আজকের আমেরিকা/আমেরিকার পল্লীগ্রাম
আমেরিকার পল্লীগ্রাম
প্রভাতে উঠে মেলা পিছনে রেখে এগিয়ে চললাম। অনেক গ্রাম পথে পড়তে লাগল। মনে হল আমার গ্রাম দেখা উচিত। তাই গ্রামে গ্রামে সময় কাটাতে আরম্ভ করলাম। ইউরোপের অনেক গ্রাম দেখেছি, কিন্তু আমেরিকার গ্রাম অন্য ধরনের। গ্রামে বিজলী বাতি, গ্যাস, গরম ও ঠাণ্ডা জলের কল, আধুনিক স্বাস্থ্যনিবাস, পেট্রল স্ট্যাণ্ড, হোটেল, রেস্তোরাঁ, কেবিন সবই বর্তমান। গ্রাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং কোলাহলহীন। প্রত্যেক গ্রামে ছোটদের স্কুল এবং বড়দের কলেজ আছে। সব গ্রামই জনবহুল। ছোট গ্রামে শুধু ছোটদেরই স্কুল আছে। আমাদের কলকাতা শহরেও এমন কোনও স্কুল-গৃহ নেই যার সংগে সেসব গ্রামের স্কুল-গৃহের তুলনা করতে পারা যায়। অনেকে বাংলো করে বাস করে এবং সেরূপ স্বাস্থ্যপ্রদ বাংলো ভারতে কোথাও দেখি নি।
আমেরিকার গ্রাম এবং ইউরোপের গ্রামে অনেক প্রভেদ রয়েছে। ইউরোপের গ্রামের পথগুলি প্রায়ই বাঁকা, ফুটপাথ অপ্রশস্ত, বাড়ীর ভিটি কোথাও বেশ উঁচু আর কোথাও একেবারে নীচে নেমে এসেছে। আমেরিকার পার্বত্য অন্চলে কোনও সময়ে ইউরোপের মতই বাড়ি ঘর এবং বাঁকা পথ ছিল, কিন্তু যখন থেকে ফোর্ড কোম্পানী মাটি কাটার কল তৈরী করেছে, সে সময় থেকে পার্বত্য গ্রামেও সোজা পথ, সমান লেভেলে বাড়ি গড়ে উঠেছে। আমেরিকার গ্রামে নতুনের গন্ধ পাওয়া যায়। ইউরোপের গ্রামে পুরাতনের প্রাধান্য বর্তমান। আমরা ভারতবাসী, আমরা ইচ্ছা করেই বলব, আমেরিকার গ্রামও একদিন পুরাতন হবে, ইউরোপের গ্রামের মত হবে। আমি বলছি তা হবে না। আমেরিকার গ্রাম চির নতুন থাকবে। হয়ত বর্তমান অবস্থা হতে আমেরিকার গ্রাম আরও উন্নত হবে, কারণ আমেরিকাতে এখনও ধর্মের বদ্খেয়ালী নাই। ভবিষ্যতে ‘অধর্মরূপী ধর্ম’ পৃথিবীর উপর তাণ্ডব নৃত্য করতে সক্ষম হবে না।
আমেরিকার গ্রামে ক্রমেই লোক সংখ্যা বাড়ছে। ভবিষ্যতে প্রত্যেকটি গ্রাম শহরে পরিণত হবে। শহরের লোক আনন্দে দিন কাটাবে। ইউরোপের ধরনেই আমেরিকার গ্রাম গড়ে উঠেছে। অ্যামেরিকার গ্রাম কিন্তু ইউরোপের গ্রামের ছাপ প্রায় মুছতে বসেছে। ইউরোপের প্রত্যেকটি গ্রামের ঠিক মধ্যস্থলে একটি চার্চ থাকে। চার্চকে কেন্দ্র করে গ্রামের গঠন হয়। আমেরিকার গ্রামে সেরূপ কিছুই নাই। গ্রামের মধ্যস্থলে বিদ্যালয়, সিনেমা, বিচারালয়, দোকান, বাজার এসব থাকে বটে কিন্তু তাতে গ্রামের সৌন্দয্য মোটেই লোপ হয় না, বরং বাড়ে। গ্রামের পাশে গোলাবাড়ি থাকে না, গৃহপালিত জীব দেখতে পাওয়া যায় না। গ্রাম দেখলেই আনন্দ হয়। আমার আনন্দ হত গ্রোসারী দোকান দেখে। দই, দুধ, ক্রিম, ঘনদুধ, নানারূপ মিঠাই, শাক, সবজী, এবং নানারূপ ফল মূল স্তরে স্তরে সজ্জিত দেখে। এসব দেখে সুখী হতাম কিন্তু ভোগ করার উপায় ছিল না।
প্রত্যেক গ্রামের একটু দূরেই পাইকারী বাজার। পাইকারী বাজারে শুধু দোকানীরাই যায়। দোকানীরা পাইকারী বাজার হতে মাছ, মাংস, সবজী, দুধ, মাখন ইত্যাদি কিনে নিকটস্থ ফেক্টরীতে গিয়ে “ড্রেস” করে। “ড্রেস” করার বাংলা শব্দ আজ পর্য্যন্ত তৈরী হয়নি। হবার কথাও নয়। সেজন্য “ড্রেস” শব্দটি ব্যবহার করলাম। যেদিন আমাদের দেশ স্বাধীন হবে, পাইকারী বাজার হবে এবং তার কাছে ড্রেস করার ফেক্টরী হবে সেদিন ড্রেস করার বাংলা শব্দ আপনি গড়ে উঠবে। ড্রেস করা কাকে বলে এখন তাই বলছি।
ধরে নেওয়া যাক একজন মাছ বিক্রেতা আধ মণ ওজনের একটা মাছ কিনল। আমাদের দেশ হলে মাছবিক্রেতা শিয়ালদহ হতে সেই মাছটা ঝাঁকায় করে অন্য কোন বাজারে নিয়ে গিয়ে তাই কেটে বিক্রি করত। আমেরিকায় তা হতে পারে না। ঝাঁকায় করে মাছ সহরের ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। মাছবিক্রেতা নিকটস্থ ফেক্টরীতে যেতে বাধ্য এবং সেখানে গিয়ে সে মাছটাকে তার ইচ্ছা মত কাটবে আইস ছাড়াবে, ধুয়ে পরিষ্কার করে, জল নিংড়িয়ে ফেলবে, তারপর ওয়েল পেপারে পেক করে খুচরা বাজারে নিয়ে আসবে। ক্রেতা সেই মাছ আর না ধুয়েই কড়াইএ চড়াতে পারে। ক্রেতাকে মাছ কেনার পর বাড়িতে এসে কাটতেও হয় না ধুইতেও হয় না। অন্যান্য জিনিসও ঠিক সে রকমেই ছোট বাজারে আনতে হয়।
ইংলণ্ডে আস্ত গরু, শূকর ঘরের ভেতর বিক্রয়ার্থ টাংগিয়ে রাখা হয়। অনেক সময় ভেড়ার হাড় সমেত মাংসও দেখতে পাওয়া যায়। আমেরিকার কোথাও সেরূপ দৃশ্য দেখা যায় না। আপার সারকুলার রোডে অথবা হগ মার্কেটে ইংলণ্ডের নমুনা সকলের চোখেই পড়ে অনেকেই সেদৃশ্য এড়িয়ে যান, অনেকে মুখ হতে থুথুও ফেলেন, কিন্তু “বিলেত ফেরতা” বাবুদের ইংলণ্ডে সেরূপ দৃশ্য দেখে থুথু অথবা মুখ ফেরাতে দেখিনি। আমেরিকায় সেরূপ দৃশ্য কোথাও দেখা যায় না। আমাদের দেশে যে সকল গৃহপালিত জীবকে হত্যা করা হয় তা শহরের ভেতর দিয়ে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হয়, আমেরিকায় তা কখনও হতে পারেনি, ভবিষ্যতেও হতে পারবে না। কশাইখানা সর্বদাই গ্রাম অথবা শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। সেখানে আজকাল মোটর যোগে জীবকে হত্যা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। মোটরের যখন ব্যবস্থা ছিল না তখনও গ্রামের ভেতর দিয়ে কশাইখানাতে গৃহপালিত জীব নিয়ে যাওয়া হত না।
আমেরিকার পত্তন হতেই কতকগুলি নিয়ম প্রচলিত হয়েছিল যা পুরাতন মহাদেশে প্রচলিত ছিল না। পুরাতন মহাদেশের শহর অথবা গ্রাম দেখলে মনে হয় যেন সবই দোকান, সবই বাজার কিন্তু আমেরিকায় তা নাই। শহরের অন্তস্থলে নীরবতা বিরাজ করছে। যে স্থানে বাজার, বিচারালয় এসব রয়েছে সে স্থানকে বলা হয় ডাউন্ টাউন। ডাউন্ টাউন ছেড়ে দিয়ে কয়েক ব্লক অগ্রসর হলেই গ্রাম্য ভাব দেখতে পাওয়া যায়। এজন্যই আমেরিকার গ্রাম ইউরোপের গ্রাম হতে অনেক সাজানো এবং আরামপ্রদ।
এসব দিক দিয়ে গ্রামগুলি বাস্তবিক সুখের। কিন্তু আমার কাছে একটি কারণে তা বিশ্রী মনে হতে লাগল। গ্রামের লোক নিগ্রো এবং হিন্দুকে একই চক্ষে দেখে, সেজন্য কোনও হোটেলে তাদের স্থান দেয় না, এমন কি অনেক সময় বিপদ আপদে সাহায্যের কথাও ভুলে যায়। অনেক বক্তৃতা করলে, অনুনয় বিনয় করলে হয়ত কারও দয়া হয়, নয়ত নিগ্রোদের মতই আমাদেরও সংবর্ধনা হয়ে থাকে। ছোট ছোট গ্রামে নিগ্রোদের থাকার জন্য কোনও কেবিন নাই। এই রকম ছোটখাটো অভাব আমাকে বিব্রত করে তুলছিল। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল আজই সাইকেলটাকে ট্রেনে অন্যত্র পাঠিয়ে দিই কিন্তু তা করলাম না। আমি নিগ্রো গৃহস্থের বাড়ি খুঁজে তাদেরই মধ্যে থাকতে লাগলাম। আমার উদ্দেশ্য―অন্তত পক্ষে কয়েকখানা গ্রাম দেখে এ সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা করে নেওয়া। সাইকেলে লেখা ছিল “হিন্দু ট্রেভালার”, তাতে কাগজ এঁটে দিলাম। লোকে আর বুঝতে পারছিল না আমি কোথাকার লোক। এতে আমার অসুবিধা মোটেই হয় নি। কেউ কোনও প্রশ্ন আমাকে করত না, আপন মনেই দিন কাটাতাম। শেষে ব্রিংহামটন নামক এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের কাছে এসে বেশ বড় এক নিগ্রোপল্লী পেলাম; এবং তাতে কয়েক দিন থাকব ভেবে একটা হোটেলে স্থান নিলাম।
নিগ্রোদের মধ্যে বসে সময় কাটান একটা কষ্টকর কাজ। এদের মাঝে আমোদ-প্রমোদের কথাই বেশী। খেলার কথা নিয়ে তর্কাতর্কির সময় এদের মধ্যে ছুরি আর পিস্তলও চলে। সিনেমার কথাটা বড় উঠে না, কারণ যতগুলি অভিনেতা অভিনেত্রী নিগ্রোদের মাঝে হয়েছে তাদের কখনও নায়ক নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেওয়া হয় না। জো লুইকে নিয়েই যা তাদের বাহাদুরি। রাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে তারা আলোচনা করতে মোটেই পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে ধর্ম নিয়ে বেশ আলোচনা করে। যখনই অবতারদের নিয়ে কথা হয় এবং তাদের আদি পুরুষ কে তা খুঁজে পাওয়া যায় তখনই তারা ভগবানের তত্ত্বকথায় ফিরে আসে। ক্লাবে বসে যখন তারা এসব কথা আমার সামনে বলত, আমি নীরব থাকতাম। আমি যে একজন পর্যটক এবং পর্যটকদের কাছে যে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় থাকে, সে ধারণা তাদের মোটেই ছিল না। এদিকে আমি এমন কোনও উপলক্ষ খুঁজে পেলাম না, যাতে করে এদের সংগে কোনও কথা বলতে পারি।
এমনি করে একটি দিন কেটে গেল। দ্বিতীয় দিন ক্লাবে বসে একটা বই পড়ছি, এমন সময় বাইরে-রাখা সাইকেলটা একটি শ্বেতকায়ের চোখে পড়ায় তিনি ভিতরে এসে আমার সন্ধান করতে লাগলেন। আমার পোষাক দেখে কেউ ধারণা করতে পারত না যে আমি পর্যটক; কারণ আমি মামুলী পোষাক পরতেই ভালবাসতাম এবং এখনও তাই ভালবাসি। সাদা লোকটি অনেক জিজ্ঞাসা করে আমার খোঁজ পেয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে আমার সংগে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁর সংগে কথোপকথনের পর মিনিট দশেকের মধ্যে ক্লাবের হলে যারা উপস্থিত ছিল তাদের নিয়ে একটা শ্রোতৃমণ্ডলী তৈরি করা হল। আমি তাদেরই কথা তাদের কাছে বলতে আরম্ভ করলাম। আমেরিকান লোকটি কাগজে ঢাকা সাইকেলের লেখা না ছিঁড়েও আমার সন্ধান করেছিলেন আর যাদের মাঝে আমি বসে রয়েছিলাম তারা আমার দিকে চেয়েও দেখেনি, আমার সম্বন্ধে কোনো কৌতূহলই তাদের মনে জাগে নি। নিগ্রো এবং আমেরিকানে এখানেই প্রভেদ।
মাসের শেষ। আমাদের দেশেও মাসের শেষ হয়, মাসের আরম্ভ হয়। আমাদের দেশে এ দুটা সময় শুধু শহরেই অনুভূত হয়, গ্রামের লোক অনেক স্থলে কোন্ মাস এল আর কোন্ মাস গেল তার বড় একটা সন্ধান রাখে না। আমেরিকার গ্রামে মাসের শেষ হওয়ার সংবাদ সকলকেই রাখতে হয়। ঘরের ভাড়া দেওয়াটা অবশ্যকর্তব্য। গ্রামে ভাড়া ইত্যাদি দেবার সপ্তাহিক প্রথা নাই, গ্রামে আছে মাসিক ভাড়া দেবার প্রথা। মাসের শেষে ভাড়া দিতে না পারলে মালিক এসে পুলিসের সাহায্যে ভাড়াটেকে ঘর থেকে বার করে দেয়। ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে মা পথে এসে দাঁড়িয়েছে, বাবা নূতন ঘরের অন্বেষণে বার হয়েছে, পুলিস আইন বজায় রাখতে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, এরূপ দৃশ্য গ্রামে মাসের শেষে বিরল নয়। গ্রামের বাসিন্দারা গ্রামের মালিক নয়। Real Estate Owner বলে এক রকমের কোম্পানি আছে, তারাই হল গ্রামের মালিক। তবে দু-এক জনের বাড়ি যে নাই তা নয়, রিঅ্যাল এস্টেট ওনার কোম্পানিই বর্তমানে আমেরিকার গ্রামে গ্রামে প্রাধান্য লাভ করছে। আমার মনে হয়, এরূপভাবে আর কিছুদিন গেলে আমেরিকার গ্রামগুলি রিঅ্যাল এস্টেট কোম্পানিরই হাতে চলে যাবে। গ্রামের লোক হবে প্রলিটারিয়েট। ইউরোপীয় দেশগুলিতে প্রলিটারিয়েট-এর সংখ্যাবৃদ্ধি মনে হয় সমাজতন্ত্রবাদের প্রসার নয়তো নাৎসীবাদের দমননীতির আওতায় সমাজকে নিয়ে আসা। আমেরিকার গ্রাম দেখে আমার ভয় হল, মনে হল দেশটা এক অন্তর্বিপ্লবের দিকে এগিয়ে চলেছে।
গ্রামের লোক পরিবর্তনের পথ চেয়ে বসে আছে। যে কোনও রকমে যে কোনও পরিবর্তন আসুক না কেন, মনে হয় গ্রামের লোক সাদরে তা গ্রহণ করবে। আমেরিকার মেরুদণ্ড গ্রামের কথা ওয়াল্স্ স্ট্রীটের কর্তারা যে সংবাদ রাখেন না, তা নয়, তবে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখবার চেষ্টা করেন।
নিগ্রো বাসিন্দাদের মাঝে ঘর ছেড়ে দেওয়া বা নূতন করে ঘর নেওয়ার কোনও চিন্তা নাই। তারা দৈনন্দিন দাস্যবৃত্তি করে কায়ক্লেশে যা পায় তাই দিয়ে ঘরের মালিকের মুখ বন্ধ রাখে, খাবার এবং পোষাকের প্রতি দৃষ্টি না রেখেই দিন গুনে যায়। একে জীবন বলা যেতে পারে না, একে বলা যেতে পারে নামরা পর্যন্ত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্রটাকে চালু রাখা। এই অবস্থায় থেকেও এরা নিজেদের সুখী মনে করে, দিনটা কাটলেই যেন সকল বালাই চুকে গেল।
নিগ্রোপল্লী থেকে শ্বেতকায় পল্লীতে যাবার নিমন্ত্রণ হল। নিমন্ত্রণ মানে কথা বলবার এবং কথা শোনবার নিমন্ত্রণ। যখন ওদের পাড়ায় গিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলাম, ওরা দেখল আমি নিগ্রোদের মত কোন ভাবভংগী দেখাচ্ছি না, ওদের অন্যান্য মানুষের মতই গণ্য করে কথা বলতে আরম্ভ করেছি, তখন ওদের মাঝে সান্ত্বনা এল, বুঝল হিন্দুস্থানের হিন্দু তাদের সমকক্ষ। মানুষের মন দুর্বলতায় ভরতি।
একটু সমবেদনা পেলেই দুর্বল আপন হৃদয়ের দরজা খুলে দেয়; যেখানে তার যত ক্ষত তা দেখিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসা করে প্রতিকারের কথা। সাদা পল্লীর লোক ভবিষ্যৎ যুদ্ধ এবং সে সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল। পরিবর্তন আসবে কিনা―এই প্রশ্নের উপরেই তারা জোর দিল বেশী। কিন্তু আমি একজন পর্যটক মাত্র। লোকের দুঃখ কষ্টের কথা শুনতে পারি, হয়ত সমবেদনাও জানাতে পারি। কিন্তু প্রতিকার করতে পারি না। হয়ত আমি বর্তমান জানি, বর্তমানের ঘটনাবলীর উপর নির্ভর করে ভবিষ্যতের কথা বলতেও পারি, কিন্তু সেটা হবে আমার একটা অভিমত মাত্র।দেখলাম গ্রামে নগরে সর্বত্র সমানভাবে অভাবের আক্রমণ শুরু হয়েছে। যারা পারছে তারা নানামতে তার প্রতিবিধান করছে, যারা পারে না তারা অসহায় ক্লান্ত বৃদ্ধের মত পথের পাশে দাঁড়িয়ে পথের দৈর্ঘ্যের সংবাদ লোককে জিজ্ঞাসা করছে। তবু আমেরিকা ধনকুবেরের দেশ। ধনীর দেশের লোকেরও এরূপ অবস্থা দেখে বাস্তবিক আমার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল।
এরূপ কষ্টের মধ্যে থেকেও গ্রামের লোক চুপ করে কেন থাকে সে কথাটা তলিয়ে দেখা সমূহ দরকার। আমেরিকার ধনীরা বেশ ভাল করেই জানে, যদি গ্রামের লোকের প্রতি অত্যাচার করা হয়। তবে বিদ্রোহ অনিবার্য। কিন্তু বিদ্রোহ হয় না। ধনীরাই বিদ্রোহ করতে দেয় না। সি, আই, ও গিয়ে গ্রামের লোকের সাহায্য করে। ফেডারেসন অব্ লেবার প্রতিবন্ধক জন্মায়। কেউ দিতে যায় আর কেউ অপহরণ করতে যায়। যারা দিতে যায় তারা দিয়ে আসে, আর যারা অপহরণ করতে যায় তারাও অপহরণ করতে সক্ষম হয়।
সি, আই, ও সর্বসাধারণের অভাবের কথা অবগত হয়ে তাদের অভাব মিটাবার চেষ্টা করে। ফেডারেসন অব্ লেবার সর্বসাধারণের সংগে সম্পর্ক না রেখে, সর্দার মজুরদের ঘুষ দিয়ে মজুরে মজুরে যাতে বিবাদ হয় তারই চেষ্টা করে। সর্দার মজুরের যখন পেট মোটা থাকে তখন সে সাধারণ মজুরের দাবী ভূলে গিয়ে আরাম করে। ফেডারেশন অব্ লেবারও একটি মজুর প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি মজুরের হিত না করে অহিতই করে বেশি। মজুর হয়ে মজুরের কেন অনিষ্ট করে সেকথাটা জানতে হলে আরও একটু গভীর জলে ডুব দিতে হবে। আমি এত গভীর জলে পাঠক শ্রেণীকে টেনে নিব না।
গ্রামের মামুলী একটা আভাষ পেয়েই মনে হল এমন করে যদি গ্রামে গ্রামে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াই, তবে আমার সমূহ ক্ষতি হবে। তাই সাইকেলখানা ট্রেনযোগে ডিট্রয় পাঠিয়ে দিয়ে হিচ্ হাইক্ করার জন্য প্রস্তুত হলাম। প্রথম দিন হিচ্ হাইক্এর স্বাদ মোটেই অনুভব করতে পারিনি, কারণ গ্রামবাসীরা বুঝতে পেরেছিলেন আমি একজন পর্যটক, আমি তাদের দেশের হবো নই। পর্যটকের সম্মান সভ্যদেশে সর্বত্র বিরাজমান। তাই গ্রামবাসী মোটরকারে করে আমাকে ব্যাফেল পাঠাবার বন্দোবস্ত করেছিলেন।
গাড়িতে বসে ভাবতে লাগলাম এরূপ করে ভ্রমণ করা কি আমার পক্ষে উচিত? পৃথিবীর প্রত্যেক ধূলিকণা আমার ভ্রমণের সাক্ষী থাকবে কিন্তু আমেরিকার ধূলিকণা ত দূরের কথা একটি লোকও আমার ভ্রমণের সাক্ষী থাকবে না। যেইমাত্র এই কথা মনে আসা অমনি স্থির করলাম আমার পক্ষে মোটরে আরাম করে বসে থাকা উচিত নয়, নেমে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য। আমি মোটর হতে নেমে পড়লাম।
মোটর গাড়ি হতে নেমে আমি দাঁড়ালাম পথের পাশে। আমার সামনা দিয়ে অনেক গাড়ি চলে যাচ্ছিল। অনেকে ভদ্রতা করে আমাকে তাদের সংগে যেতে ডাকছিল কিন্তু আমার মন কিছুতেই কারো সংগে যেতে চাচ্ছিল না। যখন নিউইয়র্ক-এ ছিলাম তখন যারা আমার সংগে অধ্যাত্মতত্বের কথা বলতে আসত তাদের দস্তুর মত গাল দিয়ে বিদায় করে দিতাম, কিন্তু আজ আমারই মনে সেই ভূয়া অধ্যাত্মতত্ব জেগে উঠল কি? যে কোন প্রকারেই হউক আজ আমি পথে দাঁড়িয়ে পথের সৌন্দর্যই দেখব।
সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার আসল। আকাশে তারকারাজি ফুটে উঠল। সন্ধ্যার স্নিগ্ধ বাতাস বইতে লাগল। দু একটা মোটরকার ফুসফাস করে চলে যেতে লাগল। সত্তর আশি মাইল যে মোটরকার ঘণ্টায় চলে তাদের ফুস করে চলে যাওয়া ছাড়া আর কি বলা চলে?
আমাদের দেশের লোকের আমেরিকার ‘হবো’দের সম্বন্ধে কোন ধারণাই নাই। আমেরিকাতে হবোরা বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। আমাকেও অনেকে অনেক সময় ভুল করে হবো ভাবত। আবার যখনই বুঝেছে আমি হবো নই তখনই সম্মান এবং ভালবাসা দেখাতেও কসুর করে নি। আমেরিকাতে অনেক ভাবপ্রবণ যুবক পথের ডাক শুনে হঠাৎ বাড়িঘর আত্মীয়স্বজন পরিত্যাগ করে পথে বেরিয়ে যায়। ভাবপ্রবণতা অনেক সময়ই ভুল পথে পরিচালনা করে। আমেরিকার যুবকগণ খামখেয়ালী করে যখন পথে বেরিয়ে পড়ে তখন তাদের কোন উদ্দেশ্যই থাকে না। তবে পথে বেড়িয়ে কি লাভ হবে? কোনো উদ্দেশ্য না দিয়ে যদি খামখেয়ালী করেও পথে বেরিয়ে পড়া যায় এবং কয়েকদিন পর দেশ পর্যটনের একটা উদ্দেশ্য ঠিক করে লোক সমক্ষে তা ধরা যায় তবুও কোনমতে অনেকদিন বেড়িয়ে আসা যায়। আমেরিকাতে যে সকল যুবক পথে বের হয় তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে এড্ভেন্চার করা এবং সেই প্রত্যক্ষ এড্ভেন্চার থেকে বই লেখা। দুঃখের বিষয় আমেরিকাতে সেরূপ বন জংগল নাই, আফ্রিকাতেও বন জংগল শেষ হতে বসেছে, অতএব কল্পিত এড্ভেন্চারের বই পাঠ করে যারা হবো হয় তারা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
১৯৩১ সালের জুন মাস হতে ক্রমাগত ভ্রমণ করে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাস পর্য্যন্ত আমি ভ্রমণ করেছি। এই সময়ের মাঝে অনেক আপদ এবং বিপদ এসেছিল। আপদ বিপদের কথা বেশি লেখা হলে আসল কথায় ফাঁকি দিতে হয়। সেজন্যই নিজের সুখ দুঃখের কথা মোটেই লিখতে প্রয়াসী হইনি।
আজকের আমেরিকায়, আমেরিকার কথা বলাই ভাল। আমেরিকাতেও আমার আপদ বিপদ ঘটেছে। সংক্ষেপে একটি ঘটনা বলব। একদিন একটি সভাতে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম এবং সেই সভায় যাওয়াও ঠিক হয়েছিল। মিঃ ওডাইয়া নামক একজন পারসী ভদ্রলোকের রেস্তোরাঁ হতে বের হয়ে পথে এসে সভাতে কি বলব তারই কথা ভাবছিলাম।
অভ্যাস মত পথ চলছিলাম। লাল রংগের বাতিগুলি যখন প্রজ্বলিত হয়ে উঠে তখন পথ অতিক্রম করতে হয়। নীল বাতি প্রজ্বলিত হলে দাঁড়াতে হয়। একটা পথের সামনে এসে (বোধহয় মেডিশন এ্যভিনিউই হবে) দেখতে পেলাম অন্যদিক দিয়ে লাল বাতি প্রজ্বলিত হয়েছে। এবং আমি যে দিকে যাব সেই পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। কি ভেবে একটু দাঁড়ালাম এবং সামনার উইন্ডো সো দেখে যে মুহূর্তে পথে আসলাম অমনি পথ বন্ধ হইয়া গেল। বাঁ দিক থেকে একখানা মোটরকার হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটি যদি কসে ব্রেক না টানত তবে সেদিনই আমার জীবন শেষ হয়ে যেত। অবশ্য আমার অসাবধানতার জন্য বেশ গাল শুনতে হয়েছিল। বেঁচে গেছি বলেই আমি সুখী হয়েছিলাম। কখনও ভাবিনি এই ছোট বিষয়টিকে ফেনিয়ে বড় করে লেখে সর্বসাধারণের কাছে উপস্থিত করতে হবে।
হবোরা কিন্তু এ ধরণের খাঁটি এড্ভেন্চারই লোকের কাছে বলার জন্য পিপাসু হ’ত কিন্তু এরূপ এড্ভেন্চার কি সকল সময় ঘটে? এরূপ এড্ভেন্চার খুঁজতে গেলে মরণেরও সম্ভাবনা থাকে। আমেরিকার দুষ্ট লেখকগণ সরল সচ্চরিত্র যুবকদের বিপথগামী করে খাঁটি থ্রিলিং গল্প পাবার জন্য ফরমাইস দিয়ে অনেক যুবককে পথে টেনে নিয়ে আসত। অবশ্য এখন সেরূপ বিপথগামী হবো খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়।
হবোরা প্রথম যখন পথে বের হয় তখন তাদের থাকে একটা সৎ উদ্দেশ্য, কিন্তু কয়েকমাস পর যখন কোন উদ্দেশ্যই সফলতার দিকে অগ্রসর হয় না তখন তারা বিগড়ে যায় এবং অন্যায় পথ অবলম্বন করে। কোনমতে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়াই হয়ে যায় তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আমেরিকাতে কোনমতে জীবন কাটান বড়ই কষ্টকর বিষয়। সেজন্যই হবোদের কেউ পছন্দ করে না, পারলে বেকার বলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। সেরূপ হবো আমাদের দেশে প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য আমাদের দেশের হবোদের জেলেও যেতে হয় না, খাদ্যের অভাবেও কষ্টও পেতে হয় না। তারা হল সাধু। সাধুদের আমরা প্রতিপালন করি পাপ হতে মুক্ত হবে বলে। অনেক বিদ্বান লোক সাধুসেবা করে ধন্য হন কিন্তু এই অশিক্ষিত বিদ্বানের দল জানেন না এরাও আমেরিকার হবোদের মত জেলে বাস করারই উপযুক্ত। ভারতের হবোরা পথে বের হয় ভগবানের ডাকে, আর আমেরিকার হবোরা পথে বের হয় পথের ডাকে। উভয় দেশের হবোদের মাঝেই পথে বের হবার বেলা চিত্তের বিকার হয় এবং উভয় দেশের হবোদেরই যখন চিত্তচান্চল্য ঘটে, তখন বিপথগামী হয়। তবে দুঃখের বিষয় আমেরিকার হবোদের সর্বসাধারণ ঘৃণা করে এবং তাদের জেলে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে। আর ভারতের হবোরা ভারতের সর্বসাধারণের মাথায় নারিকেল ভেংগে তাই ভক্ষণ করে আনন্দে জীবন কাটায়। আজ আমার জীবনেও যেন আমেরিকার হবোদের ভাবই ফুটে উঠল। গভীর রাতের ঠাণ্ডাকে অবহেলা করে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। নিদ্রা বেশ হল। ঘুম থেকে উঠে মনে হল দুর্বলের একমাত্র অস্ত্র হল হুকুম তামিল না করা, কিন্তু আমি দেখছি দুর্বল হতেও অধম। প্রকৃতির আদেশের তাঁবেদারী করছি। কেন আমার শরীরে ঠাণ্ডা লাগবে? উত্তম ঘরে উত্তম বিছানায় শোয়াই হল প্রকৃতির আদেশ অমান্য করা, মানুষ বলে পরিচয় দেওয়া। তা যদি না হত তবে আমাতে আর বন্য পশুতে অথবা অসভ্যদের মাঝে পার্থক্য কি?
মলিন মুখে উঠে দাঁড়ালাম। পথে এসে দাঁড়ালাম এবং একটি মোটরের চালককে ইংগিত করা মাত্র সে আমাকে তার মোটরে উঠিয়ে নিল। কোনো হবোকে কেউ মোটরে উঠিয়ে নেয় না কিন্তু যারা হিচ্ হাইক্ করে তাদের অনেকেই সাহায্য করে। কারণ সাহায্যকারী অবগত আছে এই লোকটি দায়ে পড়েই সাহায্য নিচ্ছে, অন্যথায় কখনও সাহায্য নিত না। আমার সাহায্যকারী আমাকে ব্যাফেল পৌঁছে একটি হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেন। আমি আমার সাহায্যকারীকে সেদিন ধন্যবাদও দেইনি কারণ আমার মন হোটেল সম্বন্ধীয় চিন্তাতেই ব্যস্ত ছিল। চিন্তাস্রোতে ভাসতে ভাসতে হোটেলে গেলাম। হোটেলে স্থান পেলাম। স্নান করে খেয়ে যখন রুমে শুতে যাচ্ছি তখন একজন বলল, “এ লোকটা কে হে, স্পেনিস্ হবো নয়ত?” অন্য জন জবাব দিল লোকটাকে স্পেনিস্ বলে মনে হয় না, তবে নিগ্রো নয় এটা নিশ্চয়, আর হবো ত নয়ই।
যখন আমার ঘুম ভাংল তখন পরের দিনের বিকাল বেলার তিনটা বেজেছিল। হোটেলের কেউ আমার ঘুম ভাংগায়নি নিজেই জেগেছিলাম। বিকাল বেলা ফের স্নান এবং খাওয়া সমাপ্ত করে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।
সারাটি বিকাল বেড়িয়ে এসে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন যে ভদ্রলোক আমাকে মোটরে করে পথ থেকে নিয়ে এসেছিসেন, হঠাৎ তিনি এসে উপস্থিত হলেন। ভদ্রলোকের নাম জন হার্টস্ এবং তাঁকে তাঁর নাম ধরে ডাকতে আমাকে অনুমতি দিলেন। আমিও আমার নাম ধরে ডাকতে তাঁকে অনুমতি দিলাম। অবশ্য নামটাকে ছোট করে বললাম আমার নাম ‘রাম’। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্ব পেকে উঠল এবং মিস্টার হার্টস্ আমাকে নিয়ে ডিট্রয় যাবেন বলে স্বীকার করলেন। হার্টস্ একজন বেকার যুবক। তার সংগে চুক্তি হল, আমি মোটরের পেট্রল খরচ বহন করব এবং তিনি মোটর চালাবেন। পথে অন্য যা কিছু খরচ হবে তা দুজনে সমান ভাগে বহন করব।
আমার নিউইয়র্ক-এর বন্ধুগণের সংগে তখনও দেখা হয় নি। হার্টস্কে বলেছিলাম, হয় তিনি আমার হোটেলে চলে আসুন, নয় ত আজ থেকে ছয়দিন বাদ দিয়ে সপ্তম দিনে এসে আমার সংগে দেখা করুন। এর মাঝে আমার নায়গ্রা প্রপাতও দেখা হয়ে যাবে।
আমেরিকায় ওয়াই. এম. সি-কে ওয়াই বলা হয়। হার্টস্ সেখানে গেলেন। সেখানে আমার মত ভারতবাসীর প্রবেশ নিষেধ। চিকাগো, সল্টলেক্ সিটি, স্যানফ্রানসিস্কো এবং লস্-এ্যন্জেল্স্এর ওয়াই দেখবার সুযোগ হয়েছিল। ওয়াই এক জাতীয় হোটেল বিশেষ। তাতে পুরুষ মাত্রেই থাকতে পারে। ওয়াই দু রকমের। একটা হল শ্বেতকায়দের জন্য, অন্যটা হল কালোদের জন্য। ব্যবসায়ের হিসাবে ওয়াই এর ব্যবসা বেশ লাভজনক। ওয়াই সম্বন্ধে এর বেশী যদি কিছু বলতে হয়, তবে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুবার সম্ভাবনা। অতএব এ সম্বন্ধে নীরব থাকাই ভাল।
আমার নিউইয়র্কের সংগীরাও ওয়াইতেই থাকতেন। আমাকে নিগ্রো হোটেলগুলিতে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষটায় সাদা হোটেলে খুঁজতে আরম্ভ করে আমার সাক্ষাৎ পেলেন। আমাকে পেয়ে তাদের কি আনন্দ। সাদায় কালোয় যে কত অন্তরংগতা হতে পারে তা তখনই মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছিলাম। ওদের সংগে বিশেষ ঘনিষ্টতা থাকায়, অনেক দিন পর দেখা হল বলে তারা হেসে এবং চীৎকার করে রুমটাকে মাথায় তুলতে লাগল। কিন্তু তারা যখন আনন্দ করছিল তখন আমি মনের দুঃখে হাসতেও পারছিলাম না। অবশ্য সেজন্য তাদের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হয়েছিল।
আমি তাদের বলেছিলাম, “বন্ধুগণ, আমার ভাবান্তরে আপনাদের চিন্তার কোন কারণ নাই। আমি আজ অন্য কথা ভাবছি। আপনাদের দেশে যেমন নিগ্রোদের প্রতি সামাজিক অত্যাচার হয়, ঠিক সেইরূপই আমাদের দেশেও অনেকেরই প্রতি সেরূপ সামাজিক অত্যাচার হয়। তার প্রতিকার করবার জন্য মহাত্মা গান্ধী অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু কৃতকার্য হতে পারেন নি। কেন জানেন? যাকে আপনারা ডিমোক্রাসি বলেন, আর আমরা যাকে গণতন্ত্র বলি, আসলে তা কিছুই নয়। আপনাদের সংগে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে, কিন্তু আপনারা যে পর্যন্ত না আমাকে হিন্দু বলে আপনাদের সমাজে পরিচয় করিয়ে দেবেন সে পর্যন্ত আপনাদের সমাজে আমার স্থান নাই। কি করে এই পাপ পৃথিবী থেকে দূর হয় তাই আমি মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে ভাবি। আমার দেশে আমার সামাজিক স্থান তথাকথিত উচ্চ শ্রেণীর লোকের মাঝেই। যদি আফ্রিকা ও আপনাদের দেশ পর্যটন না করতাম, তবে এরূপ চিন্তা আমার মাথায় আসত না। মোগল সম্রাট, পাঠান সম্রাট আমাদের দেশ শাসন করেছেন, কিন্তু এখনও তাদের বংশধররা সর্বত্র স্পৃশ্য নন। এই বর্বরতায় তাঁরা ভ্রূক্ষেপ করেন নি, চুটিয়ে রাজত্ব করতেই ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু সে ছিল এক যুগ, এখন নবযুগ এসেছে। এই নবযুগেও, বলতে গেলে নবযুগের অগ্রদূত সভ্য আমেরিকাবাসীদের মধ্যেও, ভারতের প্রাচীন এবং আধুনিক বর্বরতা বর্তমান দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি।”
তাদের সংগে কথা হল আমি একা যাব ‘নায়গ্রা ফল্স্’ দেখতে। নায়গ্রার মত এত বড় একটা পরিব্রাজকের তীর্থেও বর্ণ বৈষম্য মানা হয় কি না দেখব। পরদিন প্রাতে বাসে গিয়ে বসলাম। যে সকল বাস নায়গ্রায় যায় তাদের ‘স্ট্যাণ্ড’ শহরের বাইরে। বাস প্রত্যেক পাঁচ মিনিট অন্তর ছাড়ে। সেখান হতে বাসের ভাড়া কুড়ি সেণ্ট। আমাকে বাসে বসতে দেখে অনেকেই পরের বাসের অপেক্ষায় রইল। আমি একা। এদিকে বাস ছাড়বার সময় হয়ে গেছে কিন্তু আমি ছাড়া অন্য কোনও প্যাসেন্জার বাসে উঠেনি। অগত্যা আমাকে নিয়েই বাস ছাড়তে বাধ্য হল। কনডাক্টরকে জিগ্যাসা করলাম, “আমি একা চলেছি, অন্যান্য যাত্রীরা আমার জন্যেই বাসে উঠেনি, সেজন্যে কি আমাকে বেশী কিছু দিতে হবে।” কনডাকটর বলল, “আজকে আপনাদের লোক (মানে নিগ্রো) এদিকে বড় বেশী আসে নি, তাই এমন হয়েছে, নতুবা আমাদের ক্ষতি বড় একটা হয় না। অবশ্য পথে অন্য যাত্রী পাব, তারা আপনার বসার জন্যে কিছুই মনে করবে না।” কথাটা শুনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম, কারণ আমার কাছে সামান্য অর্থ-ই ছিল।
পথে অন্যান্য যাত্রী উঠল। কেউ আমার গা ঘেঁসে বসল না। প্রত্যেকটি আসনে দুজন করে বসা যায়। স্থানাভাবে অনেকে দাঁড়িয়ে রইল, তবুও আমার পাশে কেউ বসল না। মনে মনে ভাবলাম, বর্বরদের মত বর্বর হয়ে লাভ নাই, আমিই উঠে দাঁড়াই। উঠে দাঁড়ালাম। দুটা বর্বর আমার পরিত্যক্ত স্থান দখল করল। অমনি তাদের গিয়ে বললাম, এখানের একটা সিট আমার, আপনাদের একজনকে দাঁড়াতে হবে। নীরবে দুজনেই উঠে দাঁড়াল। আমি ফের গিয়ে সিটিএ বসলাম। এই দৃশ্যটি অনেকেরই চোখে পড়ল কিন্তু কেউই গ্রাহ্য করল না। আমিও চিন্তিত মনে আকাশ ভরা মেঘমালার দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম।