আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

বাংলায় বন্যা—খুলনা দুর্ভিক্ষ—উত্তরবঙ্গে প্রবল বন্যা—অল্পদিন

পূর্বেকার বন্যা—ভারতে অনুসৃত শাসনপ্রণালীর কিঞ্চিৎ পরিচয়—

শ্বেতজাতির দায়িত্বের বোঝা

 ১৯২১ সালে আমি যখন চতুর্থবার ইংলণ্ড ভ্রমণ করিয়া আসিলাম সেই সময়, খুলনা জেলায় সুন্দরবন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। কলিকাতায় থাকিয়া আমি অবস্থার গুরুত্ব বুঝিতে পারি নাই। মে মাসে গ্রীষ্মের ছুটীর সময় আমি যখন গ্রামে গেলাম, তখন আমার চোখের সম্মুখেই দুর্ভিক্ষের ভীষণতা দেখিতে পাইলাম। পর পর দুই বৎসর অজন্মার ফলেই এই অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছিল। জনসাধারণের ‘মা বাপ’ ম্যাজিষ্ট্রেট কালেক্টর এ অবস্থা দেখিয়াও অবিচলিত ছিলেন। কিন্তু সংবাদপত্রে ইহা লইয়া খুব আন্দোলন হইতেছিল। গবর্ণমেণ্টের চক্ষুকর্ণস্বরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট এ সব বিষয় তুচ্ছ মনে করিতেছিলেন, চারিদিক হইতে অন্নকষ্টের যে হাহাকার উঠিতেছিল, তাহা গ্রাহ্য করা তিনি প্রয়োজন মনে করেন নাই, তিনি তাঁহার সদর আফিসে বসিয়া নিশ্চিন্তমনে যে বিবৃতি প্রচার করিয়াছিলেন, তাহা লোকে কখনও ভুলিতে পারিবে না। উহা হইতে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করিতেছি:—“প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই অপর্যাপ্ত ফল জন্মে, খাল হইতে ছোট ছোট ছেলেরাও মাছ ধরিতে পারে এবং চাহিলেই একরূপ বিনামূল্যে দুধ পাওয়া যায়।” ভারতের দুর্ভিক্ষের সঙ্গে যাঁহাদের কিছু পরিচয় আছে, তাঁহারাই জানেন যে, দুধ অসম্ভবরূপে সস্তা হওয়া—দুর্ভিক্ষের ভীষণতার লক্ষণ। পিতামাতা তাহাদের শিশু সন্তানকে বঞ্চিত করিয়া দুধ বিক্রয় করে, যদি তাহার পরিবর্তে কিছু চাল পাওয়া যায়। কিন্তু দুধ কিনিবে কে? কেন না ভারতে এখন দুর্ভিক্ষের অর্থ—টাকার দুর্ভিক্ষ। পাঠককে এ কথাও স্মরণ করাইয়া দেওয়া নিষ্প্রয়োজন যে, সুন্দরবন অঞ্চলে ফলের গাছ হয় না এবং ফলের গাছ সেদিকে নাই। এখানে বলা যাইতে পারে যে, ভারতে যখনই কোন স্থানে বন্যা ও দুর্ভিক্ষ হয়, গবর্ণমেণ্ট তাঁহাদের সিমলা বা দার্জিলিঙের শৈলবিহার হইতে, প্রথম প্রথম দুর্গতদের কাতর আবেদনে কর্ণপাত করেন না। ক্রমে যখন সংবাদপত্রে ও সভাসমিতিতে আন্দোলন হইতে থাকে এবং তাহা উপেক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠে, আমলাতন্ত্রের প্রভুরা তখন কিঞ্চিৎ অস্বস্তি অনুভব করেন। কিন্তু তখনও ‘সরকারী বিবরণ’ না পাইলে তাঁহারা কিছু করিতে চাহেন না। সেক্রেটারিয়েট এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনারের উপর নির্ভর করেন, কেন না, তিনিই সংবাদ আদানপ্রদানের ডাকঘর বিশেষ। কমিশনার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট, জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবার পুলিশের দারোগার নিকট হইতে রিপোর্ট তলব করেন। দারোগা গ্রাম্য পঞ্চায়েতের উপর এবং পঞ্চায়েত গ্রাম্য চৌকীদারের উপর সংবাদ সংগ্রহের ভার দেন। এইসব চতুর অধস্তন কর্মচারীর দল জানে যে কিরূপ রিপোর্ট গবর্ণমেণ্টের মনোমত হইবে এবং সেই অনুসারেই রিপোর্ট প্রস্তুত হয়। গেজেটে যে সরকারী ইস্তাহার বাহির হয়, তাহা এইরূপ ‘প্রত্যক্ষ সংবাদের’ উপর নির্ভর করিয়া লিখিত। কোন স্বাধীন দেশ হইলে খুলনার ম্যাজিষ্ট্রেট অথবা বন্যার জন্য রেলওয়ে এজেণ্টই যে কেবল কঠিন শাস্তি পাইত, তাহা নহে, মন্ত্রিসভাও বিতাড়িত হইত। কিন্তু ভারতে বন্যা দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে এইসব ব্যাপার নিত্যই ঘটিতেছে।

 বন্ধুবর্গের অনুরোধে দুর্গতদের সেবাকার্যের ব্যবস্থা এবং দেশবাসীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিবার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করিলাম। দেশবাসী সর্বান্তঃকরণে সাড়া দিল—যদিও গবর্ণমেণ্ট সরকারীভাবে খুলনার এই দুর্ভিক্ষকে স্বীকার করেন নাই। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ সেন, জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, কুঞ্জলাল ঘোষ, প্রভৃতি খুলনার জননায়কগণ আমাকে এই কার্যে বিশেষভাবে সহায়তা করেন, বরিশাল ও ফরিদপুর জেলা হইতে বহু স্বেচ্ছাসেবক আসিয়াও আমার কাজে বিশেষভাবে সাহায্য করেন।

 ১৯২২ সালের উত্তরবঙ্গ বন্যা সম্বন্ধে বলা যাইতে পারে যে, যদি গ্রামবাসীর প্রার্থনা গ্রাহ্য করা হইত, তাহা হইলে এই বন্যা নিবারিত হইতে পারিত, অন্ততঃপক্ষে ইহার প্রকোপ খুবই হ্রাস পাইত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতে এই সমস্ত আবেদন নিবেদন সরকারী কর্মচারীরা গ্রাহ্যও করেন না। যে কোন নিরপেক্ষ পাঠকই বুঝিতে পারিবেন যে গবর্ণমেণ্ট এই বন্যার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী। বন্যা হইবার এক বৎসর পূর্বে গ্রামবাসীরা রেলওয়ে বাঁধ সম্পর্কে গবর্ণমেণ্টের নিকট দরখাস্ত করিয়াছিল। দরখাস্তকারিগণ অজ্ঞ গ্রামবাসী, কিন্তু একথা তাহারা বেশ বুঝিতে পারিয়াছিল যে, যদি রেলওয়ে বাঁধের সঙ্কীর্ণ ‘কালভার্ট’গুলির পরিবর্তে চওড়া সেতু করিবার ব্যবস্থা না হয়, তবে তাহাদিগকে সর্বদাই বন্যার বিপত্তি সহ্য করিতে হইবে। কিন্তু কার্যতঃ ঠিক ইহাই ঘটিয়াছিল। আসল কথা এই যে, বিদেশী অংশীদারদের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া রেলওয়ে রাস্তা ও বাঁধগুলি তৈরী করা হয়। খরচা যত কম হইবে, অংশীদারদের লাভের অঙ্কও তত বেশী হইবে। এই কারণে রেলপথ নির্মাণ করিবার সময় বহু স্বাভাবিক জলনিকাশের পথ মাটী দিয়া বন্ধ করিয়া ফেলা হয়, অথবা তাহাদের পরিসর এত কম করা হয় যাহাতে সঙ্কীর্ণ ‘কালভার্ট’ দ্বারাই কাজ চলিতে পারে।[] আনন্দবাজার পত্রিকা ১৯২২ সালের ২১শে নবেম্বর তারিখে রেলওয়ে বাঁধই যে দেশের সর্বনাশের কারণ এই প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় মন্তব্যে লিখিয়াছিলেন:—

 “রেলওয়ে লাইনই যে উত্তরবঙ্গের লোকদের অশেষ দুঃখ-দুর্দশার কারণ এ বিষয়ে আমরা কয়েকটি প্রবন্ধ ইতিপূর্বে লিখিয়াছি। আদমদীঘি এবং নসরতপুর অঞ্চলের (সান্তাহারের উত্তরে দুইটি রেলওয়ে ষ্টেশন) গ্রামবাসীরা, বগুড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মারফৎ রেলওয়ে এজেণ্টের নিকট দরখাস্ত করে যে, পূর্বোক্ত দুইটি ষ্টেশনের মধ্যে রেলওয়ে লাইনে সঙ্কীর্ণ কালভার্টের পরিবর্তে চওড়া সেতু করা হোক, তাহা হইলে প্রবল বর্ষার পর উচ্চ ভূমি হইতে যে জলপ্রবাহ আসে, তাহা বাহির হইবার পথ পাইবে। ইহার উত্তরে রেলওয়ে এজেণ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিম্নলিখিত পত্র লিখেন:—

নং ১৩৫৬—ভি, ডবলিউ

ই. বি. রেলওয়ের এজেণ্ট লেঃ কর্ণেল এইচ. এ. ক্যামেরন সি. আই. ই

বগুড়ার ম্যাজিষ্ট্রেটের বরাবর

কলিকাতা, ২৮শে অক্টোবর, ১৯২১
মহাশয়,

 আপনার ১৯২১ সালের ২৫শে এপ্রিল তারিখের পত্র পাইলাম। উহার সঙ্গে উমিরুদ্দীন জোদ্দার এবং আদমদীঘি ও তন্নিকটবর্তী গ্রামসমূহের অধিবাসিগণের যে দরখাস্ত[] আপনি পাঠাইয়াছেন, তাহাতে এই আবেদন করা হইয়াছে যে আদমদীঘি ও নসরতপুর ষ্টেশনের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণ করা হউক। তদুত্তরে আমি জানাইতেছি যে, যথাযোগ্য তদন্তের পর আমরা এই সিদ্ধান্ত করিয়াছি যে, উক্ত স্থানে সেতু নির্মাণের কোন প্রয়োজন নাই।

(স্বাঃ) অস্পষ্ট 
এজেণ্টের পক্ষে 
 মেমো নং ১৭৭৩—জে

বগুড়া ম্যাজিষ্ট্রেটের আফিস
৩রা নভেম্বর, ১৯২১

 উমিরদীন জোদ্দার এবং অন্যান্যের অবগতির জন্য, ম্যাজিষ্ট্রেটের পক্ষ হইতে এই পত্রের নকল প্রেরিত হইল।

(স্বাঃ) অস্পষ্ট 

 ডাঃ বেণ্টলী স্বাভাবিক জলনিকাশের পথরোধ সম্পর্কে লিখিয়াছেন:—

 “সমস্ত জলনিকাশের পথেরই গতি নদীর দিকে। ঐ সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী আবার জলরাশিকে পদ্মা ও যমুনার গর্ভে ঢালে। দেশের অবনমন ঢালুতা বা ‘গড়ান’ ৬ ইঃ হইতে ৯ ইঃ পর্যন্ত। দুর্ভাগ্যক্রমে, যে সমস্ত ইঞ্জিনিয়ার এই অঞ্চলে জেলাবোর্ড ও রেলওয়ের রাস্তাগুলি তৈরী করিবার জন্য দায়ী, তাঁহারা দেশের স্বাভাবিক জলনিকাশের পথের কথা লইয়া মাথা ঘামান নাই। কাজেই, রাস্তা ও রেলওয়ে বাঁধগুলিতে যে সব কালভার্ট বা পয়োনালীর ব্যবস্থা হইয়াছে, তাহা যথেষ্ট নহে। জলপ্রবাহ অনিষ্টকর নহে, কিন্তু উহার দ্রুত নিকাশের ব্যবস্থা করিতে হইবে। বন্যা যে প্রায় বাৎসরিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার কারণই এই যে, রেলওয়ে লাইন তৈরী করিবার ত্রুটীর দরুণ, বাংলার নদীগুলির স্বাভাবিক কার্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হইয়াছে। আমাদের সম্মুখে প্রধান সমস্যা এই—স্বাভাবিক জলনিকাশের পথের পুনরুদ্ধার—যাহাতে প্রত্যেক বর্ষার পর জল দ্রুতগতিতে বাহির হইয়া যাইতে পারে। বাংলার নদী ব্যবস্থাকে সার্ভে করিয়া দেখিতে হইবে, রেলওয়ে বাঁধের ফলে প্রত্যেক নদীর গর্ভ কি ভাবে এবং কতদূর পর্যন্ত বন্ধ হইয়াছে। যেখানেই প্রয়োজন, যথেষ্ট সংখ্যক নূতন ধরণের কালভার্ট বসাইতে হইবে।....... এই ব্যবস্থা অনুসারে কার্য করিলে বাংলা দেশ তাহার রাস্তা ও রেলওয়েগুলি ঠিকমত রক্ষা করিতে পারিবে, ম্যালেরিয়াকে বহুল পরিমাণে দূর করিতে পারিবে, জলসরবরাহের ব্যবস্থার উন্নতি করিতে পারিবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ বন্যার প্রকোপও নিবারণ করিতে পারিবে। রাস্তা ও রেলওয়ের দ্বারা দেশের জলপ্রবাহের স্বাভাবিক ব্যবস্থা নষ্ট করাতেই যত কিছু গণ্ডগোলের সৃষ্টি হইয়াছে।...... রেলওয়ে বাঁধ এবং জেলাবোর্ডের রাস্তাগুলিই অনেকাংশে বন্যার জন্য দায়ী।”

 গবর্ণমেণ্টের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর দ্বারাই সরকারী উক্তির সুস্পষ্ট প্রতিবাদ করা হইয়াছে। এরূপে দৃষ্টান্ত অতীতে বড় একটা দেখা যায় নাই, ভবিষ্যতেও দেখা যাইবে কিনা সন্দেহ।

 ১৯২২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখ হইতে আরম্ভ করিয়া যে প্রবল বৃষ্টির ফলে আত্রাই নদীর গর্ভ প্লাবিত হয়, তাহাই বন্যার কারণ। এই আত্রাই নদী ব্রহ্মপুত্রের (বা যমুনার) শাখা এবং ঐ অঞ্চলের সমস্ত জলপ্রবাহ আত্রাই নদীতে যাইয়াই পড়ে। এই ভীষণ বিপত্তির সংবাদ কলিকাতা শহরে এক অদ্ভুত উপায়ে পৌঁছে। ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে মেল ট্রেন দার্জিলিং হইতে ছাড়িয়া পরদিন পার্বতীপুরে পৌঁছে। কিন্তু ট্রেণখানি পার্বতীপুর ছাড়িয়া অগ্রসর হইতে পারে না, কেননা পার্বতীপুরের দক্ষিণে কয়েক মাইল পর্যন্ত লাইন জলমগ্ন হইয়া গিয়াছিল এবং রেলওয়ে কর্মচারীরা সংবাদ পাইয়াছিলেন যে, আক্কেলপুরে লাইন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। যাত্রিগণ এইভাবে ৪ দিন পার্বতীপুরে থাকিতে বাধ্য হন এবং পরে একটা রাস্তা দিয়া তাঁহাদিগকে কলিকাতায় পাঠান হয়। বিপন্ন যাত্রীদের মধ্যে ষ্টেটসম্যানের একজন সম্পাদক ছিলেন। তিনিই প্রথম কলিকাতায় আসিয়া এই ভীষণ সংবাদ মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করেন। রেলওয়ে বাঁধ ভাঙ্গিয়া চারিদিকে কিরূপে একটা সমুদ্রের সৃষ্টি হইয়াছিল,—ঐ সমস্ত দৃশ্যের ফটোগ্রাফও তিনি প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যে, অন্য সূত্রে সংবাদ পাইয়া শ্রীযুক্ত সভাষচন্দ্র বসু ঘটনা স্থলে অবস্থা পরিদর্শন করিতে গমন করেন। সেখান হইতে তিনি আমার নিকট, কংগ্রেস আফিসে এবং বঙ্গীয় যুবকসঙ্ঘের আফিসে তার করেন। সুভাষ বাবু বঙ্গীয় যুবকসঙ্ঘের ভাইস-প্রেসিডেণ্ট ছিলেন। সংবাদপত্রের মারফৎ সাধারণের নিকট এই মর্মে আবেদন করা হইল যে, ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশান হলে জনসভা করিয়া বন্যাসাহায্য কমিটি গঠন এবং ভবিষ্যৎ কার্যপ্রণালী আলোচনা করা হইবে। সকল সম্প্রদায়ের লোক এই সভায় অপূর্ব আগ্রহ সহকারে যোগ দিয়াছিল। বন্যা সাহায্য সমিতি গঠন হইল এবং আমি তাহার সভাপতি নির্বাচিত হইলাম। আমি প্রথমতঃ এই গুরু দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে সম্মত ছিলাম না, কেন না তখন সবেমাত্র আমি খুলনা দুর্ভিক্ষের জন্য কর্তব্য সমাপন করিয়াছি। কিন্তু লোকে আমার আপত্তি গ্রাহ্য করিল না এবং বাধ্য হইয়া সভাপতির পদ গ্রহণ করিতে হইল।

 বন্যায় কিরূপ ক্ষতি হইয়াছিল, তাহা বুঝাইবার জন্য ‘স্টেটসম্যান’ হইতে নিম্নলিখিত বর্ণনা উদ্ধৃত করিতেছি। ঐ সংবাদপত্র ভারতবাসীদের প্রতি অতিরিক্ত প্রীতিবশতঃ অতিরঞ্জন করিয়াছে, এমন কথা কেহই বলিবেন না।

 “বন্যার ফলে লোকের যে সম্পত্তি নাশ হইয়াছে, যে ক্ষতি হইয়াছে, গবর্ণমেণ্টের হিসাবে তাহার পরিমাণ খুব কমই ধরা হইয়াছে। সরকারী স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী ডিরেক্টরের হিসাবে বগুড়া জেলার ক্ষতির পরিমাণ এক কোটী টাকার উপরে। তালোরা গ্রামে প্রায় ২০০ শত বাড়ীর মধ্যে সাতখানি মাত্র চালাঘর অবশিষ্ট আছে।

 “নওগাঁ মহকুমার অবস্থা পরিদর্শন করিবার ফলে আমি বলিতে পারি, সরকারী হিসাবে যাহা বলা হইয়াছে, গো-মহিষাদি পশু ও অন্যান্য সম্পত্তি নাশের দরুণ ক্ষতির পরিমাণ তদপেক্ষা অনেক বেশী। নওগাঁ মহকুমার লোকসংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ এবং এই মহকুমার এলাকায় প্রায় ৬০ হাজার গৃহ ধ্বংস হইয়াছে।

 “প্রায় সমস্ত গাঁজার ফসল নষ্ট হইয়াছে এবং ধান্য ফসল অতি সামান্যই রক্ষা পাইবে।” (স্টেটস্‌ম্যান, ১৫ই অক্টোবর, ১৯২২)।

 সরকারী ইস্তাহারেই স্বীকৃত হইয়াছে যে বগুড়ার বন্যাবিধস্ত অঞ্চল অপেক্ষা রাজসাহীর বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের আয়তন প্রায় তিনগুণ বেশী এবং সেখানে গৃহ ও সম্পত্তি ধ্বংস বাবদ ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশী। সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগের সহকারী ডিরেক্টরের হিসাবকে ভিত্তিস্বরূপ ধরিলে পাবনা ও রাজসাহী জেলায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ৫ কোটী টাকার কম হইবে না এবং সমগ্র বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের ক্ষতির পরিমাণ ৬ কোটী টাকার ন্যূন হইবে না।

 বিজ্ঞান কলেজের প্রশস্ত গৃহে বন্যা সাহায্য সমিতির অফিস করা হইল এবং অপূর্ব উৎসাহের চাঞ্চল্যে ঐ বিদ্যামন্দিরের নীরবতা যেন ভঙ্গ হইল। দলে দলে নরনারী ঐ স্থানে যাতায়াত করিতে লাগিল। প্রায় সত্তর জন স্বেচ্ছাসেবক—তাহার মধ্যে কলিকাতার কলেজ সমূহ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও ছিলেন—প্রত্যহ সকাল হইতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত অনবরত কার্য করিতেন। সাধারণ কার্যালয়, কোষাগার, দ্রব্যভাণ্ডার, টাকাকড়ি জিনিষপত্র পাঠাইবার আফিস, এবং ঐ সমস্ত গ্রহণ করিবার আফিস এক একটি ঘরে। এই সমস্ত বিভিন্ন বিভাগের জন্য পৃথক পৃথক স্থান নির্দিষ্ট হইল। কলিকাতা আফিসের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল—প্রচার বিভাগ। জনসাধারণকে ঐ বিভাগ হইতে সঠিক সংবাদ সরবরাহ করা হইত। ভারতের সর্বত্র—এমন কি ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকাতেও সাহায্যের জন্য আবেদন করা হইল। এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের কার্য ঠিক ঘড়ির কাঁটার মত নিয়মিত ভাবে চলিত। প্রতিষ্ঠানটি নানা শ্রেণীর লোক লইয়া গঠিত হইয়াছিল বটে, কিন্তু সকল কর্মীর প্রাণেই বন্যাপীড়িতদের জন্য সমবেদনা ও সেবার আগ্রহ ছিল—কাজেই সকলে ঐক্যবদ্ধ হইয়া কাজ করিতে পারিত।

 বেঙ্গল রিলিফ কমিটির সাফল্যের কারণ এই যে প্রথম হইতেই সমবায় এবং সহযোগিতার নীতি অনুসারে ইহার কার্য পরিচালিত হইয়াছিল। বন্যার ভীষণ দুঃসংবাদ প্রচারিত হওয়া মাত্র দেশের চারিদিকে অসংখ্য সাহায্য সমিতি গড়িয়া উঠিয়াছিল। বেঙ্গল রিলিফ কমিটি এই গুলির কার্যকে ঐক্যবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত না করিলে নানা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হইত এবং বহু শক্তির অপব্যয় হইত। বেঙ্গল রিলিফ কমিটি পূর্ব হইতেই অবস্থা বুঝিয়া, কংগ্রেস কমিটি, বেঙ্গল কেমিক্যাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস, বেঙ্গল সোশ্যাল সার্ভিস লীগ, বঙ্গীয় যুবকসঙ্ঘ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে, কার্য নির্বাহক সমিতিতে তাঁহাদের প্রতিনিধি পাঠাইবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন; উদ্দেশ্য, যাহাতে পরস্পর পরামর্শ ও আলোচনা করিয়া কার্যের শৃঙ্খলা বিধান করা যাইতে পারে। এই আহ্বানে সকলেই সাড়া দিলেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হস্তে বিভিন্ন অঞ্চলের ভার অর্পিত হইল। এইরূপে এমন একটি কার্যসঙ্ঘ গড়িয়া উঠিয়াছিল যাহার মধ্যে প্রত্যেক শাখা সঙ্ঘের স্বাতন্ত্র্য ও কার্যশক্তি অব্যাহত ছিল—অথচ সকলে মিলিয়া একটা বিরাট কার্য পরিচালনা সম্ভবপর হইয়াছিল।

 শ্রীমান সুভাষচন্দ্র বসুর হৃদয় আর্তের দুঃখে স্বভাবতঃই বিগলিত হয়। তিনিই স্বেচ্ছায় প্রথমে বন্যাবিধ্বস্ত স্থানে গিয়া অবস্থা স্বচক্ষে পরিদর্শন করেন। ডাঃ জে, এম. দাসগুপ্তও বহু স্বার্থত্যাগ করিয়া, বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলে কিছুকাল থাকিয়া সেবাসমিতি গঠন করেন। বগুড়ার নিঃস্বার্থ কর্মী শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রনাথ রায়, নৌকার অভাবে কেরোসিন টিনের তৈরী নৌকায় চড়িয়া কয়েক মণ চাউল লইয়া বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থ অগ্রসর হন। বেঙ্গল কেমিক্যালের সহপারিনটেণ্ডেণ্ট শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তও তাঁহার কারখানা হইতে বহু স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করিয়া বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলে গমন করেন।

 প্রায় দুইমাস পরে শ্রীযুত সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে রাজনৈতিক কার্যে যোগ দিবার জন্য গেলে, ডাঃ ইন্দ্রনারায়ণ সেনগুপ্ত, তাঁহার কার্যভার গ্রহণ করেন। ডাঃ ইন্দ্রনারায়ণের মত নিঃস্বার্থ কর্মী আমি খুব কমই দেখিয়াছি। কিন্তু সেবাকার্যের প্রধান চাপ পড়িয়াছিল শ্রীযুত সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের উপর। তাঁহার অসাধারণ কর্মশক্তি এবং সংগঠনী শক্তি সকলেরই প্রশংসা অর্জন করিয়াছিল। শ্রীযুত সতীশ বাবু বেঙ্গল রিলিফ কমিটির গোড়া হইতেই ছিলেন এবং সাধারণ পরিচালনা ভার তাঁহার উপরই ন্যস্ত ছিল। শেষকালে তাঁহার উপরেই সম্পূর্ণরূপে সমস্ত কাজের ভার পড়িয়াছিল। বেঙ্গল কেমিক্যালের কাজে তাঁহার গুরুতর দায়িত্ব সত্ত্বেও তিনি মাসে একবার বা দুইবার—আত্রাই কেন্দ্রে গমন করিতেন। তিনি একনিষ্ঠ ভাবে সেবাকার্য করিয়াছিলেন এবং রিলিফ কমিটির কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বীয় দায়িত্ব ত্যাগ করেন নাই।

 এই ব্যাপারে আমার নাম যে সমধিক প্রচারিত হইয়াছে, এজন্য আমি কুণ্ঠিত। প্রকৃত পক্ষে, আমি নামমাত্র কর্মকর্তা ছিলাম। বন্যাসেবাকার্যের সাফল্যের জন্য দায়ী আমার বিজ্ঞান কলেজের সহকর্মিগণ, বিশেষভাবে অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র, মেঘনাদ সাহা এবং শ্রীযুত নীরেন্দ্র চৌধুরীর (বঙ্গবাসী কলেজ) মত নিঃস্বার্থ কর্মিগণ।

 “মানচেষ্টার গার্ডিয়ানের” বিশেষ সংবাদদাতা ১১ই নবেম্বর তারিখে বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চল হইতে এক পত্রে নিম্নলিখিত বিবরণ প্রেরণ করেন:—

গবর্ণমেণ্টের মর্যাদা হ্রাস

 “আমি উত্তর বঙ্গের বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলে কয়েক দিন হইল আছি এবং যে সব ব্যাপার প্রত্যক্ষ দেখিতেছি ও শুনিতেছি, তাহা বেশ শিক্ষাপ্রদ।

 “উত্তর বঙ্গ গঙ্গার বদ্বীপে, এই নিম্নভূমিতে প্রধান ফসল ধান; ইহার মধ্য দিয়া বহু নদী প্রবাহিত এবং সেই সমস্ত স্বাভাবিক জল-নিকাশের পথ রোধ করিয়া আড়াআড়িভাবে রেলওয়ে লাইন চলিয়া গিয়াছে। ২৫শে সেপ্টেম্বর হইতে ২৭শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই অঞ্চলে প্রবল বর্ষা হয় এবং জলের উচ্চতা অভূতপূর্ব রূপে বাড়ে। তাহার ফলে সমস্ত চাষের জমী জলমগ্ন হয় এবং রেল লাইন পর্যন্ত জল ওঠে। বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের আয়তন প্রায় দুই হাজার বর্গ মাইল। লোকসংখ্যা দশ লক্ষেরও অধিক। ভগবানের কৃপায় লোকের মৃত্যু-সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। জলে ডুবিয়া প্রায় ৬০ জন লোকের মৃত্যু হইয়াছে। কিন্তু ঘন বসতিপূর্ণ প্রায় ৭০০ বর্গ মাইল পরিমিত স্থানে অর্দ্ধেকের বেশী গৃহই ধ্বংস হইয়াছে। গবাদি পশুর খাদ্য সমস্তই নষ্ট হইয়াছে এবং অন্ততঃপক্ষে ১২ হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত প্রায় ৫০০ শত বর্গ মাইল স্থানে, প্রধান ফসল (ধান্য) প্রায় সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। অবশিষ্ট বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলে ক্ষতির পরিমাণ এত বেশী না হইলেও, উপেক্ষার যোগ্য নহে

গবর্ণমেণ্টকে দোষ দেওয়া হইতেছে কেন?

 “এই বিপত্তি যখন ঘটে, তখন গবর্ণমেণ্টের সদস্যগণ বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চল হইতে বহুদূরে দার্জিলিঙের শৈলশিখরে ছিলেন। তাঁহারা এখনও সেখানে আছেন। এই বিপত্তির যে প্রাথমিক সংবাদ পাওয়া গিয়াছিল, তাহাতে বোধ হয় তাঁহারা অবস্থার গুরুত্ব বুঝিতে পারেন নাই। দুর্দশার প্রতিকারকল্পে কোন রূপ কার্যকরী পন্থা অবলম্বন করিতে তাঁহাদের বিলম্ব হইয়া গেল। যেটকু তাঁহারা করিলেন তাহাও যথেষ্ট নহে, এবং লোকমতের চাপে অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই যেন সেটুকু তাঁহাদের করিতে হইল—অন্ততঃপক্ষে বাংলার জনসাধারণের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হইল।

স্যার পি, সি, রায়

 “এইরূপ অবস্থায় একজন রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক, স্যার পি, সি, রায় কার্যক্ষেত্রে অগ্রসর হইলেন এবং গবর্ণমেণ্ট যে দায়িত্ব পালনে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করিয়াছেন, দেশবাসীকে তাহাই করিবার জন্য আহ্বান করিলেন। তাঁহার আহ্বানে সকলে সোৎসাহে সাড়া দিল। বাংলার জনসাধারণ একমাসের মধ্যেই তিন লক্ষ টাকা সাহায্য করিল। ধনী স্ত্রীলোকেরা তাঁহাদের রেশমের শাড়ী এবং গহনা দান করিলেন, গরীবেরা তাঁহাদের উদ্বৃত্ত পরিধেয় বস্ত্রাদি দান করিলেন। শত শত যুবক বন্যাপীড়িত স্থানে সেবাকার্যের জন্য অগ্রসর হইল। কাজটি কঠোর পরিশ্রমসাধ্য এবং ম্যালেরিয়াপূর্ণ স্থানে স্বাস্থ্যভঙ্গের আশঙ্কাও আছে।

 “গবর্ণমেণ্টের প্রতি লোকের অসন্তোষ বৃদ্ধির আরও কারণ এই যে, তাহাদের বিশ্বাস রেললাইন নির্মাণের ত্রুটীই এই বন্যার কারণ, বন্যার জল নিকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রেলপথ নির্মাণের সময় করা হয় নাই। এই অভিমত সমর্থনের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু বন্যার প্রায় দেড় মাস পরে গবর্ণমেণ্ট এ সম্বন্ধে তদন্ত করিবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

শক্তিশালী ব্যক্তি

 “স্যার পি, সি, রায়ের আহ্বানে সাড়া দিবার একটা কারণ,—বৈদেশিক গবর্ণমেণ্টকে প্রতিযোগিতায় পরাজিত করিবার স্বাভাবিক ইচ্ছা, আর একটা কারণ দুর্গতদের সেবা করিবার প্রবৃত্তি। কিন্তু স্যার পি, সি, রায়ের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও তাঁহার প্রভাবই ইহার প্রধান কারণ। স্যার পি, সি, রায় বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। তাঁহাকে গোঁড়া অসহযোগী বলা যাইতে পারে না, কিন্তু তিনি একজন প্রবল জাতীয়তাবাদী এবং গবর্ণমেণ্টের কার্যের তীব্র সমালোচক। শিক্ষক এবং সংগঠন কর্তা হিসাবেও তাঁহার ক্ষমতা অসাধারণ। একজন ইউরোপীয়কে আমি বলিতে শুনিয়াছি—‘মিঃ গান্ধী যদি আর দুইজন স্যার পি, সি, রায় তৈরী করিতে পারিতেন, তবে এক বৎসরের মধ্যেই তিনি স্বরাজ লাভে সক্ষম হইতেন।’ একজন বাঙালী ছাত্র আমাকে বলিয়াছিলেন, ‘যদি কোন সরকারী কর্মচারী অথবা কোন অসহযোগী রাজনীতিক সাধারণের কাছে সাহায্য চাহিতেন, তবে লোকে এক পয়সাও দিত কিনা সন্দেহ। কিন্তু যখন স্যার পি, সি, রায় সাহায্য চাহিলেন, তখন লোকে জানে যে অর্থের সদ্ব্যয় হইবে এবং এক পয়সাও অপব্যয় হইবে না।’ কলিকাতায় বিজ্ঞান কলেজে স্যার পি, সি, রায়কে দেখিবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছে এবং আমি বুঝিতে পারিয়াছি কেন তাঁহার স্বদেশবাসিগণের তাঁহার উপর এমন প্রগাঢ় আস্থা। একদিন দেখিলাম, বন্যাপীড়িতদের জন্য দেশবাসীর প্রদত্ত যে সব নূতন ও পুরাতন বস্ত্র স্তুপীকৃত হইয়াছে, সেইগুলি তিনি সানন্দে পর্যবেক্ষণ করিতেছেন। স্বেচ্ছাসেবকরা তাঁহার সম্মুখে সেইগুলি গুছাইতেছেন এবং বিভিন্ন সাহায্যকেন্দ্রে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিতেছেন। পরদিন দেখিলাম, তিনি দুইজন তরুণ ছাত্রকে রাসায়নিক পরীক্ষায় সাহায্য করিতেছেন,—আমার বোধ হইল শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে যথেষ্ট প্রীতির সম্বন্ধ বর্তমান। গবর্ণমেণ্টের কথা যখন তিনি বলিলেন, তখন আমার মনে হইল যে, তাঁহার সমালোচনার বিষয়ীভূত হওয়া অপেক্ষা তাঁহার অধীনে কাজ করা বহুগুণে শ্রেয়ঃ। তিনি এমন আবেগময় ও উৎসাহী প্রকৃতির লোক যে, তাঁহার পক্ষে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সমালোচক হওয়া কঠিন। কিন্তু তাঁহার সমালোচনায় যদি কাহারও মনে আঘাত লাগে, তবে তিনি এই ভাবিয়া তৃপ্তিলাভ করিতে পারেন যে, সাধারণ সমালোচকদের ন্যায় তিনি দায়িত্ব এড়াইবেন না, বরং সুযোগ পাইলে, নিজে সেই কর্তব্যভার গ্রহণ করিবেন এবং শেষ পর্যন্ত তাহা সম্পন্ন করিবেন। বন্যার প্রায় দেড়মাস পরে আমি বিধ্বস্ত গ্রামগুলি দেখিতে গেলাম। বন্যার জল তখন নামিয়া গিয়াছে, কিন্তু ক্ষতির চিহ্ন সুস্পষ্ট বর্তমান। বিভিন্ন সেবা-সমিতিগুলি অক্লান্তভাবে কাজ করিতেছে। স্যার পি, সি, রায়ের ‘বেঙ্গল রিলিফ সমিতি’ তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এবং ইঁহারা খুব শৃঙ্খলার সহিত কাজও করিতেছিলেন। ইহা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নহে, কিন্তু ইহার হিন্দুস্থানী কর্মীদের মধ্যে দেখিলাম সকলেই অসহযোগী।

সাহায্য সমিতির কর্মিগণ

 “সাহায্য সমিতির কর্ম পরিচালনার ভার ন্যস্ত হইয়াছিল, একজন বাঙালী যুবকের উপর (শ্রীযুত সুভাষচন্দ্র বসু)। ইনি প্রায় দুই বৎসর পূর্বে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, কিন্তু পরে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়া সিভিল সার্ভিস ত্যাগ করেন। সেই অবধি ইনি রাজনৈতিক আন্দোলনে সংসৃষ্ট আছেন। তাঁহার অধীনে প্রায় দুই শত স্বেচ্ছাসেবক সাহায্যকেন্দ্রে কাজ করিতেছেন, ইঁহাদের বয়স ১৭ হইতে ২৫ বৎসরের মধ্যে। সওদাগর আফিসের কয়েকজন কেরাণী তাঁহাদের প্রভুদের অনুমতি লইয়া এই সাহায্যকেন্দ্রে কর্মিরূপে যোগদান করিয়াছেন। চিকিৎসা বিভাগে কাজ করিবার জন্য কয়েকজন ডাক্তারও ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবকই কংগ্রেস কর্মী। তাঁহাদের মধ্যে অনেকে গান্ধিজীর আহ্বানে সরকারী স্কুল কলেজ ত্যাগ করিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে আমি একজন ‘অসহযোগী’ ভারতীয় খৃষ্টান যুবককে দেখিলাম,—আর একজন হিন্দু যুবককে দেখিলাম, তিনি যুদ্ধের পূর্বে বিপ্লব আন্দোলনে জড়িত সন্দেহে অন্তরীণ হইয়াছিলেন।

 “মোটের উপর প্রতিষ্ঠানটি ভাল বলিয়া বোধ হইল, স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মের আদর্শও খুব উচ্চ বলিয়া মনে হইল। তাঁহারা বিধ্বস্ত গ্রামগুলিতে স্বয়ং যান, নিজেরা সমস্ত অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন এবং গ্রামবাসীদের নিকট হইতে তাহাদের দুঃখদুর্দশা ও ক্ষতির পরিমাণ সম্বন্ধে তদন্ত করেন। তারপর, তাঁহারা গ্রামবাসীদের যাহা প্রয়োজন তাহা নিজেরা গিয়া দিয়া আসেন অথবা গ্রামবাসীদের নিকটবর্তী সাহায্যকেন্দ্র হইতে তাহাদের প্রয়োজনীয় জিনিষ সংগ্রহ করিবার জন্য অনুমতিপত্র দেন। এইভাবে গ্রামবাসীদিগকে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য, ঔষধ ও বস্ত্রাদি বিতরণ করা হইয়াছে এবং গৃহনির্মাণের উপকরণ ও গোমহিষাদি পশুর খাদ্য বিতরণ কার্য আরম্ভ হইয়াছে। অন্যান্য সাহায্য সমিতিও কাজ করিতেছে এবং গবর্ণমেণ্টও অনেক কাজ করিয়াছেন ও করিতেছেন। কিন্তু আমি অনুসন্ধানের ফলে বুঝিলাম যে গবর্ণমেণ্টের বিরদ্ধে লোকের অভিযোগের কারণ আছে। তাহারা স্পষ্টই বলিল যে, এই সমস্ত ব্যাপারে গবর্ণমেণ্টের যথেষ্ট মর্যাদা হ্রাস হইয়াছে এবং অসহযোগীদের মর্যাদা বাড়িয়াছে। স্যার পি, সি, রায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের উৎকৃষ্ট কার্যই ইহার প্রধান কারণ।

 “আমি সকল রকমের লোকের সঙ্গেই দেখা করিয়াছি এবং এ বিষয়ে কথাবার্তা বলিয়াছি। নিম্নপদস্থ সরকারী কর্মচারী, লোকাল বোর্ডের কর্মচারী, উকীল, জমিদার, রেল কর্মচারী, অসহযোগী স্বেচ্ছাসেবক এবং গ্রামবাসী সকলেই নিম্নলিখিতরূপে অভিমত প্রকাশ করিয়াছে। ছয় বৎসর পূর্বে ছোট রেল লাইনকে বড় লাইনে পরিণত করা হয়। ইহার ফলে জল নিকাশের পথ স্থানে স্থানে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ সঙ্কুচিত হয়। ইহারই পরিণাম স্বরূপ, ১৯১৮ সালে প্রবল বন্যা হয়, ১৯২০ সালে আর একবার সামান্য আকারে একটা বন্যা হয় এবং তাহার পর বর্তমান বিপত্তি। স্থানীয় সরকারী কর্মচারিগণ পুনঃ পুনঃ সতর্ক করিয়া দিলেও, গবর্ণমেণ্ট তাহাতে কর্ণপাত করেন নাই। এখন গবর্ণমেণ্টের রেলওয়ে বিশেষজ্ঞগণ, রেলওয়ে বাঁধই যে বন্যার জন্য দায়ী এবং তাহার জন্য বিষম ক্ষতি হইয়াছে, তাহা স্বীকার করিতে চাহিতেছেন না। গবর্ণমেণ্ট যে সুযোগ হারাইয়াছেন, অসহযোগীরা সেই সুযোগ গ্রহণ করিয়া গ্রামবাসীদের হৃদয় জয় করিয়া লইয়াছে। বেঙ্গল রিলিফ কমিটি খুব তৎপরতা ও সহৃদয়তার সহিত কাজ করিয়াছে। ইহার কর্মীরা গ্রামে গিয়া কৃষকদের প্রাণে সাহস সঞ্চার করিয়াছে। রেলওয়ে বিভাগ ও তাহার কর্মচারিগণ ও খুব তৎপরতার সহিত সাহায্য করিয়াছেন এবং স্থানীয় সরকারী কর্মচারিগণ খুবই পরিশ্রমসহকারে গ্রামবাসীদের দুঃখ লাঘব করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, যদিও কোন কোন সরকারী কর্মচারী (সুখের বিষয়, তাঁহারা ইউরোপীয় নহেন) বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগগুলির প্রতি ঈর্ষার ভাবই প্রকাশ করিয়াছেন।

 “কিন্তু বেঙ্গল রিলিফ কমিটির ব্যবস্থার তুলনায় সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যবস্থা উৎকৃষ্ট বলা যায় না। চারিটি সরকারী জিলা এবং চারিটি সরকারী বিভাগ বন্যা সাহায্যকার্যের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তথাপি গবর্ণমেণ্ট কেবলমাত্র বন্যা সাহায্য কার্যের জন্য কোন কর্মচারী নিযুক্ত করেন নাই; এ বিষয়ে বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে শৃঙ্খলা বিধান করিতে পারেন, স্বেচ্ছাসেবকদের সুপরিচালিত করিতে পারেন, এমন কোন দায়িত্বসম্পন্ন লোকও নাই। কোন কোন বিভাগ লোক পাঠান বটে, কিন্তু উহাদের কোন কাজ থাকে না। আবার, অন্য কোন কোন বিভাগের লোকও নাই, টাকাও নাই। জনরব শুনিলাম যে, ২০ হাজার টাকা মূল্যের বীজ বিতরণ করিতে, কর্মচারীদের মাহিনা ও ভাতা বাবদ গবর্ণমেণ্টের ২০ হাজার টাকা ব্যয় হইয়াছে। এটা আনুমানিক হিসাব মাত্র, পরীক্ষিত হিসাব নহে সত্য, কিন্তু আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, একজন কৃষিবিশেষজ্ঞ অন্য দুইজন কৃষিবিশেষজ্ঞের কাজ পরীক্ষা করিতেছিল, শেষোক্ত দুইজন বস্তুতঃ কোন কাজই করে নাই। সুতরাং পূর্বোক্ত আনুমানিক হিসাবের চেয়ে বেশী খরচ হওয়াও আশ্চর্যের বিষয় নহে।[]

স্টেশন মাস্টারের অভিজ্ঞতা

 “একজন ষ্টেশন মাষ্টারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, তিনি তাঁহার স্ত্রী ও নবজাত শিশুসহ একটি গ্রাম্য ষ্টেশনে ছিলেন। বন্যার জল বাড়িতে আরম্ভ করিলে তাঁহার স্ত্রী নিজেদের বাসা ত্যাগ করিয়া ষ্টেশনের টিকিট ঘরে আশ্রয় লইতে বাধ্য হন। চারটি সাপও এই ঘরে আশ্রয় লইয়াছিল। ষ্টেশন মাষ্টার বলেন, তাঁহার ঘরের জানালার বাহিরে প্লাটফরমের উপরে একটা ছোট গাছ ছিল। সেই গাছের উপরে ২০টি সাপকে তিনি আশ্রয় লইতে দেখেন। ঐ অঞ্চলে যত সাপ ছিল, বন্যার ফলে সকলেই বিবরচ্যুত হইয়া মানুষের মতই উচ্চ ভূমিতে আশ্রয় অন্বেষণ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। জল আরও বাড়িলে ষ্টেশন মাষ্টার আরও উচু জায়গার সন্ধানে বাহির হইলেন। লাইনের অপর দিকে গুদাম ঘর। সেখানে গিয়া সস্ত্রীক তিনি আশ্রয় লইলেন। ধানের বস্তার উপর তামাকের বস্তা ফেলিয়া যতদূর সম্ভব উঁচু করিয়া তাহার উপর তাঁহারা উঠিলেন। তখন বেলা ১টা। পরদিন রাত্রি ৮টার সময় দেখা গেল জল আরও বাড়িয়াছে এবং তাঁহাদের আশ্রয় স্থান পর্যন্ত পৌছিয়াছে। তাঁহারা জীবনের আশা ত্যাগ করিলেন। রাত্রি দশটায় শিশুটির মৃত্যু হইল। তারপর জল কমিতে লাগিল। পাকা ষ্টেশনঘরে থাকিয়া স্টেশন মাষ্টারেরই যদি এই অবস্থা হয়, তবে দরিদ্র গ্রামবাসীদের কি অবস্থা হইয়াছিল, অনুমানেই বুঝা যাইতে পারে। তাহাদের কুঁড়ে ঘর ও মাটীর দেওয়াল বন্যার প্রথম আঘাতেই ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। তাহাদের অনেকে গাছের উপর আশ্রয় লইয়াছিল এবং অনাহারে দুই তিন দিন কাটাইবার পর কর্মীরা নৌকা লইয়া গিয়া তাহাদের নামাইয়া আনিয়াছিল। আমি স্থানীয় একজন ক্ষুদ্র জমিদারের কথা শুনিয়াছি। তিনি নিজের নৌকা লইয়া উদ্ধার কার্য করিতেছিলেন। বন্যার দ্বিতীয় দিনে তিনি দেখেন, একটি ঘর তখনও টিকিয়া আছে। আর তাহার মধ্যে দুইটি মুরগী, একটি শিয়াল, একটি শশক, দুইজন মানুষ এবং কতকগুলি সাপ আশ্রয় লইয়াছে।

 “গবর্ণমেণ্টের জনৈক সদস্য সেদিন বলিয়াছেন যে, গবর্ণমেণ্ট দাতব্য প্রতিষ্ঠান নহে। তিনি যদি বন্যাবিধ্বস্ত স্থানগুলি দেখিতেন এবং গ্রামবাসীদের অসীম দুর্দশা প্রত্যক্ষ করিতেন, তবে তিনি এই সময়ে এরূপ কথা বলিতে ইতস্ততঃ করিতেন।

গবর্ণমেণ্টের কোথায় কর্তব্যচ্যুতি হইয়াছে

 “প্রকৃত কথা এই যে, যখন গবর্ণমেণ্টের উদার ও মুক্তহস্ত হওয়া উচিত ছিল তখনই তাঁহারা অতি সাবধানতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। গ্রামবাসীদের জীবনোপায় নষ্ট হইয়া গিয়াছিল, তাহাদের মূলধন সামান্য যাহা কিছু ছিল, ধ্বংস হইয়ছিল এবং ভয়ে তাহারা বুদ্ধিহারা হইয়া পড়িয়াছিল। এই সময়ে এমন লোকের প্রয়োজন ছিল, যিনি তাঁহাদের প্রাণে সাহস সঞ্চার এবং তাহাদের সঙ্গে সহানভূতি প্রকাশ করিতে পারেন এবং যথাসাধ্য তাহাদের বিপদে সাহায্য করিয়া তাহাদিগকে ধ্বংসের মুখ হইতে বাঁচাইতে পারেন। স্থানীয় সরকারী কর্মচারীরা তাঁহাদের সাধ্যানুসারে এই কাজ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু গবর্ণমেণ্ট তাঁহাদের প্রয়োজনানুরূপ অর্থ দেন নাই, গ্রামবাসীকে বিশেষ কোন ভরসাও তাঁহারা দিতে পারেন নাই। সুতরাং ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটির’ উপরেই এই কাজ করিবার ভার পড়িয়াছিল এবং স্যার পি, সি, রায় যে বীজ বপন করিয়াছেন, তাহার সুফল অসহযোগীরাই ভোগ করিবে, ভোগ করিবার যোগ্যতাও তাহাদের আছে বটে। স্থানীয় সমস্ত সরকারী কর্মচারীই আমাকে বলিলেন যে, স্বেচ্ছাসেবকেরা গ্রামবাসীদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করিয়াছে এবং আগামী নির্বাচনে তাহারা স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ পালন করিবে। আমি জনৈক সরকারী কর্মচারীর সঙ্গে একটি ক্ষুদ্র সাহায্য কেন্দ্র দেখিতে গিয়াছিলাম। সেখানে গ্রামবাসীরা স্পষ্টই আমাদিগকে বলিল যে, গান্ধী মহারাজ (এখন আর ‘মহাত্মা গান্ধী’ নহেন, ‘গান্ধী মহারাজ’) এবং তাঁহার শিষ্যগণ গ্রামবাসীদিগকে রক্ষা করিয়াছেন, আগামী নির্বাচনে তাহারা গান্ধী মহারাজের পক্ষে ভোট দিবে। ইউরোপীয় কর্মচারীদের পরিবর্তে তাহারা ভারতীয় কর্মচারীদের চাহে, কেন না তাহারা গান্ধী মহারাজের স্বেচ্ছাসেবকদের মত তাহাদের অভাব অভিযোগ বুঝিতে পারিবে এবং সহানুভূতি প্রকাশ করিবে। তাহারা বলিল যে স্বরাজ যত শীঘ্র সম্ভব আসুক, ইহাই তাহাদের প্রার্থনা, কেন না স্বরাজের আমলে তাহারা সুখী হইবে। আমি আরও দুইদিন গ্রামে কাটাইয়াছিলাম, প্রথম দিন জনৈক অসহযোগী স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে, দ্বিতীয় দিন জনৈক অভিজ্ঞ ভারতীয় কর্মচারীর সঙ্গে। প্রত্যেক স্থানেই আমি ঐরূপ কথা শুনিতে পাই। গ্রামবাসীদের মনে পূর্বে যদি বা কিছু সংশয় থাকিয়া থাকে, এখন আর তাহা নাই। তাহারা বিশ্বাস করে যে অসহযোগীরাই তাহাদের প্রকৃত বন্ধ, সরকারী কর্মচারীরা নহে। সরকারী কর্মচারীরা নিজেরাও দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করিলেন যে, বাংলার গ্রামে ইহাই এখন প্রচলিত ধারণা।

 “আমার মনে এই ভাব আরও দৃঢ় হইল, কেন না যে সব গ্রামের কথা বলিতেছি সেগুলি মোটেই রাজনৈতিক হিসাবে উন্নত নহে। এই অঞ্চল সাধারণতঃ অনুন্নত, গ্রামবাসীরা দরিদ্র, অশিক্ষিত, সরল-প্রকৃতি, এবং ভীরু। ইহাদের অধিকাংশই মুসলমান।

 “আমি বলিয়াছি যে পাঞ্জাবে গুরু-কা-বাগের ব্যাপারে অসহযোগ জয়লাভ করিয়াছে। বাংলাদেশেও এই বন্যা সেবাকার্যের ভিতর অসহযোগ আন্দোলন আরও একবার জয়লাভ করিল।”

 মিঃ সি, এফ, অ্যানড্রুজ একাধিকবার বন্যাপীড়িত অঞ্চল পরিদর্শন করেন। তিনি সংবাদপত্রে এই বিষয়ে ৪টি প্রবন্ধ লিখেন। তাহা হইতে কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত হইল।

 “আমরা সুদীর্ঘ ভ্রমণপথে কয়েকটি গ্রামের মধ্য দিয়া গেলাম এবং সহজেই দেখিতে পাইলাম—বেঙ্গল রিলিফ কমিটির কর্মীরা কিরূপে প্রশংসনীয় কার্য করিয়াছে। তাহারা গ্রামবাসীদের গৃহ পুনর্নির্মাণ করিয়া দিয়াছে। অধিকাংশ স্থলে তাহাদের সাহায্যেই এই গৃহনির্মাণ কার্য হইয়াছে। এই ভ্রমণকালে, তাহাদের প্রচেষ্টা যে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে, তাহাই দেখিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি। রেলওয়ে লাইন হইতে দূরে নিভৃত গ্রামেও আমি গিয়াছি এবং সেখানেও তাহাদের সেবার হস্ত প্রসারিত হইতে দেখিয়াছি। কর্মীরা যেন সর্বত্রগামী, এবং তাহাদের কাজ যেমন স্বল্প ব্যয়ে নির্বাহিত হইয়াছে, তেমন ফলপ্রদত্ত হইয়াছে। যতই ঐ সব কাজ আমি দেখিয়াছি, ততই আমার মনে উচ্চ ধারণা জন্মিয়াছে। বস্তুতঃ, একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, ডাঃ পি, সি, রায় এবং তাঁহার সহকারিবৃন্দ শ্রীযুত দাশগুপ্ত, ডাঃ সেনগুপ্ত এবং অধ্যাপক এস, এন, সেনগুপ্তের উৎসাহ ও প্রেরণায় যে কাজ হইয়াছে, তাহা বর্তমান ভারতে মানবের দুঃখদুর্দশা দূর করিবার জন্য একটি সুমহৎ প্রচেষ্টা।

 “স্বেচ্ছাসেবকদের যে অভিজ্ঞতা হইয়াছে, তাহাও অপূর্ব। তাহাদের অনেকে আমাকে বলিয়াছে যে, মানবের দুর্দশা ও সহিষ্ণুতাশক্তির যে জ্ঞান তাহারা লাভ করিয়াছে, তাহার ফলে তাহাদের জীবনের আদর্শই পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। গভীর বিপদের মধ্যেও গ্রামবাসীরা যে সন্তোষ ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়াছে, স্বেচ্ছাসেবকরা আমার নিকট শতমুখে তাহার প্রশংসা করিয়াছে।

 “সান্তাহারে বেঙ্গল রিলিফ কমিটির প্রধান কর্মকেন্দ্রে তাঁহাদের কার্যপদ্ধতি আমি বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করিয়াছি এবং তাহা যেভাবে পরিচালিত হইতেছে, তাহা দেখিয়া আমি চমৎকৃত হইয়াছি। ইহা ঠিক যেন কোন ব্যবসায়ী ফার্মের প্রধান আফিস। কাগজপত্র যথারীতি রাখা হয় এবং হিসাব নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করা হয়। আমার নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফলে আমি সাধারণকে নিশ্চিতরূপে জানাইতে পারি যে, সাহায্য কার্যের জন্য যে অর্থ দান করা হইয়াছে, তাহার একটি পয়সাও অপব্যয় হয় নাই। সাহায্য বিতরণ ও পরিদর্শন প্রভৃতির জন্যও যতদূর সম্ভব কম ব্যয় করা হইয়াছে। যে অর্থ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র অপব্যয় হইবার আশঙ্কা নাই।......ঐ অঞ্চলে যত লোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে, তাঁহাদের সকলেরই বিশ্বাস যে, এই নূতন রেলওয়ে বাঁধের জন্য দেশের স্বাভাবিক জল-নিকাশের পথ রুদ্ধ হইয়াছে। ইহা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে রাজসাহী জেলার আত্রাই-পাতিসার অঞ্চলে প্রায় একমাসকাল জল দাঁড়াইয়াছিল এবং ঐ সময়ের মধ্যেই ঐ অঞ্চলের সমস্ত ফসল নষ্ট হইয়া গিয়াছিল।

 “এই প্রবন্ধ শেষ করিবার পূর্বে, কলিকাতাস্থিত বেঙ্গল রিলিফ কমিটির গঠনকর্তাগণ এবং বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের কর্মিগণ সকলকেই আমি প্রশংসা ও সাধুবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। ইঁহাদের মধ্যে অনেকে বন্যার প্রথম হইতে এই অক্টোবর মাস পর্যন্ত ক্রমাগত অক্লান্তভাবে কাজ করিতেছেন। তাঁহাদের পরিশ্রম কাজের বিস্তৃতির সঙ্গে ক্রমেই বাড়িতেছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া অতিরিক্ত পরিশ্রমে এবং উপযুক্ত আহার্য ও বিশ্রামের অভাবে অনেক কর্মী অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন। সাহায্যকেন্দ্রের হাসপাতালে এই সব কর্মীদের চিকিৎসা করা হইয়াছে এবং সুস্থ হইয়াই প্রশংসনীয় সাহসের সহিত তাঁহারা পুনরায় কর্মে যোগ দিয়াছেন।”

 বর্তমানকালে যতদূর স্মরণ হয়, এরূপ ভীষণ বন্যা ইতিপূর্বে আর হয় নাই। ছয় সাত বৎসর পূর্বে ইহার বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এই বৎসরের (১৯৩১) সেপ্টেম্বর মাসেও আর একটি প্রবল বন্যা উত্তর ও পূর্ব বঙ্গের বহুলাংশ বিধ্বস্ত করিয়াছে। ইহা ভীষণতা, ধ্বংসের পরিমাণ এবং বিস্তৃতিতে পূর্বের সমস্ত বন্যাকে অতিক্রম করিয়াছে। হিমশিলার মত ইহা সম্মুখে যাহা পাইয়াছে, সমস্তই ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে।

 অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা ১৯২২ সালের বন্যা সাহায্য কার্যে একজন প্রধান কর্মী ছিলেন। “বাংলার বন্যা ও তাহা নিবারণের উপায়” নামক একটি প্রবন্ধের মুখেবন্ধে তিনি বলিয়াছেন:—

 “কয়েক বৎসর পূর্বে বাংলাদেশে প্রবল বন্যা হইয়া গিয়াছে। গত বৎসরেও আর একটি বন্যা হইয়াছে।

 “সংবাদপত্রের বিবরণে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদীর গর্ভে প্রায় ২৫ হাজার বর্গ মাইল স্থান গত বৎসর (১৯৩১) ভীষণ বন্যায় বিধ্বস্ত হইয়াছিল। স্মরণীয় কালের মধ্যে এরপ বন্যা এদেশে আর হয় নাই। এই অঞ্চলে লোকবসতির পরিমাণ প্রতি বর্গ মাইলে প্রায় ৮ শত। সতরাং ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, বন্যায় প্রায় বিশ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে এবং প্রায় ৪ লক্ষ গৃহ বিধস্ত হইয়াছে। লেখকের বন্যা সম্বন্ধে যে অভিজ্ঞতা আছে (তাঁহার বাড়ী বন্যাপীড়িত অঞ্চলে) এবং সংবাদপত্রে যে বিবরণ বাহির হইয়াছে, তাহা হইতে অনুমান করা যাইতে পারে এই বন্যায় বাংলাদেশের ৮ কোটী হইতে ১০ কোটী টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হইয়াছে। বাংলাদেশের প্রত্যেক বাড়ীর মূল্য গড়ে ২০০ শত হইতে ২৫০ শত টাকা ধরিয়া এই হিসাব করা হইতেছে। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে বেশী হইবারই সম্ভাবনা।” (মডার্ণ রিভিউ, ফেব্রুয়ারী, ১৯৩২)।

 আমি পুনর্বার বন্যাপীড়িতদের সাহায্য কার্যের জন্য আহূত হইলাম এবং সঙ্কটত্রাণ সমিতি ঐ কার্যের ভার গ্রহণ করিল। পূর্ব পূর্ব বারের ন্যায় এবারও আমাদের সাহায্যের আবেদনে লোকে সাড়া দিল। কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্যে মন্দা এবং অর্থাভাবের জন্য, লোকের সহৃদয়তা সত্ত্বেও পূর্বের মত অর্থ পাওয়া গেল না। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাইতেছি যে, খুলনা দর্ভিক্ষ, উত্তরবঙ্গের বন্যা, এবং বর্তমান বন্যা—সকল সময়েই ইউরোপীয় মিশনারীদের নিকট হইতে আমি অর্থসাহায্য ও সহানুভূতি লাভ করিয়াছি। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করিয়া আমাকে দিয়াছেন। কেহ কেহ স্বচক্ষে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য বন্যাপীড়িত অঞ্চলে গিয়াছেন এবং সংবাদপত্রে তাঁহাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করিতে দ্বিধা করেন নাই।

 এবারও বিজ্ঞান কলেজের গৃহে সঙ্কটত্রাণ সমিতির কার্যালয় খোলা হইয়াছিল এবং সৌভাগ্যক্রমে শ্রীযুত সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, পঞ্চানন বসু, ক্ষিতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত প্রভৃতির মত কর্মীদের সাহায্য আমি পাইয়াছিলাম। ইঁহারা নিজেদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করিয়াও প্রভাত হইতে রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত কার্য করিতেন। প্রধানতঃ কাঁথি ও তমলুক হইতে আগত একদল স্বেচ্ছাসেবক আমাদের কার্যে বিশেষরূপে সাহায্য করিয়াছিলেন। বন্যার প্রথম অবস্থায় বিধস্ত অঞ্চলে কলেরা ও ম্যালেরিয়ার প্রাদূর্ভাব হইয়াছিল। কিন্তু এইসমস্ত ত্যাগী কর্মীরা “অজ্ঞাত যোদ্ধার” মতই সে সব বিপদ গ্রাহ্য করেন নাই। মানবসেবার আহ্বানে সাড়া দিয়া স্কুল কলেজের ছাত্রগণ এবং জনসাধারণও অর্থসংগ্রহ কার্যে ব্রতী হইয়াছিলেন। কয়েকমাস পর্যন্ত একটা অপূর্ব দৃশ্য দেখা গিয়াছিল—ছোট ছোট বালক বালিকারা পর্যন্ত বিজ্ঞান কলেজে তাহাদের সংগৃহীত অর্থ দান করিবার জন্য আসিত।

 গবর্ণমেণ্ট তাঁহাদের অভ্যাসমত দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের কাতর চীৎকারে কর্ণপাত করিলেন না। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহের স্তম্ভে বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের দুঃখদুর্দশার কথা সবিস্তারে প্রকাশিত হইতেছিল। সুতরাং দুর্ভিক্ষ, বন্যা প্রভৃতির প্রতিকারের ভার শাসনপরিষদের যে সদস্যের উপর, তিনি স্পেশাল সেলুন গাড়ীতে এবং ষ্টীমলঞ্চে চড়িয়া বন্যাপীড়িত অঞ্চল দেখিতে গেলেন। কিন্তু সদস্য মহাশয়ের নিজের চোখকাণ রুদ্ধ, অধস্তন কর্মচারীদের চোখকাণ দিয়াই তিনি দেখাশোনা করেন। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা ম্যাজিট্রেট, নিজের সিভিলিয়ান সেক্রেটারী ইহারাই তাঁহার বার্তাবহ ও মন্ত্রণাদাতা। দুর্ভাগ্যের বিষয় এবারে মিঃ গাইনের মত সংবাদপত্রের কোন প্রতিনিধি ছিলেন না, যিনি বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের হুবহু বর্ণনা করিতে পারেন। এই কথা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, বন্যাপীড়িত অঞ্চলে পূর্ব বৎসর হইতেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছিল। এই অঞ্চলের প্রধান ফসল পাটের দর কমিয়া যাওয়াতেই দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হইয়াছিল।

 কিন্তু গবর্ণমেণ্টের জনৈক সদস্য পূর্বেই বলিয়াছিলেন যে, গবর্ণমেণ্ট দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয় এবং দান করিবার অবসর তাঁহাদের নাই। সুতরাং বন্যায় লোকের যে অপরিসীম ক্ষতি হইয়াছিল, তাহা লঘু করিয়া দেখাইবার চেষ্টা করা গবর্ণমেণ্টের পক্ষে স্বাভাবিক। রাজস্ব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য তাঁহার ইস্তাহারে বলেন,—

 “বর্তমানে কোন দুর্ভিক্ষ নাই, যদিও কিছু সাহায্য করিবার প্রয়োজন আছে। গবর্ণমেণ্ট এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সকলেই সে সাহায্য করিতেছেন।”

 অনাহারের দৃষ্টান্তও তাঁহার চোখে পড়ে নাই!

 “সংবাদপত্রের সংবাদদাতারা যে সমস্ত আশঙ্কাজনক বিবরণ প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা যে অতিরঞ্জিত, বন্যাপীড়িত স্থানের বর্তমান অবস্থা দেখিয়া তাহা বুঝিতে পারা গেল। যদিও এখনও কতকগুলি লোককে সাহায্য করিবার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তাহাদের সংখ্যা বেশী নহে।”

 জনৈক ইংরাজ ধর্মযাজক কিন্তু বন্যাপীড়িত অঞ্চলের অবস্থা সম্পর্কে নিম্নলিখিতরূপ বিবৃতি প্রদান করিয়াছেন:—

 “ষ্টেটসম্যানের সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু (১৯৩১, ২৯শে সেপ্টেম্বর)—

 “আপনার ২৩শে সেপ্টেম্বর (১৯৩১) বুধবারের সংখ্যায় বাংলার বন্যার অবস্থা সম্পর্কে যে সরকারী ইস্তাহার প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা আমি খুব মনোযোগের সহিত পড়িলাম। ইস্তাহার পড়িয়া বোধ হইল যে রাজস্ব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য মহাশয় পাবনা, বগুড়া, এবং রংপুর জেলায় সাতদিন দ্রুতগতিতে ভ্রমণ করিয়াছেন এবং তাঁহার সেই ‘প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা’ হইতে তিনি সরকারী ইস্তাহারে বন্যার বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই।

 “তাঁহার সাহস প্রশংসনীয় হইলেও বিচারবুদ্ধির প্রশংসা করা যায় না। পাবনা জেলা সম্বন্ধে, বিশেষতঃ বেড়া এবং বনওয়ারী নগরের বিল অঞ্চল সম্বন্ধে যে রিপোর্ট দেওয়া হইয়াছে, তাহা ভ্রমাত্মক। আমি এই অঞ্চলে সম্প্রতি তিন সপ্তাহ ভ্রমণ করিয়া আসিয়াছি এবং নিজের সামর্থানুসারে সাহায্য কার্যও করিয়াছি। আমি দেখিয়াছি যে, অনেক স্থলেই, বিশেষতঃ বিল অঞ্চলে ও ইচ্ছামতী ও চিকনাই নদীর নিকটে, আউস ও আমন ধান বন্যায় ডুবিয়া গিয়াছে এবং দরিদ্র গ্রামবাসীরা কাঁচাধান যেটকু পারে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেছে। বলা বাহুল্য, উহা গরুর খাদ্য ছাড়া আর কোন প্রয়োজনে লাগিবে না। মাননীয় সদস্য মহাশয় বলেন, ‘ঐ অঞ্চলে অনাহারের কোন দৃষ্টান্ত দেখিতে পান নাই।’ তিনি ও তাঁহার দলবল যেখানে লঞ্চে ছিলেন, সেখানে হয়ত অনাহারের দৃষ্টান্ত ছিল না। যদি তিনি দুই একদিনও থাকিতেন এবং আমার মত গ্রামের ভিতরে যাইতেন, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই দেখিতে পাইতেন যে শত শত লোক অনশনে, অর্ধাশনে আছে। অনেক স্থলে আমি দেখিয়াছি যে, তিনদিনের মধ্যে একবার আহার, সৌভাগ্য বলিয়া গণ্য। আমি যে সমস্ত গ্রামে গিয়াছি এবং যে সব লোককে সাহায্য করিয়াছি, তাহাদের নামের তালিকা দিতে পারি। ঐ সব স্থান অসীম দুর্দশাগ্রস্ত।

 ....“বন্যা সাহায্যের জন্য যে অর্থ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা আপাততঃ জমা করিয়া রাখার পরামর্শ দেওয়া হইয়াছে দেখিয়া আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম। দুর্দশাগ্রস্তদের মধ্যে খাদ্য-সাহায্য বিতরণ করিবার এই সময় এবং যে অর্থ সংগৃহীত হইয়াছে তদ্ব্যতীত আরও অর্থ এই উদ্দেশ্যে এবং বস্ত্র ও ঔষধের জন্য প্রয়োজন; গবর্ণমেণ্টকে সেই কারণে আমি পরামর্শ দিই যে, তাঁহারা বীজশস্য এবং চাষের বলদ প্রভৃতির জন্য ঋণদান কার্য চালাইতে থাকুন। বন্যায় অধিকাংশ গো-মহিষাদি ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। সাধারণের নিকট হইতে যে অর্থ পাওয়া গিয়াছে, তাহা বর্তমানে দুর্গতদের সাহায্যের জন্য বিতরণ করা হউক।”

পাবনা, ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩১
(রেভাঃ) অ্যালান, জে, গ্রেস

 মিঃ এইচ, এস, সুরাবর্দী বন্যাপীড়িত অঞ্চল পরিভ্রমণ করিয়া ‘ষ্টেটসম্যানে’ একখানি সুদীর্ঘ পত্র লেখেন (২২শে অক্টোবর, ১৯৩১)। তাহাতে তিনি বলেন যে,—“স্মরণীয় কালের মধ্যে বাংলায় এরূপ ভীষণ বন্যা আর হয় নাই।”

 “জনৈক ভারতীয় পত্রলেখক” রেভাঃ গ্রেসের উক্ত পত্রের উপর নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করেন (৩০শে সেপ্টম্বর, স্টেটস্‌ম্যান):—

 “গত মঙ্গলবারের ষ্টেটসম্যানে বন্যাপীড়িত অঞ্চলের অবস্থা সম্বন্ধে পাবনার রেভাঃ অ্যালান গ্রেসের যে পত্র প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা বাংলা গবর্ণমেণ্টের রাজস্ব বিভাগের সদস্য মহাশয়কে বিব্রত করিয়া তুলিবে। মিশনারী মহাশয় রেভেনিউ সদস্যের উক্তির তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছেন, এবং দেখাইয়াছেন যে, অনাহারের কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় নাই—সরকারী ইস্তাহারের এই বর্ণনা সত্য নহে। মিঃ গ্রেসের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, কোন কোন স্থানে লোকে তিন দিনে একবার আহার করাটা সৌভাগ্যের বিষয় বলিয়া মনে করে। সরকারী ইস্তাহারের এইরূপ প্রতিবাদ যদি কোন ভারতবাসী করিতেন তবে তাহা রাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের মিথ্যা প্রচার কার্য বলিয়া অগ্রাহ্য হইত। কিন্তু গবর্ণমেণ্ট বা অপর কেহ মিঃ গ্রেসকে সেই দলে ফেলিতে পারিবেন কি না সন্দেহ। তাঁহার সময়োচিত ও সাহসিকতাপূর্ণ উক্তি দেখাইয়া দিয়াছে যে, সরকারী ইস্তাহারে মাঝে মাঝে যে সব বিবৃতি করা হয়, তাহা একরূপ অসার। এবং আরও দুঃখের বিষয় এই যে, এই ইস্তাহার একজন বাঙালী সদস্যের তদন্তের ফলাফলের উপর নির্ভর করিয়া লিখিত। এই বাঙালী সদস্য মহাশয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে বিচারপতির কার্যে যাপন করিয়াছেন।......”

 আমার মতে লেখক আসল প্রশ্নটাই এড়াইয়াছেন। রেভেনিউ সদস্যের পদে ঘটনাচকে একজন বাঙালী ছিলেন। আসলে বর্তমান শাসনপ্রণালীই যে শোচনীয় অবস্থার জন্য দায়ী, একথা আমি পূর্বেই বলিয়াছি।

 আর অধিক দৃষ্টান্ত উল্লেখ না করিয়া আমি শুধু এখানে শ্রীযুত সতীশচন্দ্র দাশ গুপ্তের বর্ণনা উদ্ধৃত করিব। তিনি নিজে বন্যা-বিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেন, শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও পদব্রজে ভ্রমণ করিয়া স্বচক্ষে সমস্ত অবস্থা দেখেন।

 “একটি গ্রামে, একটি পরিবার ব্যতীত সমস্ত লোককে আমি কুমুদ ফুলের মূল খাইয়া জীবন ধারণ করিতে দেখিয়াছি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাহারা অন্ন কাহাকে বলে জানিতে পারে নাই। গ্রামে অনাহারেও লোকের মৃত্যু হইয়াছে। মেয়েরা ছিন্ন বস্ত্র পরিয়াছিল, পুরুষেরা দুর্বল ও নৈরাশ্যগ্রস্ত, বালক বালিকাদের স্বাস্থ্য শোচনীয়। আমি যখন গিয়াছিলাম, দেখিতে পাইলাম যে, কতকগুলি বালক বালিকা কুমুদ ফুলের মূলের সন্ধান করিতেছে। এবং মেয়েরা গৃহে উহাই খাদ্যের জন্য সিদ্ধ করিতেছে। টাঙ্গাইলের বাসাইল থানার অন্তর্গত চাকদা গ্রামের এই অবস্থা। বন্যা বিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন শত শত গ্রাম আছে, যাহার অবস্থা এর চেয়ে ভাল নয়। যেখানে কুমুদ ফল হয় না, অথবা যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় না, সেখানে লোকে কলা পাতার আঁশ খাইয়া জীবন ধারণ করিতেছে।”

 শ্রীযুত ক্ষিতীশচন্দ্র দাশগুপ্তও বন্যাপীড়িত অঞ্চলে লোকের অবস্থা পরিদর্শন করিতে গিয়াছিলেন। তিনি লোকের বাড়ীতে রন্ধনশালার ভিতরে গিয়া, তাহারা কি খাইয়া বাঁচিয়া আছে অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছিলেন।

 “একটি বাড়ী প্রবেশ করিয়া ঘরের মধ্যে চাহিয়া ক্ষিতীশ বাবু এককোণে দুইখানি ইক্ষুখণ্ড দেখিলেন। গৃহস্বামী ক্ষিতীশ বাবুকে তৎক্ষণাৎ বুঝাইয়া দিলেন যে উহা ইক্ষুখণ্ড নহে, কদলীর ডগা মাত্র। ঐগুলি চাঁচা হইয়াছে, সেজন্য ইক্ষুর মত দেখাইতেছে। সোজা কথায় ওগুলি ‘নকল ইক্ষুদণ্ড’। ছোট ছেলে মেয়েরা যখন কাঁদে এবং তাহাদের খাইতে দিবার কিছু থাকে না, তখন উহা ইক্ষুখণ্ডের মত ছোট ছোট করিয়া কাটিয়া তাহাদের দেওয়া হয়। তাহারা সেগুলি চিবাইয়া রস পান করে। এই ভাবে পরিশ্রান্ত হইয়া পড়ে এবং আর কাঁদে না। শিশুরা চিবাইয়া যে ছোবড়া ফেলিয়া দিয়াছে, তাহাও ক্ষিতীশ বাবুকে দেখানো হইল। ক্ষিতীশ বাবু ঐগুলি লইয়া আসিয়াছিলেন। বিজ্ঞান কলেজে উহা দেখানো হইতেছে।

 “তার পর ক্ষিতীশ বাবু আর একটি বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন। সেখানে রান্নাঘরে গিয়া তিনি দেখিলেন যে, দুইটি ছোট ছেলে এক কোণে বসিয়া গোপনে কি যেন খাইতেছে। ক্ষিতীশ বাবু জিনিষটা কি জানিতে চাহিলেন এবং থালাখানা বাহিরে লইয়া আসিলেন। দেখিলেন, ছেলেরা কি একটা আটার মত জিনিষ খাইতেছিল। ছেলেদের বাপ বুঝাইয়া দিল, উহা কচু সিদ্ধ মাত্র। উহার সঙ্গে লবণও ছিল না। বাপ যখন কথা বলিতেছিল, সেই সময় একটা ছয় বৎসরের মেয়ে আসিয়া থালা হইতে তাড়াতাড়ি খাইতে আরম্ভ করিল। ছোট ছেলেদের জন্য খানিকটা রাখিবার জন্য মেয়েটিকে বলা হইল, কিন্তু কথা শেষ হইবার পূর্বেই সে বাকীটকু এক গ্রাসে খাইয়া ফেলিল। ছোট ছেলে দুইটি হতাশ হইয়া কাঁদিতে লাগিল। ওইটুকুই ছিল শেষ সম্বল। বাপ বেচারা রান্না ঘর হইতে পাত্র আনিয়া দেখিল, আর কিছুই অবশিষ্ট নাই।”

 দৈনিক সংবাদ পত্র হইতে উদ্ধৃত ঐ সমস্ত বর্ণনা হইতে বুঝা যায়, দেশের শাসন প্রণালী কি ভাবে চলিতেছে। ঐ সমস্ত বর্ণনাই প্রকৃত অবস্থা জ্ঞাপন করিতেছে, উহার উপর কোনরূপ টীকা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তথাপি সাম্রাজ্যবাদের কবি তাঁহার ‘ভারতীর অভিজ্ঞতা’ লইয়া নিম্নোদ্ধৃত অর্থহীন বাজে কবিতা লিখিতে কুণ্ঠিত হন না। ঐগুলি বোধ হয় স্বদেশবাসী এবং বিশ্ববাসীদের মনকে প্রতারিত করিবার জন্য।

শ্বেতাঙ্গের দায়িত্ব ভার মাথায় তুলিয়া লও;[]
দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের অন্ন দাও,
রোগ পীড়া দূর কর;
শ্বেতাঙ্গদের দায়িত্ব ভার মাথায় তুলিয়া লও,
রাজাদের তুচ্ছ শাসনের প্রয়োজন নাই।

(ইংরাজী কবিতার অনুবাদ)

 ১৯২২ সালের উত্তর বঙ্গ বন্যা সম্বন্ধে মন্তব্য প্রকাশ করিতে গিয়া আমি বলিয়াছি,—“প্রজাদের আবেদন গ্রাহ্য করিয়া যদি রেলওয়ের সঙ্কীর্ণ কালভার্টগুলি বড় সেতুতে পরিণত করা হইত, তবে এই বন্যা নিবারণ করা যাইত, অন্ততঃপক্ষে ইহার প্রকোপ বহুল পরিমাণে হ্রাস করা যাইত।” বর্তমান বৎসরের বন্যাও এমন ভীষণ হইত না যদি পূর্ব হইতে সতকর্তা অবলম্বন করিয়া জল নিকাশের পথ করা হইত। সম্প্রতি এই বিষয়ে একখানি সময়োপযোগী পুস্তিকা আমার হস্তগত হইয়াছে। লেখক বিষয়টি খুব যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করিয়াছেন, সুতরাং এবিষয়ে তাঁহার কথা বলিবার অধিকার আছে। আমি ঐ পুস্তিকা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

 “১৯২২ সালের উত্তর বঙ্গের প্রবল বন্যা অনেকের চোখ খুলিয়া দিয়াছিল। প্রসিদ্ধ ডাক্তার বেণ্টনী তাঁহার বৈজ্ঞানিক প্রতিভা বলে আবিষ্কার করেন যে ই, বি, রেল পথ (বিশেষতঃ নূতন সারা-সিরাজগঞ্জ রেল পথ) নির্মাণের গরুতর ত্রুটীই ইহার কারণ। এই সমস্ত রেল পথে সঙ্কীর্ণ কালভার্ট এবং ক্ষুদ্র অপরিসর সেতু থাকাতেই জল জমিয়া বন্যার পথ প্রশস্ত করে। এই বন্যারই আনুষঙ্গিক ফল ম্যালেরিয়া, কলেরা, এবং অন্যান্য মারাত্মক ব্যাধির প্রকোপ। কিন্তু এই বন্যা ও মহামারীর ফল ভোগ করে দরিদ্র মূক কৃষককুল, এই আত্মপ্রচার ও বড়মানুষীর যুগে যাহাদের অস্তিত্ব বিসদৃশ বলিয়াই বোধ হয়। সম্প্রতি প্রসিদ্ধ জলশক্তি বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার স্যার উইলিয়াম উইলক্‌স্ যে সব বক্তৃতা করিয়াছেন, তাহার দ্বারা বাঁধ নির্মাণ করিবার নীতির অসারতা প্রমাণিত হইয়াছে। তবু, এই সমস্ত অপকার্য নিবারণ করিবে কে? কত দিনেই বা তাহা নিবারিত হইবে? পক্ষান্তরে, ‘ভবিষ্যৎ বন্যার বিরুদ্ধে সতর্কতার ব্যবস্থা স্বরূপ’ আরও বেশী বাঁধ নির্মিত হওয়া আশ্চর্যের বিষয় নহে।”[]

 উত্তর ও পূর্ব বঙ্গের সাহসী কৃষককুলই গবর্ণমেণ্টের প্রধান সহায় ও শক্তি স্বরূপ, কেননা ইহারাই পাট চাষের দ্বারা ঐশ্বর্য উৎপাদন করে এবং ইহারাই আমদানী ব্রিটিশ বস্ত্রজাত ও অন্যান্য পণ্য দ্রব্যের প্রধান ক্রেতা। গবর্ণমেণ্ট এই দরিদ্র ও অসহায়দের মশা মাছির মত ধ্বংস হইতে দিতেছেন।

 দরিদ্র মূক রায়তেরা যে ক্ষতি সহ্য করিয়াছে, তাহা অপরিমেয়। অনেক স্থলে তাহাদের গোমহিষাদি পশু এবং বাড়ী ঘর বন্যায় ভাসিয়া গিয়াছে। ভারতগবর্ণমেণ্ট সমস্ত পাট শুল্কই নিজেরা গ্রহণ করেন এবং গত কয়েক বৎসরে তাঁহারা প্রায় ৪০।৫০ কোটী টাকা এই বাবদ লইয়াছেন। যদি এই বিপুল অর্থের শতকরা এক ভাগও দুর্গতদের সাহায্যার্থে ব্যয় করা হইত, তবে তাহারা হয়ত বাঁচিতে পারিত। কিন্তু তাহা হইলে অন্য দিকে যে সব অমিতব্যয়িতা অপব্যয়ের দৃষ্টান্ত দেখা যায়, তাহা সম্ভবপর হইত না।

 বাংলা দেশে প্রায়ই যে সব বন্যা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তাহা হইতে শিক্ষা করিবার অনেক বিষয় আছে। আমাদের জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির পরিমাণ কি এবং জাতীয় জীবনের বিকাশের পথে এই বাধা বিপত্তির বিরুদ্ধে আমরা কিরূপে সংগ্রাম করিতে পারি, তাহা এই সব বন্যা ও দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়া প্রকাশিত হইয়াছে।

 বাংলা গবর্ণমেণ্ট বন্যার ধ্বংসলীলা ও তজ্জনিত অপরিমেয় ক্ষতি লঘু করিয়া দেখাইবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করিয়াছেন। গবর্ণমেণ্ট বন্যা-বিধস্ত অঞ্চলের ক্ষতি সম্বন্ধে হাস্যকর বিবরণ প্রকাশ করেন এবং একটি নিখিল বঙ্গ সাহায্য ভাণ্ডার খোলাও প্রয়োজন মনে করেন না।

 গবর্ণমেণ্ট যদি তাঁহাদের সরকারী দস্তুর মাফিক সাহায্য কার্যের বন্দোবস্ত করিতেন, তাহা হইলে সাহায্য কার্যের জন্য প্রদত্ত অর্থের কতটা অংশ বড় বড় কর্মচারীদের মোটা মাহিনা ও গাড়ীখরচা বাবদ ব্যয় হইত? খুব সম্ভব আসল কাজ অপেক্ষা পরিদর্শনের কাজেই বেশী টাকা লাগিত। বে-সরকারী স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানগুলির কাজই অধিকতর স্বল্প ব্যয়ে এবং দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়, কেননা সেখানে সরকারী লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নাই!

 বন্যা বাংলার যুবকদিগকে নিয়মানুবর্তিতা ও দৃঢ়সঙ্কল্পের শিক্ষা দিয়াছে। ইহা হাতেকলমে আমাদিগকে স্বায়ত্তশাসনের কাজ শিখাইয়াছে। পূর্বে বন্যার সময়, সাহায্য কার্য তিন সপ্তাহ বা একমাসের বেশী স্থায়ী হইত না, উহা কতকটা প্রাথমিক সাহায্য স্বরূপ ছিল। বন্যার ভীষণতা একটু কমিলেই সাহায্য কার্য বন্ধ করা হইত এবং হতভাগ্য অধিবাসীদের নিজেদের অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিতে হইত। যতদূর সম্ভব তাহাদিগকে পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করিবার কোন চেষ্টা হইত না।

 কিন্তু বন্যার সম্বন্ধে একটা খুব বড় কথা এই যে—হিন্দু মুসলমান মিলনের সমস্যা এই বন্যা সেবাকার্যের মধ্য দিয়া আশাপ্রদ বলিয়া মনে হয়। যাঁহারা এই মিলন সম্ভবপর মনে করেন না, তাঁহাদিগকে আমি জানাইতে চাই যে, বন্যাপীড়িতদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০ জনই ছিল মুসলমান এবং যাহারা সাহায্য কার্য করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ১৯ জনই ছিল হিন্দু এবং আমি নিশ্চিতরূপে বলিতে পারি যে, কোন হিন্দুই, মুসলমান ভ্রাতাদের সাহায্যের জন্য যে সময় ও শক্তি ব্যয়িত হইয়াছে, তাহাতে আপত্তি করে নাই। রাজনৈতিক প্যাক্ট ও আপোষ সফল হইতে না পারে, কিন্তু এই আন্তরিক সেবা ও সহানভূতির দৃঢ় ভিত্তির উপর যে বন্ধুত্ব গড়িয়া উঠে, তাহার ক্ষয় নাই।

 এই বন্যার মধ্য দিয়া আমরা ভবিষ্যৎ যুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখিয়াছি। বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন রকমের জলবায়ু, বিভিন্ন ভাষা, বিচিত্র রকমের বেশভূষা, বিভিন্ন ধর্ম এবং বিভিন্ন রকমের মতামত থাকা সত্ত্বেও, ভারতবর্ষ যে একটি অখণ্ড দেশ তাহা আজ আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। ইহার কোন অংশে কোন বিপদ বা বিপত্তি ঘটিলেই সমস্ত অঙ্গই গভীর আন্তরিকতা ও সমবেদনার সঙ্গে তাহাতে সাড়া দেয়।

  1. বন্যার অব্যবহিত পরেই রাণীনগর স্টেশন হইতে নসরতপুর স্টেশন পর্যন্ত রেলওয়ে লাইনটি আমি দেখি এবং তাহার ফলে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়।
  2. শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু, সান্তাহার হইতে এই দরখাস্তখানি আমার নিকট পাঠান। ইহার একটি নকল সংবাদপত্রে পাঠানো হয় এবং আনন্দবাজার পত্রিকা ইহার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন ও এই সম্বন্ধে মন্তব্য করেন। মূল পত্রের সন্ধান পাওয়া গেল না।
  3. পত্রপ্রেরকের উক্তি অনুমানমাত্র নহে। উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা অনেকে বলিয়াছেন যে গবর্ণমেণ্ট যখন কোন সাহায্য কার্যে অর্থব্যয় করেন, তখন তাহার প্রায় অর্ধাংশই অপব্যয় হয়। (এফ, এইচ ষ্ক্রাইন, কলিকাতা রিভিউ, ১৯২৮, আগস্ট, ১৪১—৪৭ পৃ দ্রষ্টব্য।)
  4. আমি যখন এই অংশের প্রুফ দেখিতেছিলাম, তখন (১১।৬।৩২) স্যার স্যামুয়েল হোর ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের যে গুণগান করিয়াছেন, তাহা পড়িয়া কৌতুক বোধ করিলাম। প্রত্যুত্তর স্বরূপে আমার বহির এই অংশ তাঁহাকে উপহার দিতে ইচ্ছা হইতেছে। এই আত্মগরিমা কীর্তনের প্রহসন কবে শেষ হইবে?
  5. The Bengal flood, 1931—by Sailendra Nath Banerjee, Member, Board of Directors, Central Co-operative Anti-Malaria Society Ltd., pp. 3-4.