আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/অদ্ভুত আথিথেয়তা
অদ্ভুত আতিথেয়তা
আরবদেশে সলিমন নামে এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অতি প্রসিদ্ধ সম্ভ্রান্তবংশে জন্মগ্রহণ কবেন। তাঁহার পুত্র ইব্রাহিম প্রাণদণ্ডেব উপক্রম দেখি, প্রচ্ছন্দ বেশে পলাইযা, কুফা নগবে উপস্থিত হইলেন, যাঁহার উপর বিশ্বাস করিতে পারেন, এরূপ কোনও আত্মীয় বা পৰিচিত ব্যক্তি তথায় না থাকাতে, এক বড় মানুষের বাটীর বহির্দ্বারে বসিযা রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে, গৃহস্বামী, কতিপয় ভৃত্য সমভিব্যাহারে, উপস্থিত হইলেন, এবং অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইয়া ইব্রাহিমকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কে, কি জন্য এখানে বসিয়া আছ? ইব্রাহিম বলেন, আমি এক অতি হতভাগ্য বিপদ্গ্রস্ত ব্যক্তি, আপনার শরণাগত হইয়া আশ্রযপ্রার্থনা করিতেছি।
আরবদিগের রীতি এই, কেহ বিপদগ্রস্ত হইয়া প্রার্থনা কবিলে, তাঁহারা তাহাকে আশ্রয় দেন, তাহার পরিচয়গ্রহণ বা তাহার চবিত্র বিষযে কোনও অনুসন্ধান করেন না, এবং যাহাকে আশ্রয় দেন, সে ব্যক্তি, অশ্রয়দানের পর, বিষম শত্রু ও যার পর নাই অনিষ্টকারা বলিযা পরিজ্ঞাত হইলেও, তাহার অনিষ্ট সাধনে কদাচ প্রবৃত্ত হয়েন না। তদনুসারে, গৃহস্বামী ইব্রাহিমের প্রার্থনা শ্বরণমাত্র বলিলেন, জগদীশ্বর তোমায় রক্ষা করুন, তোমার কোনও আশঙ্কা নাই, তুমি আমার আলয়ে, যতদিন ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে অবস্থিতি কর। এই বলিয়া তিনি তাঁহাকে অশ্রয় প্রদান করিলেন। ইব্রাহিম, তদীয় আলয়ে আশ্রয় গ্হরণ পূর্ব্বক নিরুদ্বেগে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।
কতিপয় মাস অতিবাহিত হইল। ইব্রাহিম দেখিলেন, গৃহস্বামী প্রত্যহ নিরূপিত সময়ে ভৃত্যবর্গ সমভিব্যাহারে লইযা, অশ্বারোহণে গৃহ হইতে বহির্গত হন। তিনি, কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া, একদিন গৃহস্বামীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি প্রতিদিন এরূপ সজ্জায় কোথায় যান। তিনি বলিলেন, সলিমানের পুত্ত্র ইব্রাহিম * নামে এক ব্যক্তি আমার পিতাব প্রাণবধ করিয়াছে, শুনিয়াছি, ঐ দুরাত্মা, এই নগরের কোনও স্থানে লুকাইয়া আছে, বৈবনির্য্যাতনের অভিপ্রাযে, তাহার অনুসন্ধান কবিতে যাই।
ইব্রাহিম কিছুদিন পূর্ব্বে, এক ব্যক্তির প্রাণবধ কবিয়াছিলেন, কিন্তু ঐ ব্যক্তি এই গৃহস্বামীর পিতা, তাহা জানিতেন না, এক্ষণে, গৃহস্বামীব বাক্য শুনিয়া জীবনেব অশায বিসর্জ্জন দিয়া, তিনি বলিলেন, -মহাশয, আমি বুঝিতে পাবিলাম, জগদীশ্বব আপনকাব বৈবনির্য্যাতনবাসনা অনায়াসে পূর্ণ কবিবার অভিপ্রাষেই আমায় এ স্থানে আনিয়াছেন। আমি আপনকাব পিতাব প্রাণহন্তা, আমার প্রণবধ করিযা, আপনি বৈরনির্য্যাতনৰাসনা পূর্ণ করুন।
এই কথা শুনিয়া গৃহস্বামী বলিলেন, বোধ করি, ক্রমাগত যন্ত্রণাভোগ করিয়া, আপনকার আর বাঁচিবার ইচ্ছা নাই; এজন্যই, আপনি এরূপ প্রস্তাব কবিতেছেন। কিন্তু, অকারণে এক ব্যক্তির প্রাণবধ করিব, আমি সেরূপ নরাধম নহি। ইব্রাহিম বলিলেন, আমি আপনকার নিকট প্রবঞ্চনাবাক্য বলিতেছি না, এই বলিয়া, যেরূপে যেস্থানে, যে অবস্থায়, গৃহস্বামীব পিতার প্রাণবধ করিয়াছিলেন, তৎসমুদষের বিশেষ নির্দ্দেশ করিলেন। পিতৃবধবৃত্তান্ত কর্ণগোচর হইবামাত্র, গৃহস্বামীর কোপানল প্রজ্বলিত হইযা উঠিল। তাঁহার সর্ব্বশরীর কঁপিতে লাগিল, দুই চক্ষু রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। কিয়ৎক্ষণ পরে, তিনি অবিশ্রান্ত অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন, অনন্তর, ইব্রাহিমের দিকে দৃষ্টিসঞ্চার করিয়া বলিলেন, অহে বৈদেশিক, তুমি যে অপবাধ করিযাছ, তজ্জন্য এই দণ্ডে তোমার প্রাণবধ করা উচিত। কিন্তু তোমায় বিপদ্গ্রস্ত জানিয়া, অপন আলয়ে আশ্রয় দিছি ও অভয়দান কবিযাছি। এমন স্থলে আমি তোমার প্রাণবধ করিয়া, অধর্ম্মগ্রস্ত হইতে পারিব না। আমি তোমায় পাথেয়স্বরূপ, একশত স্বর্ণমুদ্রা দিতেছি, উহ। লইয়া, অবিলম্বে আমার আলয় হইতে পলায়ন কর। অতঃপর এরূপ সাবধান হইযা চলিবে, যেন আর কখনও তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার না ঘটে, সাক্ষাৎকার ঘটিলেই, আমার হস্তে তোমার মৃত্যু অবধারিত জানিবে। এইরূপ বলিয়, একশত স্বর্ণমুদ্রা দিয়া, তিনি ইব্রাহিমকে বিদায় দিলেন।