আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/লেখকের সহিত রাসবিহারী বসুর আলোচনা
৩রা জুলাই ১৯৪৩:
কাল ভারতীয় স্বাধীনতা সঙ্ঘের প্রতিনিধিগণের এক সভা সিঙ্গাপুরে হইবে। শ্যাম, জাভা, ব্রহ্মদেশ প্রভৃতি নানা স্থান হইতে প্রতিনিধিরা আসিয়াছেন। আমিও একখানি প্রতিনিধির কার্ড্ সংগ্রহ করিলাম।
আজ সকালে রাসবিহারী বসুর সহিত প্রতিনিধিদের ক্যাম্পে দেখা হইল। আমার সঙ্গী আলিম ভারতীয় স্বাধীনতা সঙ্ঘের পুরাতন কর্মী এবং রাসবিহারী বসুর সহিত পরিচিত। এই সুযোগে তাঁহার সহিত কথা বলিবার এক অপূর্ব সুযোগ লাভ করিলাম। তাহাদের কথার ফাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘আপনি কি মনে করেন ভারতবর্ষ স্বাধীন হইবে?’
তিনি বলিলেন-“নিশ্চয়ই হইবে।
আমার সঙ্গী বলিলেন —‘আমরা আশা করি আপনার নেতৃত্বে ভারতবাসীর স্বপ্ন সফল হইবে।’
‘আমার শরীর জরাগ্রস্ত—মনের উৎসাহের সঙ্গে তাল রাখিয়া চলিতে অক্ষম। অথচ এই কাজে প্রয়োজন এমন একজন কর্মীর যাহার মনে আছে অনন্ত উৎসাহ ও দেহে অদম্য কর্মক্ষমতা।’
‘এমন লোক কোথায়?’
‘আছে—সে সুভাষচন্দ্র বসু। আমার বিশ্বাস আছে তাহার উপর; সে-ই পারিবে। গত সম্মেলনে তাহার নাম আমি প্রস্তাব করিয়াছিলাম।’
এখানে আমি সঙ্কোচের সহিত বলিলাম—
‘একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিব, যদি কিছু মনে না করেন; লোকে বলে—
রাসবিহারী বসু হাসিয়া বলিলেন—বুঝিয়াছি। রাঘবনের সহিত গোলযোগ হইতে অনেকে ভুল বুঝিয়াছে। জাপানে বাস করিলেও ভুলিও না আমি ভারতবাসী; ভারতের জন্যই আজীবন নির্বাসন যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি—যৌবনের সেই ব্যর্থ স্বপ্নকে সত্য করিবার আশায়।’
‘লোকে সেভাবে কিছু মনে করে না। সকলেই আপনাকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু ভাবে আপনি জাপানীদের ভয় করিয়া চলেন।’
‘না—সেটা ভুল। দেশের মুক্তির জন্য বৃটিশকে ভয় করি নাই— আজ জাপানের বন্দুককেও ভয় করিব না।’
‘কিন্তু মোহন সিংএর সহিত জাপানীদের বিরোধের সময় আপনি বাধা দেন নাই।’
‘দেখ একটা জিনিষ দেখিতে হইবে; আমাদের না ছিল অর্থবল—না ছিল লোক বল। আমরা যে লড়াই করিব—কিসের জোরে?
‘জাপানীদের সাহায্য আমি ঘৃণা করি। কারণ আমি চাহি না প্রভুর পরিবর্ত্তন—বৃটিশের পরিবর্ত্তে জাপানী শাসন। এইজন্যই আমি প্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত ভারতীয়দের একত্রিত করিয়া তাহাদের অর্থ ও সামর্থ্যে আমাদের মাতৃভূমিকে আমরা নিজেরাই যাহাতে স্বাধীন করিতে পারি তাহার জন্য চেষ্টা করিয়াছি। জাপানীরা ভারতের মাটিতে পদার্পণ করে, ইহা আমি চাহি না। কিন্তু ভারতের বাহিরে যে ৩০ লক্ষ ভারতবাসী আছে তাহাদের সংঠন জাপানীদের সহযোগিতা ব্যতীত হইবার উপায় নাই কারণ হাজার হাজার মাইল দূর হইতে ইহাদের একত্রিত করা অন্য উপায়ে সম্ভব নয়। যে সব ভারতীয় সৈনিক যুদ্ধবন্দী হইয়াছে তাহাদের লইয়া আমরা নিজেদের সেনাদল গঠন আরম্ভ করিয়াছি; জাপানীরা না দিলে, ইহাদের আমরা পাইতাম না। অনেক বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়া আমাদের এইসব করিতে হইয়াছে। জাপানীরা নিজেদের যুদ্ধ লইয়াই অতি ব্যস্ত; তাহার ফাঁকেই তাহাদের গায়ে হাত বুলাইয়া আমাদের কাজ করিয়া লইতে হইবে—ঝগড়া করিয়া নয়। আমরা যদি সংঘবদ্ধ হইয়া উপযুক্ত সেনাদল গঠন করিতে পারি, আমরা নিজেরাই যুদ্ধ পরিচালনা করিতে পারিব।’
আমার সঙ্গী জিজ্ঞাসা করিলেন—
‘আমরা যদি জাপানীদের ভারতে যাইতে না দিই, তাহারা আমাদের অস্ত্রশস্ত্র দিবে কেন?’
‘দিবে—কারণ গরজ তাহাদেরও আছে। জাপান আজ তাহার ক্ষমতার অতিরিক্ত দেশ অধিকার করিয়াছে। ভারতে যদি আমরা ইংরেজকে ব্যস্ত রাখিতে পারি, তাহা হইলে জাপান আমেরিকাকে ঠেকাইতে পারিবে।’
‘আপনি সুভাষচন্দ্রের উপর ভার দিবেন বলিলেন। আপনি কি আর থাকিবেন না?’
‘আমি থাকিব শুধু পরামর্শদাতা হিসাবে। আমাদের নেতার আদেশ পালনে উন্মুখ সৈনিক মাত্র থাকিতে চাই। আমার দিন ফুরাইয়া আসিতেছে—স্বাধীন ভারতের মাটিতে শেষ নিশ্বাস ফেলিতে চাই—’
রাসবিহারী বসুর চোখের কোণে জল দেখিলাম। শ্রদ্ধায় মাথা নত হইয়া আসিল।