আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/ন্যায়পরতার পুরস্কার
ন্যায়পরতার পুরস্কার
ইংলণ্ডদেশীয় ফিট্জ্ উইলিয়ম্ নামক সন্ত্রান্ত ভূম্যধিকারীর এক প্রজা, তাঁহার নিকটে গিয়া জানাইল, মহাশয়, আপনি যে বনে মৃগয়া করিতে যান, উহার সন্নিকটে একটি বৃহৎ ক্ষেত্র আছে। ঐ ক্ষেত্রে আমি গমের চাস করিয়াছিলাম। এ বৎসর বিলক্ষণ শস্য জম্মিবে, সুতরাং, আমার বিলক্ষণ লাভ হইবে, এইরূপ প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু, আপনার সমভিব্যাহারী বহুসংখ্যক লোকের সতত যাতাযাত দ্বারা, সমস্ত শস্য একবারে নষ্ট হইয়াছে, সুতরাং, আমি যে লাভের আশা করিয়াছিলাম, তাহাও এককালে বিলুপ্ত হইয়াছে।
প্রজার এই আবেদন শুনিয়া, ভূম্যধিকারী বলিলেন, সখে, তুমি যে ক্ষেত্রে উল্লেখ করিলে, মৃগয়াকালে আমরা ঐ ক্ষেত্রে সমবেত হইতাম, তাহা আমি বিলক্ষণ জানি, এবং আমরা সমবেত হওয়াতে তোমার বিলক্ষণ ক্ষতি হইয়াছে, তাহাও স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি। তোমার কত ক্ষতি হইয়াছে, তাহার একটি ফর্দ্দ করিয়া আন, আমি তোমার ক্ষতির পুরণ করিব।
ভূম্যধিকারীর এই সদয় প্রস্তাব শুনিয়া, প্রজা বলিল, মহাশয়, আমি আপনার দয়া ও সদ্বিবেচনার পূর্ব্বাপর যেরূপ পরিচয় পাইয়া আসিতেছি, তাহাতে আমার ক্ষতির বিষয় আপনকার গোচর হইলে, আপনি অবশ্যই আমার ক্ষতিপূবণ করিবেন, তাহা বিলক্ষণ জানি। এজন্য, এক আত্মীয়কে আমাব ক্ষতির নিরূপণ করিয়া দিতে বলিয়াছিলাম। তিনি, সবিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা, যেরূপ নিরূপণ করিয়া দিয়াছেন, তাহাতে পাঁচ শত টাকা পাইলে, আমার ক্ষতিপূবণ হইতে পারে, ইহাতে আপনকার সেরূপ অভিপ্রায় হয়। এই কথা শ্রবণগোচর হইবামাত্র, ভূম্যধিকারী, পাঁচ শত টাকা দিয়া, তাহাকে বিদায কবিলেন।
কিন্তু, আশ্চর্য্যের বিষয় এই, পূর্ব্ব পূর্ব্ব বৎসরে, ঐ ক্ষেত্রে যেরূপ শস্য জন্মিত, এ বৎসর তদপেক্ষা অনেক অধিক শস্য জন্মিল। ফলতঃ, ঐ ক্ষেত্রে, এ বৎসর, প্রজার, যেরূপ প্রচুর লাভ হইল, কস্মিন্ কালেও, তাহার ভাগ্যে সেরূপ লাভ ঘটে নাই। তখন সেই প্রজা, পুনবায় ভূম্যধিকারীর নিকটে উপস্থিত হইল, এবং বলিল, মহাশয, অমুক বনের সন্নিহিত ক্ষেত্রের বিষয়ে, কিছু নিবেদন করিতে আসিয়াছি। এই কথা শুনিয়া, ভূম্যধিকারী বলিলেন, আমার বিলক্ষণ স্মরণ হইতেছে, তোমার নির্দ্দেশ অনুসারে, ঐ ক্ষেত্রসংক্রান্ত ক্ষতিপূরণের নিমিত্ত তোমায় পাঁচ শত টাকা দিয়াছি, তাহাতে কি তোমার সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ হয নাই?
ভূম্যধিকারীর বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, সেই প্রজা, বিনয়নবচনে নিবেদন করিল, মহাশয়, ঐ ক্ষেত্রে আমায় কোনও অংশে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয় নাই। এ বৎসর প্রচুর শস্য জন্মিয়াছে। অন্যান্য বৎসর, আমার যেরূপ লাভ হয়, এ বৎসর তদপেক্ষা অনেক অধিক লাভ হইয়াছে। এজন্য আমি আপনকার দত্ত ক্ষতিপূরণের পাঁচ শত টাকা ফিরিয়া দিতে আসিয়াছি। এই বলিয়া, সে, ভূম্যধিকারীর সম্মুখে পাঁচ শত টাকা রাখিয়া দিল।
প্রজার এতাদৃশী ন্যায়পরতা দর্শনে চমৎকৃত হইয়া, ভূম্যধিকারী প্রীতিপ্রফুল্ল লোচনে, সস্নেহ বচনে বলিলেন, এরূপ ব্যবহার দেখিলে, আমার বড় আহ্লাদ হয়। মনুষ্যমাত্রেরই এরূপ ব্যবহার করা সর্ব্বতোভাবে উচিত ও আবশ্যক। এই বলিয়া, তিনি সেই প্রজার সহিত সাতিশয় সদয়ভাবে কিযৎক্ষণ কথোপকথন করিলেন, এবং তদীয় অবস্থা ও পরিবার প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ের সবিশেষ পরিচয় লইলেন, অনন্তর, গাত্রোত্থান পূর্ব্বক, পার্শ্ববর্তী গৃহে প্রবেশ করিয়া, সহস্র মুদ্রা লইযা প্রত্যাগমন করিলেন; এবং, এ তোমার নিরতিশয় প্রশংসনীয় ন্যায়পরতার যৎকিঞ্চিৎ পুরস্কার, এই বলিয়া, পূর্ব্বদত্ত পঞ্চ শত মুদ্রার সহিত, সেই সহস্র মুদ্রা তাহার হস্তে দিয়া, প্রসন্ন বদনে, সাদর বচনে, তাহাকে বিদায় করিলেন।