আখ্যানমঞ্জরী (প্রথম ভাগ)/নিঃস্পৃহতা
ইংলণ্ডদেশীয় ডিউক অব মণ্টেগু অতিশয় দয়ালু ও দীনপ্রতিপালক ছিলেন। তাঁহার এই রীতি ছিল, নিরাশ্রয় ব্যক্তিদিগের দুঃখ বিমোচনের নিমিত্ত, সর্ব্বদা প্রচ্ছন্ন বেশে ভ্রমণ করিতেন। একদিন প্রাতঃকালে তিনি ঐ অভিসন্ধিতে এক অনাথমণ্ডলীতে উপস্থিত হইলেন, এবং এক বৃদ্ধা স্ত্রীকে সম্মুখে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এক্ষণে অত্যন্ত দুঃসময় উপস্থিত, এরূপ সময়ে তুমি কিরূপে দিনপাত কর? যদি আবশ্যক থাকে, বল, আমি তোমার সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি। বৃদ্ধা কহিল, জগদীশ্বরের কৃপায়, আমি স্বচ্ছন্দে আছি, আমার কোনও বিষয়ে অপ্রতুল নাই, যদি দীন দেখিয়া দয়া করিয়া দিতে ইচ্ছা থাকে, ঐ গৃহে এক অনাথা স্ত্রী আছে, তাহাকে সাহায্য দান করুন, অনাহারে তাহার প্রাণ-প্রয়াণের উপক্রম হইয়াছে।
বৃদ্ধার বাক্য শ্রবণ মাত্র, ডিউক মহোদয় নির্দ্দিষ্ট গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন এবং সেই অনাথা উপায়বিহীনা স্ত্রীকে কিছু দিয়া পুনরায় বৃদ্ধার নিকটে উপস্থিত হইয়া, তাহাকে কহিলেন, যদি তোমার আর কোনও প্রতিবেশীর অপ্রতুল থাকে, বল। তাঁহার পুনরায় সেই বৃদ্ধার নিকটে যাইবার উদ্দেশ্য এই যে, তাহাকেও কিছু দান করিবেন এবং আর কাহারও অপ্রতুল আছে কি না জিজ্ঞাসা করিলে, সে অবশ্যই আপন অবস্থা নিবেদন করিবে। কিন্তু বৃদ্ধা কহিল, হাঁ মহাশয়। আমার আর এক প্রতিবেশী আছে, সে অত্যন্ত দুঃখী ও অত্যন্ত সৎস্বভাব। ডিউক কহিলেন, অয়ি বৃদ্ধে। আমি এ পর্য্যন্ত তোমার তুল্য নিঃস্পৃহ ও সাধুশীল স্ত্রীলোক দেখি নাই। যদি তুমি বিরক্ত না হও, আমি তোমার নিজের অবস্থা সবিশেষ জানিবার অভিলাষ করি। তখন বৃদ্ধা কহিল, আমি নিতান্ত দুঃখিনী নহি, কাহারও কিছু ধারি না, তদ্ভিন্ন, আমার পনর টাকা সংস্থান আছে।
এই কথা শ্রবণ করিয়া, ডিউক অতিশয় প্রীত ও চমৎকৃত হইলেন, এবং মনে মনে তাহার সুশীলতা ও নিঃস্পৃহতার অশেষবিধ প্রশংসা করিয়া কহিলেন, তোমার যাহা সংস্থান আছে, যদি আমি তাহার কিছু বৃদ্ধি করিয়া দি, বোধ করি, তাহাতে আপত্তি হইতে পারে না। বৃদ্ধা কহিল, আপনি যাহা আজ্ঞা করিতেছেন, তাহাতে আমার সবিশেষ আপত্তি নাই, কিন্তু আপনি আমায় যাহা সাহায্য করিতে চাহিতেছেন, তাহা আমার যত আবশ্যক, অনেকের তদপেক্ষা অনেক অধিক আবশ্যক, যদি আমি উহা লই, তাহাদিগকে বঞ্চনা করা হয়, আমার বিবেচনায় ওরূপ লওয়া গর্হিত কর্ম্ম।
বৃদ্ধার ঈদৃশ উদারচিত্ততা দেখিয়া, মহানুভব ডিউক মহোদয় যৎপরোনাস্তি প্রীত হইলেন, এবং তৎক্ষণাৎ পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা বহিষ্কৃত করিয়া, তদীয় হস্তে প্রদান পূর্ব্বক কহিলেন, তোমায় অবশ্য ইহা গ্রহণ করিতে হইবে, যদি না কর, আমি যার পর নাই ক্ষুব্ধ হইব। বৃদ্ধা, তদীয় দয়ালুতা ও বদান্যতার একশেষ দর্শনে, মোহিত ও চমৎকৃত হইয়া, কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল, অনন্তর, অশ্রুপূর্ণ লোচনে, গদ্গদ বচনে কহিল, মহাশয়। অধিক কি বলিব, আপনি দেবতা, মানুষ নহেন।