আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/মাতৃভক্তির পুরস্কার
মাতৃভক্তির পুরস্কার
য়ুরোপের রাজাদের ও প্রধান লোকদিগের প্রথা এই, তাঁহারা যে গৃহে অবস্থিতি করেন, সেই গৃহের বহির্ভাগে অল্পবয়স্ক ভৃত্যরা উপবিষ্ট থাকে। আবশ্যক হইলে, তাঁহারা ঘণ্টা বাজান; ঘণ্টার শব্দ শুনিয়া, ভৃত্যেরা তাঁহাদের নিকট উপস্থিত হয়। এক দিন, প্রাশিয়ার অধীশ্বর ফ্রেডরিক ঘণ্টা বাজাইলেন; কিন্তু কোনও ভৃত্য উপস্থিত হইল না। তখন তিনি গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন, এবং একমাত্র বালকভৃত্যকে নিদ্রিত দেখিয়া, তাহাকে জাগরিত করিবার নিমিত্ত, নিকটে গিযা, তাহার জামার বগলিতে একখানি পত্র দেখিতে পাইলেন। কৌতূহলাক্রান্ত হইযা, তিনি ঐ পত্রখানি হস্তে লইলেন। পত্রখানি বালকের জননীর লিখিত। বালক, বেতন পাইয়া, জননীর ব্যয়নির্বাহের নিমিত্ত টাকা পাঠাইয়া দিয়াছিল। তিনি, টাকা পাইয়া পুত্রকে লিখিয়াছেন,—বৎস, তুমি যাহা পাঠাইয়াছ, তাহা পাইয়া আমি অতিশয আহলাদিত হইয়াছি। তুমি যথার্থ মাতৃভক্ত, আশীর্ব্বাদ করিতেছি, জগদীশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
পত্র পড়িয়া, ফেডবিক্ অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন, মাতৃভক্ত বালকের প্রশংসা করিতে করিতে, নিজ গৃহে প্রতিগমন পূর্ব্বক, একটী টাকার থলি বহিষ্কৃত কবিলেন এবং সেই পত্রখানি ও ঐ টাকার থলিটি বালকের বগলিতে রাখিয়া, নিজ গৃহে প্রবেশ করিয়া, ঘণ্টা বাজাইতে লাগিলেন। বালকের নিদ্রা ভঙ্গ হইল। তখনও ঘণ্টাধ্বনি হইতেছিল; তাহা শুনি, সে তৎক্ষণাৎ রাজসমীপে উপস্থিত হইল। রাজা বলিলেন, তোমার বিলক্ষণ নিদ্রা, হইয়াছিল। বালক নিতান্ত ভীত হইল, কোনও উত্তর করিতে পারিল না। এই সমযে, সহসা তাহার হস্ত বগলিতে পতিত হইলে, তন্মধ্যে টাকার থলি দেখি, অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইল, এবং বিষন্ন বদনে কাতর নয়নে, রাজার দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার নয়নযুগল হইতে প্রবলবেগে প্রভূত বাষ্পবারি বিনির্গত হইতে লাগিল, ভয়ে ও বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া, সে একটিও কথা বলিতে পারিল না।
তাহার এইরূপ ভাব দেখিয়া, রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, অহে বালক, কি জন্য এত কাতর হইতেছ ও রোদন কবিতেছ, বল। তখন বালক, জানু পাতিযা, ভূতলে উপবিষ্ট হইল, এবং কৃতাঞ্জলি হইযা, অশ্রুপূর্ণ লোচনে, কাতর বচনে বলিল, মহাবাজ, এই টাকার থলি কিরূপে আমাৰ বগলিতে আসিল, কিছুই বুঝিতে পাবিতেছি না। কোনও ব্যক্তি, নিঃসন্দেহ আমার সর্ব্বনাশের চেষ্টায় আছে, সেই আমার নিদ্রিত অবস্থায, এই টাকার থলি বগলিতে রাখিয়া গিযাছে, অবশেষে, আমি চুরি করিয়াছি বলিয়া, আমায় ধরাইয়া দিবে। এই বলিতে বলিতে, তাহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল।
বালকের মাতৃভক্তির বিষয় অবগত হইযা, রাজা প্রথমতঃ যত আহলাদিত হইয়াছিলেন, এক্ষণে, তাহার এই ভাব দেখিয়া, তদপেক্ষা অনেক অধিক আহলাদিত হইলেন; এবং বালকের উপর সাতিশয় প্রসন্ন হইয়া বলিলেন, অহে বালক, তুমি বগলিতে টাকার থলি দেখিয়া অত বিষণ্ণ ও কাতর হইতেছ কেন, কোন দুষ্ট লোেক, তোমার সর্ব্বনাশের অভিসন্ধিতে, তোমার বগলিতে এই টাকার থলি রাখিয়াছে, সেরূপ ভাবিয়া ভয় পাইবার প্রয়োজন নাই। দয়াময় জগদীশ্বর আমাদের হিতার্থে, অনেক শুভকর কার্য্য করিয়া থাকেন। তাঁহার ইচ্ছাতেই এই টাকার থলি তোমার বগলিতে আসিয়াছে। তুমি তাঁহাকে ধন্যবাদ দাও। কোনও দুষ্ট লোক, দুষ্ট অভিপ্রায়ে এরূপ করিযাছে, তুমি ক্ষণকালের জন্যও, সেরূপ ভাবিও না ও ভয় পাইও না। ইহা তোমার মাতৃভক্তির যৎকিঞ্চিৎ পুবস্কার।
এইরূপ বলিয়া, সেই ভয়বিহ্বল বালককে অভযপ্রদান করিয়া, রাজা বলিলেন, এই টাকাগুলি তুমি জননীর নিকট পাঠাইয়া দাও, এবং তাঁহাকে আমার নমস্কার জানাও ও লিখিযা পাঠাও, আজ অবধি আমি তোমার ও তোমার জননীর সম্পূর্ণ ভার গ্রহণ করিলাম।