আজকের আমেরিকা/নায়গ্রা প্রপাত
নায়গ্রা প্রপাত
বাস একটা প্রকাণ্ড সাগর তুল্য হ্রদের তীর দিয়ে চলছিল। হ্রদের মাঝে কবি-বর্ণিত নির্মল জলের অভাব। জল ধূসর বর্ণের। হ্রদের তীরে নানা রকমের এলোমেলো বাড়ি ঘর। দেখলেই মনে হয় এদিকে আমেরিকার ইন্জিনিয়ারদের দৃষ্টি পড়ে নি। এককালে রেড ইণ্ডিয়ানদের অত্যাচার এদিকে বেশিই হয়েছিল। রেড ইণ্ডিয়ানদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য এককালে যেমন করে গৃহসজ্জা করতে হয়েছিল, তার চিহ্ন এখনও বর্তমান রয়েছে। কেন যে আমেরিকার ইন্জিনিয়ারগণ এদিকে হাত বাড়াতে পারেন নি, তা নিয়ে মনে মনে অনেক ভাবলাম, কিন্তু উপসংহারে আসতে পারলাম না।
বাস ক্রমাগত চলছে। বাসের গতি ঘণ্টায় মাত্র পনের মাইল। এত আস্তে যাবার কারণ, পর্যটকদের হ্রদের সৌন্দর্য দেখবার সুযোগ দেওয়া। বাস কোম্পানী সাধারণের সুবিধার দিকে বেশ দৃষ্টি রাখেন। তাঁরা যেমন অর্থ উপার্জন করেন, তেমনি যাত্রীদের সুখ সুবিধার দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। দেখে খুব আনন্দ হয়েছিল। বাস নায়গ্রা শহরের গ্রে হাউণ্ড বাস কোম্পানীর স্টেশনে এসে হাজির হল। নিগ্রো কুলীরা প্রত্যেকের লাগেজ বার করে নিয়ে লাগেজরুমে রাখল। প্রত্যেকেই লাগেজের রসিদ নিয়ে নিজের নিজের লাগেজ মুক্ত করে যে যার পথ ধরল। আমার কোন লাগেজ ছিল না তাই আমি পথে এসে দাঁড়ালাম। ইচ্ছা রাত্রি কাটাবার জন্যে সর্বপ্রথম একটা হোটেল ঠিক করে একটু আরাম করি, তারপর নায়গ্রা প্রপাত দেখতে যাই।
নায়গ্রা শহরটাই হল কতকগুলি হোটেল নিয়ে গঠিত। অনেক হোটেলে গেলাম। সব হোটেলেরই ম্যানেজার স্থান নেই বলে আমাকে বিদায় করে দিল। তারপর আমি হিন্দু বলে পরিচয় দিয়ে অনেক হোটেলের ম্যানেজারের কাছে ঘর পাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাতেও কেউ আমাকে স্থান দিল না। অর্থাৎ টাকা দেখিয়েও ঘর পাওয়া সম্ভব হল না। অনেক কষ্ট করে অবশেষে একটি নিগ্রো হোটেল খুঁজে বার করলাম। হোটেলের মালিক আমাকে পেয়ে বেশ আনন্দিত হল এবং আমার থাকার জন্য একটি রুম দেখিয়ে দিল।রুমের ভাড়া প্রত্যেক রাত্রির জন্য দেড় ডলার করে (প্রায় সাড়ে চার টাকা) দিতে হয়েছিল। ঘরের ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে একটু আশ্বস্ত হলাম। হোটেলের মালিক আমার পরিচয় পেয়ে বড়ই দুঃখিত হল। সে আমাকে রাত্রে তার রেস্তোরাঁয় খাব কি না জিজ্ঞাসা করল। আমি রাজি হলাম না, কারণ সাদা হোটেলের খাবার ভাল এবং সস্তা। উপরন্তু তারা আমাকে রেস্তোরাঁয় ঢুকতে নিষেধ করে না। আমাকে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করতে নিষেধ করে না শুনে হোটেলের মালিক একটু আশ্চর্য বোধ করল। আমি তাকে বললাম, “তোমরাও যদি আমার মত সাহস করে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার দিতে আদেশ কর তবে হয়ত তোমরাও খাবার পেতে পার। দাবি করবার শক্তির তোমাদের অভাব।” হোটেলের মালিক এ কথারও কোনও জবাব দিল না, শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ভগবানের উপর দোষারোপ করল। আমি আর কোনও কথা না বলে নায়গ্রা প্রপাত দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।
নায়গ্রা প্রপাত দেখতে বেরিয়ে একেবারে প্রপাতের কাছে এসে পড়লাম। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। কিন্তু বিজলী বাতি চারিদিকে এমন তীক্ষ্ণ আলো বিতরণ করছে যে একদম যেন দিনের আলোর মত মনে হচ্ছিল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে প্রপাতের শোভা দেখলাম। এতক্ষণ দেখেও তৃপ্তি হল না, অনেকক্ষণ পায়চারি করলাম। যতই দেখতে লাগলাম ততই দেখবার ইচ্ছা হতে লাগল। আরও খানিকক্ষণ পায়চারি করে একটা পরিষ্কার স্থানে বসলাম এবং প্রপাতের দিকে চেয়ে রইলাম।
চোখে দেখতে লাগলাম প্রপাত, কানে শুনতে লাগলাম তার গর্জন। জল পড়ছে তার শব্দ, জল পড়ে ঘুরে উপরে উঠছে তার শব্দ, নানা তরংগের ঘাতপ্রতিঘাতের শব্দ। কি বিচিত্র, কি সুন্দর! অভিভূত মন নিষ্কর্মা হয়, কোনও গভীর চিন্তা তখন মনে আসে না। এ যেন আধজাগ্রৎ অবস্থা।
অনেকক্ষণ বসে যখন শরীরের রক্ত জমাট হবার উপক্রম হল, তখন উঠলাম। এতেই নায়গ্রা প্রপাত মনে গভীর রেখাপাত করল।
রাত অধিক হয়েছে, তাই আমাকে হোটেলে ফিরে আসতে হল। রাত্রে বেশ আরাম করে শোব ভেবেছিলাম, কিন্তু ক্রমাগত রেলগাড়ির সাণ্টিংএর শব্দে আর ঘুম হল না। ঘরের পাশ দিয়েই সাণ্টিং করার লাইন ছিল। প্রাতে সামান্য একটু তন্দ্রা এসেছিল। কিন্তু আমার আমেরিকার বন্ধুরা ফিরে আসার দরুন আর না ঘুমিয়ে তাদের নিয়ে বার হয়ে পড়লাম। একটি সিগারেট বিক্রেতার দোকানের কাছে এসে গতকল্য যা দেখেছি ও শুনেছি তার বর্ণনা করলাম তারপর আমরা রেস্তোরাঁয় বেশ করে পেট বোঝাই করে খেয়ে আবার নায়গ্রা প্রপাতের তীরে এলাম।
মানুষ চিন্তা করতে ভালবাসে, কিন্তু উগ্র চিন্তা পছন্দ করে না। যারা শুয়ে শুয়ে উপন্যাস অথবা ভ্রমণকাহিনী পাঠ করতে ভালবাসে তাদের কাছে ইন্জিনিয়ারিং অথবা ভূতত্ত্বের কথা বলতে যাওয়া মহা অন্যায় কাজ! তবুও আমাকে এবার ভূতত্ত্বের কথা বলতেই হবে নতুবা আমার ভ্রমণকথার সমাপ্তি হবে না। পৃথিবীর বৃহত্তম প্রপাত দেখবার জন্য লক্ষ লক্ষ নরনারী দেশ বিদেশ থেকে এসে থাকে। একটির নাম নায়গ্রা, অপরটির নাম ভিক্টোরিয়া। দুই প্রপাতই আমি দেখেছি, দুই-ই এক ধরনের। তবে ঋতুর প্রভাবে জলের স্রোতের প্রখরতার কমিবেশি হয়ে থাকে। নায়গ্রা প্রপাতে যখন বন্যার জল আসে তখনকার অবস্থা চোখে না দেখলে ছবি দেখে কিছুই বোঝা যায় না। জল বহুদূর হতে আসে, বহুদূর হতে জল আসার জন্য স্রোত তীব্র হয়ে উঠে। তারপর সেই প্রবল জলধারা একসংগে দেড়শত ফুট নীচে পড়ে যে ভীষণ শব্দের সৃষ্টি করে তা সত্যই বর্ণনাতীত। নায়গ্রা প্রপাতের আরও একটি বিশেষত্ব আছে। শীতের সময় এই প্রবল জলস্রোত বরফে পরিণত হয়। প্রপাতের জায়গাটিতে বরফের ফোয়ারা দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য যা দেখিনি তা নিয়ে বেশি কথা বলা কথার বাহুল্য মাত্র।
ভিক্টোরিয়া প্রপাতের জল পড়া অন্য ধরনের। ছোট ছোট নদী নালা বয়ে জল আসছে। তারপর চলছে এক সমতল ভূমির উপর দিয়ে। সেই সমতল ভূমির উপর বাঁদর লাফাচ্ছে, ছাগল ঘাস খাচ্ছে, এমন কি চড়ুই পাখীও কখন কখন ঝাঁকে ঝাঁকে এসে জল খাচ্ছে। এখানে নায়াগ্রা এবং ভিক্টোরিয়ায় অনেক প্রভেদ। আবার বর্ষার সময় ভিক্টোরিয়ার জল যখন পর্বত থেকে নীচে নেমে আসতে থাকে, তখন বাস্তবিক এক ভয়াবহ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
নায়গ্রা প্রপাতের দুই দিকে বিস্তীর্ণ ভূমি। উভয় দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখা যায় শস্যশ্যামল ও সমতল শস্যক্ষেত্র। নায়গ্রা প্রপাতের অবস্থা দেখে অনেকে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারণ যে স্থানে প্রপাতের ঠিক আরম্ভ হয়েছে সেখানে পাথর ধ্বসতে ও খস্তে আরম্ভ হয়েছে। ভয় এই যে ধ্বসা এবং খসা নিবারণ না করলে কালক্রমে নায়গ্রা আর প্রপাত থাকবে না, হয়ে যাবে একটা ছোট নদী। কানাডা এবং ইউনাইটেড স্টেটস পৃথিবীর এমন একটি সৌন্দর্যকে হারাতে চায় না। যে রকম শুনলাম আর বুঝলাম তাতে মনে হয়, নায়গ্রা প্রপাত যদি বেশি দিন প্রপাতরূপে বাঁচে তবে আর একশত বৎসর মাত্র। নায়গ্রা প্রপাতকে বাঁচাবার একটি মাত্র উপায় আছে। সাময়িকভাবে তার জলধারার গতি পরিবর্তিত করে যে সকল স্থান ভাংতে আরম্ভ করেছে সেই সকল স্থানের পাথর সরিয়ে দিয়ে যদি নূতন করে সিমেণ্ট দিয়ে বাঁধিয়ে ফেলা হয়, তবে হয়ত নায়গ্রা প্রপাত অনেক দিন বাঁচবে। ইউনাইটেড স্টেটসেই এরূপ আর একটা প্রপাত ছিল, যার জলধারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সরে যাওয়ায় সেই প্রপাত এখন শুকনা নদীতে পরিণত হয়েছে।
নায়াগ্রা প্রপাতের জল যেখানে সোজা হয়ে পড়ছে সেখানকার গভীরতা মাত্র একশত পন্চাশ ফিট। এই স্থান থেকে নীচের দিকে তিন মাইল পর্য্যন্ত আমি গিয়েছি এবং দেখেছি জলের গভীরতা কমছে। অনেক স্থানে মাছের পর্য্যন্ত চলাচল আছে। আমার ইচ্ছা ছিল আরও নীচে গিয়ে দেখি, কিন্তু তা আমার দ্বারা সম্ভব হল না। ক্রমাগত উঁচু নীচু ভূমি চলেছে। রেল লাইন এবং নানারূপ কারখানায় নদীর তীর আবদ্ধ থাকায়ই যেতে পারিনি। সিনেমায় নায়গ্রা প্রপাতের দৃশ্যাবলী বেশ সুন্দর করে দেখান হয়। সাধারণ জ্ঞান লাভার্থে তা যথেষ্ট বলে মনে করি।
জাহাজে করে নায়গ্রা প্রপাতের কাছে গিয়ে দেখবার ব্যবস্থা আছে। হঠাৎ মনে হল একটু মজা করা যাক। সাথী আমেরিকানদের বললাম, “আপনারা এখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকুন, আমি জাহাজের টিকেট কিন্তে যাব, দেখব, টিকিট আমার কাছে বিক্রি করে কি না।” তাঁরা বললেন “টিকেট নিশ্চয় পাবেন, তবে নিগ্রো বলে হয়ত জাহাজে কোথাও বসতে দিবে না।” যাই হ’ক, একখানা টিকিট কিনলাম এবং জাহাজের একটা সীটে গিয়ে বসলাম। বাপরে! কত লোক আমার প্রতি যে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, তার আর শেষ নাই। সকলের দৃষ্টিই যেন বলতে চায়, “উঠে যা কালো ভূত। প্রত্যেকের দৃষ্টিতেই আমার প্রতি ঘৃণাসূচক একটা ভাব প্রকাশ পাচ্ছিল। আমি তাদের দেখেও না দেখবার ভান করে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছিলাম।
নায়গ্রা প্রপাত দেখে অনেকের মনে কবিত্ব আসে। অনেক সুন্দর বই লেখে। সেই বইয়ের খুব কাটতি হয়। আমি প্রপাতে এসে সুখী হয়েছিলাম বটে, কিন্তু এক বিষয়ে একটা কাঁটা মনের মধ্যে বিদ্ধ হয়ে ছিল। ওই যে কতকগুলি চোখ, ঘৃণার বশবর্তী হয়ে আমার দিকে ক্রমাগত তাকাচ্ছিল তাতে মন অসুস্থ বোধ করছিলাম। এত শিক্ষা দীক্ষাতেও কেন যে এদের মনের ঘৃণ্য ভাব দূর হয় না, তা আমি কোনও মতেই ভেবে পাই নি। আমার চামড়াটার কালো রংএর জন্য যে আমি দায়ী নই তা ত বোঝা উচিত। এরূপ মনোভাবের লোক সকল দেশেই আছে কিন্তু এখানে খুবই কম। তার কারণ কি? এদের কখন পরিবর্তন আসবে। তাই ছিল বিবেচ্য বিষয়। আমার মনে হয় ভবিষ্যতে আমেরিকায় কালার বার থাকবে না, কারণ অশ্বেতকায়দের মাঝে বেশ সাড়া পড়েছে এবং কোথায় অশ্বেতকায়দের দুর্বলতা অনেকেই তা অনুভব করে মনের উন্নতির চেষ্টা করছে।
প্রপাতের কাছে যতই জাহাজখানা কেঁপে কেঁপে অগ্রসর হচ্ছিল ততই বৃষ্টির মত জল এসে আমাদের উপর পড়ছিল। প্রপাতের উৎক্ষিপ্ত জলকণায় ভিজে প্রপাত দেখার জন্য ওয়াটার প্রুফ নিতে হয় এবং সেজন্য ওয়াটার প্রুফের ভাড়া পন্চাশ সেণ্ট করে প্রত্যেকের
কাছ থেকে নেওয়া হয়। সবাই যখন বর্ষাতি নিতে গেল আমিও তাদের সংগে গেলাম। বর্ষাতির কোটের রক্ষক আমাকে দেখে মহা বিপদে পতিত হল। আজ পর্যন্ত কোন কালো লোক তার কাছ থেকে বর্ষাতি কোট চেয়ে নেয় নি। সর্বপ্রথমেই বর্ষাতি রক্ষক আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমার দেশ কোথায়? আমার দেশের নাম বললাম। লোকটি আমার কথা বিশ্বাস না করে আমি যে হিন্দু তার প্রমাণ চাইল। আমি আমার পাসপোর্টখানা দেখালাম। আমার পাসপোর্ট দেখে বর্ষাতি রক্ষক আমাকে একটি বর্ষাতি দিয়ে বিদায় করল। এসব অপমান সহ্য করেও যারা কবিত্ব ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে আমি তাদের দলের লোক নই।বাইরে এসে নায়গ্রা প্রপাতের দৃশ্যাবলীর দিকে চেয়ে কালো লোকদের বর্তমান জীবনের কথাই ভাবতে লাগলাম। নায়গ্রা প্রপাতের নানা দৃশ্য চোখে আসল আর গেল কিন্তু তাতে মনে কোন দাগ কাটতে পারল না। আমার আত্মসম্মানবোধ আছে তাই নায়গ্রা প্রপাত দেখে ভাবুক সাজতে সক্ষম হই নি। যারা কাপুরুষ তারাই আত্মসম্মানের কথা ভুলে গিয়ে দার্শনিক হয়, কবি হয়। আর যারা পুরুষ তারা সকল কথা ভুলে গিয়ে আত্মসম্মানের কথাই ভাবে। জাতের অথবা স্বদেশের সর্বাংগীন স্বাধীনতাই আত্মসম্মানের একমাত্র প্রতীক।
প্রপাত দেখা সমাপ্ত করে আমেরিকার বন্ধুদের সংগে আবার এসে মিশলাম এবং আমার মনের ভাব তাদের কাছে প্রকাশ করলাম। তারা বলল, “যতদিন পুঁজিবাদ এই পৃথিবীতে বর্তমান থাকবে ততদিন এই পশুভাবও থাকবে।” তাদের কথা শুনে সুখী হই নি। আজও বুঝতে পারি না, সত্যই এই পুঁজিবাদ পৃথিবী হতে বিদায় নিবে?
নায়গ্রা প্রপাতের দৃশ্যাবলীর কথা বলার পূর্বে, কি করে নায়গ্রা প্রপাত জন্ম নিল সে কথা বলব। পার্বত্য ভূমির উপর অনেক সমতল ভূমি থাকে। সাধারণতই এরূপ সমতল ভূমির উপর এবং নীচ দিয়ে জল নানা রকমে প্রবাহিত হয়। অনেক স্থানে দেখা যায় সামান্য জল বয়ে গিয়ে একটা গর্তে পরিণত হয়েছে। জল জমে সে জলে কুণ্ডলীর সৃষ্টি হয়েছে। জল নীচের দিকে প্রবাহিত হয় বলেই এরূপ কুণ্ডলীর সৃষ্টি হয়। মানুষ যখন অসভ্য থাকে তখন সেরূপ জলকে “কুণ্ড” বলে অভিহিত করে। অনেকে সেই কুণ্ডের তীরে পশু হত্যা করে এবং পশুরক্ত কুণ্ডে নিক্ষেপ করে। সেরূপ দৃশ্য আমি একটি দেখেছি। এরূপ কুণ্ডে অনেকদিন জলের কুণ্ডলী থাকে না, কারণ নীচের ফাঁকগুলি কাদায় পূর্ণ হয়ে যায় এবং নীচের দিকে জল আর চুয়াতে পারে না। যখন কুণ্ডের জল স্থির হয় তখন অসভ্য লোক ভাবে জলদেবতা তাদের পূজায় সুখী হয়েছেন।
নায়গ্রা প্রপাতের অনেক দূর নীচে গিয়েও দেখেছি সর্বত্রই পাথরের ভেতরে নানা রকমের পচা মাটি এখনও রয়েছে। পচা মাটি পরিষ্কার করেই এই দুটি প্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে আমি বিষয়টা আরও বিষদ ভাবে বলতে পারতাম, কিন্তু পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলাম। এতে ভ্রমণ কাহিনী ভূগোলে পরিণত হয়। ভ্রমণ কাহিনীতে বৈজ্ঞানিক তথ্যের স্থান নাই শুধু ইংগিত থাকে।
নায়গ্রা শহরটি যদিও ছোট তবুও তাতে বেশ পারিপাট্য আছে। খাদ্যদ্রব্য এবং ভোগ বিলাসের অভাব নাই। এখানকার শ্বেতকায় হোটেলে আমি প্রবেশ করতে সক্ষম হইনি। বাইরের দৃশ্য দেখেই এখানকার অবস্থা অনেকটা অনুভব করতে হয়েছিল। আমার সাথীরা সে বিষয়ে অনেকটা সাহায্যও করেছিলেন। বাইরের দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল এখানেও ব্যভিচারের অন্ত নাই। ভাল এবং মন্দ নিয়েই সংসার। তবে আমাদের দেশে যেমনভাবে অত্যাচার চলে তেমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। এখানকার অত্যাচার এবং ব্যভিচারের শেষ কোথায় তা খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু আমাদের দেশে তা পাওয়া যায় না।
বোধ হয় ছেলেটি স্পেনিশই হবে। মাঝে মাঝে দুএকটা স্পেনিশ শব্দও বলছিল। পথের পাশে দাঁড়িয়ে সে অনবরত “জুতা পরিষ্কার করুন” বলে চিৎকার করছিল। আমার সাথীদের প্রত্যেকেরই জুতা পরিষ্কার ছিল তবুও তারা জুতা পরিষ্কার করতে ছেলেটির কাছে গেল। প্রত্যেকেই জুতা পরিষ্কার করাল। প্রত্যেকেই তাকে তার প্রাপ্য দিল। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। চামারের ছেলের প্রতি কেউ সহানুভূতি দেখাতে রাজি নয়। চামারের ছেলে আমাদের পাশেও আসতে পারে না। আমরা তাদের মানুষ বলেও স্বীকার করি না। এদের জন্ম-মৃত্যু, সরকারী খাতায় উঠে, আমাদের মনের খাতায় উঠে না। এরা যদি নির্বংশ হয় তবুও তাদের জন্য আমরা ভাবি না। অতএব আমেরিকার দোষ আমাদের মনের খাতায় উঠাবার পূর্বে নিজেদের দোষের খাতাটা একটু দেখলে ভাল হবে। আমেরিকা সর্বাংশে আমাদের অনেক উঁচুতে বসে রয়েছে। আমরা তাদের নীচে থেকে যদি তাদের খারাপের দিকটা দেখি তবে আমরা আরও নীচে নেবে যাব, একথাটা সকল সময় মনে রেখে ভ্রমণ কাহিনী পাঠ করলে বাধিত হব।
ব্যাফেলো হতে ডিট্রয় পর্যন্ত অনেক মোটর রোড আছে। তার মাঝে সোজা পথ হল কানাডা হয়ে। কানাডা হয়ে যেতে হলে পরিচয়পত্রের দরকার। আমেরিকানদের পরিচয়পত্র নানা রকমের হয়―মোটরকার লাইসেন্স, কাজের সার্টিফিকেট ইত্যাদি। আমায় মনে হয় ভারতে পোস্ট অফিস যেরূপ সহজে পরিচয়পত্র দিয়ে থাকে, এরূপভাবে কেউ কোনও পরিচয়পত্র দিতে সক্ষম হয় না। কিন্তু আমেরিকায় পরিচয়পত্র পেতে হলে পনের মিনিট সময় লাগে। নিজের দুখানা ফটো নিয়ে যে কোনও পুলিস স্টেশনে হাজির হলেই হল। পুলিশ সর্বসাধারণের চাকর। তাকে দেখতে হয় ফটো দুখানা এই লোকের কি না, তার মুখে কিংবা প্রকাশ্য স্থানে কোনও দাগ আছে কি না। এই দুটা ফটো দেখেই সরকারী পরিচয় পত্র দিয়ে দেওয়া হয়। কলনিয়েল পুলিসের প্রবচনতুল্য অশিষ্ট ব্যবহারে অভ্যস্ত আমরা, আমেরিকার পুলিসের শিষ্ট ও সুন্দর ব্যবহারে বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারি না। কি সুন্দর সদ্ব্যবহার আমেরিকার পুলিশের! আমার সংগীদের পরিচয়পত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেল। তারপর আমরা চললাম গ্রে হাউণ্ড বাস কোম্পানির বাসকে পিছনে রেখে। স্লটর রাস্তায় ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে গাড়ি চালাবার অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের গাড়ি চলেছে ঘণ্টায় সত্তর-আশি মাইল করে। গাড়ি চলছে তো চলছে। মাঝে মাঝে ঈট্স্ (Eats) সাইন বোর্ড দেওয়া আছে। এসব খাবারের দোকানে সকল রকমের খাদ্য সকল সময় সুপক্ক অবস্থায় মজুদ থাকে। খাবার পাক করে বরফের বাক্সে রেখে দেওয়া হয়। গ্রাহক যাবামাত্র গ্যাসের উনুনে গরম করে খেতে দেওয়া হয়। এসব খাদ্য উপকারী এবং সুস্বাদু।
ঈট্স্ ঘরগুলিতে কোনও পারিপাট্য নাই, বিজলী বাতির ছড়াছড়ি নাই। দোকানী প্রায়স্থানেই পুরুষ। পুরুষগুলি শুষ্ক বদনে দণ্ডায়মান। দেখলে মনে হয়, হাসবার শক্তি ওদের লোপ পেয়েছে সব সময়েই যেন সন্ত্রস্ত, কিন্তু সুযোগ পেলেই দুর্বলের উপর হামকি তুমকি করতে ছাড়ে না। আমার পাসপোর্ট বেশ ভাল করেই পরীক্ষা করা হচ্ছিল, কিন্তু সংগীদের সেরূপ কিছুই হচ্ছিল না। ব্রিটিশ হতে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস পেয়ে কলনিয়েল্ লোকের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা হয় আজ তা ভাল করে বুঝলাম। পূর্বে ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দেও একবার বুঝেছিলাম। তখনকার কথা মনে ছিল না, এখন ফের নূতন করে মনে হল। প্রশান্ত মহাসাগরের অশান্তি নামক পুস্তকে তা বলা হবে।
গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে যেতে লাগলাম। মাঝে মাঝে ড্রাইভার সাথীকে বলে গাড়ি থামিয়ে লক্ষ্মীছাড়া গ্রামগুলি দেখতে লাগলাম। গ্রামের খড়ের ঘরগুলি খড়ে পূর্ণ, চারদিকে কোনওরূপ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার লেশ নাই। হয়ত গত একমাস যাবৎ এদিকে কেউ আসেই নি। গরুতে খড় খেয়েছে এবং খড় চারিদিকে এলোমেলো করে রেখে গেছে। ইঁদুর তাতে বেশ বড় বড় গর্ত করেছে। গরু মাঠে আপন মনে চর্ছে তাদের ভাল জলের কোনও বন্দোবস্ত নাই। শূকরগুলি আপন মনে দৌড়াচ্ছে, এবং শুচ্ছে, মনে হয় যেন তাদের কেউ দেখবারও নাই। গৃহস্থের ঘর অপরিষ্কার। কোথাও ভেংগে পড়েছে, কোথাও প্রখর সূর্যালোক টালিহীন ছাদের ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভিতর উঁকি মারছে। ইলেকট্রিক লাইট দেখলাম না, বোধ হয় মোমবাতিই ব্যবহৃত হয়। কৃষক কাংগাল হয়ে পথে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখছে। কৃষকপত্নী ম্লান মুখ নত করে সেলাইএর কাজে রত। ক্যানাডার লোকের আর্থিক অবস্থা ভাল মনে হল না।
গ্রামে যুবক-যুবতীর দল মুদীখানার দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। হাসছে বটে, কিন্তু সে হাসিতে অভাবের ছাপ মারা রয়েছে। যুবকদের স্বাস্থ্যশ্রী অনুজ্জ্বল। কিন্তু কেন? ক্যানাডার লোক কি এতই দরিদ্র যে ছেলেপিলেদের স্বাস্থ্যবিধান পর্যন্ত করতে পারে না? আমার মনে হয় তারা যা পায় তাতে তাদের অভাব মোচন হয় না। হতশ্রী গ্রাম আর দেখতে ইচ্ছা হল না। সাথীদের বললাম আর গ্রামে গাড়ি থামিও না। আমরা আর কোথাও থামি নি, সারাদিন গাড়ি চালিয়ে সন্ধ্যায় উইণ্ডসর্ নামক স্থানে এসে পৌঁছলাম।
উইণ্ডসর্ শহর। পথ ঘাট লণ্ডনের মত আঁকাবাঁকা। তত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়। লোকের চলাচল বেশি নয়। যারা পথে চলছে তাদের মুখ দেখলে মনে হয় তারা চিন্তিত। হাসির তো কথাই নাই। বেশীক্ষণ এরূপ পুঁজিবাদী শহরে থাকতে ইচ্ছা হল না। একটি রেস্তোরাঁয় সামান্য পানাহার করে এক সুড়ংপথে চললাম। সুড়ংএর উপরে হ্রদের জল খেলছে। বড় বড় জাহাজ সুড়ংএর উপরের জলে চলাফিরা করছে। সুড়ং পথটি সুন্দর করে গড়া হয়েছে। দুখানা মোটর স্বচ্ছন্দে আসা-যাওয়া করতে পারে। পথটির দৈর্ঘ্য অন্তত আড়াই মাইল হবে বলে মনে হল। এরূপ সুড়ং-পথ তৈরী করতে অনেক টাকা লেগেছে সন্দেহ নাই, অবশ্য সর্বসাধারণের তাতে অশেষ সুবিধা হয়েছে।