আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/প্রকৃত ন্যায়পরতা

প্রকৃত ন্যায়পরতা

পুরাবৃত্তে বর্ণিত আছে, পারস্য দেশের কোনও রাজা, যার পর নাই ন্যায়পরায়যণ বলিয়, সৰ্বত্র সবিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। তিনি নিজে, কদাচ অন্যায়াচরণে প্রবৃত্ত হইতেন না, এবং, কাহাকেও অন্যায়াচরণে উদ্যত দেখিলে, তৎক্ষণাৎ তাহার নিবারণ করিতেন।

 একদা, তিনি, রাজধানীর অতি দূববর্ত্তী কোনও অরণ্যে মৃগয়া করিতে গিযাছিলেন। মৃগের অন্বেষণে ও অনুসরণে, অবিশ্রান্ত পর্য্যটন করিয়া, রাজা নিতান্ত পরিশ্রান্ত এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় একান্ত আক্রান্ত হইলেন, এবং স্বীয় অনুযায়ীদিগকে বিশ্রাম করিতে আদেশ দিয়া, পরিচারকদিগকে সত্বর আহার প্রস্তুত করিতে বলিলেন। তদনুসারে তাহারা আহার প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে, তাহারা দেখিল, রাজধানী হইতে প্রস্থানকালে, রাজার আহারোপযোগী যাবতীয় দ্রব্য আনীত হইযাছে, কেবল লবণ আনিতে ভুল হইয়া গিয়াছে।

 যাহাদের অমনোযোগে লবণ আনীত হয নাই, সে ব্যক্তির যথোচিত ভর্ৎসনা করিয়া, প্রধান পরিচারক এক ব্যক্তিকে, অদূরবর্ত্তী এক গ্রাম দেখাইযা দিয়া, বলিল, যত সত্বর পার, ঐ গ্রাম হইতে লবণ লইয়া আইস। রাজা, পাকশালার সমীপবর্ত্তী পটমণ্ডপে উপবিষ্ট ছিলেন, লবণের অভাবে, পাকশালায় যে গোলযোগ উপস্থিত হইযাছিল, এবং অবশেষে, প্রধান পরিচারক এক ব্যক্তিকে যেরূপে লবণ আনিবার নিমিত্ত পাঠাইল, সমস্ত জানিতে পারিয়াছিলেন। যে ব্যক্তি লবণ আনিতে যাইতেছিল, তিনি তাহাকে আপন নিকটে আনাইলেন, এবং বলিলেন, প্রকৃত মূল্য না দিয়া, লবণ আনিলে, আমি অতিশয় অসন্তুষ্ট হইব। অতএব, সাবধান, যেন প্রকৃত মূল্য না দিয়া, কাহারও নিকট হইতে লবণ, অথবা অন্য কোনও দ্রব্য লওয়া না হয়।

 এই রাজকীয় আদেশ ও উপদেশ অনুসারে, সে ব্যক্তি প্রধান পরিচারকের নিকটে গিয়া, সবিশেষ সমস্ত বলিয়া, মূল্যপ্রার্থনা করিল। পাকশালাস্থ পরিচারকবর্গ, ঈদৃশ অতি সামান্য বিষয়েও রাজার তাদৃশ মনোযোগ দেখিয়া, যৎপবোনাস্তি বিস্মাপন্ন হইল। প্রধান পরিচারক রাজসমীপে উপস্থিত হইয়া, বলিল, মহারাজ, মূল্য না দিয়া আপনার জন্য যৎকিঞ্চিৎ লবণ লইলে, কি কোন দোষ হইতে পারে?

 প্রধান পবিচারকের এই বাক্য শুনিয়া, ঈষৎ হাস্য করিয়া, রাজা বলিলেন, দেখ, এক্ষণে পৃথিবীতে সচরাচর, যত অত্যাচার ও অন্যায়াচরণ লক্ষিত হইয়া থাকে, অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে, এইরূপে অতি সামান্য বিষয় হইতেই ঐ সমস্তর সূত্রপাত হইয়াছে। আমি রাজা; আমি যদি মূল্য না দিয়া, অল্পমাত্র লবণ লই, ঐ দৃষ্টান্ত অনুসারে রাজপুরুষেরা মূল্য না দিয়া, অধিক মূল্যের বস্তু সকল লইতে আরম্ভ করিবেন। এইরূপে যাহাদের বস্তু লওয়া যাইবে, রাজা অথবা রাজপুরুষেরা লইতেছেন, কিছু বলিলে তাঁহাদেব কোপে পতিত হইতে হইবে, এই ভযে, কেহ কিছু বলিতে পারিবে না, কিন্তু, মনে মনে গালি দিবে ও নিন্দা করিবে, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। ফলকথা এই, ছল, বল, কৌশল, অথবা অন্যবিধ অবৈধ উপায় অবলম্বন পূর্ব্বক, কাহারও কোনও বস্তুতে হস্তক্ষেপ করা যে, যার পর নাই গর্হিত ব্যবহার, তাহার সন্দেহ নাই।

 পৃথিবীর সকল লোকে এই রাজকীয় দৃষ্টান্তের অনুবর্ত্তী হইযা চলিলে, সংসার সর্ব্বাংশে নিরুপদ্রব ও যার পর নাই সুখের স্থান হইয়া উঠে, সে বিষযে অণুমাত্র সংশয় নাই। কিন্তু মানবজাতি, বিশেষতঃ ক্ষমতাপন্ন জাতি ও ব্যক্তিবর্গ, স্ব স্ব আচবণের পূর্ব্বাপর যেরূপ পরিচয় দিয়া আসিতেছেন, তাহাতে কোনও ক্রমে, সেরূপ প্রত্যাশা করা যাইতে পারে না।