আজকের আমেরিকা/নিউ ইয়র্কের ব্রেড লাইন

নিউ ইয়র্কের ব্রেড লাইন

 ইনউইয়র্ক-এর ব্রেড লাইন দেখবার বড়ই ইচ্ছা হয়েছিল, তাই একদিন বাইশ নম্বর স্ট্রীটের একটি বাড়িতে ব্রেড লাইন দেখতে গিয়েছিলাম। বাড়িটাতে কত লোক থাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু কেউ সে প্রশ্নের জবাব দিল না। আমি ভারতীয় পর্যটক, হাতে পেন্সিল এবং খাতা দেখে অনেকের সন্দেহ হয়েছিল। নোট লিখতাম নিজের ভাষায়। তাই আমার লিখবার ধরনটি দেখবার জন্যে চারিদিকে লোক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লোকসংখ্যা সম্বন্ধে কারুর কাছ থেকে কোন উত্তর না পেলেও আন্দাজে ধরে নিলাম, ছয় শ লোক বাড়িটাতে বাস করে। এদের খাদ্য এবং থাকবার ঘর দেখবার ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। তার একমাত্র কারণ হল হাতের পেন্সিল এবং খাতা। কার্যসিদ্ধি না হওয়ায় বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে আসলাম। দুদিন পর খাতা পেন্সিল না নিয়ে, টুপিটা বেশ করে মাথায় চাপিয়ে আমেরিকান্‌ ধরনে কথা বলে কয়েকটা লোকের সংগে বন্ধুত্ব করে নিলাম। তারা বুঝল আমি নিগ্রো। কুকুর বিড়ালকে দেখে আমরা যেমন ভয় পাই না অথবা কোন অন্যায় কাজ করতে যেমন করে লজ্জা অনুভব করি না তেমনি শ্বেতকায়দের নিগ্রোকে লজ্জা করবার কিছুই নাই, নিগ্রো সেজে আমার প্রশ্নগুলির জবাব পেতে মোটেই কষ্ট হল না।

 বাড়িটাতে প্রবেশ করে বেশ করে টহল দিলাম। একটি লোক কাফি খাচ্ছিল। তার কাপ হতে একটু কাফি চেয়ে খেলাম, দেখলাম তাতে দুধ এবং চিনি খুবই কম দেওয়া হয়েছে। বেকার মজুরদের যে খাদ্য দেওয়া হয় তা মোটেই ভাল নয়। লোহার খাটগুলি জেলের কয়দীরা যে খাটে শোয় তার চেয়ে খারাপ। অবশ্য মনে রাখতে হবে আমেরিকার কয়েদীদের যেরূপ খাটে শুতে দেওয়া হয় তা আমাদের দেশের প্রায় মধ্যবিত্তের ঘরেই নাই। রেষ্ট রুমগুলি যেভাবে অপরিষ্কার করে রাখা হয়েছে তা আমেরিকার সভ্যতার একটি খারাপ দৃষ্টান্ত। এসব যখন দেখছিলাম তখন মনে হয়েছিল ইম্‌পিরিয়েল প্যালেস, ওয়াল্‌স স্ট্রীট, পন্‌চম অ্যাভেনিউ এবং বুলওয়ার্ড এসব ধনীদের আরামের বস্তু।

 একদিকে ধনীদের উদ্দাম ভোগবিলাস আর অন্যদিকে যে সকল লোক তাদের সারা জীবনের সমস্ত শক্তি সমাজের হিতের জন্য ক্ষয় করেছে তাদের হাহাকার! হাহাকারই বলব, কারণ আমেরিকাতে অর্থহীন হয়ে পরের উপর নির্ভর করে বাঁচাটা আমেরিকানদের পক্ষে হাহাকার ছাড়া আর কিছুই নয়।

 আমেরিকার লোকের দারিদ্র্য নানা কারণে এসে দেখা দিয়েছে। যখন একটা জাত সাম্রাজ্যবাদী হতে চলে তখন নিজের ঘরের খবর তাদের রাখবার ফুরসত হয় না। সাম্রাজ্যবাদীরা ভাবে জাতীয় ভাবের মোহে ফেলে জাতকে ভুলিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। অনেক ক্ষেত্রে তারা এতে কৃতকার্যও হয়। আমাকে যারা নিউইয়র্কে পথ দেখাতেন, লেকচারের বন্দোবস্ত করে দিতেন তারাও অনেকে ব্রেড লাইনের সঠিক খবর রাখতেন না। আমি অনেক বেকার বৃদ্ধ মজুরদের সংগে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছে তাদের অতীত জীবনের কথা। সেই কথা যখন আমি শুনতাম তখন বড়ই মর্মবেদনা পেতাম। একজন বিল্‌ডার (রাজমিস্ত্রি) বললেন, তিনি সারা জীবন বড় বড় বিল্‌ডিং তৈরী করেছেন, এমনকি সেদিনও যখন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ইম্‌পিরিয়েল বিল্‌ডিং তৈরী হয়েছিল তাতেও তিনি কাজ করেছেন। আজ তিনি কর্মে অক্ষম তাই তাঁকে ব্রেড লাইনে দাঁড়িয়ে শেষের দিনের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আমেরিকাতে যারা প্রগতিশীল মত ও পথ বেছে নিয়েছে তারা কিন্তু এরূপ ব্রেড লাইনের পক্ষপাতী নয়, তারা বৃদ্ধ বয়সের পেনসনের পক্ষপাতী। নিউইয়র্ক ষ্টেটে বৃদ্ধ বয়সের যে পেনসন দেওয়া হয়, তা শুধু ব্রেড লাইন থেকেই পাওয়া যায়।

 সমাজের কাজে এসব মজুরের কোনো দান আছে কি না তা কেউ বুঝতে চায় না কারণ এসব মজুরের কাজের কোন তালিকা রাখা হয় নি। এজন্যই এরা বৃদ্ধ বয়সের পেনসন পাচ্ছে না। অথচ আমেরিকার ধনীরা যখন গমের দাম ঠিক ঠিক মত পায় না, তখন তারা গম পুড়িয়ে ফেলে। চিনি নষ্ট করে দেয়। বাগানের ফল বাগানে পচে। এরকম মজার দেশ আর কোথায় আছে? অথচ এরাই সোভিয়েট রূশের বিরুদ্ধাচরণ করে বেশি।

 আমি জানি না, কোন ভারতীয় পর্যটক আজ পর্যন্ত ফাদার হফ্‌কিনের নাম এদেশে এসে বলেছেন কি না। আমি কিন্তু সে নামটি একদম মুখস্থ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার নাম শুনলে আমার আতংক হত এমনকি অনেকদিন তার নাম ভুলবারও চেষ্টা করেছিলাম। ফাদার হফ্‌কিন কর্মতালিকা যখন তার লোকজন প্রচার করত তখন তা আমি শুনতাম আর ভাবতাম এই লোকটি আমেরিকাতে আরও অ্যাংকোল টমস্‌ কেবিনের সৃষ্টি করতে চায়। ফাদার হফ্‌কিন্‌ দেখতে চায় আমেরিকা হতে ইহুদী বিতাড়িত হউক, নিগ্রো নিপাত যাউক আর এদের যারা রক্ষা করতে চায় সেই প্রগতিশীল ভাবাপন্ন লোকদের শূলে চড়ান হউক। লোকটা সোসিয়েলিজমকে সাপের মত ভয় করে।

 এরই মাঝে ফাদার হফ্‌কিনের প্রচারের সুফল দেখা দিতে শুরু হয়েছে। একদিন একটি নিলামের দোকানে গিয়েছিলাম। অবশ্য আমাকে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলাম যিনি জিনিস নিলাম করছেন কতকগুলি লোক তাকে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। তিনি অনেকক্ষণ তা লক্ষ্য করে যখন দেখলেন তার জিনিস মোটেই বিক্রি হচ্ছে না তখন তিনি চিৎকার করে বললেন, “ভদ্রলোকগণ, আপনারা ভাবলেন না যে আমি একজন ইহুদী, আমি আপনাদের ব্যবহার নীরবে সহ করে যাব। মনে রাখবেন আমিও আপনাদের মতই একজন।” আশ্চর্যের বিষয় একথা বলার পরই ক্রেতারা নির্বিবাদে জিনিস কিনতে মন দিয়েছিল। দরিদ্র এবং ধনী ইহুদীদের প্রতি খৃষ্টানদের যেন একটা আক্রোশ রয়েছে। অথচ ইহুদীদের মত অন্য যে সকল খৃষ্টান খৃষ্টানদেরই রক্ত চুষে খাচ্ছে তাদের কেউ কিছু বলতে সাহস করছে না।

 আমেরিকাতে যে সকল লোক প্রগতিশীল ভাবধারা মেনে চলতে চান তাঁরা বড়ই নিরীহ প্রকৃতির লোক। তারা নিগ্রোদেরও শ্বেতকায়দের মত অধিকার দিতে চান; যারা কাজ না পেয়ে শুকিয়ে মরছে তাদের যাতে অন্নের ব্যবস্থা হয় তাঁরা তাও চান। এঁদের মাঝে আর অনেক মত আছে তবে সেই মতবাদ জানবার জন্য আমি মোটেই মনোনিবেশ করিনি। তাঁরা অন্যান্য দেশের প্রগতিশীল মতবাদীদের চেয়ে যদিও অনেক নিরীহ তবুও স্থির প্রতিজ্ঞ।

 এসব প্রগতিশীল ভাবুকদের স্থানীয় লোক কমিউনিষ্ট বলে। আমেরিকায় কমিউনিষ্ট পার্টি বে-আইনী। যদি কোনমতে আমেরিকা সরকার কাউকে কমিউনিষ্ট বলে প্রমাণ করতে পারেন তবে তৎক্ষণাৎ তার কাছ থেকে কাজ করবার অধিকারের কার্ড কেড়ে নেন। যারা কাজ করবার অধিকারের কার্ড হারিয়েছে তাদের প্রভাব ছাত্র সমাজে বড়ই প্রবল। কমিউনিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য করার জন্য মোটা রকমেৱ মাইনে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দায়ীত্ব জ্ঞানশীল যুবক যুবতীরা আগিয়ে আসে না। ছাত্র ফেডারেশন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে, হুভার হও আর রুজভেল্ট হও তোমাদের সমর্থন আমরা করব না। আমাদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ নতুন। পুরাতনকে আমরা আর আঁকড়ে ধরে রাখতে পারব না। আমরা কাজ করার অধিকার চাই। তোমাদের কাছে কাজ ভিক্ষা চাই না।

 যখন ছাত্রছাত্রীরা অবৈতনিক সরকারী বিদ্যালয় হতে বের হয় তখন তারা দেখতে পায় তাদের সামনে এক বিরাট অন্ধকার। তারা তাদের মা বাবার উপরও নির্ভর করে থাকতে পারে না। তাই যখন তারা কাজের খোঁজে বের হয় তখন কাজের খোঁজ পেতে অনেকের জুতার শুকতলী পর্যন্ত বেরিয়ে আসে অথচ কাজ যোগাড় হয় না। আমেরিকায় যুবক-যুবতীদের জন্য ভাল মন্দ দুটি পথই খোলা আছে। অনেক ধনীলোক নতুন যুবক-যুবতীদের দিকে অনেক সময় বাঁকা নজরে তাকান এবং তাদের নরকের পথে পৌঁছে দেন তার দৃষ্টান্ত আমি স্বচক্ষে অনেক দেখেছি। যে সকল ছাত্র এবং ছাত্রী বর্তমানে ছাত্র ফেডারেশনে কাজ করে এবং সেই প্রতিষ্ঠানটি চালায় তাদের অনেকের পূর্ব জীবন পাপে নিমজ্জিত ছিল। গ্রেইপস্‌ পিকার বইখানা তার একটি বিশিষ্ট নিদর্শন। যখন এই প্রকারের পথভ্রষ্ট ছাত্র এবং ছাত্রীরা প্লেটফর্মএ দাঁড়িয়ে তাদের আত্মজীবনী লোকের কাছে প্রকাশ্যে বলে তখন লজ্জা যাদের আছে তারা একের মুখ অন্যে দেখতে সাহস করে না। কথাটা এখানে আর বেশি বাড়িয়ে বলার দরকার নাই। যদি এ সম্বন্ধে এর চেয়েও বেশি কিছু জানতে চান তবে স্যানফ্রানসিস্‌কো হতে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা ‘পিপুলস্ ওয়ার্ল্ড” পাঠ করলেই জানতে পারবেন আমেরিকার বুকের উপর ধনীদের নির্মম অত্যাচার কাহিনী। কিন্তু এই শ্রেণীর কাগজ বিদেশে অতি কমই প্রেরিত হয়। প্রথম কারণ হ’ল যে সকল পর্যটক আমেরিকাতে বেড়াতে যায় তারা আশি পৃষ্ঠার সংবাদ পত্রই কেনে। চার পাতার সংবাদপত্র কিনে দশ সেণ্ট খরচ করতে কেউ রাজি নয়। দ্বিতীয় কারণ হ’ল বিদেশে গিয়ে, কে কি রকম পলিটিক্স করছে তার সংবাদ রাখতে চায় না। আরাম এবং আনন্দ নিয়েই সকলে ব্যস্ত। প্রগতিশীল লেখক এবং বিবেচক লোক আমেরিকাতে যেতে মোটেই পছন্দ করে না।