত ইংলণ্ড হইতে কতিপয় দূত প্রেরিত হইযাছিলেন। তাঁহারা সকল বিষয়ের সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া বুঝিতে পারিলেন, সভাপতি রীড্সাহেবকে হস্তগত করিতে পারিলে, ইংলণ্ডের ইষ্টসিদ্ধির পথ পবিষ্কৃত হয়, তখন তাঁহারা রীড্সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন, যদি আপনি উপনিবেশের সংস্রব পবিত্যাগ করিয়া, ইংলণ্ডের পক্ষ অবলম্বন করেন, তাহা হইলে আমরা আপনকার যথোচিত সম্মান করি।
এই বলিয়া তাঁহারা তাঁহাকে দশসহস্ৰ গিনি উৎকোচ দিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। বীড্সাহেব, উৎকোচদানের প্রস্তাব শ্রবণে মনে মনে যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হইয়া, সহাস্য বদনে বলিলেন, দেখুন, আমি অতি হীন, তাহার সন্দেহ নাই, কিন্তু আপনাদের রাজা আমায় কিনিতে পারেন, তাঁহার এত টাকা নাই। এই বলিয়া, তিনি, তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ বিদায় করিয়া দিলেন।
ফলকথা এই, অর্থলোভের বশীভূত হইয়া, উৎকোচগ্রহণ পূর্ব্বক স্বদেশের হিতসাধনে বিরত অথবা অনিষ্ট-সাধনে প্রবৃত্ত হইবেন, মহামতি সেনাপতি বীড সাহেব সেরূপ প্রকৃতির ও সেরূপ প্রবৃত্তির লোক ছিলেন না। যাহাদের অর্থলোভ অতি প্রবল, এবং ধর্মাধর্ম্মবোধ ও উচিতানুচিত বিবেচনা নাই, সেই নিতান্ত নীচাশয় নরাধমেরাই উৎকোচগ্রহণে প্রবৃত্ত হয়। আর যাহারা ন্যায়মার্গ অনুসারে কৃতকার্য্য হইতে না পারে; সেই দুরাচারেরাই উৎকোচদানরূপ অন্যায্য উপায় অবলম্বন পূর্ব্বক স্বীয় অভিপ্রেতসাধনের চেষ্টা করিয়া থাকে। ফলতঃ, উৎকোচদান ও উৎকোচ গ্রহণ, উভয়ই সর্ব্বতোভাবে নিতান্ত ন্যায়বিরুদ্ধ ও ধর্ম্মবিরুদ্ধ ব্যবহার, তাহার সন্দেহ নাই। বিবেচনা করিয়া দেখিলে, দস্যু, তস্কর, উৎকোচ গ্রাহী, ইহারা একসম্প্রদাযের লোক।