আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/দয়ালুতা ও পরোপকারিতা

দয়ালুতা ও পরোপকারিতা

ফ্রান্সদেশীয় প্রসিদ্ধ বিদ্বান্ মণ্টেঙ্কু অতিশয় দয়াশীল ও পরোপকারী ছিলেন। তিনি, কার্যবশতঃ, মাবসীলম্ প্রদেশে গিযাছিলেন। তথায়, জলপথে পরিভ্রমণ করিবার অভিলাষে, তিনি, একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া, তাহাতে আরোহণ করিলেন। এই নৌকার দাঁড়ি ও মাঝি অতি অল্পবয়স্ক, তাহাদের সহিত কথোপকথন করিতে করিতে, তিনি তাহাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, তাহারা বলিল, আমরা দুই সহোদর, সেকরার কর্ম্ম করিযা জীবিকা নির্ব্বহ করি, যে উপার্জন করি, তাহাতে আমাদের স্বচ্ছন্দে দিনপাত হয়, আয়ের বৃদ্ধি কবিবার মানসে আমরা, অবসরকালে নাবিকের কর্ম্ম করিয়া থাকি।

 এই কথা শুনিয়া, মণ্টেঙ্কু বলিলেন, আমার বোধ হইতেছে, তোমাদের অর্থলোভ অতি প্রবল; সেই লোভের বশীভূত হইয়া, তোমরা এই ক্লেশকর নীচকর্মে প্রবৃত্ত হইয়াছ। তখন তাহারা বলিল, না মহাশয়, আমরা অর্থলোভে বশীভুত হইয়া, এই নীচ কর্মে প্রবৃত্ত হই নাই। যে কারণ বশতঃ, আমাদিগকে এই নীচ কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতে হইয়াছে, তাহা অবগত হইলে, আপনি আমাদিগকে অর্থলোভর বশীভূত ভাবিবেন না। আমাদের পিতা বিদ্যমান আছেন। তিনি একখানি জলযান কিনিযা, নানাবিধ দ্রব্য লইযা, বার্ববিদেশে বাণিজ্য করিতে গিযাছিলেন। দুর্ভাগ্য বশতঃ প্রবল দ্স্যুদল, আক্রমণ ও সর্ব্বস্বহরণ পূর্ব্বক, ত্রিপোলী প্রদেশে লইয়া গিযা, তাঁহাকে দাসব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রীত করিয়াছে। তিনি তথা হইতে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত লিখিযা বলিযাছেন, যে ব্যক্তি আমায় কিনিয়াছেন, তিনি নিতান্ত অভদ্র ও নির্দ্দয় নহেন, আমার পক্ষে বিলক্ষণ সদয় ব্যবহার করিয়া থাকেন, এবং টাকা পাইলে, আমায় ছাডিয়া দিতে সম্মত আছেন। কিন্তু, তিনি এত অধিক টাকা চাহিতেছেন যে, কোনও কালে, আমি ঐ টাকার সংগ্রহ করিতে পারিব, তাহার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই, সুতরাং আর আমার দেশে যাইবার আশা নাই। অতএব, তোমরা, আমায় আর দেখিতে পাইবে, সে আশা করিও না।

 এই কথা বলিতে বলিতে, তাহাদের দুই সহোদরের শোকানল প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। তদীয় নয়ন হইতে অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা বিনিঃসৃত হইতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে, শোকসংবরণ করিয়া, তাহারা বলিল, মহাশয়, আমাদের পিতা অতিশয় পুত্ত্রবৎসল, তাঁহার অদর্শনে আমরা জীবন্মত হইয়া আছি। যত টাকা দিলে, তিনি দাসত্বমুক্ত হইতে পারেন, আমরা, সেই টাকার সংগ্রহের নিমিত্ত, প্রাণপণে যত্ন ও চেষ্টা করিব, এই প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। অন্য উপায় দেখিতে না পাইযা, অবশেষে, এই নীচ বৃত্তি অবলম্বন কবিয়াছি। আমরা যে তাহাকে দাসত্বমুক্ত করিতে পারিব, আমাদের সে আশা নাই, কিন্তু তদর্থে, যথোচিত (চষ্টা না করিয়াও, ক্ষান্ত থাকিতে পাবিতেছি না।

 তাহাদের কথা শুনিয়া ও পিতৃভক্তি দেখিয়া, মণ্টেঙ্কু প্রসন্ন বদনে বলিলেন, দেখ, প্রথমত, তোমাদিগকে অর্থলোভী স্থির করিয়াছিলাম, কিন্তু এক্ষণে, কি কারণে তোমরা এই নীচ বৃওি অবলম্বন করিয়াছ, তাহার সবিশেষ অবগত হইযা, যৎপরোনাস্তি প্রীতি প্রাপ্ত হইলাম, তোমবা যথার্থ সুসন্তান, অচিরে তোমাদের মনস্কাম পূর্ণ হইবে। এই বলিয়া, বিলক্ষণ পুৰস্কার দিয়া, তিনি প্রস্থান কবিলেন।

 কতিপয় মাস অতীত হইল। এক দিন তাহারা দুই সহদরে দোকানে কর্ম্ম করিতেছে, এমন সময়ে তাহাদের পিতা তথায় উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে নয়নগোচর কৱিষা, তাহারা বিস্ময়াপন্ন হইল, এবং আহলাদে গদগদ হইয়া, অশ্রুপাত করিতে লাগিল। তাহাদের পিতা, মনে কৱিয়ছিলেন, পুত্ত্রেরা টাকা পাঠাইয়াছিল, তাহাতেই তিনি দাসমুক্ত হইয়াছেন। তিনি, তাহাদের মুখচুম্বন করিয়া, আশীর্ব্বদ করিলেন; এবং জিজ্ঞাসিলেন, তোমরা এত টাকা কোথায় পাইলে? আমার আশঙ্কা হইতেছে, কোনও অন্যায় উপায় অবলম্বন পূর্ব্বক, এই টাকার সংগ্রহ করিযাছ। তাহারা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইযা বলিল, না মহাশয়, আপনি ওরূপ আশঙ্কা করিতেছেন কেন, আমরা আপনকার দাসত্বমোচনেব জন্য, টাকা পাঠাই নাই, বলিতে কি, আমরা এ বিষযেব বিন্দু বিসর্গও জানি না।

 এই কথা শুনিয়া, তাহাদের পিতা সাতিশয় বিস্মযাপন্ন হইলেন, এবং বলিলেন, তবে এ টাকা কে দিল। আমার প্রভু, টাকা পাইয়া, আমায় নিষ্কৃতি দিয়াছেন, তাহা আমি অবধারিত জানি। টাকাও অনেক, এত টাকা কোথা হইতে আসিল, তাহা আমিও জানিলাম না, তোমরাও জানিলে না, এ বড় আশ্চর্য্রযে বিষয়। ফলতঃ, তিন জনেই বিস্ময়াপন্ন হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। কিযংক্ষণ পরে, তাহারা দুই সহোদরে বলিল, মহাশয, আমরা এতক্ষণে বুঝিতে পারিয়াছি; এ আর কাহারও কর্ম্ম নহে। কিছু দিন পূর্ব্বে, এক সদাশয় দয়ালু মহাশয়, আমাদের নৌকায় চড়িয়া, কথাপ্রসঙ্গে আপনার বৃত্তান্ত অবগত হইয়াছিলেন। তিনি অতিশয় দয়াশীল, প্রস্থানকালে আমাদিগকে যথেষ্ট পুরস্কার দিয়াছিলেন, এবং বলিয়াছিলেন, অচিরে তোমাদের মনস্কাম পূর্ণ হইবে। তিনিই আমাদেব দুঃখে দুঃখিত হইয়া, দযা করিয়া, আমাদের মনস্কাম পূর্ণ করিযাছেন, তাহার সন্দেহ নাই। ফলতঃ, তাহাদের এই অনুমান অমূলক নহে। মণ্টেঙ্কুব দয়াতেই, তাহাদেব পিতা দাসত্বমুক্ত হইয়াছেন।