হার্‌লাম

 মানহাটন দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাংশ হার্‌লাম নামে পরিচিত। এ স্থানের বাসিন্দা সবাই নিগ্রো। হার্‌লামের বাড়ি-ঘর নিউইয়র্কএর অন্যান্য বাড়ি-ঘরের মতই। যদি নিগ্রোরা এ অন্‌চলে বাস না করত তবে এ স্থানটার এত বদনাম হত না। হার্‌লামে দিনের বেলা আমেরিকানরা খুব কমই আসে। কিন্তু সন্ধ্যার পর হতেই এদিকে শ্বেতকায়দের আগমন শুরু হয়। লণ্ডন, সাংহাই, জিব্রাল্টার, নীস্‌ এবং আমার মনে হয় প্যারীও রাতের বেলা হারলামের কাছে হার মানে। রাত্র যখন অধিক হয় তখন অন্যান্য স্থানের লোক হারলামের দিকে আসতে থাকে। তখন হারলাম হয় ভূস্বর্গ। সত্যই হারলাম ভূস্বর্গ। ভূস্বর্গে বসতি ক্রমে বেড়ে চলেছে। পূর্বে ভূস্বর্গের সীমানা ছিল ১০৪ স্ট্রীট পর্যন্ত, বর্তমানে হয়েছে ১০৮ স্ট্রীট। ক্রমেই এর সীমা বাড়ছে দেখে ফাদার হফ্‌কিনের মন কেঁপে উঠছে এবং ফাদার ডিভাইনএর আনন্দ বাড়ছে। উভয়েই খ্রীষ্টধর্মপ্রচারক। উভয়েই ইহুদী এবং কমিউনিস্ট বিদ্বেষী। অথচ উভয়ের মধ্যে মতের মিল নাই। ফাদার হফ্‌কিন চান নিগ্রোদের নিপাত করে সাদা চামড়াদের একাধিপত্য বিস্তার করতে, শুধু আমেরিকায় নয় পৃথিবীর সর্বত্রই। ফাদার ডিভাইন কিন্তু সেরূপ কিছু চান না, তবে তিনি নিগ্রো নিপাত মোটেই পছন্দ করেন না।

 ইটালি যখন আবিসিনিয়া আক্রমণ করল তখন হারলামের নিগ্রোরা আবিসিয়ান্‌দের সাহায্য করবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেও কিছু করে উঠতে পারে নি। ফাদার হফ্‌কিন তখন সুর উঠিয়েছিলেন, আমেরিকার অর্থ যদি এমন করে বিদেশে চলে যায় তবে দেশের দুর্গতি হবে। ‘অ্যাম্‌স্টারডম নিউজ’ সেই হফ্‌কিন যুক্তিকে খণ্ডন করার জন্য নানা যুক্তি দেখিয়ে নানা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ তার প্রতিবাদ করে পাল্টা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সংবাদপত্রগুলি যতই বাগযুদ্ধে মাতোয়ারা হল, নিগ্রোরা ততই দুঃখিত হয়ে গির্জায় গির্জায় হাবসী সম্রাটের জন্য প্রার্থনা করতে লাগল। হাবসী সম্রাটকে সাহায্য করবার কথা ভুলে না গিয়ে পুরাদমে তারা অর্থ জমাতে লাগল। ফাদার হফ্‌কিন হঠাৎ একদিন ঘোষণা করে দিলেন, বর্বর সম্রাট হাইলে সেলাসিকে আমেরিকা কোনওরূপ সাহায্য করতে পারবে না। নিজের শক্তি দেখাবার জন্যে কতকগুলা ভাড়াটে গুণ্ডাকে তিনি গির্জায় গির্জায় পাঠিয়ে দিলেন যাতে করে চাঁদা তোলা বন্ধ হয়ে যায়। ফল তার উলটা হল, দাংগা শুরু হল। শ্বেতকায়গণ হারলামে দোকান করে বেশ দু পয়সা উপার্জন করছিল, সেটি বন্ধ হল। দাংগার কথা সংবাদপত্রে এমন ঘটা করে বার হতে লাগল যে, লোক ইটালি-আবিসিনিয়ার যুদ্ধের কথা ভুলে গিয়ে দাংগার কথা নিয়েই মেতে উঠল। আসল কথা, দাংগা হাংগামা তেমন কিছু হয় নি। আমেরিকার হফ্‌কিনী কীর্তি আমি আফ্রিকাতে কিছুটা উপলব্ধি করেছিলাম। ইউরোপীয়ানরা ইংরেজী সংবাদপত্র পাঠ করে ফেলে দিতেন না, পুড়িয়ে ফেলতেন যাতে করে নিগ্রোরা ইটালি-আবিসিনিয়ার যুদ্ধের কোনও সংবাদ না পায়।

 হারলামের এমন গির্জা নাই, এমন ক্লাব নাই, যেখানে আমি আমার আফ্রিকা-ভ্রমণের কথা না বলেছি। এই কারণেই অনেক নিগ্রো আমার সংস্পর্শে এসেছিল এবং আমাকে অন্তরের সংগে ভালবেসে তাদের দৈনন্দিন আচার-ব্যবহারের সকল দিকই আমার কাছে খুলে ধরেছিল। আমি তা শুনে সুখী হতাম এবং প্রাণ খুলে তাদের সংগে কথা বলতাম।

 আমেরিকা আজ নূতন রূপ নিয়েছে। দরিদ্র এবং ছাত্র সমাজ বুঝতে পেরেছে আর লীডার বানিয়ে দরকার নাই, ভোটাভুটিতে গিয়ে বেগার খেটে কাজ নাই; কর্তৃত্বের মূলে যাঁরা আছেন, তাঁরা থাকেন ওয়ালস্‌ স্ট্রীটের উপরতলায় বসে। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও ডিমক্র্যাসির দোহাই দিয়ে তাঁরা নিজেদেরই অভিপ্রায় সিদ্ধ করেন। কাজ শেষ হয়ে গেলেই তাঁদের দরজায় “ভারি বিজি” লেখা সাইনবোর্ড ঝুলতে থাকে; তেমন করে কিন্তু আর চলবে না। মিস মেয়োও তা বুঝতে পেরেছিলেন। একদা তিনি বাজারে নিলামে বিক্রী হয়েছিলেন, আজ আর সেরূপ আত্মবিক্রীত হবার ইচ্ছা তাঁর নাই। তাই বোধ হয় তাঁর সুবুদ্ধি এসেছে, নূতনভাবে মত্ত হয়ে এবার তিনি দরিদ্র এবং ছাত্র বন্ধুদের সংগে মিশতে এসেছেন। তিনিই করুণ সুরে বলেছেন, রুশিয়ার সংগে আর চালবাজি করলে চলবে না। নিজেদের মাঝে যে নূতন রুশিয়া গড়ে উঠেছে তাকে স্বীকার করতে হবেই। ইহুদী এবং নিগ্রোও মানুষ, তাঁদেরও সমাজে স্থান দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মিস মেয়ো বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতবর্ষ এবং ফিলিপাইন দ্বীপপুন্‌জের সংগে আমেরিকার তুলনা করা অন্যায় হবে। আমেরিকার লোক যা চাইবে তা তাদের দিতে হবেই। যদি না দেওয়া যায় ভবিষ্যতে খারাপও হতে পারে।

 পূর্বই বলেছি লোকজনাকীর্ণ হারলামে দিনের বেলায় শ্বেতকায়রা যান না, অথচ রাত্রে তাদের সেদিকে যাওয়া চাইই! হারলামে এমন কি মোহ আছে যে তথায় রাত্রে যাওয়া অতীব দরকার। একটি মোহ আছে সেই মোহটি হল নাইট ক্লাব। আমেরিকার নাইট ক্লাবগুলি প্যারীকে হার মানিয়েছে। প্যারীর বদনাম আমরা অনেক শুনেছি, কিন্তু আমেরিকার নাইট ক্লাবের কথা কজন বলেছেন অথবা বলবার সুযোগ পেয়েছেন? আমার সে সুযোগ হয়েছিল কারণ আমি নিগ্রোদের সংগে মিশতে সক্ষম হয়েছিলাম।

 যাদের মনে সাহস নাই, যারা পরের দাসত্ব পছন্দ করে, তারাই ধর্মভীরু হয় বেশি। একদিন একটি গির্জাতে নিগ্রোদের উপাসনা দেখতে গিয়েছিলাম। পাদরী মহাশয় পুরুষ হয়েও যেমন করে মেয়েলী ভাব দেখালেন তাতে মনে হয়েছিল এ জাত আর টিকবে না। এ জাত শ্বেতকায়দের সংগে হয় মিশে যেতে বাধ্য হবে নয় ত ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি তাদের মিশে যাওয়াটাই চাই কিন্তু আমাদের দেশে যেমন করে আর্য রক্তের সংগে অনার্য রক্ত মিশতে দেওয়া হয় না, তেমনি আমেরিকার শ্বেতকায়রা নিগ্রোদের নিজের মাঝে মিশিয়ে ফেলতে রাজি নয়। শ্বেতকায়দের গররাজি অথবা নিমরাজিতে কিছু আসে যায় না। মানুষ বাসনার দাস। মানুষ বাসনাকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। নিগ্রোরাও খাওয়া পায়, আমেরিকানরাও ভুরিভোজন করে। আমেরিকার নিগ্রোদের মন প্রিমিটিভ ষ্টেজে নাই অতএব শ্বেত এবং কালোয় মিলন অনিবার্য। এই মিলনের ফলেই এমন অনেকগুলি নরনারীর জন্ম হয়েছে যারা বর্ণশংকর বলে পরিচিত। নাইট ক্লাবগুলিই সাদায় কালোয় মিলনের স্থান যদি বলা হয় তবে অন্যায় বলা হবে না। অবশ্য তার প্রমাণ আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে না, এটা একটা অনুমান মাত্র। তবে সকল সময় অনেক অনুমান সত্য হয় না। আমার অনুমানও যে ধ্রুব সত্য তা আমি জোর গলায় বলতে পারি না, তবে একথা বলতে পারি সাদায় কালোয় মিলনের ফলে যেসব বর্ণশংকরের জন্ম তাদের জন্মস্থান হারলামেই। সেইজন্য ইউরোপীয়গণ বলেন হারলাম শুধু হারলাম নয়, হারলাম একটি পূর্বদেশীয় “হারেম”। ইউরোপীয়গণ কেন হারলামের উপর হারেমত্ব আরোপ করেন, সে কথার জবাব তারাই ভাল করে দিতে পারবেন। আমি পর্যটক মাত্র, আমি কোন কথার বিচার করার অধিকারী নই।

 একদিন লণ্ডনের একটি প্রসিদ্ধ ক্লাবে একজন বিশিষ্ট ধনীর সংগে সাক্ষাৎ হয়। ধনী নিজেই আমার সংগে কথা বলেছিলেন। লণ্ডনে নিজে উপযাচক হয়ে কোন ধনী অথবা সম্মানিতের সংগে আমি সাক্ষাৎ করতে অথবা কথা বলতে যাইনি। এই কাজটি আমার কাছে সর্বদা সর্বত্র অপমানজনক মনে হ’ত। ধনী বলেছিলেন, যেমন করে এদেশে আমরা অশ্বেতকায়দেরে নিজের মাঝে মিশিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছি, তেমনি যদি আমেরিকানরাও নিগ্রোদের তাদের সংগে মিশিয়ে ফেলতে পারত তবে সাদা কালো বলে তাদের কোন বালাই থাকত না। হারলামে থাকবার সময় বেশ ভাল করেই অনুভব করেছিলাম, প্রকাশ্যভাবে কেউ নিগ্রোদের সংগে মিশতে রাজি নয়, কিন্তু গোপনে অনেকেই অনেক কাজ করে। এরূপ গোপন কাজ আমাদের দেশেও হয়, কিন্তু তা আমরা হজম করতে পারি না। আমেরিকাতে শিশু রক্ষা করার নানা রকমের প্রতিষ্ঠান আছে বলেই সে দেশে ভ্রূণ হত্যা হয় না। কোন কোন মাতার আইন মতে বিবাহ হবার পূবেই সন্তান হয়। আমেরিকা সরকার সে রকমের সন্তানকে শিশুসদনে প্রতিপালিত করেন। আমাদের দেশেও আর্যদের সময়ে সেরূপ ছেলে মেয়ের অস্তিত্ব ছিল। সেরূপ একটি ছেলের নাম হ’ল কর্ণ। সে যুগে কর্ণের মত বীর কমই ছিল। কুন্তীর বিয়ে হবার পূর্বেই কর্ণের জন্ম হয়। সমাজের ভয়ে কুন্তী কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দেন কারণ সেরূপ শিশুকে রক্ষণ করার ভার সমাজ প্রকাশ্যে গ্রহণ করত না। আমেরিকায় সেরূপ শিশু রক্ষণ করার ভার গ্রহণ করেছে। ইউরোপেও সেরূপ শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের ভার সর্বত্রই বিরাজমান। হারলামে এরূপ শিশুর অভাব ছিল না। তাদের কারো বাবা নিগ্রো আর মা আমেরিকান, আবার কারো মা নিগ্রো বাবা আমেরিকান। নিগ্রো মহিলা সন্তানকে কোনমতেই পরিত্যাগ করেন না। আমেরিকান মহিলা নিগ্রো পিতার সন্তানকে শিশু সদনে পরিত্যাগ করে। সেরূপ অনেক শিশু যারা এখন বড় হয়েছে, বিয়ে করে সংসারি হয়েছে তাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁরা আমার সংগে কথা বলে আরাম পেতেন কারণ আমি তাদের ঘৃণা করতাম না। মানুষ হয়ে মানুষকে ঘৃণা করা বড়ই অন্যায় কাজ। আমেরিকার শ্বেতকায়রা কিন্তু সেরূপ অন্যায়কে এখনও প্রশ্রয় দিয়ে থাকে।

 হারলাম নিউইয়র্ক-এর একটি অংশ। হারলামের মত সুন্দর স্থান দ্বিতীয়টি দেখিনি। লোকে প্যারীর কথা বলে কিন্তু প্যারী হারলামের কাছে হাজার বার হার মানে। তবুও প্যারীর নাম এত কেন? তার একমাত্র কারণ হল, আমাদের দেশের যে সকল হোমরা চোমরা ইউরোপ যান। তারা প্যারীতে গিয়ে বেশ আনন্দ করেন। তাদের নিউইয়র্ক যাবার ফুরসত হয় না এবং যদি কেউ ভুল করে নিউইয়র্কে যান তবে হারলামের দিকে যেতে চান না পাছে তাদের সম্মানের লাঘব হয়। কি করে সম্মানের লাঘব হয় হয় তা হয়ত পাঠক মোটেই বুঝবেন না। আমেরিকায় আজও ভারতবাসী অছুতরূপেই গণ্য হয়। যদি কোন পর-শ্রমজীবী বিলাত ভ্রমণ করে আমেরিকায় যান তখন দেখতে পান তিনি একজন ভারতীয় হরিজন ছাড়া আর কিছু নন। তাই কোনমতে শ্বেতকায়দের সংগে দিনকয়েক কাটিয়ে মানে মানে দেশে ফিরে আসেন। হারলামের কথা মনেতেই রাখেন, মুখে প্রকাশ করেন না।

 প্যারীতে টাকার অভাব লেগেই আছে। নিউইয়র্কে টাকার অভাব নাই। কিন্তু সে টাকা শুধু ধনীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ তাই নিউইয়র্ক টাকায় বোঝাই হয়েও দরিদ্রতায় পূর্ণ। নিউইয়র্ক লণ্ডন হতেও বড়। এই নগরের সকল কথা যদি জানতে হয় এবং দেখে তা উপলব্ধি করতে হয় তবে অন্তত ছয়টি মাস ক্রমাগত তথায় ঘুরে বেড়ান দরকার। আমার সে সুযোগ হয় নি তবে এ কথা বলতে পারি সাইকেলে, কারে, এলিভেটারে, বাসে এবং স্যাবওয়েতে যতটুকু ভ্রমণ করেছি ততটা সকলে পেরে উঠে না। এত ছুটাছুটি করে জানতে পেরেছি দরিদ্রতা কোথা হতে এসেছে। পাদ্রীরা বলে মদ খেয়ো না, অথচ মদের দোকান চব্বিশ ঘণ্টা খুলে রাখার ব্যবস্থা আছে। ঠিক সেরূপভাবে যুবক-যুবতীদের নানা উপদেশ দেওয়া হয়। অথচ তাদের ধ্বংসের পথ এত ব্যাপকভাবে খুলে রাখা হয়েছে যে তারা নিজেদের অজ্ঞাতসারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর কি কোন প্রতিকার নাই? প্রতিকার আছে। সে প্রতিকারের জন্য সরকার একেবারে উদাসীন। যারা পারছে তারাই সেই ধ্বংসের পথ হতে ফিরে আসছে আর যারা পারছে না তারাই অকালে অক্কা পাচ্ছে।