আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
রাজনীতি-সংসৃষ্ট কার্যকলাপ
আমার আলোচিত বিজ্ঞান সম্পর্কীয় কাজ, বা শিল্পে তাহার প্রয়োগ, অথবা দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা মোচন, এই সব কাজেই প্রধানতঃ আমি মন দিয়াছি। নানা বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকিলেও, রসায়ন বিজ্ঞানের প্রতি আমার গভীর আকর্ষণ আমার জীবনের শান্তিস্বরূপ ছিল। যে বিজ্ঞানদেবীর নিকট প্রথম জীবনে আমি আত্মনিবেদন করিয়াছিলাম, তাঁহাকে কখনও আমি পরিত্যাগ করি নাই। সরকারী কার্য হইতে অবসর গ্রহণের পর ক্বচিৎ কখনও আমি রাজনৈতিক ব্যাপারে যোগ দিবার জন্য আহূত হইয়াছি।
আমি কখনও মনে করি নাই যে, আমার স্বভাব ও প্রবৃত্তিতে রাজনীতিক হইবার যোগ্যতা আছে। যে ব্যক্তির জীবনের অধিকাংশ সময় লেবরেটরি ও লাইব্রেরীতে কাটিয়াছে, এই বিশাল মহাদেশের সর্বত্র ঘুরিয়া সভাসমিতিতে বক্তৃতা করিয়া বেড়ানো তাহার পক্ষে দুঃসাধ্য। ইহাতে যে শারীরিক শক্তি ব্যয় করিতে হয়, তাহাই করা আমার পক্ষে অসম্ভব। বস্তুতঃ, আমার ক্ষীণ দেহ, স্বাস্থ্য এবং বার্ধক্য রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পক্ষে প্রধান বাধাস্বরূপ।
আমি পূর্বেই বলিয়াছি, গত অর্ধশতাব্দী কাল ধরিয়া আমি অনিদ্রারোগে ভুগিয়াছি, উহা আমার কাজের পক্ষে প্রবল বাধা সৃষ্টি করিয়াছে। দীর্ঘকাল ধরিয়া কোন কাজে শক্তি ও সময় ব্যয় করিলে, আমার স্বাস্থ্য ভাঙিয়া পড়ে। লর্ড রোজবেরী গ্লাডস্টোনের পর, কিছুদিন প্রধান মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই তাঁহাকে অবসর গ্রহণ করিতে হইয়াছিল, যদিও তাঁহার স্বদেশবাসীরা পুনঃ পুনঃ তাঁহাকে নেতৃত্ব গ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছেন। লর্ড ক্রু কর্তৃক লিখিত লর্ড রোজবেরীর জীবনীতে আমরা জানিতে পারি,—“লর্ড রোজবেরী অশেষ প্রতিভা ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তাঁহার অনিদ্রা রোগও ছিল।” ১৯১৩ সালে লর্ড রোজবেরী লিখেন, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি আমি পুনর্বার প্রধান মন্ত্রীত্বের পদ গ্রহণ করি, তবে আবার আমার অনিদ্রারোগ হইবে।”
আমার স্বাস্থ্যের এইরূপ অবস্থা সত্ত্বেও, ১৯২১—২৬ এই কয় বৎসরে আমি দেশের সর্বত্র ঘুরিয়া জাতীয় বিদ্যালয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা, খদ্দর প্রচলন এবং অস্পৃশ্যতা বর্জনের জন্য প্রচার কার্য করিয়াছি। খুলনা, দিনাজপুর কটক প্রভৃতি স্থানে কয়েকটি জেলা সম্মেলনে আমাকে সভাপতিত্ব করিতেও হইয়াছে, কেননা ঐ সময়ে প্রায় সমস্ত খ্যাতনামা রাজনৈতিক নেতাই কারাগারে অবরুদ্ধ ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের যখন পূর্ণ বেগ, সেই সময়ে আমি বলি—বিজ্ঞান অপেক্ষা করিতে পারে, কিন্তু স্বরাজ অপেক্ষা করিতে পারে না। এই কথার ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। প্রসিদ্ধ ক্যানিজারো—যখন রাসায়নিক রূপে কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে উদ্যত, সেই সময় ১৮৪৮ সালের ফরাসী বিপ্লব আরম্ভ হইল, ক্যানিজারো তাঁহার পথ বাছিয়া লইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করিলেন না। তিনি তাঁহার গবেষণাগার বন্ধ করিয়া স্বেচ্ছাসৈনিক হইয়া বন্দুক ঘাড়ে করিলেন। জন হাম্পডেনের ন্যায় যুদ্ধের প্রথম অবস্থাতেই গুলিতে তাঁহার মৃত্যু হইতে পারিত। বিগত ইউরোপীর মহাযুদ্ধের সময় বহু প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক দেশের প্রতি কর্তব্যের আহ্বানে তাঁহাদের জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ইংরাজ পদার্থ বিদ্যাবিৎ মোজলে অন্যতম। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসিদ্ধ পদার্থ বিদ্যাবিৎ মিলিক্যান তাঁহার সম্বন্ধে বলেন:—“২৬ বৎসর বয়স্ক এই তরুণ বৈজ্ঞানিক আণবিক জগত সম্বন্ধে যে গবেষণা করিয়াছেন, তাহা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অপূর্ব, আমাদের চক্ষের সম্মুখে ইহা বহুতর রহস্যের নূতন দ্বার খুলিয়া দিয়াছে। ইউরোপীয় যুদ্ধে যদি এই তরণ বৈজ্ঞানিকের মৃত্যু ভিন্ন আর কোন অনর্থ না ঘটিত, তাহা হইলেও সভ্যতার ইতিহাসে ইহা একটি বীভৎস এবং অমার্জনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইত।”
১৯১৫ সালের ১০ই আগষ্ট প্রসিদ্ধ ফরাসী রসায়নবিৎ হেনরী ময়সানের একমাত্র পুত্র লুই যদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন। যুদ্ধের পূর্বে তিনি কলেজে তাঁহার পিতার সহকারী ছিলেন।
ভারতে বর্তমানে আমরা যেরূপ সঙ্কটময় সময়ে বাস করিতেছি, তাহাতে বিখ্যাত মনীষী হ্যারল্ড ল্যাস্কির নিম্নলিখিত সারগর্ভ মন্তব্য আমাদের প্রণিধান করা কর্তব্য:—
“একথা নিশ্চিতরূপে বলা যাইতে পারে যে নিশ্চেষ্টতা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধির অভাবে পর্যবসিত হয়। যাহারা বলে যে, কোন একটা অবিচারের প্রতিকার করিবার দায়িত্ব তাহাদের নহে, তাহারা শীঘ্রই অবিচার মাত্রই রোধ করিতে অক্ষম হইয়া উঠে। লোকের নিশ্চেষ্টতা ও জড়তার উপরেই অত্যাচারের আসন। অবিচারের বিরুদ্ধে কেহ কোন প্রতিবাদ করিবে না, বাধা দিবে না, এই ধারণার যখন সৃষ্টি হয়, তখনই স্বেচ্ছাচারীর প্রভুত্ব প্রবল হইয়া উঠে। ‘যে রাষ্ট্রের অধীনে কোন ব্যক্তিকে অন্যায়রূপে কারারুদ্ধ করা হয়, সেখানে প্রত্যেক খাঁটি ও সৎলোকের স্থানও কারাগারে’—থোরোর সেই প্রসিদ্ধ উক্তিটির মর্ম ইহাই, কেন না সে যদি অন্যায়ের ক্রমাগত প্রতিবাদ না করে, তবে মনে করিতে হইবে যে সে অন্যায় ও অবিচারকে প্রশ্রয় দিতেছে। তাহার নীরবতার ফলে সে-ই ‘জেলার’ বা কারাধ্যক্ষ হইয়া দাঁড়ায়। শাসকগণ তাহার উপর নির্ভর করে, মনে করে সে অতীতে যে নিশ্চেষ্টতার পরিচয় দিয়াছে, তাহাতেই প্রমাণ, তাহার বিবেক বুদ্ধি লোপ হইয়াছে। অত্যাচারী প্রভু, নিষ্ঠুর বিচারক এবং দুশ্চরিত্র রাজনীতিক—ইহাদের কাজে কেহ অতীতে বাধা দেয় নাই বলিয়াই, ইহারা নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে সাহসী হইয়াছে। তাহাদের অত্যাচার ও অবিচারকে একবার বাধা দেওয়া হোক, একজন সাহসের সহিত দণ্ডায়মান হোক, দেখিবে সহস্র লোক তাহার অনুসরণ করিতে প্রস্তুত। এবং যেখানে সহস্র লোক অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে প্রস্তুত, সেখানে অন্যায়কারীকে কোন কাজ করিবার পূর্বে পাঁচবার ভাবিতে হয়।”—(The Dangers of Obedience— pp. 19-20)।
ইংলণ্ড ও আমেরিকা প্রভৃতির ন্যায় উন্নত দেশে গণশক্তি জাগ্রত, সেখানে বহু কর্মী সাধারণের কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করিয়া থাকেন। সেখানেও লোকে এই অভিযোগ করে যে, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক রাষ্ট্রনীতি হইতে দূরে থাকিয়া দেশের ক্ষতি করে। একজন চিন্তাশীল লেখক এই সম্পর্কে বলিয়াছেন:—
“অনেক দিন হইতেই একটা কথা প্রচলিত আছে যে, বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকের পক্ষে জনারণ্য হইতে দূরে নির্জনে বাস করা শ্রেয়ঃ। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। বর্তমান যুগের জনসাধারণ চিন্তা ও ভাবে সাড়া দিতে জানে, তবে তাহারা নিজেদের সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতার মধ্যে সেগুলি বুঝিতে চায়। দৈনন্দিন কার্য-প্রবাহের মধ্যে উহাকে দেখিতে চায়। চিন্তা ও ভাবের আদর্শ যে জনসাধারণের বুদ্ধির স্তরে নামাইতে হইবে তাহা নহে, কিন্তু তাহারা যে সব সমস্যায় পীড়িত, সেগুলির সমাধান করিতে হইবে। যাহাদের চিন্তার মৌলিকতা ও নেতৃত্বের ক্ষমতা আছে, এমন সব বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক যদি ঐ সব সমস্যার সমাধানে প্রবৃত্ত না হন, তাহা হইলে কোন যশের কাঙাল, জনমতের ক্রীতদাস, নিম্নশ্রেণীর সাংবাদিক বা দুষ্টপ্রকৃতির রাজনীতিক সেই ভার গ্রহণ করিবে? (Lucian Romier,—Who will be Master,—Europe or America?”)
প্লেটো এই কথাটি অতি সংক্ষেপে নিম্নলিখিত ভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন—সৎ নাগরিকেরা যদি রাষ্ট্রীয় ও পৌর কার্যের অংশ গ্রহণ না করে, তবে তাহার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ অসৎ লোকদের দ্বারা তাহাদের শাসিত হইতে হয়।
যদিও আমি প্রকাশ্যভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেই নাই, তথাপি আমি একেবারে উহার সংস্রব ত্যাগ করিতেও পারি নাই। আমাকে অনেক সময়ই রাজনৈতিক বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়াইতে হইয়াছে। কোকনদ কংগ্রেসে (১৯২৫), আমি দর্শক ও প্রতিনিধিরূপে উপস্থিত ছিলাম। প্রেসিডেণ্ট মহম্মদ আলির নিকটেই আমার বসিবার আসন হইয়াছিল। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে, বৈকালিক নমাজের সময়, প্রেসিডেণ্টের স্থলে অন্য একজনের সভাপতির আসন অধিকার করিবার প্রয়োজন হইল। সাধারণতঃ অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিরই এরূপ ক্ষেত্রে প্রেসিডেণ্টের আসন গ্রহণ করিবার কথা। কিন্তু মহম্মদ আলি আমাকে সভাপতির আসন গ্রহণ করিতে বলিলেন এবং এ বিষয়ে প্রতিনিধিবর্গের মত জিজ্ঞাসা করিলেন। সকলে সানন্দে এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন এবং আমি দশ মিনিটের জন্য সভাপতি হইলাম। ইহার অনুরূপ আর একটি দৃষ্টান্তও আমার স্মরণ হইতেছে, যদিও উহা কতকটা হাস্যকর। লর্ড হ্যালডেন বার্লিন হইতে ফিরিলে, ১৯০৭ সালে রাজা সপ্তম এডোয়ার্ড জার্মান সম্রাটকে উইণ্ডসর প্রাসাদে রাজকীয়ভাবে নিমন্ত্রণ করিলেন। জার্মান সম্রাটের সঙ্গে তাঁহার কয়েকজন সঙ্গীও আসিলেন, কেন না রাজনৈতিক ব্যাপার আলোচনা করিবার প্রয়োজন ছিল। লর্ড হ্যালডেন তাঁহার আত্মজীবনীতে লিখিতেছেন—“এক সময় মন্ত্রীদের মধ্যে মতভেদ হইল এবং তুমুল তর্ক বিতর্ক আরম্ভ হইল। আমি জার্মান সম্রাটকে বলিলাম যে আমি একজন বিদেশী এবং তাঁহার মন্ত্রিসভার সদস্য নহি, সুতরাং আমার সেখানে থাকা উচিত নয়। কিন্তু সম্রাটের রসবোধ ছিল এবং আমার সমর্থন লাভ করিবারও ইচ্ছা ছিল। তিনি বলিলেন,—‘আজ রাত্রির জন্য আপনি আমার মন্ত্রিসভার সদস্য হউন, আমি আপনাকে ঐ পদে নিযুক্ত করিব।’ আমি সম্মতি জ্ঞাপন করিলাম। আমার বিশ্বাস, আমিই একমাত্র ইংরাজ যে জার্মান মন্ত্রিসভার সদস্য হইতে পারিয়াছি, যদিও অল্প কয়েক ঘণ্টার জন্য মাত্র।” (হ্যালডেন—আত্মজীবনী)
ইয়োরোপীয় মহাযুদ্ধ শেষ হইবার পর ভারতবাসীরা আশা করিয়াছিল ব্রিটেন তাহাদিগকে কৃতজ্ঞতার চিহ্ন স্বরূপ একটা বড় রকমের শাসন সংস্কার দিবে। কেন না ব্রিটেনের সঙ্কট সময়ে ভারত অর্থ ও সৈন্য দিয়া বিশেষরূপে সাহায্য করিয়াছিল। কিন্তু ভারতবাসীরা সশঙ্ক চিত্তে দেখিল যে তাহাদের রাজভক্তির পুরস্কার স্বরূপ ‘রাউলাট আইন’ পাইয়াছে! এই আইন অনুসারে পুলিশ যে কোন রাষ্ট্রিককে গ্রেপ্তার করিয়া বিনা বিচারে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দী করিয়া রাখিতে পারে। ইহার ফলে স্বভাবতঃই দেশব্যাপী আন্দোলন আরম্ভ হইল। টাউনহলে একটি সভা হইল, তাহার প্রধান বক্তা ছিলেন সি, আর, দাশ,—তিনি তখন সবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করিতেছেন। আমার বন্ধু সত্যানন্দ বসু একদিন আমাকে বলিলেন যে আমি যদি একটু আগে ময়দানে বেড়াইতে যাই, তবে সভায় যোগদান করিতে পারিব। সুতরাং কতকটা ঘটনাচক্রেই আমি সভায় উপস্থিত হইলাম। টাউনহলের নীচের তলায় সভাস্থলে লোকে লোকারণ্য হইয়াছিল। হলের দক্ষিণ দিকের সিঁড়ির উপরে এবং রাস্তাতেও বিপুল জনসমাগম হইয়াছিল। লোকে যাহাতে তাঁহার বক্তৃতা শুনিতে পারে, এই জন্য শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন দাশ সম্মুখের সিঁড়ির উপরে দাঁড়াইয়াছিলেন। আমি জনতার পশ্চাতে ছিলাম। এই সময়ে কেহ কেহ আমাকে দেখিতে পাইয়া সম্মুখের দিকে ঠেলিয়া দিল এবং চিত্তরঞ্জনের পার্শ্বেই আমি স্থান গ্রহণ করিলাম। আমি যাহাতে কিছু বলি, সেজন্য সকলেরই আগ্রহ ছিল। তাহার পর কি হইল, একখানি স্থানীয় দৈনিক পত্রে বর্ণিত হইয়াছে:—
“মিঃ সি, আর, দাশ ডাঃ স্যার পি, সি, রায়কে আলোচ্য প্রস্তাব সম্বন্ধে বক্তৃতা করিবার জন্য আহ্বান করিলেন। ডাঃ রায় বক্তৃতা করিবার জন্য উঠিলেন। সেই সময়ে এমন একটি দৃশ্যের সৃষ্টি হইল, যাহা ভুলিতে পারা যায় না। কয়েক মিনিট পর্যন্ত ডাঃ রায় কোন কথা বলিতে পারিলেন না। কেন না তাঁহাকে অভিনন্দন করিয়া চারিদিকে ঘন ঘন আনন্দোচ্ছাস ও ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি হইতে লাগিল। ডাক্তার রায় আরম্ভে বলিলেন যে তাঁহাকে যে সভায় বক্তৃতা করিতে হইবে, ইহা তিনি পূর্বে কল্পনা করিতে পারেন নাই। তিনি মাত্র দর্শক হিসাবে আসিয়াছিলেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারেই তাঁহার কাজ। কিন্তু এমন সময় আসে, যখন বৈজ্ঞানিককেও—তাঁহার অবশিষ্ট কথাগুলি শ্রোতৃবর্গের আনন্দধ্বনির মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া গেল। ডাঃ রায় পুনরায় বলিলেন—‘এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও গবেষণা ছাড়িয়া দেশের আহ্বানে সাড়া দিতে হয়।’ আমাদের জাতীয় জীবনের উপর এমন বিপদ ঘনাইয়া আসিয়াছে যে ডাঃ পি, সি, রায় তাঁহার গবেষণাগার ছাড়িয়া এই ঘোর অনিষ্টকর আইনের প্রতিবাদ করিবার জন্য সভায় যোগ দিয়াছিলেন।” (অমৃতবাজার পত্রিকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯১৯)।
পূর্ব পৃষ্ঠায় বলা হইয়াছে যে ভারত ইউরোপীয় যুদ্ধের সময়ে ব্রিটেনকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করিয়াছিল। নিম্নে ঐ সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইল।
সহকারী ভারতসচিব লর্ড ইসলিংটন ‘ইণ্ডিয়া ডে’ বা ‘ভারত দিবস’ (৫ই অক্টোবর, ১৯১৮) উপলক্ষে একটি বিবৃতি পত্র প্রস্তুত করেন। উহাতে, ইউরোপীয় যুদ্ধে ভারতের দান তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হয়। (ক) সৈন্য, (খ) যন্ত্রের উপকরণ, (গ) অর্থ; তন্মধ্যে প্রধান বিষয়গুলি উল্লেখ করা হইতেছে।
(ক) সৈন্য—ভারত হইতে যে সব ভারতীয় ও ব্রিটিশ সৈন্য ৪ঠা আগষ্ট ১৯১৪ হইতে ৩১শে জুন ১৯১৮ পর্যন্ত প্রেরণ করা হইয়াছিল, তাহাদের সংখ্যা ১,১১৫,১৮৯।
(খ) যুদ্ধের উপকরণ—ইহা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, যদি ভারতের প্রদত্ত মালমশলা উপকরণ প্রভৃতি ব্রিটেন না পাইত, তবে বিপদ আরও শতগুণে বৃদ্ধি পাইত এবং এরূপ ভাবে যুদ্ধ চালানো অসম্ভব হইত। মিশর, মেসপটেমিয়া এবং অন্যান্য স্থানের ভারতীয় সৈন্যের রসদ প্রভৃতি যোগাইবার জন্য তখন ব্রিটেনকে যুদ্ধের মালমশলা সরবরাহ করার জন্য ভারতে বিশেষভাবে একটি মিউনিশান বোর্ড স্থাপন করতে হইয়াছিল।
(গ) অর্থ—১৯১৭ সালের জানুয়ারী মাসে, ভারত গবর্ণমেণ্ট যুদ্ধের ব্যয় স্বরূপ ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টকে ১০ কোটী পাউণ্ড সাহায্য করেন। ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট তাহা সকৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করেন।
ভারত গবর্ণমেণ্ট যুদ্ধের সময়ে সামরিক ব্যয় করিয়াছিলেন, তাহাতেই ভারতের আর্থিক দায়িত্ব শোধ হইয়া যায় নাই, বন্ধের জন্য নানা প্রকারে তাহার আর্থিক দায়িত্বভার বাড়িয়াছিল। বস্তুতঃ ভারত আর্থিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভস্বরূপ।
বাংলার অসহযোগ আন্দোলনের প্রাণস্বরূপ চিত্তরঞ্জন দাশের কারাদণ্ডের সময়, আমি তাঁহার পত্নী শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবীকে নিম্নলিখিত পত্র লিখিয়াছিলাম। উহা তৎকালে ভারতের প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল।
“আমার মনে যে প্রবল ভাবাবেগ হইয়াছে, তাহা আমি প্রকাশ করিতে অক্ষম। আপনার স্বামী যখন সেই ইতিহাস-স্মরণীয় মোকদ্দমায় শ্রীঅরবিন্দের পক্ষ সমর্থন করেন, সেই দিন হইতেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। তাঁহার অশেষ বদান্যতা, তাঁর স্বদেশপ্রেম, মহান আদর্শবাদ, দীনদরিদ্রের পক্ষ সমর্থনের জন্য তাঁহার অসীম আগ্রহ, সর্বদাই লোকের প্রশংসা অর্জন করিয়াছে। যদিও কোন কোন বিষয়ে তাঁহার সঙ্গে আমার মতের পার্থক্য আছে, তবুও চিরদিনই তাঁহার প্রতি আমি আকর্ষণ অনুভব করিয়াছি। তিনি বাংলা দেশ বা তরুণ ভারতের চিত্ত অধিকার করিবেন, ইহা কিছুই আশ্চর্যের বিষয় নহে। রাজনীতিতে তাঁহার সঙ্গে যাঁহাদের মতভেদ আছে, তাঁহারাও তাঁহার (চিত্তরঞ্জনের) অপূর্ব স্বার্থ ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারেন না। শ্রীযুত দাশের এই অগ্নি পরীক্ষার দিনে, তাঁহার প্রতি স্বতঃই আমাদের চিত্ত ধাবিত হইতেছে। আমি জানি, আমার মত বৈজ্ঞানিক শ্রীযুত দাশের জীবনের ব্রত সম্পূর্ণ ধারণা করিতে পারিবে না, কেন না লোকসমাজ ও ঘটনার স্রোত হইতে সর্বদাই আমি দূরে বাস করি। চিরজীবন একান্তভাবে বিজ্ঞান অনুশীলনের ফলে আমার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ, মনের প্রসার বোধ হয় সঙ্কুচিত হইয়াছে। কিন্তু প্রিয় ভগ্নি, আমি আপনাকে নিশ্চিতরূপে বলিতে পারি যে, যখন আমি বিজ্ঞান চর্চা করি, তখন বিজ্ঞানের মধ্য দিয়া দেশকেই সেবা করি। আমাদের লক্ষ্য একই, ভগবান জানেন। আমার জীবনের অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই।
“আপনি আপনার দুঃখ অপূর্ব সাহস ও আনন্দের সঙ্গে বহন করিতেছেন। বাংলার সম্মুখে নারীত্বের যে উচ্চ আদর্শ আপনি স্থাপন করিয়াছেন, তাহা সেই অতীত রাজপুত গৌরবের যুগকেই স্মরণ করাইয়া দেয়। আমি মনে প্রাণে আশা করি, যে কৃষ্ণ মেঘ আমাদের মাতৃভূমির ললাট আচ্ছন্ন করিয়াছে, তাহা শীঘ্রই অপসারিত হইবে এবং আপনার স্বামীকে আমরা ফিরিয়া পাইব।