আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় খণ্ড
শিক্ষা, শিল্পবাণিজ্য, অর্থনীতি ও
সমাজ সম্বন্ধীয় কথা
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার জন্য উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষা
(১) দলে দলে গ্রাজুয়েট সৃষ্টি
“আমি একমাত্র বৃহৎ গ্রন্থ অধ্যয়ন করিয়াছি, একমাত্র শিক্ষকের নিকট পড়িয়াছি। সেই বৃহৎ গ্রন্থ জীবন, সেই শিক্ষক দৈনিক অভিজ্ঞতা।”—মুসোলিনী।
“আমার বিশ্বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন অধিকাংশ লোকের পক্ষে ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্টই বেশী করে।” র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভের জন্য অদ্ভুত ব্যাকুলতা আমাদের যুবকদের একটা ব্যাধির মধ্যে দাঁড়াইয়াছে। এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মার্কা’ পাইবার জন্য ব্যাকুলতা—ইহার মূলে আছে একটা অন্ধ বিশ্বাস। আমাদের ছাত্রগণ এবং তাহাদের অভিভাবকেরা সকলেই মনে করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি সরকারী চাকুরী লাভের একমাত্র উপায়,—আইন, ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি ব্যবসায়ক্ষেত্রে প্রবেশ করিবারও ঐ একমাত্র পথ। উপাধিধারীদের অবশেষে যে শোচনীয় দুর্দশা হইয়াছে, তাহা এস্থলে বলা নিষ্প্রয়োজন। এইমাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে, অসংখ্য বেকারদের কথা বিবেচনা করিলে, একজন গ্রাজুয়েটের বাজার দর গড়ে মাসিক ২৫৲ টাকার বেশী নহে। তাহাদের মধ্যে শতকরা একজন বোধহয় জীবনে সাফল্য লাভ করে, বাকী সকলে চিন্তাহীনভাবে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়। বাস্তব জীবনের সম্মুখীন হইয়া অনেক শিক্ষিত যুবক আত্মহত্যা করে—বিশেষতঃ যদি তাহাদের ঘাড়ে সংসারের ভার পড়ে।[১]
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-ব্যবস্থার দ্বারা আমরা একাল পর্যন্ত জাতির শক্তি ও মেধার যে অপরিমেয় অপব্যয় হইতে দিয়াছি, তাহার প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২০ সালে ভাইস চ্যান্সেলররূপে বক্তৃতা করিতে গিয়া শ্রীযুত শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার যে হৃদয়বিদারক বর্ণনা করেন, এই প্রসঙ্গে তাহা উদ্ধৃত করিব।
“মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮,৫০০ হাজার গ্রাজুয়েটের জীবনের ইতিহাস অনুসন্ধান করিয়া দেখা গিয়াছে যে, প্রায় ৩৭,০০ জন সরকারী কাজে নিযুক্ত ছিল; প্রায় ঐ সংখ্যক গ্রাজুয়েট শিক্ষকরূপে কাজ করিতেছিল। ৬০০০ হাজার আইন ব্যবসায়ে যোগ দিয়াছে। চিকিৎসা ব্যবসায়ে ৭৬৫ জন, বাণিজ্যে ১০০ এবং বিজ্ঞান চর্চায় মাত্র ৫৬ যোগ দিয়াছে। এই ১৮১২ হাজার লোকের মধ্যে মানবজ্ঞানভাণ্ডারে কিছু দান করিতে পারিয়াছে, এমন লোক খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।”
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস সংবাদ দিতেছেন (১৯২৬)—
“এই বৎসর মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাধি লাভার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪৫০ হইয়াছে। এই সংখ্যাধিক্যের জন্য এবার স্থির হইয়াছে যে, আগামী বৃহস্পতিবার দুইবার কনভোকেশান হইবে। প্রথমবার ২টার সময়, ভাইস-চ্যান্সেলর উহাতে সভাপতিত্ব করিবেন, দ্বিতীয়বার ৪১২টার সময়, চ্যান্সেলর উহার সভাপতি হইবেন।”
কলিকাতা ও মাদ্রাজের দুই বিশ্ববিদ্যালয় অজস্র গ্রাজুয়েট প্রসবের কারখানা স্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু ইহাও যেন পর্যাপ্ত বলিয়া মনে হয় নাই, তাই পর পর কতকগুলি নূতন বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হইয়াছে। এক যুক্তপ্রদেশেই বারাণসী, আলিগড়, লক্ষৌ এবং আগ্রাতে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় হইয়াছে। মাদ্রাজ প্রদেশও পশ্চাৎপদ হইবার পাত্র নহে, সেখানেও অন্নমালাই ও অন্ধ্র—আরও দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় হইয়াছে। মধ্যপ্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ও অজস্র গ্রাজুয়েট সৃষ্টি করিয়া জাতির যুবক শক্তির ক্ষয়ে সহায়তা করিতেছে। ডিগ্রী লাভের জন্য এই অস্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা ব্যাধিবিশেষ হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং ঘোর অনিষ্ট করিতেছে। জাতির মানসিক উন্নতি ও সংস্কৃতির মূলে ইহা বিষের ন্যায় কার্য করিতেছে। বর্তমানে যেরূপ ভ্রান্ত প্রণালীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়া হইতেছে তাহার ফলে এমন এক শ্রেণীর শিক্ষিত যুবেকের সৃষ্টি হইতেছে, যাহাদের কোন কর্মপ্রেরণা, উৎসাহ ও শক্তি নাই এবং জীবনসংগ্রামে তাহারা নিজেদের অসহায় বলিয়াই বোধ করে। সংখ্যার দিক দিয়া এই শিক্ষায় কিছু লাভ হইতেছে বটে, কিন্তু উৎকর্ষের দিক দিয়া ইহা অধঃপতনের সূচনাই করিতেছে। সাধারণ গ্রাজুয়েটরা মার্কাধারী মূর্খ বলিলেও হয়। আমার কয়েকটি প্রকাশ্য বক্তৃতায় আমি স্পষ্টভাবেই বলিয়াছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি অজ্ঞতা ঢাকিবার ছদ্মবেশ মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীর অতি সামান্য জ্ঞানই আছে এবং পরীক্ষায় পাশ করিবার জন্য যেটুকু না হইলে চলে না, সেই টুকুই সে শিখে।[২]
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীরা অনেক সময় অভিযোগ করেন, আমি তাঁহাদের প্রতি অবিচার করিতেছি। তাঁহারা বলেন, “আপনি কি আমাদের মাড়োয়ারী হইতে বলেন?” আমি স্পষ্ট ভাবেই তাঁহাদিগকে বলি যে আমি মোটেই তাহা চাই না। আমি যদি এই শেষ বয়সে ‘মাড়োয়ারীগিরি’ প্রচার করি, তবে আমি নিজেকে এবং সমস্ত জীবনের কার্যকেই ছোট করিয়া ফেলিব। প্রত্যেক ধ্রুবকই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভকেই জীবনের চরম আকাঙ্ক্ষা বলিয়া মনে করিবে, ইহাই আমি তীব্র নিন্দা করি। এ সম্বন্ধে বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০। ২৫ হাজার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরও প্রায় দুই হাজার ছাত্র ডিগ্রী লাভের জন্য প্রস্তুত হইতেছে। ইহাদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২।৩ জন সরকারী চাকরী, এবং ডাক্তারী, ওকালতী প্রভৃতি ব্যবসায়ে স্থান পাইতে পারেন, এই অপ্রিয় সত্য সকলেই ভুলিয়া যান। অবশিষ্ট শতকরা ৯৭ জনের কি হইবে? তাঁহাদের যে নিতান্ত অক্ষম অবস্থায় জীবন সংগ্রামের সম্মুখীন হইতে হইবে! যদি এই বিপুল সংখ্যা হইতে বাছিয়া বাছিয়া তিন হাজার ছাত্রকে উচ্চ শিক্ষা লাভার্থ প্রেরণ করা যায়, তবে অবসর গ্রহণ বা পদত্যাগ প্রভৃতির ফলে যে সমস্ত চাকরী খালি হয় তাহার জন্য যথেষ্ট লোক পাওয়া যাইবে, নানা বিদ্যায় গবেষণা করিবার জন্য ছাত্রের অভাব হইবে না এবং ভবিষ্যৎ শাসক, ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট, মুন্সেফ এবং উচ্চশ্রেণীর কেরাণী পদের জন্যও লোক জুটিবে।
ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটুটারী কমিশনের রিপোর্ট (সেপ্টেম্বর, ১৯২৯) [Interim Report—Review of the Growth of Education in British India] হইতে নিম্নে যে অংশ উদ্ধৃত হইল তাহাতে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হইবে।
“অন্যান্য দেশের ন্যায় ভারতেও আইন ব্যবসায়ে দুই চারিজনের ভাগেই মাত্র পুরস্কার মিলে, আর অধিকাংশের ভাগে পড়ে শূন্য। একজন সাধারণ উকীলের পক্ষে জীবিকার্জন করাও কঠিন হইয়া পড়ে।[৩] চিকিৎসা ব্যবসায় ও ইঞ্জিনিয়ারিং অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক লোকই অবলম্বন করিতে পারে—ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাশিক্ষা ব্যয়সাধ্যও বটে। যে সমস্ত লোকের বিদ্যাচর্চার প্রতি কোন আকর্ষণ নাই, তাহা অনুশীলন করিবার যোগ্যতাও নাই, তাহারা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজী শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তাহার একটি প্রধান কারণ, এই যে, গবর্ণমেণ্ট সরকারী কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী একান্ত আবশ্যক বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। যে সমস্ত কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর প্রকৃতপক্ষে কোন প্রয়োজন নাই তাহাতে গবর্ণমেণ্ট যদি ডিগ্রীর দাবী না করিতেন, তাহা হইলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির উপর চাপ বোধ হয় কম পড়িত। আমরা প্রস্তাব করি যে, কতকগুলি সরকারী কেরাণী পদের জন্য বিলাতে যেমন সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা আছে, ঐ ধরণের পরীক্ষার ব্যবস্থা হউক। কেরাণীগিরির জন্য যে সব বিষয় জানা প্রয়োজন, উক্ত পরীক্ষা তদনুরূপ হইবে এবং উহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর দরকার হইবে না। আমরা শুধু কেরাণীগিরি কাজের কথাই বলিতেছি, উচ্চশ্রেণীর সার্ভিসের কথা বলিতেছি না। কেন না এই সব উচ্চশ্রেণীর কাজে কম লোকেরই প্রয়োজন হয় এবং উহার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যার বিশেষ কিছু হ্রাসবৃদ্ধি হইবার সম্ভাবনা নাই।
“বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সব ছাত্রের ভীড়ই বেশী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ফলে যাহাদের মানসিক বা আর্থিক কোন উন্নতি হয় না। শত শত ছাত্রের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অর্থ ও শক্তির অপব্যয় মাত্র। আর ইহাতে কেবল ব্যক্তিগত অর্থেরই অপব্যয় হয় না। সকল দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের প্রত্যেক ছাত্রের জন্য তাহার প্রদত্ত ছাত্রবেতন অপেক্ষা অনেক বেশী ব্যয় হয়, কোন কোন স্থলে পাঁচ ছয়গুণ বেশী অর্থ ব্যয় হয়।[৪] ভারতবর্ষে এই অতিরিক্ত অর্থ লোকের প্রদত্ত বৃত্তি হইতে এবং অনেকাংশে সরকারী তহবিল হইতে ব্যয় হয়। বর্তমানে যে সব ছাত্র উচ্চশিক্ষার যোগ্যতা না থাকিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে যায় তাহাদের মধ্যে অনেককে যদি অল্প বয়সেই তাহাদের শক্তি সামর্থ্যের অনুরূপ নানা বৃত্তি শিক্ষার জন্য নিযুক্ত করা যায়, তবে তাহার ফল ভালই হইবে। একদিকে যেমন ঐ অতিরিক্ত অর্থ অধিকতর কার্যকরী শিক্ষার জন্য ব্যয় করা যাইবে, অন্যদিকে তেমনই মেধাবী ছাত্রগণের জন্য ভাল শিক্ষার ব্যবস্থা করা যাইবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কলেজে যে সব ছাত্র দলে দলে যায়, তাহাদের মধ্যে অনেকের শিক্ষা ব্যর্থ হয়; দেশ ও সমাজের দিক হইতেও তাহাদের কোন চাহিদা নাই এবং ইহার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অবনতি ঘটিতেছে।”
(২) বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট বনাম আত্মচেষ্টায় শিক্ষিত ব্যক্তি
একজন ক্ষীণ-স্বাস্থ্য ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ না করিয়াও, সাহিত্য জগতে কিরূপ কৃতিত্ব লাভ করিতে পারেন, তাহার দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘সভ্যতার ইতিহাস’ প্রণেতা হেনরি টমাস বাক্লের (১৮২১-১৮৬২) নাম করা যাইতে পারে। তাঁহার স্বাস্থ্য বাল্যকাল হইতেই ভাল ছিল না এবং চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁহার পিতামাতা ‘তাঁহার মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত করিতে চেষ্টা করেন নাই।’ আট বৎসর বয়সেও তাঁহার অক্ষর পরিচয় হয় নাই এবং আঠারো বৎসর বয়স পর্যন্ত তিনি ‘সেক্সপীয়র’, ‘পিল্গ্রিম্স্ প্রোগ্রেস' এবং ‘আরেবিয়ান নাইটস’ ছাড়া বিশেষ কিছু পড়েন নাই। তাঁহাকে বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়, কিন্তু সেখান হইতে তাঁহাকে ছাড়াইয়া আনা হয়।
সতের বৎসর বয়সে বাক্লের স্বাস্থ্য কিছু ভাল হয়। ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে তিনি ১৯টি ভাষা বেশ সহজে পড়িতে পারিতেন। তাঁহার স্বল্পায়ু জীবনে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ভয় সর্বদা তাঁহার মনে ছিল, এবং একাদিক্রমে তিনি বেশী পড়াশুনা কখনই করিতেন না। তৎসত্বেও নিয়মিত অভ্যাসের ফলে তিনি প্রায় বাইশ হাজার বই পড়িয়াছিলেন। “সভ্যতার ইতিহাস” পড়িলে তাঁহার পরিণত চিন্তা এবং অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় প্রত্যেক পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়।
প্রসিদ্ধ মহিলা ঔপন্যাসিক জর্জ ইলিয়ট ৫ বৎসর হইতে ১৬ বৎসর বয়স পর্যন্ত স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন, কলেজী শিক্ষা তাঁহার হয় নাই। কিন্তু তিনি বহু গ্রন্থ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন এবং জার্মান ও ইটালিয়ান ভাষা জানিতেন।
মহিলা কবি এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং (১৮০৬—৬১) নিজের চেষ্টাতেই শিক্ষালাভ করেন। বিদ্যাশিক্ষার ক্ষমতা তাঁহার অসাধারণ ছিল। আট বৎসর বয়সের সময় তাঁহার একজন গৃহশিক্ষক ছিল। সেই সময় তিনি একহাতে হোমরের মূল গ্রীক কাব্য পড়িতেন, অন্য হাতে পুতুল লইয়া খেলা করিতেন। তাঁহার স্বাস্থ্য বরাবরই খারাপ ছিল।
মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য বিদ্যা প্রবর্তনের একজন প্রধান সহায়। তিনি এই প্রচলিত মতের প্রধান প্রচারকর্তা ছিলেন—“যাহারা বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম হয়, তাহারাই উত্তরকালে জীবনসংগ্রামে সাফল্য লাভ করে।” মেকলে বলেন—“বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংলারদের এবং জুনিয়র ওপটিমদের তালিকা তুলনা করিয়া আমি বলিতে চাই যে, পরবর্তী জীবনে যেখানে একজন জানিয়র ওপটিম সাফল্য লাভ করিয়াছে, সেখানে বিশ জন র্যাংলার কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছে।[৫]
“কিন্তু সাধারণ নিয়ম নিশ্চয়ই এই যে যাহারা বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম হইয়াছে, তাহারাই জীবনসংগ্রামে জয়লাভ করিয়াছে।”
মেকলে অন্যান্য দৃষ্টান্তের মধ্যে ওয়ারেন হেষ্টিংসের নাম করিয়াছেন। কিন্তু যেরূপেই হউক, রবার্ট ক্লাইভের কথা তাঁহার একবারও মনে পড়ে নাই। রবার্ট ক্লাইভের পিতামাতা তাঁহার সম্বন্ধে হতাশ হইয়া গিয়াছিলেন, সকলেই তাঁহাকে একবাক্যে ‘গদর্ভ’ বলিতেন। “তাঁহাকে (মেকলের ভাষাতেই) জাহাজে করিয়া মাদ্রাজ পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল—উদ্দেশ্য ছিল, হয় তিনি সেখানে ঐশ্বর্য লাভ করিবেন অথবা জ্বরে ভুগিয়া মরিবেন।” পূর্বে হেষ্টিংসের কথা উল্লেখ করিয়াছি, তিনি দারিদ্র্যবশতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকিতে পারেন নাই।
মেকলের নিজের কথা হইতেই আমি তাঁহার মতের প্রতিবাদ আর একবার করিব। তাঁহার প্রিয় নায়ক উইলিয়ম অব অরেঞ্জ সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন—“ইতিমধ্যে তিনি তৎকালীন ‘ফ্যাশন’ কেতাবী বিদ্যায় অতি সামান্য দক্ষতাই লাভ করিয়াছিলেন। সাহিত্য বিজ্ঞান কোন বিষয়েই তাঁহার উৎসাহ ছিল না। নিউটন ও লিবনিজের আবিষ্কার অথবা ড্রাইডেন এবং বোয়ালোর কবিতা-সমস্তই তাঁহার নিকট অজ্ঞাত ছিল।”
ব্লেনহিম সমরক্ষেত্রের বীর জন চার্চিল (পরে ডিউক অব মার্লবরো) সম্বন্ধে আমরা মেকলের বইতেই[৬] পড়ি,—“তাঁহার শিক্ষা সম্বন্ধে এত বেশী ঔদাসীন্য প্রদর্শন করা হইয়াছিল যে তিনি তাঁহার নিজের ভাষার অতি সাধারণ শব্দ পর্যন্ত বানান করিতে পারিতেন না। কিন্তু তাঁহার তীক্ষ্ণ ও জোরাল বুদ্ধি এই কেতাবী বিদ্যার অভাব পূর্ণ করিয়াছিল।” তাঁহারই প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস প্রসিদ্ধ বংশের একজন বংশধর উইনস্টন চার্চিল বিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় বিদ্যাবুদ্ধির বিশেষ কোন পরিচয় দেন নাই। উত্তরকালে তিনি যে একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি হইবেন, তাহার কোন আভাষই পাওয়া যায় নাই। তাঁহার পিতা লর্ড র্যান্ডলফ তাঁহার সম্বন্ধে হতাশ হইয়া কেপ কলোনি গবর্ণমেণ্টের অধীনে তাঁহার জন্য একটি সামান্য কাজের জোগাড় করিবার চেষ্টায় ছিলেন। একথা সত্য যে, গ্ল্যাডস্টোনের সময় পর্যন্ত অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের ‘বিদ্যা’ পার্লামেণ্টারী গবর্ণমেণ্টের একটা বিশেষ লক্ষণ ছিল। “১৮৫৯ সালে পামারষ্টোন যখন তাঁহার গবর্ণমেণ্ট গঠন করেন, তখন তাঁহার মন্ত্রিসভায় অক্সফোর্ডের ছয়জন প্রথম শ্রেণীর গ্রাজুয়েট ছিলেন (তাঁহাদের মধ্যে তিনজন আবার ডবলফার্স্ট) এবং মন্ত্রিসভার বাহিরে তাঁহার দলে চার জন প্রথম শ্রেণীর গ্রাজুয়েট ছিলেন ১৮৫০—১৮৬০ পর্যন্ত আমি অক্সফোর্ডের ছাত্র ছিলাম। ঐ সময়ে ইংলণ্ডের শিক্ষাব্যাপার ধর্মযাজকদের মুষ্টির মধ্যেই ছিল; কিন্তু তাঁহাদের দিন শেষ হইয়া আসিয়াছিল।” (মর্লির স্মৃতিকথা—প্রথম খণ্ড, ১২ পৃঃ)। কিন্তু গ্ল্যাডস্টোনের সময়েও ইহার ব্যতিক্রম ছিল। জন ব্রাইট স্কুল কলেজের বিদ্যার ধার ধারিতেন না। জোসেফ চেম্বারলেন নিজেকে ‘ব্যবসায়ী’ বলিয়া গর্ব করিয়াছেন। তাঁর স্ক্রুর কারখানা ছিল। ডবলিউ. এইচ. স্মিথ উত্তরকালে পার্লামেণ্টে রক্ষণশীলদলের নেতা হইয়াছিলেন। “তিনি তাঁহার প্রথম যৌবনে ও মধ্যবয়সে নিজের চেষ্টায় এবং সাধু উপায়ে একটা বৃহৎ ব্যবসায় গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। উহাতে তাঁহার প্রচুর আয় হইত।”[৭]
বার্ট ও ব্রডহার্স্ট শ্রমিক প্রতিনিধিরূপে পার্লামেণ্টে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন এবং শেষোক্ত ব্যক্তি পরে গ্ল্যাডস্টোন মন্ত্রিসভার সদস্যও হইয়াছিলেন। শ্রমিক নেতা জন বার্নসও ১৯১৪ সালে মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
স্যার হ্যারি পার্কস কূট রাজনীতিতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। তাঁহার জীবনী হইতে আমি কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি। “তিনি অনাথ বালক রূপে মেকাওতে তাঁহার এক আত্মীয় পরিবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৫ বৎসর বয়সে ব্রিটিশ রাজদূতের অফিসে চাকরী পান। ক্যাণ্টন দখলের সময় তিনি খুব নাম করেন এবং বৈদেশিক অধিকারের সময় ঐ নগরের শাসনকর্তা হন। অ্যাংলো-ফরাসী সৈন্যদলের অভিযানের সময় তিনি পিকিন সহরে চীনাদের হস্তে নির্যাতিত হন। ৩৭ বৎসর বয়সে তিনি জাপানে ব্রিটিশ মন্ত্রী রূপে বদলী হইয়াছিলেন।”[৮] আরও দুইটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করিতেছি।
“লয়েড জর্জের গৌরবময় জীবনকাহিনীর সঙ্গে ডিজ্রেলির তুলনা করা হয়। এই দুই চরিত্রের মধ্যে অনেক বিষয়ে সাদৃশ্য আছে সন্দেহ নাই। তাঁহাদের পূর্বগামী ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রীদের মত তাঁহাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ছিল না। পক্ষান্তরে নিজেদের চেষ্টায় তাঁহারা শিক্ষালাভ করেন এবং জীবনসংগ্রামে আত্মশক্তির উপরই নির্ভর করিতেন।”[৯] যাঁহারা সমাজের নিম্নস্তর হইতে আসিয়াছেন—কৃষক ও শ্রমিকের ছেলে—বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষা পান নাই—তাঁহাদের মধ্যেও অসাধারণ বাগ্মিতার শক্তি দেখা গিয়াছে এবং রাজনীতিক হিসাবেও তাঁহারা প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। লর্ড কার্জন তাঁহার রীড বক্তৃতায় (১৯১৩) এই বিষয়টি নিপুণভাবে আলোচনা করিয়াছেন। তাঁহার ঐ বক্তৃতাগ্রন্থের নাম Modern Parliament Eloquence.
“আমি আশা করি ভবিষ্যতে দেশে অন্য এক শ্রেণীর বক্তৃতার উদ্ভব হইবে, যাহা অধিকতর সময়োপযোগী ও লোকপ্রিয়। জর্জিয়ান যুগের বক্তৃতা ছিল অভিজাতধর্মী। মধ্য ভিক্টোরিয়ান যুগের বক্তৃতায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রাধান্য দেখা যাইত। আমার মনে হয় ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক যুগের উপযোগী বাগ্মিতার আবির্ভাব হইবে। আমেরিকার আব্রাহাম লিঙ্কনের মত যদি কেহ সমাজের সাধারণ লোকদের ভিতর হইতে উদ্ভূত হন এবং তাঁহার যদি অসামান্য প্রতিভা ও বাগ্মিতা থাকে, তবে তিনি ইংলণ্ডে পুনরায় চ্যাথাম বা গ্র্যাটানের গৌরবময় যুগ সৃষ্টি করিতে পারেন। জনসভা অপেক্ষা সেনেটে তাঁহার সাফল্য কম হইতে পারে, তাঁহার বক্তৃতাভঙ্গী অতীত যুগের বিখ্যাত বক্তাদের মত না হইতে পারে, কিন্তু তিনি নিজ শক্তির বলে সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ করিয়া সাম্রাজ্য পরিচালনা ও তাহার ভাগ্য নির্ণয় করিতে পারেন। লয়েড জর্জের মধ্যে এইরূপ শক্তির লক্ষণ দেখা যায়।... হাউস অব কমন্সে শ্রমিক সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন উচ্চশ্রেণীর বক্তা আছেন—যথা মিঃ ফিলিপ স্নোডেন এবং মিঃ র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড।” কার্জনের এই বাণী ভবিষ্যৎ বাণীতে পরিণত হইয়াছে, ইহা বলা বাহুল্য।
যে তিনটি বক্তৃতা ইংরাজী ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তৃতা এবং ইংরাজী ভাষাভাষী জাতির সম্পদরূপে গণ্য হয়, তাহার মধ্যে দুইটিই ‘বুনো’ আব্রাহাম লিঙ্কনের। ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দের ৯ই নভেম্বর, গেটিসবার্গ সমাধিভূমিতে আব্রাহাম লিঙ্কন যে বক্তৃতা করেন, তাহা বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ।
বিগত ইয়োরোপীয় যুদ্ধের সময়, আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবকেরা অনেক সময়ে কাজের যোগ্য বলিয়া গণ্য হইত না, সহজবুদ্ধি সাধারণ ব্যবসায়ীদিগকে ডাকিয়া কাজ চালাইতে হইত।
যুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন বিভাগের কার্য পরিচালনার জন্য আমেরিকা এডিসনের নীতি অনুসরণ করিয়া ‘কার্যক্ষম ব্যক্তিদিগকেই’ নির্বাচিত করিরাছিল। আমাদের বিশ্বাস যে তাহারা শ্রেষ্ঠ লোকদেরই বাছিয়া লইয়াছিল। মিঃ ড্যানিয়েল উইলিয়ার্ড সৈন্য ও রসদ চালান বিভাগের (ট্রান্সপোর্টেশান) কর্তা ছিলেন। ইনি এখন আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ রেলওয়ে, বালটিমোর এবং ওহিও রেলওয়ের প্রেসিডেণ্ট। তিনি রেলওয়ে শ্রমিক রূপে জীবন আরম্ভ করেন। পরে এঞ্জিনচালক হন এবং ক্রমে ক্রমে বর্তমান পদ লাভ করিয়াছেন। ব্যাঙ্কার মিঃ ভ্যান্ডারলিপ আমেরিকায় বৃটিশযুদ্ধ-ঋণ-কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে তিনি ট্রেজারী-সেক্রেটারীর সহকারী নিযুক্ত হন। জগতের মধ্যে ষষ্ঠ বৃহৎ ব্যাঙ্কের তিনি প্রধান কর্তা। তিনি সংবাদপত্রের রিপোর্টার রূপে প্রথম জীবনে কাজ আরম্ভ করেন। মিঃ রোজেন-ওয়াল্ড যদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যক্রয় বিভাগের কর্তা ছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে সংবাদবাহক বালক ভৃত্য ছিলেন। তিনি এখন শিকাগোর একটি বড় মাল সরবরাহকারী ব্যবসায়ী ফার্মের কর্তা এবং তাঁহার আয় বার্ষিক প্রায় ১০ লক্ষ ডলার। ব্যাঙ্কার মিঃ এইচ. পি. ডেভিসন যুদ্ধের কাজে সহায়তা করিবার জন্য ব্যাঙ্কারদের একটি কমিটি গঠন করেন। তাঁহার বিশ বৎসর বয়সেই তিনি ২ লক্ষ পাউণ্ড উপার্জন করেন, সুতরাং বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সময় পান নাই। (Hankin: The Mental Limitations of the Expert-pp. 55—56.)
লর্ড রণ্ডা এবং স্যার এরিক গেডিস্ ব্যবসায়ীরূপে গত যুদ্ধের সময় অনেক কাজ করিয়াছেন। কিন্তু শ্রমিক গবর্ণমেণ্টের মন্ত্রিসভাতেই ইহার চূড়ান্ত দেখা গিয়াছে। “গতকল্য আমরা নূতন শ্রমিক মন্ত্রিসভার সদস্যগণের একখানি ফটোগ্রাফ প্রকাশ করিয়াছি। ১৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র পাঁচ জন কোন সাধারণ বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন এবং দুইজন পরীক্ষা দিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ করেন। যে যুগে ইটন ও হ্যারো স্কুল হইতে মন্ত্রিসভার সদস্য লওয়া হইত, মনে হয়, সে যুগ অতীত হইয়াছে। ইংলণ্ডের ৪ জন মন্ত্রীর মধ্যে কেবল একজন স্কুলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন এবং বর্তমান ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্যগণের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশেরই কোন কলিকাতা সামাজিক ক্লাবের সদস্য হইবারও যোগ্যতা নাই। ইংলণ্ডে এখন আর কেবলমাত্র পুরাতন পন্থায় উচ্চ পদ লাভ হয় না। মিঃ জোসেফ চেম্বারলেন, মিঃ লয়েড জর্জ, মিঃ বোনার ল এবং মিঃ র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড পুরাতন রীতির ব্যতিক্রম করিয়াছেন। বিশ্ববিদ্যালয় হইতে এখন আর উচ্চতম যোগ্যতা বিশিষ্ট লোক বাহির হইতেছে না, লোকের মনে যাহাতে এই বিশ্বাস না জন্মে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে তদ্বিষয়ে অবহিত হওয়া আবশ্যক।” (ষ্টেটসম্যান, ২৯শে জুন, ১৯২৯)
মিঃ র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড তাঁহার প্রথম জীবনের কিছু বিবরণ দিয়াছেন। তিনি বলেন—“সাইক্লিষ্টদের ভ্রমণ ক্লাবে আমি প্রথমে একটা কাজ পাই। সেখানে খামের উপরে নাম ও ঠিকানা লিখিতে হইত, সপ্তাহে দশ শিলিং করিয়া বেতন পাইতাম। কিন্তু ঐ কাজ মাত্র কিছুদিনের জন্য ছিল। মাথার ঋণের বোঝা লইয়া কপর্দক শূন্য বেকার অবস্থায় লণ্ডনের রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়ানোর অভিজ্ঞতাও আমার আছে।”
মিঃ ম্যাকডোনাল্ডের জ্ঞানার্জনের স্পৃহা ছিল এবং কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করিবার জন্য তিনি ব্যগ্র হইয়াছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্যের জন্য তাঁহার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয় নাই। তিনি বলেন—“বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করিতে পারি নাই বলিয়া আমি দুঃখিত নহি। বস্তুতঃ আমার বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অধিকাংশ লোকের পক্ষে ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্ট বেশী করে।”
আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। স্যার জোসিয়া চাইল্ড্ উইলিয়ম অব অরেঞ্জের সময়ে (১৬৯১) ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সংসৃষ্ট প্রধান ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। “তিনি ঐশ্বর্য ও প্রভাব প্রতিপত্তিতে তাঁহার সময়ের বড় বড় অভিজাতদের সমকক্ষ ছিলেন।” সামান্য শিক্ষানবিশরূপে তিনি কর্মজীবন আরম্ভ করেন। সহরের একটি ব্যাঙ্কের বাড়ী তাঁহাকে ঝাড়ু দিতে হইত। “কিন্তু এই নিম্নতম অবস্থা হইতে স্বীয় যোগ্যতার বলে তিনি ঐশ্বর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি, যশ ও মান লাভ করেন।” (মেকলে)
সম্প্রতি মিঃ উইল আরউইন তাঁহার সহপাঠী প্রেসিডেণ্ট হুভারের প্রথম জীবন সম্বন্ধে একটি বিবরণ লিখিয়াছেন, তিনি বলেন—“১১ বৎসর বয়সে হুভার তাঁহার প্রভুর ঘোড়ার পরিচর্যা করিতেন, গাভী দোহন করিতেন, হাপর জ্বালাইতে সাহায্য করিতেন এবং এই সব কাজ করিয়া স্কুলেও পড়িতে যাইতেন। সালেমে একটি অফিসে বালকভৃত্য রূপে কাজ করিবার সময়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা শিখিবার জন্য তাঁহার আগ্রহ হয় এবং নূতন লেল্যাণ্ড স্ট্যানফোর্ড জুনিয়র বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষালাভ করিতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের জীবিকাও অর্জন করিতেন।”
“দরিদ্রের কুটীর হইতে প্রেসিডেণ্টের রাজপ্রাসাদ”—আমেরিকায় ইহা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা বিশেষ।
ইংরাজী সাহিত্যের কয়েক জন বিখ্যাত লেখকের ভাগ্যে স্কুল কলেজের শিক্ষালাভ হয় নাই। জনসন, গিবন ও কার্লাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়িয়াছিলেন বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার তাঁহারা নিন্দাই করিয়াছেন। ইংলণ্ডের বর্তমান সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বার্নাড শ বলেন যে, তিনি ১৫ বৎসর বয়সে কেরাণীগিরি কাজ করিতে বাধ্য হন। সুতরাং তিনি কলেজী শিক্ষা লাভ করিতে পারেন নাই। স্পেন্সার সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতে যাহা কিছু শিক্ষা লাভ করেন। যখন তিনি Social Statics নামক গ্রন্থ লিখেন তখন তিনি কোন স্কুল কলেজের শিক্ষা পান নাই। তিনি নিজে বলিয়াছেন,—“আমার পিতৃব্যের সহিত থাকার সময়, ১৩ বৎসর হইতে ১৬ বৎসর বয়স পর্যন্ত, আমার শিক্ষা ইউক্লিড, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, মেকানিক্স এবং নিউটনের প্রিন্সিপিয়ার প্রথম ভাগে নিবদ্ধ ছিল। এর চেয়ে বেশী শিক্ষা আমি কখনও লাভ করি নাই।” (জীবনী, ৪৩৭ পঃ)
“অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট আমি কোন ঋণ স্বীকার করি না এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ও সানন্দে আমার ছাত্রত্ব অস্বীকার করিবেন। আমি ১৪ মাস ম্যাগডালেন কলেজে ছিলাম; আমার সমস্ত জীবনের মধ্যে ঐ ১৪ মাস অলস ও কর্মহীন বলিয়া আমি মনে করি।
“অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, অধিকাংশ অধ্যাপক কয়েক বৎসর হইতে শিক্ষাদানের ছলনা পর্যন্ত ত্যাগ করিয়াছেন। দেখা গিয়াছে, পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান শাস্ত্র ব্যতীত আর সমস্ত বিদ্যাই পুরাতন প্রথায় অধ্যাপকের সাহায্য ব্যতিরেকেও নানা মূল্যবান পুস্তিকা পাঠেই অধিগত করা যায়।
“ম্যাগডালেন কলেজে অথবা অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজের অন্য কোন কলেজে আমি যদি অনুরূপ অনুসন্ধান করিতাম, তবে প্রত্যুত্তরে অধ্যাপকরা হয়ত একটু লজ্জিত হইতেন অথবা বিদ্রূপভরে ভ্রূকুঞ্চিত করিতেন।
“কমনার (Commoner) হিসাবে আমি ‘ফেলো’ নির্বাচিত হইয়াছিলাম। আমি আশা করিয়াছিলাম যে-সাহিত্য সম্বন্ধীয় কোন শিক্ষা ও আনন্দপ্রদ বিষয় লইয়াই বুঝি আমাদের আলোচনা হইবে। কিন্তু দেখিলাম, আমাদের কথাবার্তা কলেজের ব্যাপার, টোরী রাজনীতি, ব্যক্তিগত কাহিনী এবং কুৎসা প্রভৃতিতেই সীমাবদ্ধ।
“ডাঃএর বেতনের বিষয়টা বেশ মনে থাকে, কেবলমাত্র কর্তব্য করিতেই তিনি ভুলিয়া যান!”—গিবন, আত্মচরিত।
(৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা—ব্যবসায়ে সাফল্যের পথে বাধাস্বরূপে
“ব্যবসায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবক— ইংলণ্ডে তাহাদের অবস্থা কিরূপ?—শীর্ষক একটি প্রবন্ধে মিঃ গিলবার্ট ব্র্যাণ্ডন এই অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন যে, ব্যবসাবাণিজ্যক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি জীবনে সাফল্য লাভের পক্ষে বাধাস্বরূপে। বড় বড় ব্যবসায়ী বা শিল্পপ্রবর্তকদের কথা চিন্তা করিলে স্বীকার করিতে হয় কেন অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পান নাই। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই কঠোর পরিশ্রম ও অক্লান্ত সাধনার দ্বারা নিম্নতম স্তর হইতে সাফল্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছেন। তাঁহাদের আর একটি বিশেষ শক্তি ছিল—যাহার নাম দেওয়া যাইতে পারে, অর্থোপার্জনের বুদ্ধি বা কৌশল।
পাবলিক স্কুলের ছাত্রগণের নিয়োগ
“একজন ভদ্রলোক জোরের সঙ্গে বলেন যে সাধারণ বিদ্যালয়ের ছাত্রগণকে কার্যে নিয়োগ করিতে হইবে। আমার অভিজ্ঞতা এই যে, অধিকাংশক্ষেত্রে সাধারণ বিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সুদক্ষ ব্যবসায়ী হইতে পারে না। ইংলিশ পাবলিক স্কুলের প্রচলিত ধারণা এই যে সেখানে ‘ভদ্রলোক’ তৈরী করা হয়। পাঠ্যাদিও সেই আদর্শ অনুসারেই স্থির হয়। খেলা-ধূলার উপরে বিশেষ জোর দেওয়া হয়। আমি ব্যবসায়ক্ষেত্রে বহু সাধারণ বিদ্যালয়ে শিক্ষিত যুবকদিগকে লক্ষ্য করিয়াছি, কাজ অপেক্ষা খেলার দিকেই তাহাদের মন বেশী। তাহারা সর্বদাই ঘড়ির দিকে চাহিয়া থাকে, কখন কাজ ছাড়িয়া তাহারা গল্ফ্ বা টেনিস খেলায় যাইতে পারিবে।
“সাধারণ বিদ্যালয়ে শিক্ষিত যুবক কাজের ‘অর্ডারে’র জন্য দালালি করিয়া বেড়াইতে চাহে না। কাজ করিতে তাহার আত্মসম্মানে বাধে। সে মনে করে, তাহার কাজ হইতেছে চেয়ার টেবিলে ঘণ্টা বাজাইয়া অধীনস্থ কর্মচারীদিগকে ডাকা এবং চিঠিতে নাম দস্তখত করা।
অক্সফোর্ডের ত্রুটি
“আমি ‘ক্লাসিক’ বা প্রাচীন সাহিত্যে শিক্ষিত বহু যুবককে দেখিয়াছি। তাহাদের মধ্যে মৌলিকতা ও কর্ম-প্রেরণা নাই। তাহাদের মন যেন খাঁটি ‘ক্ল্যাসিক্যাল’। যখন কোন গুরুতর সমস্যা উপস্থিত হয়, তখন তাহারা সক্রেটিসের উক্তি উদ্ধৃত করিতে পারে, কিন্তু সক্রেটিসের উপদেশ কার্যে পরিণত করিবার ক্ষমতা তাহাদের নাই অথবা নিজে বুদ্ধি করিয়াও তাহারা কিছু একটা করিতে পারে না।”
মিঃ অ্যানড্রু কার্নেগী তাঁহার “Empire of Business” গ্রন্থে লিখিয়াছেন—“প্রধান প্রধান ব্যবসায়ীদের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটের অভাব বিশেষভাবে চিন্তা করিবার বিষয়। আমি সর্বত্র অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি, কর্মক্ষেত্রে যাঁহারা নেতা বা পরিচালক তাঁহাদের মধ্যে গ্রাজুয়েটদের নাম পাই নাই। বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাহারা অবশ্য বিশ্বস্ত কর্মচারিরূপে নিযুক্ত আছে। ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। ব্যবসায়ে যাঁহারা সাফল্যলাভ করিয়াছেন, তাঁহারা গ্রাজুয়েটদের অনেক পূর্বেই কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াছেন। তাঁহারা ১৪ বৎসর হইতে ২০ বৎসর বয়সের মধ্যে কাজে ঢুকিয়াছেন, আর এই সময়টাই শিক্ষার সময়। অপরপক্ষে কলেজের যুবকেরা এই সময়ে অতীতের তুচ্ছ কাহিনী অথবা মৃত ভাষা আয়ত্ত করিবার জন্যই ব্যস্ত ছিল। এই সব বিদ্যা ব্যবসায়ক্ষেত্রে কোন কাজে লাগে না, এ যেন অন্য কোন পৃথিবীর উপযোগী বিদ্যা। যিনি ভবিষ্যতে ব্যবসায়ক্ষেত্রে নেতৃত্ব করিয়াছেন, তিনি তখন হাতেকলমে কাজ শিখিয়া ভবিষ্যৎ জীবনসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন।”[১০] জনৈক আমেরিকান লেখক বলিয়াছেন—“ব্যবসায় শিক্ষার বেলায়, একথা ভুলিলে চলিবে না যে ব্যবসায়ীর ভবিষ্যৎ জীবন কাজের জীবন হইবে, অধ্যয়নের জীবন হইবে না। অকেজো উপাধিলাভের প্রচেষ্টায় তাহার স্বাস্থ্য যাহাতে নষ্ট না হয় এবং বাজে বিষয় চিন্তা করিয়া সে যাহাতে বেশী ভাবপ্রবণ না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইবে।”
আমি যদি পুনর্বার যুবক হইতাম!
যুবকদের সুযোগ
ব্যবসায়ী, ক্রোরপতি এবং খেলোয়াড় স্যার টমাস লিপ্টন দারিদ্রের নিম্ন স্তর হইতে অভ্যুত্থান করিয়াছেন। “জীবনে কে সাফল্য লাভ করে?”—এ সম্বন্ধে তিনি তাঁহার নিজস্ব ভঙ্গীতে জোরাল ভাষায় নিম্নলিখিত কথাগুলি বলিয়াছেন:—
“ষাট বৎসরেরও অধিক হইল, আমি গ্লাসগোর একটি গুদাম ঘরে শ্রমিকের কাজ করিতাম, পারিশ্রমিক ছিল সপ্তাহে অর্দ্ধ ক্রাউন (২১২ শিলিং)। সেই সময় আমি মনে করিতাম, আমার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য আত্মগর্ব। তার পর বহু বৎসর অতীত হইয়াছে, আমি এখন বুঝিতে পারিয়াছি মানুষের জীবনে সর্বাপেক্ষা বড় সম্পদ তাহার আত্মবিশ্বাস।
“আমার সেই প্রথম জীবনে যখন আমার আয় দৈনিক ৬ পেন্সের কম ছিল,—আমি আমার মাতাকে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলাম, শীঘ্রই তাঁহার জুড়ীগাড়ী হইবে। ইহা ফাঁকা প্রতিশ্রুতি নয়, আমার মাতার মৃত্যুর বহু বৎসর পূর্বেই তিনি প্রায় এক ডজন জুড়ীগাড়ীর অধিকারিণী হইয়াছিলেন।
আমার মা আমাকে উৎসাহ দিয়াছিলেন
“আমি যদি পুনরায় যুবক হইতাম! আমি যদি অতীতকে অতিক্রম করিয়া পুনর্বার জীবন আরম্ভ করিতে পারিতাম, তাহা হইলে পূর্বের মতই জীবনপথে অগ্রসর হইতাম।
“কিন্তু আমার চরিত্রে দুইটি অমূল্য গুণ থাকার প্রয়োজন হইত—আমার মাতার প্রতি ভক্তি ও ভালবাসা এবং নিজের যোগ্যতার প্রতি বিশ্বাস। যে যুবক জীবনযুদ্ধে সাফল্যলাভ করিবেন, তাঁহার মধ্যে এই দুইটি গুণ দেখিতে চাই। আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি, আমার সমস্ত সাফল্যের জন্য মায়ের নিকট আমি ঋণী, তিনি আমাকে প্রত্যেক কাজে উৎসাহ দিতেন।[১১]
“যে যুবক ব্যবসায়ক্ষেত্রে প্রবেশ করিবে, তাহার পক্ষে সাধারণ বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার কি প্রয়োজন আছে, আমি বুঝিতে পারি না। ঐ শিক্ষার ফলে এমন সব বিদ্যা সে অধিগত করে যাহা তাহার কোন কাজে লাগে না। এবং উহাতে অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় হয়, যাহা সে উপার্জনে ব্যয় করিতে পারিত।
“একজন যুবক ২১।২২ বৎসর বয়স পর্যন্ত স্কুলে থাকিবে কেন? সেই সময় মধ্যে কাজ করিয়া সে জীবনে সম্মান ও ঐশ্বর্য লাভ করিতে পারিত। বর্তমানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবক ব্যবসায়ক্ষেত্রে কোন কাজে আসে না, আফিসের একজন উচ্চশ্রেণীর বালকভৃত্য হইতে পারে মাত্র।
“আমাকে যদি পুনর্বার জীবন আরম্ভ করিতে হইত, তবে আমি একজন শ্রমিকের ছেলের চেয়ে বেশী শিক্ষা চাহিতাম না। আমি সর্বদা চেষ্টা করিতাম,—কিসে জীবনযুদ্ধে অগ্রসর হইয়া নিজের ক্ষমতার পরিচয় দিব।
“আমি ষাট বৎসর পূর্বের মতই ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইতাম, আমি সেইভাবেই দেশবাসীকে খাদ্য যোগাইবার ভার লইতাম, কেননা খাদ্যের চাহিদা কখনও কম হয় না। আমার ব্যবসা লোকের খেয়ালের উপর নির্ভর করিত না। আমি এমন জিনিষের ব্যবসা করিতাম, যাহা চিরদিনই লোকপ্রিয় হইতে বাধ্য।
“ব্যবসা আরম্ভ করিয়া আমি আমার সম্মুখে কয়েকটি আদর্শ রাখিতাম। আমি পুরাতন কোন খরিদ্দার কখনও ত্যাগ করিব না, পরন্তু সর্বদা নূতন খরিদ্দার সংগ্রহ করিব। আমি খরিদ্দারদের “সেবা” করিব, সুতরাং কেহই আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইবে না। আমি সর্বদা এই গর্ব করিব যে, আমি সর্বাপেক্ষা কম দামে, বেশী ও ভাল জিনিষ দিই, আমার ব্যবসা অন্যের আদর্শস্বরূপ। আমি প্রত্যেক খরিদ্দারকে আমার বন্ধু করিতে চেষ্টা করিব, প্রত্যেকে এইকথা ভাবিবে যে তাহার জন্য আমি সর্বদা অবহিত।
চোখে ঠুলি দেওয়া যুবকগণ
“সংক্ষেপে, আমি আমার অভিজ্ঞতালব্ধ পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত নীতিগুলি অবলম্বন করিব। এবং সর্বোপরি আমার মাতার প্রভাব আমাকে সর্বদা মহত্তর ও বৃহত্তর কাজের প্রেরণা দিবে।
“এ একটা মহৎ প্রচেষ্টা হইবে। বর্তমানে জীবনসংগ্রাম বড় কঠোর, সুতরাং অধিকতর উৎসাহ ও আনন্দপূর্ণ।
“যে ব্যক্তি একক জীবনসংগ্রামে প্রবেশ করে, সে শীঘ্রই বড় বড় প্রতিযোগীদের সম্মুখীন হয়, তাহারা তাহাকে পশ্চাতে ঠেলিয়া দিতে চেষ্টা করে।
“কিন্তু বর্তমানে সে তাহার ক্ষমতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করিবার বহু সুযোগ পাইবে। যে যুবক সাফল্য লাভ করিতে চায়, বাধাবিপত্তি তাহার কাছে কিছুই নয়।”—পিয়ার্সনস্ উইকলি।
লর্ড কেব্ল[১২] এবং লর্ড ইঞ্চকেপ (মিঃ ম্যাকে) নিম্নতম স্তর হইতে জীবন আরম্ভ করেন। লর্ড কেব্ল মাসিক একশত টাকা বেতনের শিক্ষানবীশ ছিলেন। একজন ইংরাজের পক্ষে এই বেতন অতি সামান্য।
“যুবকরা গোড়া হইতে কার্য আরম্ভ করিবে এবং অধস্তন পদে কাজ করিবে, ইহাই ভাল ব্যবস্থা। পিট্সবার্গের বহু প্রধান ব্যবসায়ীকে কর্মজীবনের আরম্ভেই গুরুতর দায়িত্ব বহন করিতে হইয়াছিল। তাঁহাদিগকে প্রথম অবস্থায় আফিস ঘর ঝাঁট দিতে পর্যন্ত হইত। দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে আমাদের যুবকগণ ঐ ভাবে ব্যবসায় শিক্ষার সুযোগ পায় না। ঘটনাক্রমে যদি কোন দিন সকালবেলা ঝাড়ুদার অনুপস্থিত হয়, তবে যে যুবক ভবিষ্যৎ মালিক হইবার যোগ্যতা রাখে সে কখনও ঘর ঝাড়ু দিতে পশ্চাৎপদ হইবে না। আমি ঐরূপ একজন ঝাড়ুদার ছিলাম।” অ্যানড্রু কার্নেগী, The Empire of Business.
“৪৫ বৎসর পূর্বে একজন নির্মলকান্তি, প্রিয়দর্শন ল্যাঙ্কাশায়ার যুবক এক মুদীর দোকানে কাজ করিত। তাহার দুইটি চোখ ভিন্ন বিশেষ ভাবে আকর্ষণের বস্তু আর কিছু ছিল না। যাহার এরূপ চোখ, সে কখন সাধারণ লোক হইতে পারে না। কোন শিল্পীই সেই চোখের বিচিত্র বর্ণ ধরিতে পারিত না। এই বালকই ভবিষ্যতে লর্ড লেভারহিউল্ম্ হইয়াছিলেন। বিশ বৎসর পূর্বে জনৈক বোল্টনবাসীর মুখে আমি এই বর্ণনা শুনি। সে উইলিয়াম লেভার ও তাঁহার পিতাকে চিনিত। বালক এখন একজন প্রধান ব্যবসায়ী এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী।
“পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেকার কথা আমার মনে পড়িতেছে। যুবক লেভার অল্পকালই শিক্ষা পাইয়াছিলেন, তার পরই তিনি ব্যবসায়ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন।” (লর্ড বার্কেনহেড, Contemporary Personalities, ২৭৭ পৃষ্ঠা।)
লোহা ও ইস্পাতের ব্যবসায়ে দুইজন প্রধান অগ্রণী হেনরী বেসেমার এবং অ্যানড্রু কার্নেগী। বেসেমার ইস্পাত তৈরী প্রক্রিয়ায় যুগান্তর আনয়ন করেন। “তিনি ধাতুবিদ্যার কিছুই জানিতেন না, কিন্তু তাহাতে তিনি পশ্চাৎপদ হন নাই। এ বিষয়ে যাহা কিছু পাঠ্য পাইয়াছিলেন, সমস্তই তিনি পড়িয়াছিলেন। বহু-কোটিপতি এবং লোকহিতব্রতী অ্যানড্রু কার্নেগী টেলিগ্রাফের পিওন রূপে কাজ আরম্ভ করেন। তাঁহার জীবনেও এই একই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। এক কথায় তিনি সম্পূর্ণ স্বীয় চেষ্টায় শিক্ষালাভ করেন। কার্নেগী আবিষ্কারক কিম্বা বৈজ্ঞানিক নহেন। কিন্তু একটা মহৎ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে সময়োপযোগী করিয়া কিরূপে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করিতে হয়, সে বিষয়ে তাঁহার সমকক্ষ কেহ ছিল না। অ্যানড্রু কার্নেগী ‘বেসেমার প্রক্রিয়াকে’ গ্রহণ করিয়া আমেরিকায় তথা জগতের শিল্পে যুগান্তর আনয়ন করেন। সুতরাং দেখা যাইতেছে, ব্যবসায়ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করিতে হইলে, অথবা শিল্পপ্রবর্তক হইতে হইলে, বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞের জ্ঞান তেমন প্রয়োজনীয় নহে, সেজন্য চাই সঙ্ঘবদ্ধভাবে কার্য করিবার শক্তি, উৎসাহ ও প্রেরণা। ডাঃ হ্যার্কিন যথার্থই বলিয়াছেন:—
“ব্যবসায়ীর নিকট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি অকেজো বলিয়াই মনে হয়। ব্যবসায়ীর মতে সহজ বুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞানই আসল জিনিষ, ইহার দ্বারাই অর্থোপার্জন করা যায়। বিশেষজ্ঞের মধ্যে ইহার একান্ত অভাব।
“জনৈক বিশেষজ্ঞ কোন ব্যবসায়ীর জ্ঞানের সুযোগ লইয়া ব্যবসায়ক্ষেত্রে অধিকতর সাফল্য লাভ করেন। ব্যবসায়ীটি এজন্য দুঃখ করিয়া বলেন,—‘আমি ভাবিয়াছিলাম, সে কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক।’
“পরলোকগত আমেরিকান ব্যাঙ্কার মরগ্যান একবার বলিয়াছিলেন, ‘আমি ২৫০ ডলার দিয়া যে কোন বিশেষজ্ঞকে ভাড়া করিতে পারি, এবং তাহার প্রদত্ত তথ্যের দ্বারা আরও ২৫০ হাজার ডলার উপার্জন করিতে পারি। কিন্তু সে আমাকে ঐভাবে কাজে খাটাইতে পারে না।’ একজন সাধারণ বিশেষজ্ঞের ব্যবসায়ক্ষেত্রে উপযোগিতা কতটুকু, তাহা এই কয়টি কথার দ্বারাই প্রকাশ পাইতেছে।”
আর একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত দিতেছি।
মি: বাটার কর্মজীবন
“মোরেভিয়ার জিলিন সহরনিবাসী মিঃ টমাস বাটা দশ বৎসরে এক কোটী পাউণ্ড উপার্জন করিয়াছেন বলিয়া শোনা যায়। ইনি জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় পাদুকা ব্যবসায়ী। কিছুদিন পূর্বে বিমানযোগে ইনি কলিকাতায় আসিয়াছেন।
“ব্যবসায়ক্ষেত্রে মি: বাটার সাফল্যের কাহিনী উপন্যাসের মতই চিত্তাকর্ষক। তিনি একজন গ্রাম্য মুচির ছেলে, বাল্যকালে লোকের বাড়ী জুতা বিক্রয় করিয়া বেড়াইতেন। বর্তমানে ৫৫ বৎসর বয়সে তিনি জগতের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ জুতার কারখানার অধিকারী। তাঁহার কারখানায় প্রত্যহ ১ লক্ষ ৬০ হাজার জোড়া জুতা তৈরী হয় এবং ১৭ হাজার লোক কাজ করে। (দৈনিক সংবাদপত্র, ৮ই জানুয়ারী, ১৯৩২)
আমি বহুবার বক্তৃতাপ্রসঙ্গে বলিয়াছি যে, স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যদি ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করিতেন, তাহা হইলে বাংলাদেশের পক্ষে দুর্ভাগ্য হইত। যদি তিনি বি, ই, ডিগ্রীধারী হইতেন, তবে তাঁহার কর্মজীবন ব্যর্থ হইত।[১৩]
বাংলার কথা বলিতে গেলে, দেখিতে পাই,—“সরকারী লবণগোলার ভূতপূর্ব দেওয়ান বিশ্বনাথ মতিলাল মাসিক আট টাকা বেতনে প্রথম জীবনে কার্য আরম্ভ করেন এবং দেওয়ানী কার্য হইতে অবসর লইবার পূর্বে তিনি ১০।১২ লক্ষ টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলেন বলিয়া প্রকাশ। প্রসিদ্ধ ধনী আশুতোষ দেবের পিতা একজন দেশীয় মালিকের অধীনে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে কর্ম করিতেন। তৎপরে তিনি ফেয়ারলি, ফার্গুসন অ্যাণ্ড কোম্পানীর ফার্মে কেরাণীর কাজ পান। আমেরিকান জাহাজ ব্যবসায়ীদের অধীনেও তিনি কার্য করেন। শেষোক্ত ব্যবসায়ীরা তাঁহার নামে তাঁহাদের একখানি জাহাজের নাম ‘রামদুলাল দেব’ রাখিয়াছিলেন। এই দুই বিদেশীয় ফার্মের অধীনে কার্য করিয়া তিনি প্রভূত ঐশ্বর্য সঞ্চয় করেন। কলিকাতার রথচাইল্ড, টাকার বাজারের সর্বেসর্বা মতিলাল শীল প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে মাসিক দশ টাকা বেতনে কর্ম আরম্ভ করেন।” (ইণ্ডিয়ান মিরর, ১৪ই আগষ্ট, ১৯১০)
পরলোকগত শ্যামাচরণ বল্লভ তাঁহার সময়ে একজন প্রধান পাটব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি সামান্য অবস্থা হইতে উন্নতি লাভ করেন। প্রচলিত মত অনুসারে তিনি “শিক্ষিত” ছিলেন না, কিন্তু তাঁহার ব্যবসায়বুদ্ধি ও কর্মপটুতা উচ্চশ্রেণীর ছিল।
শ্রীযুত ঘনশ্যামদাস বিড়লার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নাই। যদি তাঁহাকে তরুণ বয়সে বই মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা পাশ করিতে হইত, তবে তাঁহার একটুও ব্যবসায়বুদ্ধি বা কর্মপ্রেরণা হইত না। শিল্প-বাণিজ্য, মুদ্রানীতি ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁহার অভিমত লোকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে।
বোম্বাইয়ের ‘টাটা কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কসের’ মিঃ এস, পি, ব্যানার্জি আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে আফিসে নিম্নতম কেরাণী রূপে কাজ আরম্ভ করেন। তিনি ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষাও পাশ করেন নাই, কিন্তু তিনি আশ্চর্য কর্মশক্তি ও প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন। তাঁহার ফার্ম সাধারণ ইমারতাদি তৈয়ারীর বড় বড় কন্টাক্টই যে গ্রহণ করে, তাহা নহে, রেলরাস্তা প্রভৃতি নির্মাণের কন্ট্রাক্টও লয়। অপর পক্ষে, যাহারা ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় শিক্ষালাভ করিয়াছে, তাহারা কেবল চাকরী খুঁজিয়া বেড়ায়।
শ্রীযুত নলিনীরঞ্জন সরকার। ব্যবসায়ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করিয়াছেন। তিনি মাত্র ম্যাট্রিকুলেশান পাশ। কিছুকাল হইল বিবিধ অর্থনৈতিক সমস্যার আলোচনায় তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। এ সম্বন্ধে তাঁহার বক্তৃতা ও পুস্তিকাদি চিন্তিত তথ্যে পূর্ণ।
আমি যখন এই কয় ছত্র লিখিতেছিলাম, তখন ঘটনাচক্রে সংবাদপত্রে মিঃ মরিসের একটি বিবৃতির প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। মিঃ মরিসকে “ইংলণ্ডের ফোর্ড” বলা হয়। মরিস বলিয়াছেন—“ব্যবসায়ের দিক দিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সময়ের অপব্যয় মাত্র। দু-একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকিতে পারে, কিন্তু সাধারণতঃ আমার ব্যবসায়ে দেখিয়াছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কোন কাজে লাগে না। বাণিজ্যক্ষেত্রে যে সব গুণের প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয় তাহা দিতে পারে না, বরং ঐরূপ কোন গুণ থাকিলে তাহা নষ্ট করে। আণ্ডারগ্রাজুয়েটদের ধারণা জন্মে যে জীবন অতি সহজ ব্যাপার, তাহারা খেলাধূলা, আমোদপ্রমোদের প্রতিই বেশী মনোযোগ দেয়।”
গত ৪০ বৎসর ধরিয়া আমি বাংলার কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছি। এই সব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবকদের অযোগ্যতা দেখিয়া আমি মনে গভীর আঘাত পাইয়াছি।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ ও নারীদের যদি একটা হিসাব লওয়া যায়, তবে দেখা যাইবে, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নাই, অথবা কোনরূপ শিক্ষাই তাঁহারা লাভ করেন নাই।
স্মরণ রাখিতে হইবে যে, অ্যানড্রু কার্নেগী, হেনরী ফোর্ড, টমাস এডিসন, লর্ড কেব্ল, র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড, টমাস লিপ্টন প্রভৃতির মত লোক যদিও কলেজে শিক্ষিত হন নাই, তবুও তাঁহাদের ‘কালচার’ বা সংস্কৃতির অভাব ছিল না। কঠোর জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকিয়া যখন তাঁহারা ভবিষ্যৎ সাফল্যের গোড়া পত্তন করিতেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে স্বীয় চেষ্টায় জ্ঞান উপার্জনের সুযোগও তাঁহারা ত্যাগ করেন নাই।
যাঁহারা বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্রনীতিবিৎ রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, অথচ সমাজের নিম্নস্তরে যাঁহাদের জন্ম অথবা সামান্য শ্রমিকরূপে জীবন আরম্ভ করিয়াছিলেন, এরূপ বহু লোকের দৃষ্টান্ত আমি প্রায়ই উল্লেখ করিয়া থাকি। এই সমস্ত লোক সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় কৃতিত্বলাভ করেন।
আরও কয়েকজন প্রসিদ্ধ লোকের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। ইঁহারা ব্যবসায় বুদ্ধির সহিত রাজনীতি জ্ঞান অথবা বৈজ্ঞানিক প্রতিভার সমন্বয় সাধন করিয়াছিলেন। গোসেন এবং লাবক (লর্ড আভেবেরী) ব্যাঙ্কার ছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গোসেন ছিলেন রাজনীতিক এবং লাবক রাজনীতিক ও বৈজ্ঞানিক উভয়ই ছিলেন। একই ব্যক্তির মধ্যে বহু গুণের এরূপ সমন্বয় দুর্লভ এবং উহা রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়ও নহে। বর্তমান সমাজ শ্রমবিভাগের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমি বরাবর বলিয়া আসিয়াছি যে, বাংলার আর্থিক দুর্গতির একটা প্রধান কারণ এই যে, প্রত্যেক যুবক এবং তাহার অভিভাবক মনে করে, যদি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কা না পায়, তবে তাহার জীবন ব্যর্থ হইবে।[১৪] যদি কেবলমাত্র সর্বাপেক্ষা প্রতিভাশালী এবং বিদ্যানুরাগী ছেলেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হইত এবং অন্য ছেলেরা স্কুলের পড়া শেষ করিবার পরই ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতিতে শিক্ষানবিশী আরম্ভ করিত, তবে বাংলায় এই আর্থিক দুর্গতি নিবারণ করা যাইতে পারিত।
“যাহাদের প্রতিভা আছে, রাষ্ট্র কেবল তাহাদের জন্যই শিক্ষার ব্যয় বহন করিয়া থাকে। যাহাদের সে যোগ্যতা নাই, তাহাদের জন্য অন্য নানা পথ আছে।
“গণতন্ত্রের আদর্শ অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয় সকলের জন্যই; একই আধারে মণিমাণিক্য ও জঞ্জাল উভয়ই এক সঙ্গে থাকিতে পারে। কিন্তু আমি এই নীতির বিরুদ্ধবাদী। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় মনে করিত স্কুল তাহাদেরই জন্য। সতরাং ইহার প্রতি তাহাদের কোন সম্মান বোধ ছিল না। তাহারা বিদ্যালয়ের নিকট হইতে যতদূর সম্ভব প্রশ্রয়ই চাহিত। উদ্দেশ্য তাড়াতাড়ি কোন উপাধিলাভ অথবা যে কোন প্রকারে উচ্চশ্রেণীতে প্রমোশন।”—মুসোলিনী, আত্মচরিত।
(৪) শ্রমের প্রতি অবজ্ঞা—জাতীয় সঙ্কটের লক্ষণ
স্যার এডওয়ার্ড ক্লার্ক সম্প্রতি একটি বক্তৃতার বলিয়াছেন—“কিংস কলেজ, লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস এবং সমস্ত দেশের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। এমন বহু ছাত্র আছে, যাহারা জীবিকার জন্য দৈনন্দিন কার্য করিবার পর, অতিরিক্ত সময়ে পরিশ্রম করিয়া অধ্যয়ন করে।” এই শ্রেণীর ছাত্র হইতেই শ্রমিক মন্ত্রিসভা গঠিত হইয়াছে এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাসম্পন্ন এই সব ব্রিটিশ যুবকদের প্রতি জাতি নির্ভর করিতে পারে। বস্তুতঃ, কোন উদ্দেশ্য লইয়া অধ্যয়ন করাতেই ফল হয়।
যাহারা এইরূপ উদ্দেশ্য লইয়া পড়াশুনা করে, তাহারা সেই সব ছাত্রদের চেয়ে বেশী যোগ্যতা প্রদর্শন করিবে, যাহারা কেবলমাত্র অভিভাবকদের তাড়নায় পড়িতে বাধ্য হয়; সেরূপ ছাত্রদের প্রকৃতপক্ষে নিজেদের কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই নাই।
বিদ্যালয়ে সাফল্যের উপর বাহিরের কাজের প্রভাব
যাহারা জীবিকার জন্য নিজে উপার্জন করিতে বাধ্য হয়, তাহারাই বিদ্যালয়ে বেশী কৃতিত্ব প্রদর্শন করে। কেবল মাত্র কাজ করিলেই সফলতা লাভ করা যায় না। তাহার উদ্দেশ্য থাকা চাই। The Vocational Guidance Magazine-এ ফ্রান্সিস টি ম্যাকেব (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়) কর্তৃক প্রকাশিত একটি বিবরণ হইতে এই তথ্য অবগত হওয়া যায়। রিঞ্জ টেক্নিক্যাল স্কুলে (কেম্ব্রিজ, মাসাচুসেট্স) এ সম্বন্ধে একটি পরীক্ষা করা হয়। ঐ বিদ্যালয়ে ১৩ বৎসর হইতে ২০ বৎসর বয়স্ক প্রায় এক হাজার ছাত্র আছে।
“৭৫৮ জন ছাত্র লইয়া এই পরীক্ষা করা হয়, ঐ সমস্ত ছাত্রের প্রকৃতি অথবা যোগ্যতা পূর্ব হইতে জানা ছিল না। বিদ্যালয়ের পরে কে কি কাজ করে প্রত্যেক ছাত্রকে তাহা জিজ্ঞাসা করা হয়; এই ভাবে ছাত্রদিগকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়—যাহারা বিদ্যালয়ের পরে কাজ করে এবং যাহারা সেরূপ কোন কাজ করে না।
“ইহার সঙ্গে বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর মিলাইয়া দেখা গেল, যাহারা জীবিকার জন্য কাজ করিতে বাধ্য হয়, তাহারাই বেশী দায়িত্বজ্ঞান লইয়া পড়াশোনা ও পরিশ্রম করে।
“উপরোক্ত দুই শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে, যাহারা কাজ করিতে বাধ্য হয়, তাহারাই বিদ্যালয়ে পরীক্ষায় ভাল নম্বর পায়।
“যাহারা কাজ করে না অথবা সাময়িক ভাবে কিছু অর্থ সংগ্রহের জন্য কাজ করে, তাহাদের অপেক্ষা যাহারা নিয়মিত ভাবে কাজ করিতে বাধ্য হয়, তাহারাই বিদ্যালয়ে বেশী কৃতিত্ব প্রদর্শন করে
“যাহারা কলেজে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সব ছাত্র প্রায়ই দেখা যায়। আমেরিকার প্রত্যেক স্টেটে কৃষি এবং শিল্প শিক্ষা দিবার জন্য সরকারী বিদ্যালয় (Land-Grant Colleges) আছে। স্টেট এবং যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল হইতে এই সব বিদ্যালয়ে সাহায্য করা হইয়া থাকে। এরূপ ৪৮টি কলেজ লইয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখা গিয়াছে যে, ছাত্রদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক এবং ছাত্রীদের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ জীবিকার জন্য কার্য করে।
“এই সব কলেজে প্রায় ১৩ হাজার ছাত্র এবং ৩ হাজার ছাত্রী কলেজে থাকিবার সমর স্বোপার্জিত অর্থে ব্যয় নির্বাহ করে। সাধারণতঃ আণ্ডার-গ্রাজুয়েটরা আংশিক সময়ে কাজ করিয়া এক এক ‘টার্মে’ ৩০ পাউণ্ড হইতে ৭০ পাউণ্ড এবং গ্রীষ্মাবকাশে ৪০ পাউণ্ড হইতে ৫০ পাউণ্ড পর্যন্ত উপার্জন করে।”
ট্রিবিউন পত্রিকার চীনস্থিত একজন সাংবাদিকের কথাপ্রসঙ্গে ক্যারূপ নিলসেন বলিয়াছেন—“অন্য অনেক আমেরিকান সাংবাদিকের ন্যায় তিনি জীবনে নানা কাজ করিয়াছেন, তার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লইয়া সংবাদপত্রসেবী হইয়াছেন। এক সময়ে তিনি রেলওয়ে লাইনে শ্রমিকের কাজও করিয়া ছিলেন।”—The Dragon Awakes p. 77.
ইহার দ্বারা বুঝা যায় না যে, আমেরিকার প্রত্যেক কলেজের ছাত্র স্বাবলম্বী এবং পরিশ্রমী। বহু বৎসর পূর্বে, এমার্সন সহরের পুত্তলিকাবৎ অকর্মণ্য ছাত্র (ইহারা অনেকটা আমাদেরই সহরবাসী ছাত্রদের মত) এবং দৃঢ়-প্রকৃতি স্বাবলম্বী যুবকের তুলনা করিয়া বলিয়াছেন:—
“আমাদের যুবকরা যদি প্রথম চেষ্টাতেই ব্যর্থ হয়, তবে তাহারা ভগ্নহৃদয় হইয়া পড়ে। যদি কোন নবীন ব্যবসায়ী সাফল্য লাভ করিতে না পারে, লোকে বলে যে সে একেবারে ধ্বংসের মুখে গিয়াছে। যদি কোন বুদ্ধিমান ছাত্র কলেজ হইতে বাহির হইয়া এক বৎসরের মধ্যে বোস্টন বা নিউইয়র্কে কোন আফিসে কাজ না পায় তবে সে এবং তাহার বন্ধুগণ মনে করে তাহার নিরাশ হইবার ও সারাজীবন বিলাপ করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। পক্ষান্তরে, নিউ হাম্পাশায়ার বা ভারমণ্ট হইতে আগত দৃঢ় প্রকৃতি যুবক একে একে সমস্ত কাজে হস্ত দেয়, সে ফার্মে শ্রমিকের কাজ করে, ফেরী করে, স্কুলে পড়ায়, বক্তৃতা করে, সংবাদপত্র সম্পাদন করে, কংগ্রেসে যায়, নাগরিকের অধিকার ক্রয় করে। বৎসরের পর বৎসর এইরূপ বিভিন্ন কাজ করিয়াও তাহার চিত্তের স্থৈর্য নষ্ট হয় না। সে একাই, সহরবাসী এক শত অকর্মণ্য পুত্তলিকার সমকক্ষ, সে জীবনের পথে বুক ফুলাইয়া চলে, কোন উচ্চতর বৃত্তি শিক্ষা করে নাই বলিয়া লজ্জা বোধ করে না,—কেননা সে কখনও তাহার জীবনের গতি বন্ধ করে নাই, সর্বদাই সে জীবন্ত। তাহার জীবনে মাত্র একবার সুযোগ আসে না, শত শত সুযোগ তাহার সম্মুখে বর্তমান।”
মিষ্টার সি, জে, স্মিথ গত ৪০ বৎসর ধরিয়া অনেক বড় বড় কাজ করিয়াছেন। তিনি সম্প্রতি (১৯৩১) ৬৯ বৎসর বয়সে ‘ক্যানাডিয়ান ন্যাশন্যাল রেলওয়ের’ ভাইস প্রেসিডেণ্টের পদ হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহার সারগর্ভ অভিমত পর পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত হইল।
“কানাডাতে গ্রীষ্মের ছুটীর সময় বালকদিগকে, ভবিষ্যতে যে বৃত্তি সে অবলম্বন করিবে, তাহা হাতে কলমে শিক্ষা করিবার সুযোগ দেওয়া হয়। আমার মতে এই রীতি ভাল। ইহার ফলে সে সব দিক হইতে বিষয়টি শিখিতে পারে।
“আমি যখন যুবক ছিলাম, তখন গল্ফ বা বিলিয়ার্ড খেলা ছিল না। এবং ৩০ বৎসর বয়সে আমি যখন ‘সভ্যতার’ সংস্পর্শে আসিলাম, তখন আমি পুল বা গল্ফ খেলা জানিতাম না।”
যাঁহারা সামান্য অবস্থা হইতে স্বীয় চেষ্টায় জীবনের নানা বিভাগে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করিয়াছেন, এরূপ বহু ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ইতিপূর্বে আমি দিয়াছি। চারজন প্রসিদ্ধ জননায়কের প্রথম জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়া আমি এই অধ্যায় শেষ করিব।
মিঃ র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড এইভাবে তাঁহার প্রথম জীবনের বর্ণনা করিয়াছেন (২৬শে নবেম্বর, ১৯৩১ তারিখে প্রদত্ত বক্তৃতা):—“অতীত জীবনের ঘটনা স্মরণ করিলে বিস্মিত হইতে হয়। কয়েক বৎসর পূর্বে লসিমাউথের জনৈক বৃদ্ধা ধীবররমণী আমাকে দেখিয়া তাহার সরল সহানভূতিপূর্ণ স্বরে বলিয়াছিল—‘জিমি, পৃথিবীতে এমনই আশ্চর্য ঘটনা ঘটে!’”
“জীবনের সহজ সুগম সদর রাস্তা দিয়া না গিয়া যদি দুর্গম কর্দমাক্ত সঙ্কীর্ণ পথে চলা যায়, তবে মানব জীবনের সুখ দুঃখ, উন্নতি অবনতি, ত্যাগ ও আনন্দ, সব অবস্থারই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ হয়।”
মিঃ ম্যাকডোনাল্ড তাঁহার বাল্য স্মৃতি হইতে দুইটি ঘটনার উল্লেখ করেন। “শীতের প্রভাত, তুষার পাত হইতেছে। অন্ধকার থাকিতে আমরা উঠিয়াছি এবং তুষারাবৃত পথে প্রায় এক মাইল পদব্রজে গিয়াছি। আমরা একটি আলুর ক্ষেতে গেলাম। সেখানে যন্ত্রযোগে মাটীর নীচ হইতে আলু তোলা হইতেছে, আমি একটি ঝুড়িতে আলু সংগ্রহ করিতেছি। দুই হাত তুষার-হিম হইয়া গিয়াছে, চোখের জল রোধ করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। আমাদের সকলের উপরে যে সর্দার সে আমার কাছে আসিল, আমার তুষার-হিম কর্ণমূলে চপেটাঘাত করিল। সেই কথা স্মরণ করিতেই এখনও যেন আমি শরীরে বেদনা বোধ করি। অনেক সময় পার্লামেণ্টে গবর্ণমেণ্টের পক্ষীয় সম্মুখের আসনে বসিয়া ঐ অতীত কাহিনী এখনও আমার মনে ভাসিয়া আসে।”
মিঃ ম্যাকডোনাল্ড তাঁহার বাল্যস্মৃতিতে একজন সেকেলে লোকের কথা বলিয়াছেন। তিনি লসিমাউথের রাস্তায় ঠেলাগাড়ীতে ফেরী করিয়া বেড়াইতেন। “তাঁহার গাড়ীর সম্মুখে এক খণ্ড ট্যাসিটাসের বই থাকিত। তিনি লাটিন ও গ্রীক বই পড়িতেন আর সঙ্গে সঙ্গে জিনিষের নাম হাঁকিতেন। একদিন তিনি আমার হাতে একখানি বই দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি এ সব পড়িতে ভালবাস?’ এবং আমার হাতে একখানি হেরোডোটাসের ইতিহাস দিলেন। পরে কয়েকমাস যাবৎ তিনি আমাকে আরও কতকগুলি বই দিয়াছিলেন।”
আর একজন শ্রমিক নেতা জর্জ ল্যান্সবেরী সম্প্রতি (ডিসেম্বর, ১৯৩১) তাঁহার বাল্যজীবনের কথা এবং কিভাবে তাঁহাকে কঠোর জীবনসংগ্রাম করিতে হইয়াছিল, তাহার বর্ণনা করিয়াছেন। দুই একটি স্থান উদ্ধৃত করিতেছি।
“আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুতর ঘটনা (রাজনৈতিক ব্যাপার ব্যতীত) ১৮৮৪-৮৫ সালে ঘটে। সেই সময়ে আমি স্ত্রী, ৪ বৎসরের কম বয়স্ক তিনটি শিশু এবং ১১ বৎসরের কম বয়স্ক একটি ছোট ভাইকে সঙ্গে লইয়া দেশ ছাড়িয়া অস্ট্রেলিয়াতে যাত্রা করি।
“অবশেষে একটা পাথর ভাঙ্গার কাজ আমি পাইলাম; একরকম নীল রঙের গ্র্যানাইট পাথর—উহাতে যখন হাতুড়ী পিটাইতাম, তখন মনে হইত আমার হাতের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ও বুঝি ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে।
“পরে পার্সেল বিলি করিবার জন্য পিয়নের কাজ পাইলাম। তারপর যত দিন আমি অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম, ঐ কাজই করিতাম, আমার বেতন ছিল সপ্তাহে পাঁচ শিলিং, ব্রিসবেন হইতে পাঁচমাইল দূরে টুঅং নামক স্থানে থাকিবার জন্য একটি বাড়ীও পাইলাম।
প্রবল বর্ষার ধারা
“আমার প্রথম রাত্রির কাজ, খুব উত্তেজনাপূর্ণ হইয়াছিল। পার্সেলের গাড়ী খোলা ছিল এবং প্রবল বেগে বর্ষা আসিল। আমাকে বিভিন্ন বাড়ীতে ২০০টি পার্সেল বিলি করিতে হইবে, অথচ আমি একটি বাড়ীরও ঠিকানা জানি না। আমি সন্ধ্যা ৬টার সময় রওনা হইলাম এবং ভোর ৪টার সময় শেষ পার্সেল বিলি করিয়া ফিরিলাম। সকলেই ভাবিয়াছিল, আমি নূতন লোক, সুতরাং এ কাজ করিতে পারিব না। কিন্তু এই ভাবে কাজ সুসম্পন্ন করাতে কার্যে আমার বেশ নাম হইল এবং আমি ছয় মাস সেখানে কাজ করিলাম।
“কাজের সম্বন্ধে বেশী কিছু বলিবার নাই। তবে পরিশ্রম একটু বেশী হইত। প্রায়ই সকাল বেলা ৮টা হইতে পরদিন বেলা ১২টা কি ১টা পর্যন্ত কাজ করিতে হইত।”
মুসোলিনীর জীবনীতে আমরা পড়ি:—
“রাজমিস্ত্রীর মজুরের কাজে তিনি দেশময় ঘুরিয়া বেড়াইতেন। সুইজারল্যাণ্ডে বেশী শীত পড়াতে বাড়ী তৈরীর কাজ বন্ধ হইয়া যায়। মুসোলিনী সেই অবসর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সান্ধ্য বিদ্যালয়ে পড়িতে লাগিলেন। সুইজারল্যাণ্ডের ন্যায় স্কটল্যাণ্ডেও বাড়ী তৈরীর কাজে নিযুক্ত যুবকদের শীতকালে কোন কাজ থাকে না। সেই সময়ে তাহারা মুসোলিনীর মতই স্কুলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে। আমি যখন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম তখন এইরূপ ছাত্রকে সেখানে দেখি। কিন্তু মুসোলিনী আমার স্বদেশবাসীর চেয়ে অধিকতর কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন, কেন না তিনি শ্রমের কাজ একেবারে ত্যাগ করেন নাই, তিনি কখনও কখনও দোকানদারদের দারোয়ান বা সংবাদবাহকরূপে কাজ করিতেন। তাহাদের মালপত্র ক্রেতাদের বাড়ীতে ঘাড়ে করিয়া বা বাক্সে ঝুলাইয়া লইয়া যাইতেন। জিনিষ বেশী ভারী হইলে কিংবা ক্রেতাদের বাড়ী একটু দূর হইলে ঠেলাগাড়ীতেও লইয়া যাইতেন। এইভাবে যাহা উপার্জন করিতেন, তাহাতে তাঁহার বিদ্যালয়ের বেতন এবং ছাত্রাবাসের ব্যয় নির্বাহ হইত।”—Robertson, Mussolini, pp. 49-50.
ম্যাসারিক সম্বন্ধে তাহার জীবনীকার মিঃ স্ট্রীট লিখিয়াছেন—
“এই সময়ে (১৮৬৮-৬৯) তাঁহার বাল্য জীবনে তাঁহাকে নিজের এবং তাঁহার এক ভ্রাতার ভরণপোষণের জন্য অর্থোপার্জন করিতে হইত, সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ে পড়াশুনাও করিতে হইত। তাঁহার মাতা মাঝে মাঝে তাঁহাকে হয়ত কয়েক ফ্লোরিন (মুদ্রা) পাঠাইতেন। কিন্তু অন্যের নিকট হইতে তাঁহার আর কোন সাহায্য প্রাপ্তির আশা ছিল না। তাঁহাকে নিজের উপরই সম্পর্ণরূপে নির্ভর করিতে হইত।
“তিনি প্রথমতঃ নোভা ইউলিসের একজন মুচির বাড়ীতে থাকিতেন। তাঁহার সঙ্গে আরও কয়েকজন তাঁহারই মত দরিদ্র ছাত্র থাকিত। তাহাদের থাকা, খাওয়া, জলখাবার এবং কাপড় কাচার জন্য প্রত্যেক ছাত্র মাসে তিন শিলিং করিয়া দিত। মুচির বাড়ীতে কিরূপ অবস্থায় বাস করিতে হইত, তাহা অনুমানেই বুঝা যাইতে পারে, কিন্তু ম্যাসারিক ও অন্যান্য বালকেরা উহারই মধ্যে সানন্দে কালযাপন করিতেন।”
আর একটি দৃষ্টান্ত লর্ড রিডিংএর জীবন। তিনি প্রথমবার জাহাজের ছোকরা বা ‘ক্যাবিন বয়’ রূপে কলিকাতায় আসেন, দ্বিতীয় বার আসিয়াছিলেন ভারতের বড়লাটরূপে।
ইউরোপ ও আমেরিকাতে শ্রমের মর্যাদা এইরূপে শ্রদ্ধা ও সম্মানের জিনিব, কিন্তু ভারতে তাহার বিপরীত ভাব। বিশেষতঃ যে সব বালক ও যুবক স্কুল কলেজে পড়ে, তাহারা শ্রমকে হেয় জ্ঞান করে। ভূতপূর্ব স্কুল সমূহের ইনস্পেক্টর মৌলবী আবদুল করিম এ সম্পর্কে ব্যথিত চিত্তে লিখিয়াছেন:—
“মফঃস্বল ভ্রমণের সময় বাখরগঞ্জ জেলার একটি স্কুল পরিদর্শন করিতে গিয়া আমি দেখি অর্থ ও ছাত্রাভাবে স্কুলটি উঠিয়া যাইবার উপক্রম। আমি স্থানীয় মাতব্বর লোকদের অনুরোধ করিলাম তাঁহারা যেন আমার সঙ্গে আমার নৌকায় গিয়া দেখা করেন। তাঁহারা গেলে, আমি তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া বলিলাম যে স্কুলটি রক্ষার জন্য তাঁহাদিগকে অর্থ সাহায্য করিতে হইবে এবং ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করিয়া দিতে হইবে। এই সময়ে আমি শুনিলাম একজন নিম্নস্বরে বলিতেছেন, স্কুলটি উঠিয়া গেলে তিনি হরিলুট দিবেন। ভদ্রলোকেরা চলিয়া গেলে, আমি স্থানীয় পুলিশের দারোগাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তাঁহারা স্কুলের উপর এমন বিরক্ত কেন দারোগা যাহা বলিলেন, তাহাতে আমি বুঝিতে পারিলাম, গ্রামের লোকদের স্কুলের উপর বিরক্ত হইবার যথেষ্ট কারণ আছে। স্থানটিতে অনেক ছোট ছোট দোকানদারের বাস। তাহারা চায়, তাহাদের ছেলেরা দোকানের জিনিষ বিক্রয় ও হিসাবপত্র রাখার কাজে সাহায্য করুক। কিন্তু যেই ছেলেরা স্কুলে ভর্তি হয়, অমনি তাহাদের ‘চাল’ বাড়িয়া যায় এবং এই ভাব দেখায় যে লেখা পড়া জানা লোকের পক্ষে দোকানদারী ছোট কাজ। এই ঘটনা হইতে এবং পরে আরও অনুসন্ধান করিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, গ্রামে স্কুল থাকায় অনেক স্থলে কৃষকদের পক্ষে বিরক্তি ও অসুবিধার কারণ হইয়াছে। ‘গুরুর’ অনুরোধে ও বালকদের আগ্রহে অনেক সময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও কৃষকরা ছেলেদের স্কুলে পাঠাইতে বাধ্য হয়। কিন্তু স্কুলে ঢুকিয়াই ছেলেরা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির হইয়া যায়। তাহাদের ধরণ ধারণ, অভ্যাস, রুচি সব বদলাইয়া যায়, এমন কি অনেক সময় নাম পর্যন্ত বদলাইয়া ফেলে।
“তাহাদের পিতামাতা কেবল যে তাহাদের নিকট হইতে গরু চরানো, চাষের কাজ ইত্যাদির সাহায্য হইতেই বঞ্চিত হয়, তাহা নহে, তাহাদের জন্য ভাল কাপড় চোপড়, ছাতা, বহি, খাতাপত্র ইত্যাদি যোগাইতে বাধ্য হয়। এই সব ব্যয় করা অনেক সময় তাহার সাধ্যাতীত। ফলে ছেলে পরিবারের বোঝা এবং সমাজের অভিশাপ স্বরূপ হয়। কেন না সে দলাদলি সৃষ্টি করে, মামলা মোকদ্দমা পাকাইয়া তোলে, এমন কি অনেক সময় জালজয়চুরীও শিখায়।” (Some Political, Economical & Educational Questions pp. 5-6)]। এরূপ অবস্থা প্রত্যেক দেশহিতকামী ব্যক্তিকে হতাশ করিয়া তুলিবে। আমাদের বুঝিবার সময় আসিয়াছে যে, যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফলে গ্রামের উপর অবজ্ঞা জন্মে, সেগুলি দেশের পক্ষে কল্যাণকর নহে, বরং জাতীয় উন্নতির ঘোর শত্রু স্বরূপ।
(৫) আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটী—বিদেশী
ভাষা শিক্ষার বাহন হওয়াতে বিরাট শক্তির অপব্যয়
বাঙালী ছাত্রদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিরাট শক্তির অপব্যয় হয়, তাহার কথা ভাবিলে স্তম্ভিত হইতে হয়। বালকের জীবনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ৫।৬ বৎসর কাল একটি দুরূহ বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করিতেই ব্যয় করিতে হয়, কেন না ঐ ভাষার মধ্য দিয়াই তাহাকে অন্যান্য বিষয় শিখিতে হইবে। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এরূপ অস্বাভাবিক ও ঘোর অনিষ্টকর ব্যবস্থা নাই। মাতৃভাষাই সব সময়ে শিক্ষার বাহন হওয়া উচিত। এই স্বতঃসিদ্ধ সহজ সত্য ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন নাই। একজন ইংরাজ বা স্কচ বালক ডিকেন্সের Child’s History of England, স্কটের Tales of a Grand father, Gulliver’s Travels অথবা Alice in Wonderland গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়ে। তাহার পিতামাতার নিকট হইতেও সে অনেক বিষয় শিখে। সে ভ্রমণ বৃত্তান্ত, উত্তর মেরুর অভিযানের বিবরণ, কিলিমানজারো, আণ্ডিস অথবা হিমালয় পর্বত শিখরে আরোহণের কাহিনী সাগ্রহে পড়ে, তাহার নির্দিষ্ট পাঠ্য পুস্তকে এ সব নাই, একথা তাহাকে বলিয়া দিতে হয় না। একজন ইংরাজ বালককে প্রথমে পারসী, চীনা, জার্মান অথবা রুশীয় ভাষা শিখিয়া, তাহার মধ্য দিয়া অন্যান্য বিষয় শিখিতে হইতেছে, এরূপ ব্যাপার কেহ কল্পনা করিতে পারেন কি? কাহারও নানা বিষয়ে জানা শোনা আছে, এরূপ বলিলে বোঝা যায় না, কোন্ ভাষার সাহায্যে সে ঐ সব বিষয় শিখিয়াছে। আমরা অন্ধ ভাবে একটা অনিষ্টকর ব্যবস্থা অনুসরণ করিতেছি, এবং ইহার ফলে আমাদের ছেলেদের যথার্থ শিক্ষা ও জ্ঞানলাভে প্রবল অন্তরায় সৃষ্টি হইতেছে।[১৫]
প্লেটো, হেগেল ও কাণ্ট, কনফিউসিয়াস্ ও মেনসিয়া, বাইবেল ও কোরান, রামায়ণ ও মহাভারত—এখনও প্রায়ই লোকে অনুবাদের সাহায্যে পড়ে। ভাষাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিত ব্যতীত কেহ মূল ভাষায় গ্রন্থ পড়িবার জন্য গ্রীক, জার্মান, চীনা, হিব্রু, আরবী বা সংস্কৃত শিখে না। এমন কি হিন্দুরাও সাধারণতঃ রামায়ণ মহাভারত তুলসীদাস, কৃত্তিবাস ও কাশীরামের অনুবাদের মধ্য দিয়া পড়ে। কিন্তু ভারতে আমরা একটা কৃত্রিম অস্বাভাবিক ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছি এবং তাহার জন্য শাস্তিভোগও করিতে হইতেছে।
ইতিহাস, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, পাটীগণিত, স্বাস্থ্যতত্ত্ব, প্রাথমিক বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি বাংলা ভাষার মধ্য দিয়াই অনায়াসে শিখানো যাইতে পারে। ইংরাজীকে দ্বিতীয় ভাষার পর্যায়ে রাখা উচিত।
যাহারা পণ্ডিত হইতে ইচ্ছা করে, তাহারা কেবল ইংরাজী নয়, জার্মান ও ফ্রেঞ্চও শিখিবে। তবে ইংরাজীকে কোন ক্রমেই শিক্ষার বাহন করা উচিত নয়। শিক্ষিত ব্যক্তিকে মোটামুটি সমস্ত বিষয়ের সাধারণ জ্ঞান লাভ করিতে হইবে এবং মাতৃভাষার সাহায্যেই সে সহজে এবং অল্প সময়ের মধ্যে এই জ্ঞান লাভ করিতে পারে। জীবনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সময়ে আমাদের ছেলেদের সময় ও শক্তির কিরূপ বিষম অপব্যয় হয়, তাহা নিম্নলিখিত তথ্যগুলি হইতেই বুঝা যাইবে। ১৯৩০—৩১ সালে কতজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এ, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহা এই তালিকায় দেওয়া হইয়াছে।
বিষয় ... |
পঞ্চম বার্ষিক শ্রেণী |
৬ষ্ঠ বার্ষিক শ্রেণী |
ইংরাজী | ১১৯ | ১১২ |
গণিত | ৩৬ | ২১ |
দর্শন | ৩৬ | ২৬ |
ইতিহাস | ৫৫ | ৪৪ |
অর্থনীতি | ১১৬ | ৯২ |
বাণিজ্য | ২৩ | ২০ |
প্রাচীন ইতিহাস | ১৪ | ১৭ |
নৃতত্ত্ব | ৫ | ৬ |
পরীক্ষামূলক মনোবিদ্যা | ৪ | ৩ |
তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব | ১ | ০ |
সংস্কৃত | ১৯ | ২০ |
পালি | ২ | ২ |
আরবী | ৪ | ১ |
পারসী | ৮ | ৩ |
ভারতীয় ভাষা | ৭ | ১৮ |
মোট | ৪৪৯ | ৩৯৩ |
ছাত্রেরা এবং তাহাদের অভিভাবকগণ পাঠ্য বিষয় নির্বাচনের জন্য যে বিন্দুমাত্রও চিন্তা করেন না, এই তালিকা হইতেই তাহা বুঝা যাইতেছে। দেখা যাইতেছে, ইংরাজী ভাষার প্রতিই ছেলেদের বেশী আকর্ষণ। অথচ অবস্থা ইহার বিপরীত হওয়াই উচিত ছিল। কেননা একটা কঠিন বিদেশী ভাষার দুরূহ তত্ত্ব অধিগত করিতে যে সময় ও শক্তি ব্যয় হয়, তাহা অন্য দিকে প্রয়োগ করিলে বেশী লাভ হইত। পাঠ্য বিষয়ের গ্রন্থ তালিকা দেখিলে চক্ষু স্থির হয়। গ্রন্থকারগণ এবং তাঁহাদের কৃত গ্রন্থ তালিকা পড়িলে স্তম্ভিত হইতে হয়, উহা ক্যালেণ্ডারের সাড়ে পাঁচ পৃষ্ঠা জুড়িয়া আছে। প্রাচীন যুগ হইতে আধনিক কাল পর্যন্ত বিশাল ইংরাজী সাহিত্য ইহার অন্তর্ভুক্ত। ভিক্টোরিয়া যুগের পরবর্তী আধুনিক কালের এইচ, জি, ওয়েলস্, কনর্যাড, বার্নাড শ, আর্নল্ড, বেনেট, গল্স্ওয়ার্দি সকলেই ইহার মধ্যে আছেন।
আমি সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করি যে, এমন সব ভারতীর ছাত্র থাকিবেন যাঁহারা সমস্ত জীবন ধরিয়া ইংরাজী সাহিত্য অধ্যয়ন করিবেন। ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও জার্মানীতেও এমন অনেক ছাত্র আছেন যাঁহারা সমস্ত জীবন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করিতেছেন। ভারতীয় শ্লেগেল বা টেইনের অভ্যুদয়ে আমি আনন্দিত হইব। কিন্তু ইংরাজীতে এম, এ, উপাধি লাভের জন্য ২৩০ জন ছাত্র সময় ও শক্তি ব্যয় করিবে কেন? তাহাদের জ্ঞান পল্লব-গ্রাহিতার নামান্তর। সুতরাং একজন ইংরাজীর এম, এ, লোকের নিকট উপহাসের পাত্র হইবে, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। ঢাকা শিক্ষক ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ মিঃ ওয়েষ্ট, কৃষি কমিশনের সম্মুখে সাক্ষ্য দিবার সময় বলিয়াছেন,—“একজন এম, এ-র ইংরাজী পাঠের ক্ষমতা ১৫ বৎসরের ইংরাজ বালিকার সমান, একজন বি, এ-র ১৪ বৎসরের ইংরাজ বালিকার এবং একজন ম্যাট্রিক পাশের ১০ বৎসরের ইংরাজ বালিকার সমান।”
মিঃ ওয়েষ্ট অজ্ঞাতসারে কিছু অতিরঞ্জন করিয়া থাকিতে পারেন। কিন্তু একজন সাধারণ গ্রাজুয়েটের সম্বন্ধে তাঁহার কথা মোটের উপর সত্য।
১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে মেকলে তাঁহার ইতিহাসপ্রসিদ্ধ রিপোর্টে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন সমর্থন করেন—প্রতীচ্যবাদী এবং প্রাচ্যবাদীদের মধ্যে যে তর্ক বিতর্ক চলিতেছিল, মেকলের রিপোর্টে তাহার অবসান হয়।[১৬] মেকলেকে এজন্য নিন্দা করা হইয়া থাকে। বলা হইয়া থাকে যে, তিনি মাতৃভাষার দাবী উপেক্ষা করেন। ইহা ন্যায্য সমালোচনা বলিয়া বোধ হয় না। কেননা মেকলে নিজেই দূরদৃষ্টিবলে বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, ভারতবাসীরা পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভ করিয়া মাতৃভাষায় গ্রন্থ লিখিয়া পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান দেশবাসীর মধ্যে প্রচার করিবে।[১৭] তাঁহার ভবিষ্যৎ বাণী সফল হইয়াছে। মেকলের রিপোর্ট প্রকাশিত হইবার ২০ বৎসরের মধ্যে, এমন কি তাহারও পূর্বে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র এবং আরও অনেকে, বাংলা ভাষায় শিক্ষাপ্রদ গ্রন্থ লিখিতে আরম্ভ করেন। ঐ সকল গ্রন্থের বহুল প্রচার হইয়াছিল। একথা ভুলিলে চলিবে না, মেকলের রিপোর্ট লিখিবার ২০ বৎসর পূর্বে (১৮১৬) কলিকাতায় হিন্দু প্রধানেরা নিজেদের অর্থ সাহায্যে একটি কলেজ স্থাপন করেন। যুবকদিগকে ইংরাজী সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়াই ইহার উদ্দেশ্য ছিল। ১৮২২ খৃষ্টাব্দে রামমোহন রায় লর্ড আমহার্স্টের নিকট তেজোব্যঞ্জক ভাষায় একখানি পত্র লিখেন। ঐ পত্রে তিনি দেশবাসীকে ইংরাজী সাহিত্য এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষা দিবার সাগ্রহ অনুরোধ করেন,—উহার কতকগুলি লাইনের সঙ্গে মেকলের রিপোর্টের হুবহু মিল আছে। প্রথম ইংরাজী কবিতা লেখক বাঙালী কাশীপ্রসাদ ঘোষ, মেকলের রিপোর্ট প্রকাশিত হইবার পাঁচ বৎসর পূর্বে সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন।
প্রকৃত কথা এই যে আমাদের পূর্বপুরুষরাই ইংরাজী শিক্ষা লাভের জন্য উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করিয়াছিলেন। ১৮৪৪ খৃষ্টাব্দের ২৫শে নবেম্বর ফ্রি চার্চ ইনষ্টিটিউশান হলে একটি জনসভা হয়। তদানীন্তন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁহার একটি রিপোর্টে সরকারী কাজে “অশিক্ষিত” ভারতবাসীদের চেয়ে “শিক্ষিত” ভারতবাসীদিগকে অধিকতর সুযোগ দিবার জন্য সুপারিশ করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ দিবার উদ্দেশ্যে এই সভা আহূত হইয়াছিল। প্রথমে ইংরাজী ভাষা শিখিয়া তাহার সাহায্যে জ্ঞান আহরণ না করিলে, কেহই “শিক্ষিত” বলিয়া গণ্য হইবেন না, এস্থলে ইহাই স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছিল। এই কারণে ইংরাজী শিক্ষার উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া হইল এবং স্কুল কলেজে একটা কৃত্রিম শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত হইল। ইহার ফলে প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিক, এমন কি মাইনর স্কুলগুলি পর্যন্ত উপেক্ষিত হইয়াছে। কেবলমাত্র ম্যাট্রিক স্কুলগুলিকেই লোক পছন্দ করে, ঐগুলিই সংখ্যায় বাড়িতেছে, কেন না ঐ স্কুলে পাশ করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা যায়।[১৮]
ইংরাজী শিক্ষার প্রথম অবস্থায় ১৮৩০ হইতে ১৮৪০ সালের মধ্যে, ইংরাজী ভাষা শিক্ষার উপর জোর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, কেন না ঐ ভাষাই তখন পাশ্চাত্য বিদ্যা লাভের দ্বারস্বরপ। কিন্তু তখনও প্রত্যেক ছাত্রকে ইংরাজী ভাষার মধ্য দিয়া সর্বপ্রকার বিষয় শিখিবার জন্য বাধ্য করা উচিত হয় নাই। উহা একটি মারাত্মক ভুল হইরাছিল এবং উহার একমাত্র কারণ সরকারী চাকরী পাইবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ১৮৬০ সালে জেকোস্লোভাকিয়াতে শিক্ষিত সমাজের মানসিক অবস্থা অনেকটা এইরূপ ছিল। “ম্যাসারিকও একটি প্রসিদ্ধ জার্মান রচনাভঙ্গী শিক্ষা করিয়াছিলেন। তিনি যে এত আগ্রহের সঙ্গে জার্মান ভাষা শিক্ষার দিকে মন দিয়াছিলেন, উহা কতকটা তাঁহার প্রকৃতি বিরুদ্ধে বলিয়া মনে হইতে পারে, কেন না, অন্য দিকে আবার ‘জেক’ জাতীয় ভাব তাঁহার মধ্যে বাড়িয়া উঠিতেছিল। কিন্তু, ইহার মধ্যে বস্তুতঃ বিরোধ কিছুই নাই। জেক ভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হইত না। কেবলমাত্র সাধারণ কথাবার্তায়, বিশেষতঃ দরিদ্র ও অশিক্ষিতদের মধ্যে এই ভাষার ব্যবস্থা ছিল। ম্যাসারিককে যদি শিক্ষিত সমাজের নিকট কোন কথা নিবেদন করিতে হইত, তবে জার্মাণ ভাষার আশ্রয় লইতে হইত,—সমগ্র বোহিমিয়া ও মোরেভিয়া দেশে এই জার্মান ভাষা প্রচলিত ছিল। অনেকেই তখন ভাবিতে পারেন নাই যে, উত্তরকালে এই জার্মান ভাষা শিক্ষার ফলেই, ‘জেক’ জাতি তাহাদের মাতৃভাষাতেই আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় সক্ষম হইয়াছিল।” (প্রেসিডেণ্ট ম্যাসারিক―জীবনচরিত)
মিঃ ওয়েষ্ট তাঁহার Bilingualism গ্রন্থে (বিশেষভাবে বাংলাদেশ সম্বন্ধে) এই বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছেন। তাহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত হইল।
“যে দেশের বিদ্যালয়ে দুইটি ভাষা শিখিতে হয় এবং যে দেশে মাত্র একটি ভাষা শিখিতে হয়, এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। শেষোক্ত দেশে, যে অল্পসংখ্যক ছেলেমেয়ের ভাষা শিক্ষার প্রতিভা আছে, অথবা ঐশ্বর্য ও অবসর আছে, কেবল তাহারাই স্বেচ্ছায় কোন বিদেশী ভাষা শিখে; পক্ষান্তরে, প্রথমোক্ত দেশে (দ্বৈভাষিক দেশে) প্রত্যেক সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন, এমন কি তার চেয়েও নিকৃষ্ট ছেলেমেয়েকে বাধ্য হইয়া একটি বিদেশী ভাষা শিখিতে হয়। যাহাদের ভাষা শিক্ষার প্রতিভা আছে, তাহাদিগকেও বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করিতে যথেষ্ট পরিশ্রম ও শক্তি ব্যয় করিতে হয়। সুতরাং সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন এবং ততোধিক নিকৃষ্ট ছেলে মেয়েদের পক্ষে বিদেশী ভাষা শিক্ষার চেষ্টা কি সম্পূর্ণ নিম্ফল হইবে না? বুদ্ধিমান ছাত্রের সময় ও অবসর জুটে, কিন্তু সাধারণ ছাত্রের সে অবসর কোথায়? যদিই বা কোন সাধারণ ছাত্র বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলে অন্য সমস্ত বিষয় শিক্ষা করিবার পর্যাপ্ত সময় সে পায় না। সুতরাং তাহাকে ভাষা শিক্ষা এবং জ্ঞানলাভ এই দুইটির মধ্যে একটিকে বাছিয়া লইতে হয়। হয় তাহাকে ভাষায় দরিদ্র হইতে হইবে, অথবা তাহাকে সাধারণ শিক্ষা বিষয়ে নিকৃষ্ট হইতে হইবে।
“ইংরাজী বলা, শোনা বা লেখা তাহাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় নহে, কেবলমাত্র ইংরাজী পড়িতে পারাই তাহাদের পক্ষে দরকার। কেন না ইংরাজী পড়িতে শিখিলে, ঐ ভাষায় সঞ্চিত বিরাট জ্ঞানভাণ্ডারে তাহারা প্রবেশ করিতে পারে।”
মিঃ এফ. জে. মোনাহান বাংলার দুইটি বিভাগে কমিশনারের কার্য করিয়াছেন। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় এবং গভীর জ্ঞান আছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিশনের সম্মুখে সাক্ষ্য দিতে গিয়া তিনি বলিয়াছেন:
“আমার মনে হয়, যে সব ইংরাজ স্কুল কলেজে ইংরাজী ভাষাকে শিক্ষার বাহন রাখিবার পক্ষপাতী তাঁহাদের মধ্যে অনেকে সাম্রাজ্যবাদের ভাবের দ্বারা প্রভাবাম্বিত। ইংরাজী ভাষাকে সাম্রাজ্যের মধ্যে ঐক্যসূত্ররূপে তাঁহারা গণ্য করেন;—এই ভাষাই ভারতের সর্বত্র সাধারণ ভাষা হইয়া উঠিবে, এমন স্বপ্নও তাঁহারা দেখেন।
* * * “বহু, দৃষ্টান্ত হইতে বুঝা যায় যে, শিল্প বাণিজ্যে সাফল্য লাভ করিতে হইলে ইংরাজী ভাষার জ্ঞান অতি সামান্যই প্রয়োজন। এমন কি সেজন্য বেশী কিছু শিক্ষারই প্রয়োজন নাই। বড়বাজারের ক্রোরপতি মাড়োয়ারী বণিক ইংরাজী শেখা প্রয়োজন বোধ করেন নাই; কিন্তু তিনি ইংরাজীতে চিঠিপত্রাদি লিখিবার জন্য মাসিক ৪০৲ টাকা বেতনে একজন বি. এ. পাশ বাঙালীকে নিযুক্ত করেন। ইংরাজী ভাষার সহিত ভাল সাধারণ শিক্ষা ভারতবাসীর পক্ষে জীবনের নানা ক্ষেত্রে সুবিধার বটে; কিন্তু যদি বহুসংখ্যক ভারতবাসীকে শিল্প বাণিজ্যে দক্ষ করিয়া তুলিতে হয়, তাহা হইলে সম্ভবতঃ নিম্নলিখিত প্রণালীই উৎকৃষ্ট হইবে। ছেলেরা যত শীঘ্র সম্ভব স্কুলে কাজ চালানো গোছের কিছু ইংরাজী, সঙ্গে সঙ্গে অঙ্ক ও হিসাবপত্র রাখা শিখিবে, তারপর অল্প বয়সেই তাহাদিগকে কোন বাণিজ্য বা শিল্প ব্যবসায়ে শিক্ষানবীশ করিয়া দিতে হইবে।
“আমার মনে হয়, ভারতবর্ষের মত দেশে, যেখানে বহু বিচিত্র জাতি, ভাষা, সভ্যতা, আদর্শ, ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্র বিদ্যমান, সেখানে বিদেশী ভাষার মধ্য দিয়া একই প্রণালীতে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা মহা ভ্রম। তার পর সর্ব শ্রেণীর সরকারী চাকরী এবং ওকালতী, ডাক্তারী প্রভৃতি ব্যবসায়ে প্রবেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিকেই একমাত্র উপায় রূপে নির্দিষ্ট করা আরো ভুল। মধ্যবিত্ত ও উচ্চশ্রেণীর ভারতবাসীদের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা দিয়াছে, তাহার অনেকটা এই কারণ হইতেই উদ্ভূত বলিয়া আমার বিশ্বাস। আমার প্রস্তাব এই যে, সরকারী চাকরীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাকে আর একমাত্র যোগ্যতা রূপে গণ্য করা হইবে না, অবশ্য, যে সব কাজের জন্য টেকনিক্যাল বা বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন, সেগুলির কথা স্বতন্ত্র। পক্ষান্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকেও উদারতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। যে কলেজ বা উচ্চশ্রেণীর প্রতিষ্ঠান বিবিধ বিষয়ে শিক্ষা দিবে, সেগুলিকে ইহার অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে, বিভিন্ন শ্রেণীর ভাষাকে শিক্ষার বাহন রূপে স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল দেখিবেন যে, শিক্ষার আদর্শ ঠিক আছে কিনা। অধিকাংশ ছাত্রের পক্ষে মাতৃভাষাই উপযুক্ত শিক্ষার বাহন হইবে; কাহারও কাহারও পক্ষে অবশ্য ইংরাজী ভাষাও শিক্ষার বাহন হইতে পারে।”
১৯২৬ সালে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাধি বিতরণের সময় আমি যে বক্তৃতা দিয়াছিলাম তাহার কিয়দংশ এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করিতেছি।
“ভারতে যে শিক্ষা প্রণালী বর্তমানে প্রচলিত, তাহা পরীক্ষা করিলে বলিতে হইবে, আমাদের সর্ব প্রথম অপরাধ বিদেশী ভাষাকে শিক্ষার বাহন করা। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমাদের শিক্ষানীতির এই গুরুতর ভ্রম—যাহা আমাদের বুদ্ধি ও প্রতিভার বিকাশের পথ রুদ্ধ করিয়াছে—আমরা অতি অল্প দিন পূর্বেই আবিষ্কার করিয়াছি। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এখনও পর্যন্ত, আমাদের কোন কোন সুপরিচিত শিক্ষা ব্যবসায়ী মনে করেন যে ইংরাজী ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার শ্রেণীতে গণ্য করিলে, তাহার ফল ঘোর অনিষ্টকর হইবে। যাহাতে কাহারও মনে কোন ভ্রান্ত ধারণা না হইতে পারে, সেজন্য পরিষ্কার করিয়া বলা প্রয়োজন যে ইংরাজী বা অপর কোন বিদেশী ভাষা শিক্ষার প্রতি আমি উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছি না; কেননা, ঐ সব ভাষা শিক্ষার ফলে জ্ঞানের নূতন দ্বার খুলিয়া যায়। শিক্ষিত ব্যক্তিকে প্রথমতঃ সব বিষয়ের মোটামুটি জ্ঞান লাভ করিতে হইবে এবং মাতৃভাষার সাহায্যেই এই শিক্ষা যথাসম্ভব কম সময়ে উত্তমরূপে হইতে পারে। পাটীগণিত, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, তর্কশাস্ত্র এবং ভূগোল মাতৃভাষার সাহায্যেই সহজে শিক্ষা করা যাইতে পারে। উচ্চতর শিক্ষার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার ইহাই সর্বোৎকৃষ্ট উপার।”
বাংলার “দ্বৈভাষিক শিক্ষা” সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ জনৈক শিক্ষাব্যবসায়ী এবিষয়ে নিম্নলিখিত অভিমত আমার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন।:—
বিদেশী ভাষা শিক্ষা পরে আরম্ভ করিতে হইবে
“আমার বিশ্বাস, বিদেশী ভাষা শিক্ষায় এদেশে এত অধিক শক্তি ও সময় ব্যয় হওয়ার কারণ এই যে ছেলেমেয়েরা অতি অল্প বয়সেই বিদেশী ভাষা শিখিতে আরম্ভ করে। সাধারণের একটা ধারণা আছে যে, যত অল্প বয়সে বিদেশী ভাষা শিখিতে আরম্ভ করা যায়, ঐ ভাষা তত বেশী আয়ত্ত হয়। আট বৎসর বয়সের নীচে একথা খাটিতে পারে, ছোট শিশু একজন বয়স্ক লোকের চেয়ে শীঘ্র বিদেশী ভাষা মুখে মুখে শিখিয়া ফেলিতে পারে। কিন্তু এই অল্প বয়সে এরূপ দ্বৈভাষিক শিক্ষার ব্যবস্থায় মাতৃভাষা শিক্ষার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু যেখানে ছেলেমেয়েরা বাড়ীতে বিদেশী ভাষা শুনে না, অথবা যেখানে তাহারা ৮।৯ বৎসর বয়সে পাঠ্য বিষয় রূপে স্কুলে উহা পড়িতে আরম্ভ করে, সেখানে এই যুক্তি খাটে না। বিদেশী ভাষা শিক্ষা আরম্ভ করিবার উপযুক্ত সময় ১২ বৎসর হইতে ১৪ বৎসর বয়সের মধ্যে, কেননা ঐ বয়সে ছাত্রেরা প্রায় মাতৃভাষা আয়ত্ত করিয়া ফেলে, ব্যাকরণের মূল সূত্র জানিতে পারে এবং কোন বিষয় অধ্যয়ন করিবার উপযুক্ত মনের বিকাশ তাহাদের হয়। বিশেষতঃ, ১৪ বৎসর বয়স হইলে, বুঝিতে পারা যায়, ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাহাদের বিদেশী ভাষা শিক্ষার যোগ্যতা আছে, অথবা ঐ ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না।
“বর্তমানে আমরা অসংখ্য ছাত্রকে ইংরাজী শিখাইয়া থাকি,—উহাদের মধ্যে অনেকের পক্ষে ঐ ভাষা কোন প্রয়োজনেই লাগিবে না। অনেকের ঐ ভাষা আয়ত্ত করিবার মত মেধা নাই। ছাত্র সংখ্যাও এত বেশী যে, আমরা প্রয়োজনানুরূপ যোগ্য শিক্ষক পাই না। সুতরাং শিক্ষা ভাল হয় না। ক্লাসের ছাত্র সংখ্যার উপরে ভাষা শিক্ষা বহুল পরিমাণে নির্ভর করে। ছেলেরা কথাবার্তার মধ্য দিয়াই ভাষা শিখে। যে ক্লাসে ৬০ জন ছাত্র আছে, সেখানে প্রত্যেক ছাত্র গড়ে এক মিনিটের বেশী কথা বলিতে পারে না; উহার মধ্যে শিক্ষক যদি আধ মিনিট কথা বলেন, তবে প্রকৃত পক্ষে প্রত্যেক ছাত্র গড়ে আধ মিনিট কথা বলিতে পারে। আমার বিবেচনায়, ২৫ জনের বেশী ছাত্র কোন ক্লাসে থাকিলে, বিদেশী ভাষায় কথাবার্তা বলার কোন ভাল ব্যবস্থা হইতে পারে না, তাহাও যদি শিক্ষকের দক্ষতা থাকে। সেই রূপ, লিখিতে অভ্যাস করিয়াই লেখা শিখে। কিন্তু ভুল সংশোধন ব্যতীত লেখার কোন মূল্য থাকে না। ক্লাসের ছাত্র সংখ্যা যদি কম না হয় এবং ছাত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা যদি না থাকে, তাহা হইলে ছাত্রদের লেখা খাতা এত বেশী হয়, যে তাহা সংশোধন করিবার সময় শিক্ষকের থাকে না। বিশেষতঃ নিকৃষ্ট ছাত্রেরা এত বেশী ভুল লিখে যে, তাহা সংশোধন করিতেই শিক্ষকের অনেক বেশী সময় অপব্যয় হয়। আমার বিশ্বাস, এদেশে শিক্ষা সংস্কারের একটা প্রথম ও প্রধান উপায় মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। যে সমস্ত ছাত্র এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবে, কেবল তাহাদিগকেই ইংরাজী বলিতে ও লিখিতে শিখানো হইবে।”
(৬) বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ কার্য
কেহ কেহ মনে করিতে পারেন যে, আমি সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বিরূদ্ধেই প্রচার করিতেছি। আমার উদ্দেশ্য মোটেই সেরূপ নয়। আমাদের যুবকদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিলাভের জন্য যে অস্বাভাবিক উন্মত্ততা দেখা যাইতেছে, তাহার বিরূদ্ধেই আমার অভিযোগ। আমি চাই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষালাভের জন্য বাছাই করিয়া খুব অল্প সংখ্যক ছাত্র প্রেরিত হইবে। যাহার ভিতরে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য প্রেরণা নাই তাহার কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া উচিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পাণ্ডিত্য, গবেষণা ও উচ্চতর সংস্কৃতির কেন্দ্র স্বরূপ হইবে। যাহারা জ্ঞানান্বেষণের জন্য সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত, তাহারাই যেন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়।
অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাক্সি তাঁহার Dangers of Obedience গ্রন্থে বলেন:—
“অধ্যাপক তাঁহার বক্তৃতায় যদি কেবল পুঁথি পড়া বিদ্যা উদ্গীরণ করেন, তবে তাহাতে আমার কোন প্রয়োজন নাই।
“যদি ছাত্রেরা নিজেদের মধ্যে অধীতব্য বিষয় লইয়া সাগ্রহে আলোচনা করিতে না শিখে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হইল। আর যদি শিক্ষার ফলে মহৎ গ্রন্থ সমূহ পড়িবার প্রবৃত্তি তাহাদের না জাগে তবে সে শিক্ষাও নিষ্ফল।
“ছাত্র যদি সংক্ষিপ্তসার পড়িয়াই সন্তুষ্ট হয়, তবে বুঝিতে হইবে যে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দর মহলে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া চলিয়াছে; সে কেবল তথ্য গলাধঃকরণ করিয়াছে, কিন্তু হজম করিতে পারে নাই।
“মহৎ শিক্ষকের সংখ্যা মনুষ্য সমাজে বিরল।
“অধ্যাপকের বক্তৃতা, সমালোচনা, তর্ক বিতর্ক প্রতি বৎসর একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এগুলি স্বভাবতঃই শিখিয়া ফেলে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অনেক সময় এই অভিযোগ করা হয় যে, আমাদের আশার স্থল তরুণ যুবকেরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা পার হইয়া বাহিরে আসে তখন তাহারা নিজেদের জীবিকা অর্জন করিতে পারে না। এরপ হওয়ার কারণ, এতকাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি এবং প্রতিযোগিতা সরকারী চাকরী ও ডাক্তারী, ওকালতী প্রভৃতি ব্যবসায়ে প্রবেশ লাভের উপায় স্বরূপ ছিল। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি যে, এক্ষেত্রে চাহিদা অপেক্ষা যোগানো মালের সংখ্যা শতগুণ, সহস্রগুণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। কাজেই প্রধানতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-প্রণালীর বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাইতেছে। এ কথা আমরা প্রায়ই ভুলিয়া যাই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্য উদার শিক্ষা দেওয়া, যাহার ফলে তাহাদের জ্ঞাননেত্র উম্মীলিত হইবে এবং মনের সঙ্কীর্ণতা দূর হইবে। সাধারণ বিষয়ী লোকেরা এই সঙ্কীর্ণতা অতিক্রম করিতে পারে না।
ল্যাক্সি বলিতেছেন:—“আণ্ডারগ্রাজুয়েটদিগকে সমস্ত তথ্যের আধার করিয়া তোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়। মানুষকে ইহা নানা কাজে বিশেষজ্ঞ করিয়া তুলিতেও পারে না। তথ্যসমূহ কিরূপে সত্যে পরিণত হয়, তাহাই শিখানো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ।.......ইহা মনকে এমনভাবে গঠন করে যাহার ফলে ছাত্রেরা তথ্যসমূহ যথার্থরূপে বিচার বিশ্লেষণ করিয়া সত্যে উপনীত হইতে পারে। নূতনকে গ্রহণ করিবার শক্তি, জ্ঞানলাভের স্পৃহা; সংযম ও ধীরতা—ইহাই শিখানো বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য। যদি কোন ছাত্র এই সমস্ত গুণ লইয়া কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে পারে, তবেই বুঝিবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তাহার পক্ষে ব্যর্থ হয় নাই।”
কার্ডিন্যাল নিউম্যান যথার্থই বলিয়াছেন;—“জ্ঞানই মনের প্রসারতার একমাত্র উপায় এবং জ্ঞান দ্বারাই ঐ প্রসারতা লাভ করা যায়।” (Idea of A University.)
“যে সংস্কৃতি প্রজ্ঞার উপর প্রতিষ্ঠিত, তাহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য; এই প্রজ্ঞার অনুশীলনই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ।”
“জ্ঞানানুশীলনের উদ্দেশ্যই জ্ঞানলাভ। মানুষের মনের গঠন এমনই যে, জ্ঞানলাভই জ্ঞানের পুরস্কাররূপে গণ্য হইতে পারে।”
বহু প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ও ব্যবসায়ীর উক্তি হইতে বুঝা যাইবে যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রণালীর সংস্কারের প্রয়োজন কত গুরুতর। এডিসন বলিয়াছেন,— “সাধারণ কলেজ গ্রাজুয়েটদের জন্য এক পয়সাও দিতে আমি প্রস্তুত নহি।” “যে কেবল ইতিহাসের পাতার কয়েকটি তারিখ মুখেস্থ করিয়া রাখিয়াছে, সে শিক্ষিত ব্যক্তি নহে; যে নিজে কোন কাজ সসম্পন্ন করিতে পারে, সেই শিক্ষিত ব্যক্তি। যতই কলেজের উপাধি লাভ করুক না কেন, যে চিন্তা করিতে পারে না, তাহাকে শিক্ষিত ব্যক্তি বলা যায় না।” (হেনরী ফোর্ড)
সম্প্রতি ল্যাক্সি প্রায় এইরূপ ভাষাতেই অনরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন:—“কারখানার প্রণালীতে শিক্ষাদানের একটা রীতি আছে। এই উপায়ে হাজারে হাজারে ‘শিক্ষিত ব্যক্তি’ তৈরী করা যাইতে পারে। কিন্তু চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মন তৈরী করাই যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তবে এ উপায় বিপজ্জনক।”
এই “দলে দলে গ্রাজুয়েট সৃষ্টি” সম্বন্ধে মুসোলিনী বলিয়াছেন:—
“শিক্ষার জন্য যোগ্য ছাত্র নির্বাচন এবং বৃত্তি শিক্ষার ভাল ব্যবস্থা আমাদের নাই। আমাদের শিক্ষার ঘানি হইতে একই ধরণের ছাত্র দলে দলে বাহির হইতেছে এবং তাহারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারী চাকরী গ্রহণ করিয়া জীবন শেষ করিতেছে। এই সব ব্যক্তিদের দ্বারা সরকারী চাকরীর আদর্শ পর্যন্ত নীচু হইয়া পড়ে। আইন ও চিকিৎসা নামধেয় তথাকথিত ‘স্বাধীন ব্যবসায়ে’ বিশ্ববিদ্যালয় আর কতকগুলি পুতুল তৈরী করে।”
“জাতীয় জীবনের উপর যাহার এমন অসাধারণ প্রভাব সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে নূতন করিয়া গড়িবার সময় আসিয়াছে।” (আত্মজীবনী)
“গ্রন্থ-সংগ্রহই এ যুগের যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয়”—কার্লাইল তাঁহার The Hero as Man of Letters নামক নিবন্ধে এই কথা বলিয়াছেন।
মিঃ এইচ, জি, ওয়েল্স, এই কথাটিরই[১৯] বিস্তৃত ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেন:—
“অধ্যাপকের বক্তৃতা নয়, উৎকৃষ্ট গ্রন্থসমূহকেই শিক্ষার ভিত্তি রূপে গ্রহণ করিলে, তাহার ফল বহুদূর প্রসারী হইয়া পড়ে। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে শিক্ষালাভ করিবার পুরাতন প্রথার দাসত্ব লোপ পায়। নির্দিষ্ট কোন ঘরে যাইয়া নির্দিষ্ট কোন সময়ে অধ্যাপকের শ্রীমুখ হইতে অমৃতময় বাণী শুনিবার প্রয়োজন ছাত্রদের আর থাকে না। যে যুবক কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের সুসজ্জিত কক্ষে বেলা ১১টার সময় পড়ে এবং যে যুবক সমস্ত দিন কাজ করিয়া রাত্রি ১১টার সময় গ্লাসগো সহরে কোন ক্ষুদ্র গৃহে বসিয়া পড়ে,— তাহাদের মধ্যে আর কোন প্রভেদ থাকে না।”
যদি উপযুক্ত আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া চলে,—তবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ জাতির প্রভূত হিত সাধন করিতে পারে। ষ্টীট তাঁহার “প্রেসিডেণ্ট ম্যাসারিক” গ্রন্থে এই ভাবটি বেশ পরিষ্কাররূপে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন।
“ম্যাসারিক তাঁহার নিজের অভিজ্ঞতা হইতে এবং যে সব ছাত্র পরবর্তী কালে তাঁহার নিকট পড়িয়াছিল, তাহাদিগকে দেখিয়া, শিক্ষা সম্বন্ধে অভিমত গঠন করিয়াছিলেন। বোহিমিয়ার শিক্ষা প্রণালীর বিরুদ্ধে তাঁহার প্রধান বক্তব্য এই যে, ইহার দ্বারা চরিত্রের স্বাতন্ত্র্য, আত্মজ্ঞান এবং আত্মমর্য্যাদা বোধ জন্মে না। ইহার দ্বারা পরীক্ষায় পাশ করিবার উদ্দেশ্যে পল্লবগ্রাহিতাই প্রশ্রয় পায়,—প্রকৃত জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাঁহার নিজের কথা একটু স্বতন্ত্র। গৃহের প্রভাব হইতে দূরে থাকিয়া স্বোপার্জিত অর্থে তাঁহাকে জীবিকা নির্বাহ করিতে হইয়াছিল, তাহার ফলে স্বভাবতঃই তিনি স্বাধীনভাবে চিন্তা করিবার ক্ষমতা লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু অন্য যাঁহারা তাঁহার চেয়ে অধিকতর স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে লালিত হইয়াছিলেন, ছাত্রজীবন তাঁহাদের চরিত্রগঠনে সহায়তা করে নাই। অর্থোপার্জন, কোন নিরাপদ সরকারী চাকরী লাভ এবং পেন্সন পাওয়ার নিশ্চয়তা, ইহা ভিন্ন ঐ সব ছাত্রদের মধ্যে আর কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। ম্যাসারিক ইহার মধ্যে দেখিয়াছিলেন,—মৃত্যুভীতি ও সংগ্রামময় জীবনের সম্বন্ধে একটা আশঙ্কা; সংক্ষেপে যে সব গুণ থাকিলে জননায়ক হওয়া যাইতে পারে, তাহার সম্পূর্ণ অভাব।
“ম্যাসারিকের মত এই যে, ছেলেরা স্কুলে যাহা শিখে, পরবর্তী কালে তাহা সমস্তই ভুলিয়া যায়। সুতরাং অন্ততঃপক্ষে, শিক্ষার প্রথম অবস্থায়, ছেলেদের কেবল কতকগুলি তথ্য গলাধঃকরণ করাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নহে, তাহাদের মনে এমন কৌতূহল জাগ্রত করা উচিত যাহাতে তাহারা নিজেরাই তথ্য নির্ধারণে সক্ষম হইতে পারে। এরূপ কৌতুহল জাগ্রত করিবার প্রধান উপায়, শিক্ষককে নিজে সেই বিষয়ে আগ্রহশীল হইতে হইবে। শিক্ষক রূপে ম্যাসারিকের সাফল্যের কারণ বোধ হয় এই যে, তিনি যে বিষয় শিখাইতেন, সে বিষয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন। যুবক অবস্থায় তিনি বালকদের শিক্ষকতা করিতেন এবং পরবর্তীকালে প্রাগ সহরে তাঁহার ক্লাসে স্লাভ দেশের সর্বত্র হইতে তাঁহার নিকট পড়িবার জন্য ছাত্রেরা আসিত। সকল ক্ষেত্রেই শিক্ষাদান কার্যে তিনি এইরূপ সাফল্যলাভ করিয়াছিলেন।
“একই ছাঁচে ঢালা, একই প্রকৃতির শত শত গ্রাজুয়েট সৃষ্টি করা তাঁহার লক্ষ্য ছিল না। তিনি এমন এক শ্রেণীর লোক তৈরী করিতে চাহিয়াছিলেন, যাহাদের চিন্তার স্বাধীনতা জন্মিবে। তাঁহার মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হইবে, মানুষের প্রকৃতিকে এমনভাবে গঠন করা যাহার ফলে কোন বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হইলে, সে নিজেই তাহার সমাধান করিতে পারে। বাল্য বয়স হইতে ছাত্রদের কেবল কতকগুলি তথ্য শিখাইলে চলিবে না, নির্ভুল ও সুশৃঙ্খল ভাবে কাজ করিবার এবং মনঃসংযোগ করিবার অভ্যাস তাহাদিগকে শিক্ষা দিতে হইবে।”
হার্বার্ট স্পেন্সার যথার্থই বলিয়াছেন,—“বিদ্যানুশীলনের জন্য পুস্তকের প্রয়োজনীয়তাকে খুব বেশী অতিরঞ্জিত করা হয়। প্রত্যক্ষভাবে লব্ধ জ্ঞান অপেক্ষা পরোক্ষ ভাবে লব্ধ জ্ঞানের মূল্য কম হওয়া উচিত এবং জ্ঞান প্রত্যক্ষভাবে লাভ করাই সঙ্গত, কিন্তু প্রচলিত ধারণা তাহার বিপরীত বলিলেই হয়। ছাপা বইয়ের পাতা হইতে সংগৃহীত বিদ্যা শিক্ষার অঙ্গ বলিয়া গণ্য হয়। কিন্তু যে বিদ্যা জীবন এবং প্রকৃতির নিকট হইতে সাক্ষাৎভাবে লব্ধ তাহা শিক্ষার অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হয় না। পুস্তক অধ্যয়নের অর্থ অন্যের দৃষ্টি দিয়া দেখা, নিজের ইন্দ্রিয় প্রভৃতির দ্বারা না শিখিয়া অন্যের ইন্দ্রিয় বুদ্ধি প্রভৃতি দ্বারা শেখা। কিন্তু প্রচলিত ধারণা এমনই সংস্কারাচ্ছন্ন যে প্রত্যক্ষভাবে লব্ধ জ্ঞান অপেক্ষা পরোক্ষভাবে লব্ধ জ্ঞান শ্রেষ্ঠ বলিয়া বিবেচিত হয় এবং বিদ্যানুশীলনের নামে চলিয়া যায়।”
স্টিভেনসন বলেন,—“পুস্তকের এক হিসাবে প্রয়োজনীয়তা আছে বটে, কিন্তু তাহারা প্রাণহীন, অভিজ্ঞতা ও সাক্ষাৎ জীবনের কাছে কিছুই নহে।”
প্রেসিডেন্সি কলেজে ২৭ বৎসর ব্যাপী অধ্যাপনাকালে আমি বিশেষ করিয়া নিম্নতর শ্রেণীতেই অধ্যাপনার ভার গ্রহণ করিতাম। হাই স্কুল হইতে ছেলেরা যখন প্রথম কলেজে পড়িতে আসে, তখনই তাহাদের মন যথার্থরূপে শিক্ষাগ্রহণের উপযোগী থাকে। কুম্ভকার যেমন কাদার তাল হইতে ইচ্ছা মত মূর্তি গড়ে,—এই সময়ে ছেলেদের মনও তেমনি ইচ্ছা মত গড়িয়া তোলা যায়। আমি কোন নির্দিষ্ট পাঠ্য গ্রন্থ ধরিয়া পড়াইতাম না। যদি সেসনের প্রথমে কোন ছাত্র আমাকে জিজ্ঞাসা করিত, কোন্ বহি পড়িতে হইবে—আমি উত্তর দিতাম, যদি কোন বহি কিনিয়া থাক, পোড়াইয়া ফেল এবং আমার বক্তৃতা অনুসরণ কর।” অবশ্য বাজার চল্তি কোন বই অপেক্ষা উচ্চশ্রেণীর কোন মৌলিক গ্রন্থ হইলে, আমি তাহা পড়িতে পরামর্শ দিই।
জুলাই, আগষ্ট, সেপ্টেম্বর সেসনের আরম্ভে এই তিনমাস,—অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন এই তিন মূল পদার্থ এবং তজ্জাত মিশ্র পদার্থগুলির আলোচনা হয়। আমি আমার ছাত্রদিগকে রসায়নের ইতিহাস, অক্সিজেনের আবিষ্কার, প্রিস্টলে, লাভোয়াসিয়ার এবং শীলের আবিষ্কারকাহিনী এবং তাঁহাদের পরস্পরের কৃতিত্ব এই সব শিখাই, তারপর অকসাইড্স অব নাইট্রোজেন, পরমাণুতত্ত্ব প্রভৃতি বিশ্লেষণ করি এবং ডাল্টনের আবিষ্কারকাহিনী বলি। এইরূপে নব্য রসায়নী বিদ্যার প্রবর্তকদের সঙ্গে ছাত্রদের মনের যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করি। সংক্ষেপে আমি প্রথম হইতেই ছাত্রদের রসায়নজ্ঞানকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমি সভয়ে দেখি, অন্যান্য কলেজ ইতিমধ্যেই পাঠ্যগ্রন্থ অনেকখানি পড়াইয়া ফেলিয়াছেন, এমন কি পুনরালোচনা চলিতেছে।
এই প্রসঙ্গে, বর্তমানে কলেজে সাহিত্য ও বিজ্ঞান যে প্রণালীতে পড়ানো হয়, তাহার কথা স্বভাবতঃই আসিয়া পড়ে। কেবল ছাত্রেরা নয়, অধিকাংশ শিক্ষকও গতানুগতিক প্রথার দাস হইয়া পড়িয়াছেন এবং তাঁহারা কেবলমাত্র পাঠ্যপুস্তক গুলিরই অনুসরণ করিয়া থাকেন। বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী আগাগোড়া দূষিত হইয়া উঠিয়াছে। যদি কোন শিক্ষক পাঠ্য পুস্তকের বাহিরে গিয়া, নূতন কোন কথা বলিতে চেষ্টা করেন, তবে ছাত্রেরা বিরক্ত ও অসহিষ্ণু হইয়া উঠে। তাহারা প্রতিবাদ করিয়া বলে, “স্যার, আপনি বাহিরের কথা বলিতেছেন, আমরা এগুলি শুনিয়া মন ভারাক্রান্ত করিব কেন? পরীক্ষার পাশ করার জন্য এগুলির প্রয়োজন নাই।”
যদি পাঠ্যপুস্তকগুলিও ঠিক মত পড়া হইত, তাহা হইলেও আমি খুসী হইতাম। কিন্তু কয়েক বৎসর হইল ব্যাপার আরও শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে। ছাত্রেরা পাঠ্যপুস্তকগুলি পরিহার করিয়া তৎপরিবর্তে সংক্ষিপ্তসার, নোটবুক প্রভৃতি পড়িতেছে।[২০] অন্যত্র আমি বলিয়াছি, যে, আমার ছাত্রজীবনে আমি কেবল পাঠ্যপুস্তক পড়িয়াই সন্তুষ্ট হইতাম না, সেগুলিকে কেবল পথপ্রদর্শকরূপে ব্যবহার করিতাম। পক্ষান্তরে আমি ইংরাজী, জার্মান, ফরাসী সাময়িক পত্রাদি খুঁজিয়া মৌলিক প্রবন্ধসমূহ পড়িতাম। পূর্বেই বলিয়াছি যে, আমি নিজের চেষ্টায় লাটিন এবং ফরাসী ভাষা শিখি। আমি সেই বয়সেই সেক্সপীয়রের কয়েকখানি নাটক এবং ইংরাজী সাহিত্যের কয়েকখানি উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ পড়িয়া ফেলিয়াছিলাম। এই কারণে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উচ্চ স্থান অধিকার করিতে পারি নাই এবং সাধারণ ছাত্র রূপে গণ্য হইতাম।
আমার ছাত্রজীবনের সঙ্গে প্রেসিডেণ্ট ম্যাসারিকের ছাত্রজীবনের সাদৃশ্য দেখিয়া আমি বিস্মিত ও আনন্দিত হইলাম। “গ্রেট্স” “ডবল ফার্স্ট” প্রভৃতি পরীক্ষার সম্মানকে আমি বরাবরই কৃত্রিম জিনিষ বলিয়া গণ্য করিয়াছি।
“ভিয়েনা এবং ব্রুনো উভয় স্থানের কোথাও তিনি শিক্ষকদের বিশেষ প্রিয়পাত্র হইতে পারেন নাই। তাঁহারা তাঁহাকে সাধারণ ছাত্র বলিয়া মনে করিতেন, মেধাবী ছাত্ররূপে গণ্য করিতেন না। ইহার কারণ এই যে, ম্যাসারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঁধা প্রণালী মানিতেন না এবং কোন একটি বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হইতে চেষ্টা করিতেন না। ব্রুনোতে তিনি যে সর্বগ্রাসী জ্ঞানতৃষ্ণার পরিচয় দিয়াছিলেন, ভিয়েনাতে আসিয়া তাহা অতিরিক্তরূপে বাড়িয়া গেল।
“এই সময়ে তিনি ‘ক্লাসিক’ সাহিত্য পড়িতে ভাল বাসিতেন। গ্রীক ও লাটিন সাহিত্যের প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলী তিনি মূল ভাষাতেই পড়িয়াছিলেন। স্কুলের নির্দিষ্ট পাঠ্যে তাঁহার আশা মিটিত না। যদি কোন বিষয় পড়িতে হয়, তবে তাহা ভাল করিয়াই পড়িতে হইবে, ইহাই ছিল তাঁহার মত।......১৯ বৎসর বয়সেই তিনি যেন বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষায় তাঁহার বিশেষ কোন উপকার হইবে না। তাঁহার সমসাময়িক অন্যান্য বুদ্ধিমান যুবকদের ন্যায় তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার ভবিষ্যৎ স্বীয় শক্তির উপরেই নির্ভর করিতেছে। সে ভবিষ্যৎ কিরূপে হইবে, তখন পর্যন্ত তাহা অবশ্য তিনি জানিতেন না। কিন্তু তিনি জানিতেন—সেই ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সাধন করিতে হইলে, তাঁহাকে কঠোর পরিশ্রম করিতে হইবে। কেবল বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান লাভ করিলেই চলিবে না, তাহার বাহিরে যে বৃহত্তর জ্ঞানরাজ্য পড়িয়া আছে, তাহার মধ্যে প্রবেশ করিতে হইবে। যে সব শক্তি মানব-জগতকে পরিচালনা করিতেছে, ম্যাসারিকের পক্ষে তাহার মূল রহস্য অবগত হওয়া প্রয়োজন ছিল।”
বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনের ফলে যে অনিষ্ট হইয়াছে, জনৈক চিন্তাশীল লেখক তাহা নিম্নলিখিতভাবে বর্ণনা করিয়াছেন:—
“পাঠ্য পুস্তক নির্দিষ্ট করা—বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিশাপ স্বরূপ। গোড়ার কথা এই যে, ছাত্রেরা কোন বিষয়ের মূল বস্তু প্রথমতঃ সাক্ষাৎ সম্বন্ধে শিখিবে। যদি সে সেক্সপীয়র পড়ে, সেক্সপীয়রের মূল গ্রন্থ তাহাকে পড়িতে হইবে। ব্রাড্লে অথবা কিট্রেজ সেক্সপীয়র পড়িয়া কি শিখিয়াছেন, তাহা জানাই ছাত্রদের পক্ষে যথেষ্ট নয়। যদি সে রাষ্ট্রনীতির ঐতিহাসিক ধারা জানিতে চায়, তবে তাহাকে প্লেটো ও আরিস্টট্ল, লক, হবস্ এবং রুশোর বই পড়িতে হইবে। এবং সেই সমস্ত জানিয়া যদি সে পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত অসংখ্য নামের তালিকা আবৃত্তি করিতে না পারে, তাহা হইলেও তাহার পক্ষে বিশেষ ক্ষতির কারণ হইবে না। যদি সে অর্থনীতির শিক্ষার্থী হয়, তবে অ্যাডাম স্মিথ ও রিকার্ডোর গ্রন্থ পড়া তাহার পক্ষে একান্ত প্রয়োজন। ঐ সমস্ত চিন্তা-প্রবর্তকদের গ্রন্থ পড়িলে, তাহার মনের শক্তি বৃদ্ধি পাইবে, কোন অধ্যাপকের লেখা পাঠ্য গ্রন্থ পড়িয়া তার চেয়ে বেশী জ্ঞান সে লাভ করিতে পারিবে না।” (হ্যারল্ড ল্যাস্কি)
মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উপলক্ষে প্রদত্ত অভিভাষণে (১৯২৬) আমি বলিয়াছিলাম:—
“সকলেই স্বীকার করিবেন যে, মাধ্যমিক শিক্ষার (সেকেণ্ডারী এডুকেশান) ব্যবস্থা যদি উন্নততর করা হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় অনেক অনাবশ্যক অঙ্গ বর্জন করা যাইতে পারে এবং তাহার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার যথার্থ উন্নতি হইতে পারে। শিক্ষার যে গতানুগতিক অংশের স্কুলেই শেষ হওয়া উচিত, তাহার জের এখন দুর্ভাগ্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত টানা হয়। মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা উন্নততর করিলে, ইহার অবসান হইবে এবং ফলে বিশ্ববিদ্যালয় যথার্থরূপে বিদ্যা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হইয়া উঠিবে। এ বিষয়ে আরও একটু বিস্তৃতভাবে বলা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীতে এত বেশী খুঁটিনাটি শিক্ষা দেওয়া হয় যে, ইহার কাজ অনেকটা সেকেণ্ডারী স্কুলের মতই হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এমন কি পোষ্ট-গ্রাজুয়েট ক্লাসে পর্যন্ত কেহ কেহ রীতিমত “একসারসাইজ” দিবার জন্য জিদ করেন। আমি এমন কথা বলি না যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার নামে, ছেলেদের ভিতর আলস্যের প্রশ্রয় দেওয়া হোক। মানসিক যোগ্যতার সঙ্গে পরিশ্রম করিবার অভ্যাস, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিবার গোড়ার সর্ত্ত হওয়া উচিত। আমি ইহাই বলিতে চাই যে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে অধ্যাপকদের বক্তৃতা ও ‘একসারসাইজ’ দেওয়ার যে বাঁধাধরা নিয়ম আছে, তাহা তুলিয়া দিতে হইবে; অন্যথা ছাত্রদের মানসিক শক্তির বিকাশ হইতে পারে না। অবশ্য, বক্তৃতা দেওয়ার রীতির দ্বারা মনে হইতে পারে, কিছু কাজ হইতেছে। কিন্তু যদি কোন ছাত্র নিজের সময়ের সদ্ব্যবহার করিতে চায়, তাহা হইলে সে দেখিবে যে, এই সব বক্তৃতায় ক্লাশ হইতে অনুপস্থিত থাকাই তাহার পক্ষে বেশী লাভজনক। এই বাঁধাধরা বক্তৃতা দেওয়ার রীতির প্রধান ত্রুটী এই যে, ছাত্রেরা কোন বিষয় না বুঝিতে পারিলেও, অধ্যাপককে সে সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার সুযোগ কদাচিৎ পাইয়া থাকে। এই ত্রুটী সংশোধন করিবার জন্য কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টিউটোরিয়াল সিস্টেম’ বা ছাত্রদিগকে ‘গৃহশিক্ষা’ দেওয়ার রীতিও প্রবর্তিত হইয়াছে। কিন্তু যদিও এই ব্যবস্থায় প্রথমোক্ত রীতির ত্রুটী কিছু সংশোধিত হয়, তথাপি মোটের উপর ইহা অনেকটা পরীক্ষায় পাশ করাইবার জন্য ‘ছেলে তৈরী’ করিবার মত। ইহাতে ছেলেদের বিশেষ কিছু মানসিক উন্নতি হয় না। ইহার বিপরীত শিক্ষাপ্রণালীর কথা বিবেচনা করিয়া দেখুন। অধ্যাপকেরা ছাত্রদের নিকট কেবল কতকগুলি গ্রন্থের নাম করেন এবং ঐ সমস্ত গ্রন্থে যে সব সমস্যা আলোচিত হইয়াছে, তাহার উল্লেখ করেন। ছাত্রেরা ঐ সব গ্রন্থ পড়ে, তাহাতে যে সমস্ত সমস্যার আলোচনা হইয়াছে, তৎসম্বন্ধে চিন্তা করে, নিজেরাই সমাধানের উপায় আবিষ্কার করে এবং কলেজের তর্কসভার অধ্যাপক ও সহপাঠীদের সঙ্গে ঐ বিষয়ে তর্কবিতর্ক ও আলোচনা করে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, এই প্রণালীতে ছাত্রের বিশ্লেষণ ও সমীকরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং যদিও প্রথম প্রথম তাহার পক্ষে এই প্রণালী কষ্টকর মনে হইতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ইহারই মধ্য দিয়া নিজের একটা ‘জ্ঞানরাজ্য’ গড়িয়া তোলে। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নততর না হইলে, এই প্রণালী প্রবর্তিত হইতে পারে না।
“প্রশ্ন হইতে পারে, যদি অধ্যাপকদের বক্তৃতা দেওয়ার রীতি বন্ধ করা যায়, তাহা হইলে তাঁহাদের কাজ কি হইবে? উত্তর অতি স্পষ্ট—অধ্যাপকদের প্রধান কাজ হইরে মৌলিক গবেষণা। অধ্যাপক যেখানে মনে করেন যে, তাঁহার নূতন কিছু শিক্ষা দিবার আছে, কেবল সেই স্থলেই তিনি বক্তৃতা দেন, আলোচনা করেন এবং এইভাবে ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানান্বেষণের প্রবৃত্তি জাগ্রত রাখেন। বারট্রাণ্ড রাসেলের ভাষায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় পাঠশালার গুরুগিরির স্থান আর এখন নাই।........
“আমি এ পর্যন্ত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রণালীর ৪টি গুরুতর ত্রুটী উল্লেখ করিয়াছি—শিক্ষার বাহন, ছাত্র নির্বাচনের অভাব, অধ্যাপকের বক্তৃতা দেওয়ার বাধ্যতামূলক রীতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের সঙ্গে ছেলেদের যোগসূত্রের অভাব। আরও অনেক ত্রুটী আছে, তন্মধ্যে একটি বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কাধারীদের জন্যই কেবল ঐ প্রতিষ্ঠানটি একচেটিয়া থাকিবে, এরপ ধারণা ভ্রমাত্মক, আমরা যতদিন বিশ্বাস করিতাম যে, আমাদের শিক্ষাদানপ্রণালী নির্ভুল এবং শিক্ষালাভযোগ্য সকলের ভারই আমরা গ্রহণ করিতে পারি, ততদিন পর্যন্ত এ ধারণার একটা অর্থ ছিল। এরূপ দাবী একান্ত অমূলক। যদি আমরা স্বীকার করিয়া লই যে বিশ্ববিদ্যালয় মৌলিক গবেষণার কেন্দ্রস্বরূপ হইবে, তাহা হইলে, যে কেহ মৌলিক চিন্তা, ও গবেষণার পরিচয় প্রদান করিবে, তাহারই জন্য উহার দ্বার উন্মুক্ত করিতে হইবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ তাহার দেহে থাকুক আর নাই থাকুক। এরূপ উদার নীতি অবলম্বনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির গতি রুদ্ধ হইবে, কোন শিক্ষা ব্যবসায়ী এমন কথা বলিতে পারেন না। পক্ষান্তরে, যদি আমরা চিন্তা করি যে, সমাজের অতি সামান্য অংশই শিক্ষা লাভের সুযোগ পাইতেছে, এবং অজ্ঞাত প্রতিভা হয়ত সুযোগের অভাবে আত্মপ্রকাশ করিতে পারিতেছে না, তাহা হইলে প্রচলিত সঙ্কীর্ণ নীতির পরিবর্তন করা একান্ত প্রয়োজন। পৃথিবীর মহৎ ও প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের যদি একটা হিসাব আমরা করি, তাহা হইলে দেখিতে পাইব যে, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট, এমন কি কোন বিশেষ শিক্ষা প্রণালীর নিকটই ঋণী নহেন। সেক্সপীয়র গ্রীক ও লাটিন অতি সামান্যই জানিতেন। আমাদের দেশের কেশবচন্দ্র সেন এবং রবীন্দ্রনাথ, অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টাপাধ্যায় এবং শ্রেষ্ঠ নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার অতিক্রম করেন নাই।[২১] বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ বৃদ্ধির ছাত্রদেরই আশ্রয় দেয়, এ অভিযোগ যেমন সম্পূর্ণ অমূলক নহে, তেমনি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিভার বিরোধী, এমার্সনের এ অপবাদও সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করা যায় না। যাঁহারা মানবজ্ঞানের ক্ষেত্র বিস্তৃত করিবার জন্য আগ্রহান্বিত বিশ্ববিদ্যালয় এমন সমস্ত কর্মীকে যেমন সাদর অভ্যর্থনা করিবেন, তেমনি প্রতিভার অধিকারীদের যাহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে একান্তভাবে নির্ভর করিতে না হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য ব্যতীত স্বাধীন ভাবে তাঁহারা কার্য করিতে পারেন, তাহাও আমাদের দেখিতে হইবে।”
মিঃ এইচ, জি, ওয়েলস বলেন—“ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ কোন সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা করিবে না, সাহিত্য বা বিজ্ঞানে পরীক্ষা করিয়া কোন উপাধি দিবে না। যে সমস্ত যুবক জ্ঞানচর্চার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করিবেন এবং সেই কারণে প্রসিদ্ধ মনীষী ও অধ্যাপকদের সহকারী, সেক্রেটারী, শিষ্য ও সহকর্মীরূপে কাজ করিতে আসিবেন, তাঁহারাই সে যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররূপে গণ্য হইবেন। এই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যের ফলে জগতের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধিশালী হইবে।”
(৭) বিদেশী উপাধির মোহ—দাস মনোভাব—হীনতা-বোধ
পরাধীন জাতির সহস্র প্রকার দুর্ভাগ্যের মধ্যে একটি এই যে, সে তাহার আত্ম-সম্মান ও মর্যাদাজ্ঞান হারাইয়া ফেলে এবং প্রভুজাতির মাপকাঠিতেই সমস্ত বস্তুর মূল্য নির্ণয় করিতে থাকে। আমাদের শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে এই শোচনীয় মনোবৃত্তির কথা আমি অনেকবার বলিয়াছি। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি এই ভাবে ক্রমে ক্রমে অজ্ঞাতসারে আমাদিগকে জয় করিয়াছে। আমাদের শাসকরাও নানা ভাবে এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়াছেন।
এমার্সন যথার্থই বলিয়াছেন—“আত্মানুশীলনের অভাবেই ‘দেশ-ভ্রমণের’ সম্বন্ধে এক প্রকার কুসংস্কার জন্মিয়াছে। শিক্ষিত আমেরিকাবাসীরা মনে করে যে বিদেশ ভ্রমণ না করিলে কোন উন্নতি হইতে পারে না। এই কারণেই ইটালী, ইংলণ্ড, মিশরের মোহে তাহারা আচ্ছন্ন। যাহারা ইংলণ্ড, ইটালী বা গ্রীসকে কল্পনায় বড় মনে করে, তাহারা স্থাণুর মত এক জায়গাতেই স্থির হইয়া থাকে। মানুষের মত যখন আমরা চিন্তা করি, তখন বুঝিতে পারি, কর্তব্যই সর্বাপেক্ষা বড় জিনিষ। বিদেশ ভ্রমণ নির্বোধেরই কল্পনার স্বর্গ।”
আমাদের দেশের যুবকদের উচ্চতর সরকারী পদ লাভ করিতে হইলে ইংলণ্ডে যাইতে হইবে এবং সেই বহুদূরবর্তী বিদেশে থাকিয়া বহু কষ্টে, বহু অর্থব্যয়ে বিদেশী ভাষার সাহায্যে শিক্ষা লাভ করিতে হইবে; এবং এত কষ্ট ও অর্থব্যয়ের পর, প্রবল প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় সাফল্যের উপর তাহার ভাগ্য নির্ণীত হইবে। এই উপায়ে, গত ৫০। ৬০ বৎসরে অল্প সংখ্যক ভারতবাসী ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের সিভিল, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে প্রবেশ লাভ করিতে পারিয়াছে। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরাও ঐ সমস্ত বিভাগে প্রবেশ করিয়াছে, কিন্তু তাহাদের পদ-মর্য্যাদা পূর্বোক্ত ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের লোকদের চেহে হীন। এইরূপে এক শ্রেণীর নূতন জাতি-ভেদ গড়িয়া উঠিয়াছে। আই. সি. এস., আই. এম. এস., এবং আই. ই. এস. নিজেদের উচ্চস্তরের জীব মনে করে এবং তথাকথিত নিম্নতর সার্ভিসের লোকদের করুণার চক্ষে দেখে।
বিদেশী বিশেষতঃ ব্রিটিশ ডিগ্রী বা যোগ্যতার মোহে আমাদের বহু অর্থ, শক্তি ও সময়ের অপব্যয় হইতেছে। সম্প্রতি লণ্ডনস্থ ভারতের হাই কমিশনারের আফিস হইতে তথাকার শিক্ষাবিভাগের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতে জানা যায় যে, ইংলণ্ড, ইয়োরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় ছাত্রদের মোট সংখ্যা ২৫০০ এর কম নহে। হিসাব করিলে দেখা যাইবে যে, এই সব ছাত্রদের শিক্ষার জন্য বৎসরে প্রায় এক কোটি টাকা ভারত হইতে বাহির হইয়া যাইতেছে, কিন্তু তাহার প্রতিদানে ভারতের বিশেষ কিছু লাভ হইতেছে না। উক্ত রিপোর্টে নিম্নলিখিত সারগর্ভ মন্তব্য লিপিবদ্ধ হইয়াছে:—
গুরুতর অপব্যয়
“ভারতে বর্তমানে সরকারী কাজে অধিক সংখ্যায় ভারতীয়দের নিয়োগ করা হইতেছে। যে সমস্ত পদে বিলাত হইতে লোক নিযুক্ত করা হইত, তাহার অনেকগুলিতে ভারতেই লোক নিযুক্ত করা হইতেছে,—ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার যোগ্যতাও সমান ভাবেই স্বীকৃত হইতেছে;—তৎসত্ত্বেও এই ভ্রান্ত ধারণা কিছুতেই দূর হইতেছে না যে, যাহারা ভারতে শিক্ষা লাভ করে, তাহাদের চেয়ে যাহারা বিদেশে শিক্ষা লাভ করে তাহারা সরকারী কাজে বেশী সুযোগ ও সুবিধা পায়। এই শ্রেণীর ছাত্রেরাই বেশীর ভাগ বিদেশে গিয়া সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভাগে উপাধি লাভের জন্য অধ্যয়ন করে। ঐরূপ শিক্ষা লাভ করিলেই কোন বিশেষ সরকারী কাজে তাহাদের যোগ্যতা জন্মে না। ঐ ধরণের শিক্ষা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও তাহারা পাইতে পারিত। এই শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে অনেকে ব্যারিস্টার হইবার জন্য আইন পড়ে, ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রও ইহাদের মধ্যে কম নয়। ১৯২৮ সালে ২৬৬ জন ছাত্র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে ১৭০ জনই ছিল ভারতীয় এবং এই ১৭০ জনের মধ্যে মাত্র ১৭ জন পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করিয়াছিল।
“ইহাদের মধ্যে আবার এমন সব ছাত্রও দেখা যায় যাহাদের বিলাতের বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতিতে পড়িবার মত যোগ্যতা নাই। প্রতি বৎসরই কতকগুলি ছাত্র অতি সামান্য সম্বল লইয়া এদেশে আসে; তাহাদের তীক্ষ বুদ্ধি, অধ্যবসায়, ও সাহস প্রশংসনীয় বটে, কিন্তু অর্থ ও যোগ্যতার অভাবে তাহারা সাফল্য লাভ করিতে পারে না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শ্রেণীর ভারতীয় ছাত্র নিঃসম্বল অবস্থায় ভবঘুরের মত এদেশে আসে, শীঘ্রই তাহারা পিতামাতা ও অভিভাবকদের উদ্বেগের কারণ হইয়া দাঁড়ায় এবং এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষও তাহাদের জন্য চিন্তিত হইয়া উঠেন। যখন দেশ হইতে তাহাদের টাকা আসা বন্ধ হয় অথবা অন্য কারণে তাহারা নিঃসম্বল হইয়া পড়ে, তখন হাই কমিশনারের আফিস হইতে অর্থ সাহায্য করিয়া তাহাদিগকে ভারতে পাঠাইবার বন্দোবস্ত করিতে হয়।
“এ সমস্ত কথা পূর্বেও বহুবার বলা হইয়াছে, কিন্তু ভারতীয় জনমতকে সচেতন করিতে পুনরাবৃত্তি করিবার প্রয়োজন আছে। ইহা কিছুমাত্র অত্যুক্তি নহে যে প্রতি বৎসর যে সব ছাত্র ভারত হইতে বিদেশে আসে, তাহাদের অধিকাংশের দ্বারাই আর্থিক হিসাবে বা বিদ্যার দিক দিয়া ভারতের কোন উপকার হয় না। ইহারা হতাশ ও বিরক্ত হইয়া দেশে ফিরিয়া যায়, কোন কাজের উপযুক্ত বিশেষ কোন যোগ্যতা লাভ করে না, এবং অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক জীবনের স্নেহবন্ধন হইতে তাহারা বিচ্যুত হইয়া পড়ে, স্বজাতির স্বার্থের সঙ্গেও তাহাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়। একথা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না যে, এই ভাবে প্রতি বৎসর ভারতের যুবকশক্তির বহু অপব্যয় হইতেছে। ভারতের যুবকদের মঙ্গল কামনা যাঁহারা করেন, তাঁহাদের এই গুরুতর বিষয়টি বিশেষ ভাবে চিন্তা করিয়া কর্তব্য নির্ণয় করা প্রয়োজন।”
একটা কথা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিবার বিষয়। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীরা নিজেদের খুবই উচ্চ শ্রেণীর জীব বলিয়া মনে করে বটে, কিন্তু এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে তাহাদের তুলনা করিলে, অনেক স্থলেই তাহাদের সে ধারণা ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিপন্ন হয়।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ, দর্শনশাস্ত্রের কথা ধরা যাক। ডাঃ ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের নাম অবশ্যই এক্ষেত্রে সর্বাগ্রগণ্য। তাঁহার বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র-শিক্ষার্থীদের চিত্তে ঈর্ষা ও নৈরাশ্যের সঞ্চার করে। তাঁহার সমকক্ষতা লাভের কল্পনাও তাঁহারা করিতে পারেন না। এ কথা সত্য যে, তিনি এমন কোন গ্রন্থ প্রকাশ করেন নাই, যাহার দ্বারা তাঁহার নাম প্রসিদ্ধ হইতে পারে। কিন্তু কয়েক পুরুষ ধরিয়া যে সব ছাত্র তাঁহার পদমূলে বসিয়া শিক্ষা লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা ডাঃ শীলের নিকট তাঁহাদের অশেষ ঋণ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। তিনি সক্রেটিসের মতই তাঁহার শিষ্যবর্গের মধ্য দিয়া জ্ঞান রশ্মি বিকীর্ণ করেন।[২২]
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অপর যে সব প্রসিদ্ধ অধ্যাপক আছেন, তাঁহাদের মধ্যে হীরালাল হালদার, রাধাকিষণ, এবং সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তিন জনের মধ্যে কেবল একজনের “অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসাবে” বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি আছে। ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ ইয়োরোপে গিয়াছেন বটে, কিন্তু সে কেবল প্রতীচ্যের নিকট প্রাচ্য দর্শনের ব্যাখ্যাতা রূপে।
ইহাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার যে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অথবা তাহার সংসৃষ্ট কলেজ সমূহে যাঁহারা ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যের কৃতী অধ্যাপকরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা কেহই অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজে শিক্ষা লাভ করেন নাই। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটই তাঁহারা ঋণী। এই প্রসঙ্গে জয়গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, নৃপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জিতেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফক্স ঘোষ এবং ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে।
যাঁহারা বিলাতের কোন “ইনস্ অব কোর্টে” ডিনার খাইয়া ব্যারিষ্টার হইয়া আসেন, কলিকাতা হাইকোর্টে আইনের ব্যবসায়ে তাঁহারা এযাবৎ কতগুলি বিশেষ সুবিধা ভোগ করিয়াছেন; এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের উপাধি প্রাপ্ত উকীলেরা ঐ সমস্ত সুবিধা হইতে বঞ্চিত ছিলেন। এই কারণে ব্যারিষ্টারেরা উকীলদের চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলিয়া অভিমান করেন।
কিন্তু সিভিলিয়ানদের মত আইনজীবীরা ভাগ্যবান নহেন,—জীবন সংগ্রামে কঠোর প্রতিযোগিতা করিয়া তাঁহাদের সাফল্য অর্জন করিতে হয়। সুতরাং আশ্চর্যের বিষয় নহে যে, উকীলেরা অনেক সময় ব্যারিষ্টারদের চেয়ে যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠ বলিয়া প্রতিপন্ন হন এবং ব্যারিষ্টারেরা তাঁহাদের তুলনায় উপহাসের পাত্র হইয়া দাঁড়ান। ভাশ্যাম আয়েঙ্গার বা রাসবিহারী ঘোষের প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ও দক্ষতার তুলনা নাই। যে ৫৬ জন এ পর্যন্ত “ঠাকুর আইন বৃত্তি” পাইয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে ৩৮ জনের মধ্যে ২৮ জন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষা লাভ করিয়াছেন। তাঁহাদের প্রদত্ত বক্তৃতা শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য এবং আইনে প্রমাণ স্বরূপ উদ্ধৃত হয়। এই প্রসঙ্গে রাসবিহারী ঘোষ, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল সরকার, প্রিয়নাথ সেন এবং আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাম সর্বাগ্রে মনে পড়ে
ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে দেখিতে পাই, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজমদার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। বোম্বাই প্রদেশে ইংরাজী ভাষা অনভিজ্ঞ ভাউদাজী এবং ডাঃ ভাণ্ডারকর ও তাঁহার পুত্র খ্যাতিমান। ইঁহাদের মধ্য কেহই বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেন নাই এবং ডাঃ সেন ব্যতীত আর কাহারও কোন বিদেশী বিদ্যালয়ের উপাধি নাই। ডাঃ সেন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ করিয়াছেন বটে, কিন্তু তৎপূর্বেই তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরূপে মৌলিক গবেষণায় খ্যাতি লাভ করিয়াছেন।
পদার্থ-বিজ্ঞান বিভাগে দেখা যায়, ‘রামন তত্ত্বে’র (Raman Effect) আবিষ্কর্তা অধ্যাপক রামন[২৩] স্বীয় চেষ্টাতেই বিজ্ঞান বিদ্যার নিগূঢ় রহস্য অধিগত করিয়াছেন। তাঁহার সমস্ত প্রসিদ্ধ মৌলিক গবেষণা কলিকাতার লেবরেটরীতেই করা হইয়াছে।
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ভাণ্ডারে ধর, ঘোষ, মুখোপাধ্যায়, সাহা, বসু প্রভৃতির অবদানের কথা পূর্বেই বর্ণনা করিয়াছি (১৩শ ও ১৪শ অধ্যায়)। এস্থলে শুধু এইটুকু বলা প্রয়োজন যে, তাঁহাদের প্রত্যেকে কলিকাতার লেবরেটরীতে গবেষণা করিয়াই খ্যাতি লাভ করেন। আমি কয়েক বার জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলিয়াছি যে, ঘোষ ও সাহা লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়া শিক্ষা সমাপন করিলেও ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি, এস-সি, উপাধি ইচ্ছা করিয়াই গ্রহণ করেন নাই। কেননা তাঁহাদের মনে হইয়াছিল যে তদ্দারা তাঁহাদের স্বীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টর’ উপাধির গৌরব ক্ষুণ্ণ হইবে। সত্যেন্দ্রনাথ বসু (বোস-আইনষ্টাইন তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত) যদিও বিদেশে গিয়া তথাকার প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ পদার্থতত্ত্ব-বিদগণের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন; তথাপি ঐ একই মনোভাবের বশবর্তী হইয়া কোন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় হইতে উপাধি গ্রহণ করেন নাই।
এই প্রসঙ্গে আমার আর একজন প্রিয় ছাত্রের নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন,—আমি অধ্যাপক প্রিয়দারঞ্জন রায়ের কথা বলিতেছি।
একটি আশার লক্ষণ এই যে, আমি যে সব কথা বলিলাম, তাহা এদেশে অধ্যয়নকারী ছাত্রেরা নিজেরাই ক্রমে উপলব্ধি করিতে পারিতেছেন। লণ্ডনে ভারতীয় ছাত্র সম্মেলনে (ডিসেম্বর, ১৯৩১) ‘ব্রিটিশ ডিগ্রীর মূল্য’ আলোচনা প্রসঙ্গে বিশ্বভারতীর শ্রীযুত অনাথনাথ বসু বলেন, “ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির মূল্য ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুল্য নহে, একথা বলিলে, আমাদের মনের শোচনীয় অবস্থার পরিচয়ই দেওয়া হয়। আমি বিশ্বাস করি না যে, কোন ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বৎসর পড়িয়া যে শিক্ষা লাভ করা যায়, কোন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বৎসর পড়িয়া সেইরূপ শিক্ষা লাভ করা যায় না। অথচ ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীরা উচ্চ পদ ও মোটা বেতন পান। ইহা মর্যাদাবোধের কথা এবং ইহার মূলে রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা আমাদিগকে বৃদ্ধি করিতে হইবে।”
শ্রীযুত এম, ভি, গঙ্গাধরন বিলাতে ভারতীয় ছাত্রের আইন শিক্ষার নিন্দা করিয়াছেন। তিনি বলেন, একজন ভারতে শিক্ষিত আইনজ্ঞ কেন যে বিলাতে শিক্ষিত কোন আইনজ্ঞ অপেক্ষা কম দক্ষ হইবেন, তাহার কারণ তিনি বুঝিতে পারেন না। “আমি সেই দিনের প্রতীক্ষা করিতেছি, যেদিন ভারতীয় ছাত্রেরা বিলাতের ‘ইন্স্ অব কোর্টে’র কমন রুমে ‘আশ্চর্য বস্তু’ বলিয়া গণ্য হইবে। কিছুদিন পূর্বে পর্যন্ত বিলাতে শিক্ষিত আইনজ্ঞেরা, কিছু বেশী সুবিধা ভোগ করিতেন। কিন্তু ঐ সমস্ত সুবিধা তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, সুতরাং এখন ভারতীয় ছাত্রের পক্ষে বিলাতে গিয়া আইন শিখিবার কোনই প্রয়োজন নাই।”
দেশী অথবা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ করিবার দুর্নিবার মোহ সম্বন্ধে আমার স্বদেশবাসীর বিশেষভাবে চিন্তা করিবার সময় আসিয়াছে। বাংলাদেশ তাহার চিন্তাহীনতার জন্য আর্থিক ধ্বংসের মুখে চলিয়াছে। এখনও প্রতিকারের সময় আছে। কেহ যেন না ভাবেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিলাভের মোহ সম্বন্ধে আমি যাহা বলিলাম, তদ্দ্বারা আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই প্রচার করিতেছি। বিশ্ববিদ্যালয় অল্পসংখ্যক মেধাবী ছাত্রদের জন্য। অবশিষ্ট সাধারণ ছাত্রেরা জীবনসংগ্রামে প্রস্তুত হইবার জন্য পূর্ব হইতেই তদনুরূপ শিক্ষালাভ করিবেন। যখন সত্যকার জীবনসংগ্রাম আরম্ভ হয় তখন উচ্চতর বিদ্যার গবেষণা করা অধিকাংশ সাধারণ ছাত্রের পক্ষে সময় ও শক্তির অপব্যয় মাত্র। আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা হইতে ইহা আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। বিপদসূচক সঙ্কেত সম্মুখেই দেখা যাইতেছে এবং যে সমস্ত ছাত্র ও অভিভাবক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি—বিশেষতঃ বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির জন্য এখনও মোহাবিষ্ট, তাঁহাদের এ বিষয়ে ধীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখা কর্তব্য, পূর্ব হইতে সাবধান হইলে, বিপদকে সহজে নিবারণ করা সম্ভব হইতে পারে।
- ↑ “মৃত্যুঞ্জয় শীল নামক ৩০ বৎসর বয়স্ক যুবক আত্মহত্যা করে। এই সম্পর্কে করোনারের আদালতে তদন্তের সময় নিম্নলিখিত বিবরণ প্রকাশিত হয়। শীল অনেকদিন পর্যন্ত বেকার ছিল। সম্প্রতি একদিন সে তাহার মাকে বলে যে, সে একটি কাজ পাইয়াছে। ১৪ই মার্চ সকালে দেখা গেল সে গুরুতররূপে পীড়িত,―জিজ্ঞাসা করিলে বলে যে সে বিষ খাইয়াছে। হাতপাতালে স্থানান্তরিত করিলে সেইখানেই তাহার মৃত্যু হয়। তাহার পকেটে একখানি পত্র পাওয়া যায়। ঐ পত্রে লেখা ছিল যে, তাহার মা ও স্ত্রী অনাহারে আছে, ইহা সে আর সহ্য করিতে পারে না। সে তাহার মাকে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা দিবার জন্য মিথ্যা করিয়া বলিয়াছিল, সে কাজ পাইয়াছে।”— দৈনিক সংবাদপত্র, ২৮শে মার্চ, ১৯২৮।
এইরূপ ঘটনা আজকাল প্রায়ই ঘটিতেছে। - ↑ “যত কম মূল্যে সম্ভব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারীকে ক্রয় করাই যেন প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ২৫৲ টাকায় একজন বি. এ-কে পাওয়া যায় (সম্ভবতঃ তাহারা আরও অন্য কাজ করে বা আইন পড়ে)। সব সময়ের জন্য একজন বি. এ-কে ৪০৲ টাকায় পাওয়া যায়। ইহারা সব চেয়ে দুর্বল, হতাশ প্রকৃতির লোক। ইহাদের স্বাস্থ্য ও শক্তি উভয়ই হ্রাস পাইয়াছে। কাজ যেমনভাবে ইচ্ছা চলুক, ইহাই তাহাদের মনের ভাব। যদি কোন ছাত্র পড়ে ভাল,—না পড়িয়া দুষ্টামি করিয়া বেড়ায়, তাহাতেও ক্ষতি নাই।”—মাইকেল ওয়েস্ট, এডুকেশন, ১৭৮ পৃঃ।
- ↑ আলিপুর বারে প্রায় ১৫০ জন বি. এল ও এম. এ. বি. এল উকীল আছেন। কয়েকজন কৃতী উকীলের মুখে আমি শুনিয়াছি যে ঐ সমস্ত উকীলদের মধ্যে শতকরা ১০ জনও ভালরূপে জীবিকার্জন করিতে পারে না। এই সব ‘ব্রিফহীন’ উকীলের কথা প্রবাদবাক্যের মত হইয়া পড়িয়াছে। মক্কেলের চেয়ে উকীলের সংখ্যাই বেশী। কোন কোন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন লোকের নিকট শুনিয়াছি, বরিশালে একজন উকীলের আয় গড়ে মাসে ২৫৲ টাকার বেশী নহে। অবশ্য ‘ব্রিফহীন’ উকীলদের অবস্থা বিবেচনা করিয়াই এই হিসাব ধরা হইয়াছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কলিকাতা ও ঢাকার আইন কলেজে দলে দলে ছাত্র যোগদান করিতেছে।
- ↑ ১৯২৭-২৮ সালে বিভিন্ন কলেজে প্রত্যেক ছাত্রের শিক্ষার জন্য নিম্নলিখিতরূপ ব্যয় হইয়াছে:— প্রেসিডেন্সি কলেজে ৭৫৫৲ টাকা, তন্মধ্যে সরকারী তহবিল হইতে ৩০১.৫ টাকা; ঢাকা ইণ্টারমিডিয়েট কলেজে ৪৩১.৯ টাকা, তন্মধ্যে সরকারী তহবিল হইতে ৩৪৩.৪ টাকা; হুগলী কলেজে ৫১৫.৫ টাকা, সরকারী তহবিল হইতে ৪২৭.২ টাকা; সংস্কৃত কলেজে ৫৫৬.৩ টাকা, সরকারী তহবিল হইতে ৫০৯ টাকা; কৃষ্ণনগর কলেজে ৫৩৫.৩ টাকা, সরকারী তহবিল হইতে ৪৩৫.৬ টাকা এবং রাজসাহী কলেজে ২৮৫.৩ টাকা, তন্মধ্যে সরকারী তহবিল হইতে ১৯২.৬ টাকা। (বাংলার বার্ষিক শিক্ষাবিবরণী—১৯২৭-২৮)।
- ↑ Trevelyan—Life and Letters of Macaulay, Vol. II
- ↑ Macaulay—History of England.
- ↑ Oxford and Asquith—Fifty Years of Parliament.
- ↑ J. W. Hall—Eminent Asians, p. 161.
- ↑ Edwards—Life of Lloyd George.
- ↑ পরলোকগত ভূপেন্দ্রনাথ বসু যখন বিলাতে ‘ইণ্ডিয়া কাউন্সিলের’ সদস্য ছিলেন, তখন তাঁহার জনৈক সহকর্মীকে (ইনি কোন বড় ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংসৃষ্ট ছিলেন), একটী বাঙালী যুবককে ব্যাঙ্কের কাজে শিক্ষানবীশ লইতে অনুরোধ করেন। সহকর্মী যখন জানিতে পারিলেন যে যুবকটি গ্রাজুয়েট এবং তাহার বয়স ২২ বৎসর, তখন মাথা নাড়িয়া বলিলেন—“তরুণ বন্ধু তুমি তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ অপব্যয় করিয়াছ এবং আমার আশংকা হয়, ব্যাঙ্কের কাজ শেখা তোমার পক্ষে অসম্ভব। আমরা গ্রামার স্কুলের পাশকরা ১৪ বৎসর বয়সের ছেলেদের ব্যাঙ্কে শিক্ষানবীশ লইয়া থাকি। তাহারা ঘরে ঝাড়ু দেয়, টেবিল চেয়ার পরিষ্কার করে, সংবাদবাহকের কাজ করে, সেই সঙ্গে হিসাব রাখিতে ও খাতাপত্র লিখিতে শিখে এবং এইরূপে তাহারা ক্রমে ব্যাঙ্কের কাজে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়া দারিত্বপূর্ণ পদ পায়।”
- ↑ কার্নেগীও তাঁহার মাতার প্রতি এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়াছেন।
সাধারণতঃ ইয়োরোপীয় পিতামাতার কিছু বুদ্ধি বিদ্যা আছে। রবার্ট বার্নস, অ্যানড্রু, কার্নেগী, মুসোলিনী এবং লয়েড জর্জের পিতামাতার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাইতে পারে।
“সচ্চরিত্র দরিদ্র পিতামাতার ছেলেমেয়ের ধনীদের ছেলেমেয়ের অপেক্ষা এই বিষয়ে অনেক বেশী সুবিধা আছে। মা, ধাত্রী, রাঁধুনী গবর্নেস, শিক্ষক, ধর্মের আদর্শ সবই একজন; অপরপক্ষে, পিতা একাধারে আদর্শ চরিত্র, পথপ্রদর্শক, পরামর্শদাতা ও বন্ধু। আমি ও আমার ভ্রাতা এইভাবেই মানুষ হইয়াছিলাম। একজন লক্ষপতি বা অভিজাত বংশের ছেলের ইহার তুলনার কি বেশী সম্পদ আছে?” কার্নেগী, আত্মচরিত। - ↑ “বার্ড অ্যাণ্ড কোম্পানীর লর্ড কেব্লের জীবন এই শিক্ষা দেয় যে দৃঢ় সংকল্প ও যোগ্যতা দ্বারা নানা বাধাবিপত্তির মধ্যেও সাফল্য লাভ করা যায়। লর্ড কেব্ল ইংলণ্ডে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু অল্প বয়সে কলিকাতায় আসেন এবং এখানেই যাহা কিছু শিক্ষালাভ করেন। ক্রমে ক্রমে তিনি নিজের যোগ্যতা বলে ব্যবসায়ক্ষেত্রে সর্বোচ্চতম স্থান অধিকার করেন এবং বহু ঐশ্বর্য সঞ্চয় করেন। একসময়ে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতির পদেও তিনি নির্বাচিত হইয়াছিলেন”—ষ্টেটসম্যান, ৩১শে মার্চ, ১৯২৭। লর্ড কেব্ল মাসিক একশত টাকা বেতনে শিক্ষানবিশরূপে কাজ আরম্ভ করেন।
- ↑ “সরকারী কাজ পাইবার সম্ভাবনাই ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা শিক্ষার প্রধান আকর্ষণ। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দশজন ছাত্রের মধ্যে গড়ে ৮ জন মাত্র সরকারী কাজ পায় এবং কেবলমাত্র একজন বে-সরকারী কাজে নিযুক্ত হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ মিঃ হিটন বলেন যে, বাংলার শিল্পের উন্নতি যে কত কম হইতেছে, এই ঘটনাই তাহার জলন্ত প্রমাণ।” T. G. Cumming:_Technical and Industrial Instruction in Bengal, 1888— 1908 part I, p. 12.”
- ↑ সা-আদত কলেজের অধ্যক্ষ তাঁহাদের কলেজ ম্যাগাজিনে “নতুবা আমার জীবন ব্যর্থ হইবে” এই শীর্ষক একটি নিবন্ধে বিষয়টি সুন্দররূপে বর্ণনা করিয়াছেন।
- ↑ বহির এই অংশ ছাপিতে দিবার সময় Report of the Matriculation Regulations Committee ((June, 1932) আমার হাতে পড়ে। উহাতে দেখিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছেন যে, ম্যাট্রিকুলেশনে ইংরাজী ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত বিষয় মাতৃভাষার সাহায্যেই শিখাইতে হইবে, সতরাং এই অধ্যায়ে আমার বিবৃত যুক্তিগুলি মাত্র ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে গণ্য হইতে পারে। কিন্তু আমি দেখিয়া হতাশ হইলাম যে নূতন নিয়মাবলীতে, একদিক হইতে যে সুবিধা দেওয়া হইয়াছে, অন্যদিক হইতে তাহা কাড়িয়া লওয়া হইয়াছে। দুরূহ বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করিবার কঠোর পরিশ্রম ছেলেদের মস্তিষ্ক এখনও ভারাক্রান্ত করিতে থাকিবে। বস্তুতঃ ইংরাজীকে এত বেশী প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে যে তাহার জন্য তিনটি প্রশ্নপত্র নির্দিষ্ট হইয়াছে। অথচ ইতিহাস ও ভূগোলের ন্যায় প্রয়োজনীয় বিষয়ের জন্য মাত্র একটি করিরা প্রশ্নপত্র থাকিবে। গণিতের জন্য একটি এবং মাতৃভাষার জন্য দুইটি করিয়া প্রশ্নপত্র থাকিবে। সুতরাং ইংরাজীর জন্য যেরূপ মনোযোগ দেওয়া হইবে, তাহার মাত্র ষষ্ঠ অংশ ইতিহাস বা ভূগোলের জন্য দেওয়া হইবে এবং অন্য সমস্ত বিষয়ের ক্ষতি করিয়া ইংরাজীর জন্যই ছেলেদের অতিরিক্ত পরিশ্রম করিতে হইবে। তা ছাড়া, এইভাবে শিক্ষিত হইয়া ছাত্রেরা জীবন সংগ্রামে দাঁড়াইতে পারিবে না, কেন না সেজন্য প্রয়োজন সাধারণ ও সহজ জ্ঞান, কোন বিশেষ ভাষায় পারদর্শিতা নহে। মোটের উপর, বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীর যে সব দোষ ও ত্রুটী তাহা বরং কোন কোন দিকে বেশী হইবে। মিঃ মোনাহানের ভাষার এই রিপোর্ট সাম্রাজ্যবাদের ভাবের দ্বারা অত্যধিক প্রভাবান্বিত হইয়াছে।
- ↑ বর্তমান সময়ে মেকলের রিপোর্টের যে অংশ আপত্তিজনক বলিয়া গণ্য হয়, তাহা এই—“প্রধান প্রশ্ন এই যে, কোন ভাষা শিক্ষা করা সর্বাপেক্ষা লাভজনক?....... প্রাচ্য বিদ্যার মূল্য সম্বন্ধে আমি প্রাচ্য-তত্ত্ববিদদের মতই গ্রহণ করিতে প্রস্তুত। আমি একজনও প্রাচ্য তত্ত্ববিদ দেখি নাই যিনি অস্বীকার করিতে পারেন যে, কোন ভাল ইয়োরোপীয় লাইব্রেরীর এক আলমারী বই, ভারত ও আরবের সমস্ত দেশীয় সাহিত্যের সমতুল্য।...... আমি মনে করি যে, এ দেশের অধিবাসীরা ইংরাজী শিখিবার জন্য ব্যগ্র, সংস্কৃত বা আরবী শিখিতে তাহারা ইচ্ছুক নহে।”—Minute by Macaulay, 2nd Feb., 1935.
“সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু শাস্ত্রের পক্ষপাতী হইবেন, এরূপ আশা করা যায়। কিন্তু তিনি রামমোহন, এমন কি মেকলে অপেক্ষাও তীব্র ভাষায় বেদান্তের নিন্দা করিয়াছেন। ১৮৫৩ সালে কাউন্সিল অব এডুকেশানের নিকট তিনি যে পত্র লিখেন তাহাতে আছে—“কতকগুলি কারণে আমরা এক্ষণে সাংখ্য ও বেদান্ত শিক্ষা দিতে বাধ্য হইতেছি। বেদান্ত ও সাংখ্য যে মিথ্যা দর্শন শাস্ত্র তাহাতে এখন আর সন্দেহ নাই।” (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়—বিদ্যাসাগর)
বস্তুতঃ, রামমোহন ও বিদ্যাসাগর নিজেরা সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী হইলেও, স্বজাতির মনকে প্রাচীন প্রথা ও সংস্কারের মোহ হইতে মুক্ত করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া ছিলেন। এই শাস্ত্র-দাসত্ব হিন্দুর মনের উপর এতকাল পাথরের মত চাপিয়া বসিয়াছিল। এই দুই মহাপুরুষের উদ্দেশ্য ছিল যে, কেবলমাত্র সংস্কৃত ও পারসী শাস্ত্র ও সাহিত্যের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ না থাকিয়া, আমাদের সাহিত্য পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইবে। রামমোহন বেশ জানিতেন যে, তাঁহার স্বদেশবাসীরা যদি জ্ঞান লাভ করিতে চায় তবে মাতৃভাষাকেই শিক্ষার বাহন করিতে হইবে। এই কারণে তিনি একখানি বাংলা সংবাদ পত্র (সংবাদ কৌমুদী ১৮২১) পরিচালনা করিতেন, এবং সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে, একখানি বাংলা পুস্তিকা লিখিয়াই তিনি আন্দোলন আরম্ভ করেন। বিদ্যাসাগরের অধিকাংশ সুপরিচিত গ্রন্থ মূল ইংরাজী হইতে অনুবাদ এবং উহার ভাষা বাংলা রচনার আদর্শ। রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরকেই লোকে বাংলা গদ্যের জনক বলিয়া গণ্য করে। - ↑ কেহ কেহ প্রস্তাব করিয়াছেন যে, গ্রন্থকারগণকে পারিশ্রমিক দিয়া তাঁহাদের দ্বারা দেশীর ভাষায় পুস্তক লিখাইতে হইবে। মেকলে এ সম্বন্ধে নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন:—
“৪। ৫ জন বেতনভুক লোক দ্বারা সাহিত্যসষ্টির চেষ্টা, কোন দেশে কোন কালে সফল হয় নাই, হইবেও না। ভাষা ক্রমে বিকাশ লাভ করে, উহা কৃত্রিম উপায়ে তৈরী করা যায় না। আমরা এখন যে প্রণালী অবলম্বন করিতেছি, ধীরে ধীরে হইলেও তাহার ফল নিশ্চিত। এই উপায়েই ভারতের বিভিন্ন ভাষাসমূহে উৎকৃষ্ট গ্রন্থ রচিত হইবে। আমরা ভারতে এক বিশাল শিক্ষিত সম্প্রদায় গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছি। আমি আশা করি, বিশ বৎসর পরে, এমন শত সহস্র ভারতবাসীর আবির্ভাব হইবে, যাঁহারা পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানে পারদর্শী এবং উৎকৃষ্ট রচনাশক্তির অধিকারী হইবেন। তাঁহাদের মধ্যে এমন অনেক লোক পাওয়া যাইবে, যাঁহারা পাশ্চাত্য জ্ঞান স্বদেশীয় ভাষার সাহায্যে প্রচার করিতে সক্ষম হইবেন। আমার বিশ্বাস, এ দেশের ভাষায় উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করিবার ইহাই একমাত্র উপায়।” ট্রিভেলিয়ান লর্ড মেকলের জীবনী ও পত্রাবলী, ৪১১ পৃঃ। - ↑ “মাতৃভাষা শিক্ষার প্রতি লোকের তীব্র বিরাগ পূর্ববৎই রহিল। ১৮৫২ সালের রিপোর্টে দেখা যায়, প্রত্যেক জেলার ইংরাজী শিক্ষার জন্য আগ্রহ বৃদ্ধি পাইয়াছিল। ভার্নাকুলার স্কুলগুলির জন্য যাহারা সামান্য অর্থসাহায্য করিতেও কাতর হইত, তাহারা কিন্তু ইংরাজী শিক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় অর্থদান করিত এবং ঐ উদ্দেশ্যে স্কুল স্থাপন করিত। একথা স্বীকার করিতে হইবে, প্রকৃত শিক্ষা লাভ অপেক্ষা ছেলেরা ভাল চাকুরী পাইবে, অধিকাংশ স্থলে এই আশাতেই অভিভাবকরা তাহাদের ইংরাজী শিক্ষার ব্যয় বহন করিয়া থাকেন। ভার্নাকুলার স্কুলে এই লাভের আশা নাই।” Michael West: Education.
- ↑ কার্লাইল এতদূর পর্যন্ত বলিয়াছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় উঠাইয়া দিলেও চলে। তিনি বলিতেছেন:
“বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বর্তমান যুগের সৃষ্টি—শ্রদ্ধার বস্তু। গ্রন্থ সংগ্রহ ইহার উপরে অশেষ প্রভাব বিস্তার করে। যে সময়ে কোন বই পাওয়া যাইত না, সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উদ্ভব হয়। তখনকার দিনে একখানি বইয়ের জন্য লোকে নিজের এক খণ্ড ভূ-সম্পত্তি পর্যন্ত দিতে বাধ্য হইত। সেই সময়ে কোন জ্ঞানী ব্যক্তি যে ছাত্র সংগ্রহ করিয়া তাঁহাদিগকে শিক্ষাদান করিতে চেষ্টা করিবেন, ইহার প্রয়োজন ছিল। আবেলার্ডের নিকট জ্ঞানলাভ করিতে হইলে, তাঁহার নিকট যাইতে হইত। সহস্র সহস্র ছাত্র আবেলার্ড এবং তাঁহার দার্শনিক মতবাদ জানিবার জন্য তাঁহার নিকটে যাইত।” - ↑ “Aids”, “Digests”, “Compendiums”, “One-day-preparation Series”, “Made easy Series”—এইগুলিই বেশী প্রিয়। ছাত্রেরা পরীক্ষার পূর্ব ক্ষণে এই সব বটিকা সেবন করে।
১৯২৮-২৯ সালের ভারতের শিক্ষার বিবরণে এডুকেশনাল কমিশনার বলিতেছেন:—“বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালরের ছাত্রেরা পাঠ্যপুস্তক পড়িবার জন্য মাথা ঘামায় না, তাহারা তৎপরিবর্তে বাজার চলতি সংক্ষিপ্তসার, নোটবুক প্রভৃতি মুখস্থ করিয়াই সন্তুষ্ট হয়।” (‘নেচার’ হইতে উদ্ধৃত) - ↑ গিরিশচন্দ্র এবং শরৎচন্দ্র উভয়েই প্রগাঢ় পণ্ডিত। গিরিশচন্দ্র সম্বন্ধে জনৈক লেখক অমৃতবাজার পত্রিকায় (২৬-১-৩১) লিখিয়াছেন—“গিরিশচন্দ্র অক্লান্ত অধ্যয়নশীল ছিলেন। যাহা কিছু পড়িতেন, তাহাই আরম্ভ করিতে পারিতেন। বৎসরের পর বৎসর ছাত্রদের মতই তিনি অনেক সময় তাঁহার পুস্তকাগারে পাঠে নিমগ্ন থাকিতেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁহার এই অভ্যাস বজায় ছিল।” শরৎচন্দ্রের ক্ষুদ্রপুস্তক ‘নারীর মূল্য’ পড়িলেই বুঝা যায়, তিনি কত গ্রন্থ পড়িয়াছেন।
- ↑ রবীন্দ্রনাথ ডাঃ শীলকে জ্ঞানের মহাসমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করিয়াছেন। কত জন যে তাঁহার পদমূলে বসিয়া শিক্ষা লাভ করিয়া প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের অধিকারী হইয়াছেন তাহা অনেকেই জানেন। কেবলমাত্র তাঁহার মৌখিক উপদেশ শুনিয়াই বহু ছাত্র বিশ্ববিদ্যালরের ‘ডক্টর’ উপাধি লাভ করিয়াছেন।
- ↑ অধ্যাপক রামনের ‘নোবেল প্রাইজ’ পাওয়ার বহু পূর্বে এই প্রসঙ্গ লিখিত হইয়াছে। অল্প দিন পূর্বে (২৭—৬—৩১); কলিকাতা কর্পোরেশান অধ্যাপক রামনকে সম্বর্ধনা করিবার সময় এই বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন:—
“ভারতে প্রাপ্ত শিক্ষা বলে, ভারতীয় লেবরেটরীতে গবেষণা করিয়া আপনি অপূর্ব কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছেন। এই দেশ বৈজ্ঞানিক গবেষণার কিরূপ কৃতিত্ব লাভ করিয়াছে, আপনার কার্য: আপনি তাহা প্রদর্শন করিয়াছেন।”