আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/সিঙ্গাপুর যাত্রা
১২ই জুন ১৯৪২: ব্যাঙ্কক্:
আজ ঠিক করিলাম ব্যানার্জির সঙ্গে সিঙ্গাপুর যাইব। ইণ্ডিয়ান্ ইণ্ডিপেণ্ডেন্স্ লীগে একটি কাজ পাওয়া যাইবে। আমার কারবার নষ্ট হইয়া গিয়াছে; এখন রেঙ্গুনে ফিরিয়া কোন লাভ নাই।
একটি জাহাজে মালয় ও সিঙ্গাপুরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে পৌছিলাম।
দূরে সিঙ্গাপুর। সমুদ্রের ধারের কারখানা হইতে গগনস্পর্শী চিমনি দেখা যাইতেছিল। একখানা ছোট মোটর বোটে পাইলট্ আসিয়া জাহাজ পরিচালনার ভার গ্রহণ করিল। জাহাজ ধীরে ধীরে হার্বারের পথে অগ্রসর হইল।
সিঙ্গাপুর সুন্দর শহর। মোটরে ব্যানার্জির সঙ্গে তাহার বাসায় পৌছিলাম। সিঙ্গাপুর নাম পরিবর্তিত করিয়া জাপানীরা ইহার নূতন নামকরণ করিয়াছে—শোনান্। সিঙ্গাপুর—সংস্কৃত সিংহপুর—প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিজয়ের স্মৃতি বিজড়িত। সেই স্মৃতির বিলোপ করা উচিত হয় নাই।
ইণ্ডিয়ান্ ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগের প্রধান অফিস ব্যাঙ্ককে; সিঙ্গাপুরের অফিস তাহার অধীন।
২০শে আগষ্ট ১৯৪২: সিঙ্গাপুর: আজ মেহের খাঁর নিকট সিঙ্গাপুরের পতনের গল্প শুনিলাম।
মেহের খাঁ বলিল—
‘সিঙ্গাপুরে ইংরেজরা ১৫ই ফেব্রুয়ারি (১৯৪২) জাপানীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৬ই তারিখে সন্ধ্যায় খবর পাইলাম, পরের দিন ভারতীয় সৈনিকদের ফেরার্ পার্কে সমবেত হইতে হইবে।
১৭ই ফেব্রুয়ারি আমরা আদেশমত ফেরার্ পার্কে জড় হইলাম। কর্ণেল্ হাণ্ট্ আমাদের বলিলেন —‘আমরা সকলেই বন্দী হইয়াছি; আমি তোমাদের জাপানের প্রতিনিধি মেজর ফুজিওয়ারার হাতে সমর্পণ করিতেছি। এখন হইতে তোমরা তাঁহার আদেশ পালন করিবে।’
‘তারপর মেজর ফুজিওয়ারা একটি বক্তৃতা দিলেন। তিনি বলিলেন—‘জাপান চাহে পূর্ব এশিয়ার সকল জাতি স্বাধীন হয় এবং সকলে পরস্পরের সহিত সহযোগিতাসূত্রে আবদ্ধ হইয়া এক শক্তিশালী জাতি সঙ্ঘে পরিণত হয়। পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য স্বাধীন ভারতের প্রয়োজন। ভারতবাসীগণ যাহাতে তাহাদের স্বাধীনতা লাভ করিতে পারে এজন্য সকল প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা করিতে জাপ গভর্নমেণ্ট প্রস্তুত। আপনারা ভারতবাসী— আপনাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য আপনাদেরই চেষ্টা করা উচিত। ভারতবাসীদের আমরা বন্ধু বলিয়াই মনে করি। আপনাদের আমরা যুদ্ধ বন্দী বলিয়া মনে করি না। আপনারা স্বাধীন।’
‘ইহার পর কাপ্তেন মোহন সিং বলেন—‘মালয় যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধের সুযোগ পায় নাই। তাহার প্রথম কারণ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়; তাহা ছাড়া, আমাদের পদাতিক সৈন্য দলকে সাহায্য করিবার জন্য না ছিল এরোপ্লেন না ছিল পর্য্যাপ্ত অস্ত্র। বৃটিশরা আমাদের জাপানীদের হাতে তুলিয়া দিয়াছে। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করিবার এই অবসর। ভারতের নিজস্ব কোন বাহিনী নাই; ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সেনাবাহিনী গঠনের একটা বড় সুযোেগ আমরা পাইতেছি। আমাদের উচিত এই জাতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করা।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘সভায় লোক কত ছিল?’
‘প্রায় ৪০।৫০ হাজার হইবে।’
‘এত?’
‘হাঁ, ভারতীয় সেনাদল তো ছিলই, তাহা ছাড়া সিঙ্গাপুরের অনেক বেসামরিক ভারতীয় অধিবাসীও আসিয়াছিলেন।’
‘ইহার পর আপনারা কি করিলেন?’
‘আমাদের মধ্যে অধিকাংশই ‘আই-এন্-এ’ তে যোগদান করিলাম।’
‘আপনাদের কি যোগ দিতে বাধ্য করা হইয়াছিল?’
‘না—কাহাকেও বাধ্য করা হয় নাই। আমরা বুঝিয়াছিলাম যে সকলের অপেক্ষা দেশই বড় এবং আমাদের অনুগত্য দেশের কাছেই— অন্য কাহারও নিকট নয়।’
‘আপনাদের তো জাপানীরা ছাড়িয়া দিল। আপনাদের কি করিয়া চলিত?’
‘আমাদের কয়েকটি ক্যাম্পে রাখা হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে ক্রান্জি ক্যাম্প্, সেলেতার ক্যাম্প ও বিদাদারি ক্যাম্প্ প্রধান। কাপ্তেন মোহন সিং আমাদের সব ব্যবস্থা করেন।
মার্চ মাসের ২৮শে হইতে ৩০শে পর্য্যন্ত টোকিওতে প্রবাসী ভারতবাসীদের এক সভা হয়। রাসবিহারী বসু সভাপতি হন। এই সভায় ইণ্ডিয়ান্ ইণ্ডিপেণ্ডেন্স্ লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। কাপ্তেন মোহন সিং আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন কার্য্য আরম্ভ করেন। হাতের কাছেই ছিল বন্দী ভারতীয় সৈন্যগণ; প্রথমে তাহাদের লইয়াই এই প্রচেষ্টার সূত্রপাত হইল।’