আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

সময়ের সদ্ব্যবহার ও অপব্যবহার

 সম্প্রতি কয়েক বৎসর হইল, কেহ কেহ আমাকে প্রশ্ন করিতেছেন, আমি আমার প্রিয় বিজ্ঞান ও গবেষণাগার ত্যাগ করিয়াছি কিনা, কিংবা উভয়কেই উপেক্ষা করিতেছি কি না? লোকের পক্ষে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা অসঙ্গত নহে। ১৯২১ সাল হইতে খদ্দর প্রচার ও জাতীয় শিক্ষা বিস্তারে আমি প্রধান অংশ গ্রহণ করিয়াছি এবং কিয়ৎ পরিমাণে রাজনৈতিক আন্দোলনের সংশ্রবেও আসিয়াছি। আমি কয়েকটি জেলা সম্মেলনের সভাপতিত্ব করিয়াছি। তথাকথিত “অবনত সম্প্রদায়” কর্তৃক আহূত কয়েকটি সম্মেলনেও সভাপতির পদ গ্রহণ করিয়াছি। এতদ্ব্যতীত, ১৯২১ সালের খুলনা দুর্ভিক্ষ এবং ১৯২২ সালের উত্তরবঙ্গ বন্যা সম্পর্কে সেবাকার্যের নেতৃত্বও কয়েকবার আমাকে করিতে হইয়াছে। গত দশ বৎসরে আমি ভারতের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়াছি এবং আমার ভ্রমণের পরিমাণ দুই লক্ষ মাইলের কম হইবে না। ১৯২০ সালে এবং ১৯২৬ সালে যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম বার বিলাত ভ্রমণও করিয়া আসিয়াছি।

 সম্প্রতি একদল যুবকের নিকট আমি সময়ের ব্যবহার ও অপব্যবহার সম্বন্ধে বক্তৃতা করি। উহাতে আমি কতকটা আমার নিজের জীবনযাত্রা প্রণালীরই যেন সমর্থন করি। বক্তৃতায় কবি কাউপারের সেই প্রসিদ্ধ কবিতা[] উদ্ধৃত করিয়া আমি বুঝাইয়াছিলাম, যদি কেহ নিজের নির্দিষ্ট সময় তালিকা অনুসারে কাজ করে, তবে কত বেশী কাজ করিতে পারে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মানুষ যদি ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করে, তবে দশ গুণ বেশী কাজ করিতে পারে। ইংলণ্ড ও ইয়োরোপে কয়েকবার ভ্রমণকালে আমি যাহাতে ঠিক সকাল সাতটার মধ্যে প্রাতর্ভোজন শেষ করিতে পারি, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিতাম। তাহার ফলে বাড়ী হইতে বাহির হইবার পূর্বে আমি দু একঘণ্টা অধ্যয়ন করিবার অবসর পাইতাম। পূর্বে রেলগাড়ীতে ভ্রমণ করিবার সময় ঝাঁকানির জন্য আমি পড়িতে পারিতাম না। কিন্তু সম্প্রতি এইভাবে ভ্রমণ করা আমার পক্ষে এমন অভ্যাস হইয়া গিয়াছে যে, আমি গাড়ীতে একঘণ্টাকাল অনায়াসে পড়িতে পারি। আমার ভ্রমণ তালিকা প্রস্তুত করিবার সময় আমি প্রথমেই বড় হরফে ছাপা কতকগুলি ভাল বই বাছিয়া লই। আমি যখন কলিকাতার বাহিরে মফঃস্বলে যাই, তখন স্বভাবতঃই বহু লোক আমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করিতে আসেন এবং তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিতে হয়। কিন্তু দ্বিপ্রহর হইতে বেলা ৩টা পর্যন্ত, অর্থাৎ খুব গরমের সময়, কেহ বড় একটা আসে না এবং সেই সময়ে আমি ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া বই পড়ি। উহাই আমার পক্ষে বিশ্রামের কাজ করে। কার্লাইলের ন্যায় আমিও বলিতে পারি, অধ্যয়নই আমার প্রধান বিশ্রাম। কার্লাইল লণ্ডনে গিয়া এমন স্থানে বাড়ী লইবার জন্য উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলেন—যেখানে কেহ তাঁহাকে বিরক্ত করিতে না পারে। তাঁহার মনোভাবের প্রতি আমার সহানভূতি আছে। কার্লাইল যে এত বেশী অধ্যয়ন করিয়াছিলেন—বিভিন্ন ভাষায় এমন পাণ্ডিত্য লাভ করিয়াছিলেন, তাহার প্রধান কারণ, তিনি ‘মেনহিলের’ নির্জ্জন গৃহে বাস করিবার সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার চরিতকারের ভাষায়, লণ্ডনে যাইবার পূর্বে, “ইংলণ্ড ও স্কটলণ্ডে তাঁহার সমবয়স্ক এমন কেহ ছিল না, যে তাঁহার মত এত বেশী পড়াশুনা করিয়াছে অথচ বহির্জগতের সঙ্গে যাহার এত কম পরিচয় ছিল। ইতিহাস, কাব্য, দর্শনশাস্ত্রে তিনি প্রগাঢ়রূপে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। ফরাসী, জার্মান ও ইংরাজী সাহিত্য তথা সমগ্র আধুনিক সাহিত্যের সম্বন্ধে তাঁহার যেমন গভীর জ্ঞান ছিল, তাঁহার সমবয়স্ক আর কোন ব্যক্তিরই তেমন ছিল না।”

 আমি আমার অধ্যয়ন কার্যকে পবিত্র বলিয়া মনে করি। কিন্তু ইহার পবিত্রতা রক্ষা করা অনেক সময় কঠিন হইয়া পড়ে। যখন কেহ অধ্যয়ননিমগ্ন আছেন, অথবা কোন সমস্যা গভীরভাবে চিন্তা করিতেছেন—তখন তাঁহার কাজে ব্যাঘাত জন্মাইতে আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরাও দ্বিধা করেন না। মেকলের প্রগাঢ় অধ্যয়নস্পৃহার কথাও এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে। “সাহিত্য আমার জীবন ও বিচারবুদ্ধিকে রক্ষা করিয়াছে। সকাল পাঁচটা হইতে নয়টা পর্যন্ত (তাঁহার কলিকাতা বাস কালে) এই সময়টা আমার নিজস্ব এখনও আমি ঐ সময়ে প্রাচীন সাহিত্য পাঠ করিয়া থাকি।” কিন্তু এইরূপে কঠোর সাধনা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার ইচ্ছা থাকিলেও এরূপ করিবার শক্তি আমার নাই। আমার ভাল ঘুম হয় না, সুতরাং সকালবেলা একসঙ্গে সওয়া ঘণ্টার বেশী আমি পড়িতে পারি না।

 মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করিবার সময়ে নিউটন প্রায় ভাবোন্মাদ অবস্থায় ছিলেন। যদি লোকে সেই সময়ে তাঁহাকে ক্রমাগত বিরক্ত করিত, তবে অবস্থা কিরূপ হইত, কল্পনা করাও কঠিন। কোলরিজ এ বিষয়ে তাঁহার তিক্ত অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। একসময়ে তিনি ভাবমুগ্ধ অবস্থায় “কুবলা খাঁ অথবা একটি স্বপ্নদৃশ্য” নামক প্রসিদ্ধ কবিতার দুই তিনশত ছত্র মনে মনে রচনা করেন। তন্দ্রা হইতে জাগিয়া তিনি কাগজে সেই ছত্রগুলি লিপিবদ্ধ করিতেছিলেন, এমন সময় অন্য কাজে তাঁহার ডাক পড়িল এবং সেজন্য তাঁহাকে একঘণ্টারও অধিক সময় ব্যয় করিতে হইল। ফিরিবার সময় লিখিতে বসিয়া তিনি দেখেন যে, স্বপ্নের কথা তাঁহার মাত্র অস্পষ্টভাবে মনে আছে। এমার্সন গভীর ক্ষোভের সঙ্গে বলিয়াছেন —“সময় সময় সমস্ত পৃথিবী যেন ষড়যন্ত্র করিয়া তোমাকে তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ে বন্দী করিয়া রাখিতে চায়।......এই সব প্রবঞ্চিত এবং প্রুবঞ্চনাকারী লোকের মন যোগাইয়া চলিও না। তাহাদিগকে বল—হে পিতা, হে মাতা, হে পত্নী, হে ভ্রাতা, হে বন্ধু, আমি তোমাদের সঙ্গে এতদিন মিথ্যা মায়াময় জীবন যাপন করিয়াছি। এখন হইতে আমি কেবল সত্যকেই অনুসরণ করিব।”[]

 লোকে যেরূপ অবস্থার মধ্যে থাকে, তাহারই সঙ্গে সামঞ্জস্য করিয়া লইতে হয়, বৃথা উত্তেজিত বা বিরক্ত হইয়া লাভ নাই। বহুলোক আমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করিতে আসেন। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই যুবক। তাঁহারা আমার নিকট নানা বিষয়ের সংবাদ ও পরামর্শ চান। কিরূপে জীবিকা সংগ্রহ করিবেন, সেজন্যও উপদেশ চাহেন। ইহার উপর ভারতের সমস্ত অঞ্চল হইতে আমার নিকট বহু চিঠিপত্র আসে এবং পত্রলেখকেরা অনেক সময় উত্তর আদায় না করিয়া ছাড়েন না। আমি ইহার জন্য অভিযোগ করি না, কেননা আমি জানি, নানাদিকে আমি যে সব কাজে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, তাহার ফলেই এইভাবে আমাকে কিছু সময় ব্যয় করিতে হয়। আমি যথাসাধ্য প্রসন্নভাবেই এ সব সহ্য করি এবং আমার আদর্শ মার্কাস অরেলিয়াসের নীতি অনুসরণ করিতে চেষ্টা করি। চিত্তের সমতা বা প্রশান্তিই ছিল মার্কাস অরেলিয়াসের জীবনের মূলমন্ত্র। তিনি সৈন্যশিবিরের কোলাহলের মধ্যে সমাহিত চিত্তে বসিয়া যে সব চিন্তা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, তাহা এখনও আমাদিগকে পথ প্রদর্শন করে।

 আমি আমার যুবক বন্ধুদিগকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ‘আত্মচরিত’ পাঠ করিতে অনুরোধ করি। ফ্রাঙ্কলিন গরীবের ছেলে ছিলেন, তাঁহাকে ছাপাখানায় শিক্ষানবিশরূপে কঠোর পরিশ্রম করিয়া অর্থোপার্জন করিতে হইত। তিনি বিদ্যালয়ে অতি সামান্য লেখাপড়ার সুযোগই পাইয়াছিলেন, কেন না দশ বৎসর বয়সেই তাঁহাকে পিতার কাজে সাহায্য করিতে হইয়াছিল। তাঁহার পিতা সাবান ও মোমবাতির কাজ করিতেন। কিন্তু ফ্রাঙ্কলিন নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার ঘরে বসিয়া রাত্রির অধিকাংশ সময়ই পড়িয়া কাটাইতেন, কেন না অনেক সময় তিনি সন্ধ্যাবেলা বই ধার করিয়া আনিতেন এবং সকালবেলা তাহা ফেরৎ দিতেন। ছাপাখানার কাজ শেষ করিয়া যেটুকু অবসর পাইতেন, ফ্রাঙ্কলিন সে সময় পড়িতেন। ক্রমে ক্রমে ফ্রাঙ্কলিন মুদ্রাকররূপে সাফল্যলাভ করিলেন। জনৈক বন্ধু বলিয়াছেন—“ফ্রাঙ্কলিনের পরিশ্রম ও অধ্যবসায় অসাধারণ ছিল। আমি যখন ক্লাব হইতে বাড়ী ফিরিয়া যাইতাম, দেখিতাম ফ্রাঙ্কলিন কাজ করিতেছেন; সকালে তাঁহার প্রতিবাসীরা শয্যাত্যাগ করিবার পূর্বেই আবার তিনি কাজ আরম্ভ করিতেন। ফ্রাঙ্কলিন নিজের চেষ্টায় পরে বিদ্যুৎ সম্বন্ধে গবেষণা ও পরীক্ষা করেন এবং বিদ্যুৎ-পরিচালকের (Lightning conductor) আবিষ্কর্তারূপে তিনি ইয়োরোপীয় বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ হইয়া আছেন। পেনসিলভেনিয়ার এই প্রসিদ্ধ রাজনীতিজ্ঞের জীবনের কার্যাবলী সম্বন্ধে এখানে বেশী কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। সকলেই জানেন, তাঁহার অসাধারণ রাজনৈতিক কৌশল ও বুদ্ধি বলেই আমেরিকার স্বাধীনতাসংগ্রাম সাফল্যের সঙ্গে শেষ হইয়াছিল।

 ফ্রাঙ্কলিন কিরূপে জীবনের বিবিধ কার্যক্ষেত্রে এমন সাফল্য লাভ করেন, তাহার মূলমন্ত্র তাঁহার নিজের কথাতেই পাওয়া যায়। “আমার প্রত্যেকটি কাজের জন্য সময় নির্দিষ্ট থাকিত এবং সেই শৃঙ্খলা অনুসারে আমি কাজ করিতাম।”

ফ্রাঙ্কলিনের দৈনন্দিন কার্য-প্রণালী

সকালে
প্রশ্ন—আজ আমি কি ভাল কাজ করিব?
৫টা
৬টা
৭টা
ঘুম হইতে ওঠা, হাত মুখ ধোওয়া, পোষাক পরা। (Powerful goodness!) দিবসের কার্য সম্বন্ধে চিন্তা করা এবং সঙ্কল্প স্থির করা। বর্তমানের কার্য ও প্রাতর্ভোজন
৮টা কার্য
৯টা
১০টা
১১টা
১২টা অধ্যয়ন, হিসাব পরীক্ষা এবং
দ্বিপ্রহর ১টা
২টা
মধ্যাহ্নভোজন
অপরাহ্ণ ৩টা
৪টা
৫টা
কার্য
সন্ধ্যা ৬টা জিনিষপত্র যথাস্থানে রাখা। সান্ধ্যভোজন। সঙ্গীত ও বিশ্রাম অথবা কথাবার্তা, দিনের কার্যাবলী সম্বন্ধে চিন্তা করা
রাত্রি ৯টা
১০টা
১১টা
১২টা
১টা
২টা
৩টা
৪টা
নিদ্রা

 আমার নিজের কথা বলি। আমার ডায়েরীর কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া দেখাইব, কিরূপে আমি আমার কাজগুলি করি।

১৫ই জুন, ১৯২০

 সকাল ৭— /টা—কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নাল পাঠ; ৯—১২টা—লেবরেটরিতে গমন;  / /টা—পুনরায় লেবরেটরিতে গমন। মোটরে করিয়া পটারী কারখানায় যাই;  /টায় ফিরিয়া আসি। পুনরায় লেবরেটরি দেখি ৫—৬টা—জোলা লিখিত গ্রন্থ ‘মানি’ (Money)। ৬-১৫— /টা—সিটি কলেজ কাউন্সিল সভা। ৮— /টা—ময়দান ক্লাব।

১২ই নবেম্বর, ১৯২১

 সকাল—টেইন লিখিত ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস পাঠ। ৯টা—লেবরেটরি। ষ্টীম ন্যাভিগেশান কোম্পানির এজেণ্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ। একটু পরে বেঙ্গল কেমিক্যালের ম্যানেজারের সঙ্গে গুরুতর বিষয়ে পরামর্শ। একটি ঋণের বন্দোবস্ত করা। পটারী ওয়ার্কসের ম্যানেজারের সঙ্গে সাক্ষাৎ, অপরাহ্ণে লেবরেটরি। বেঙ্গল কেমিক্যালের ডিরেক্টরদের সভা—খুব প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলোচনা।

৪ঠা জুন, ১৯২২

 বহুবিষয়ে মনোযোগ দিবার ক্ষমতাই আমার একটা দৌর্বল্যবিশেষ। সকালবেলা—কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নাল (এপ্রিল সংখ্যা) পাঠ, তারপর ‘মডার্ণ রিভিউ’-এ লাহিড়ীর ‘ফিস্‌ক্যাল পলিসি’ এবং কালিদাস নাগের ‘মলিয়েরের ত্রিশতবার্ষিকী’ প্রবন্ধ। শেষোক্ত প্রবন্ধ পড়িয়া মুগ্ধ হইলাম।

২৫শে জুন, ১৯২২

 খুলনা দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত সেবাকার্যে এবং চরকা প্রচারে গত বৎসর হইতে আমার পরিশ্রম বাড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু মনের মত কাজ পাইলে, পরিশ্রমেও আনন্দ হয়।

৩১শে আগষ্ট, ১৯২২ 

 কিভাবে জীবন যাপন করিতেছি! আমার সকালবেলার সময়ের উপরও লোকে আক্রমণ করে। অজস্র দর্শক ও ছাত্রের দল আমার নিকটে নানা কাজে আসে। বলা বাহুল্য, আমি কোন আপত্তি করিতে পারি না। খদ্দর প্রচারের কাজে পরিশ্রম বাড়িয়া গিয়াছে। তারপর পটারী কারখানা এবং বঙ্গলক্ষ্মী মিলের সভা।

৬ই অক্টোবর, ১৯২২ 

 বাংলাদেশ পুনর্বার ভীষণ দুর্গতির কবলে—উত্তরবঙ্গে প্লাবন; আমাকে আবার সেবাকার্যের ব্যবস্থা করিতে হইবে, যদিও এ কার্য আমার সাধ্যের অতিরিক্ত। তৎসত্ত্বেও গবেষণাকার্য বেশ চলিতেছে, বোধ হয় এরূপ সুফল পূর্বেও কখন লাভ করি নাই।

খৃষ্টজন্মদিন, ১৯২২ 

 প্ল্যাটিনাম সম্বন্ধে গবেষণা—লেবরেটরির কাজ পুরোদমে চলিতেছে। দুইটি মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রস্তুত। আরও দুইটির উপকরণ সংগৃহীত হইতেছে। বন্যাসেবাকার্যের ভার কিছু হ্রাস হইয়াছে; সেইজন্য লেবরেটরির কাজ খুব চলিতেছে। উৎসাহ পূরামাত্রায় আছে।

২৭শে ডিসেম্বর, ১৯২২ 

 কয়েকদিন হইল অনিদ্রারোগে ভুগিতেছি। অভিযোগ করিয়া লাভ নাই, সহ্য করিতেই হইবে। হাক্সলির Controverted Essays পড়িতেছি—চিত্তাকর্ষক ও আনন্দদায়ক।

৪ঠা মার্চ, ১৯২৩ 

 নানা কাজের গোলমালে রসায়নশাস্ত্রের প্রতি মনোযোগ দিতে পারি নাই। সকালবেলা কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নাল পড়িলাম; যুদ্ধের পর ইংরাজ বৈজ্ঞানিকেরা নিজেদের ধাতে আসিতেছে। অন্য পক্ষে আমাদের জাতির নিশ্চেষ্টতা ও অবসাদ গভীর চিন্তা ও উদ্বেগের কারণ।

৪ঠা এপ্রিল, ১৯২৩ 

 “Progress of Chemistry”-র বার্ষিক বিবরণীতে (১৯২২) ‘ঘোষের নিয়মের’ আলোচনা পিতৃস্নেহসিক্ত মন লইয়াই পড়িয়াছি।

২৮শে আগষ্ট, ১৯৩১ 

সকাল

৬-৪৫ হইতে ৯টা—
৯টা—৯ ১/২টা—
৯ ১/২—হইতে ১০টা—
১০টা—১১-৪৫—

অধ্যয়ন
সংবাদপত্র
সূতাকাটা
লেবরেটরি, সঙ্গে সঙ্গে

বন্যা-সেবাকার্যে মনোযোগদান। অসংখ্য পত্র, টেলিগ্রাম, দলে দলে স্কুলের ছাত্র এবং অন্যান্য বহু দাতা সাহায্য করিতেছেন।

 আহার ও বিশ্রাম—১২টা-১ ১/২টা। ১ ১/২টার সময় ভবানীপুরে গেলাম। পদ্মপুকুর ও সাউথ সুবার্বন স্কুলের ক্লাসে ঘুরিয়া ছাত্রদিগকে তাহাদের সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ দিলাম এবং আরও সাহায্য সংগ্রহ করিবার জন্য উৎসাহিত করিলাম। আশুতোষ কলেজে গিয়া ৩-১৫ মিনিটের সময় খোলা প্রাঙ্গণে একটি সভায় বক্তৃতা করিলাম। ৩-৪৫ মিনিটের সময় ফিরিয়া আসিলাম। ৪টা—৫টা—বিশ্রাম অর্থাৎ ‘ক্রমওয়েল’-এর জীবনী পড়িলাম। ৫-৩০টায় মহাত্মাজীর নিকট তাঁহার সাফল্য সামনা করিয়া তার করিলাম। তার পরেই “শিক্ষা-মন্দিরে” গিয়া উদ্বোধন কার্য সম্পন্ন করিলাম।

 ৭টায় ময়দানে যাই এবং রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকি। দেখা গিয়াছে, বহু প্রসিদ্ধ ব্যক্তি[] এবং গ্রন্থকার ১০।১৫ ঘণ্টা অক্লান্তভাবে কাজ করেন, তারপর আবার কিছুকাল নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়া থাকেন। কিন্তু এইরূপে সাময়িক উত্তেজনাবশে কাজ করা আমার পক্ষে কোনদিনই প্রীতিপ্রদ নহে। আমি যাহা কিছু করিয়াছি, ধীরে ধীরে নিয়মিত পরিশ্রমের দ্বারাই করিয়াছি। গল্পের কচ্ছপ তাহার অক্লান্ত ধীর গতির দ্বারাই খরগোসকে পরাস্ত করিতে পারিয়াছিল। কোন গভীর বিষয়ে অধ্যয়ন বা রচনা, অনেকদিন আমি খুব সকালেই শেষ করিয়াছি—যে সময়ে যুবকেরা সুতপ্ত শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিবার মত শক্তি সঞ্চয় করিতে পারেন না। আমি সাধারণতঃ ৫টার সময় উঠি—তারপর দ্রুতপদে একট ভ্রমণ এবং কিছু লঘু জলযোগের পর ৬টার সময় পড়িতে বসি।

 গ্রন্থ নির্বাচন সম্বন্ধে দুই একটি কথা এখানে বলিলে অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। অল্প লোকই কোন একটা উদ্দেশ্য লইয়া পড়েন। তাঁহারা হাতের কাছে যে-কোন বই পান, টানিয়া লইয়া পড়েন। এইরূপ অধ্যয়নের দ্বারা মানসিক উন্নতি হয় না।

 রেলযাত্রীরা প্রায়ই ষ্টেশনের বুকষ্টলে যাইয়া একখানা বাজে নভেল কিনিয়া পড়িতে আরম্ভ করেন—বইয়ের চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী পড়িয়াই প্রধানতঃ তাঁহারা আনন্দলাভ করেন। স্কট, ডিকেনস্, থ্যাকারে, ভিক্টর হুগো, টুর্গেনিভ, টলষ্টয়, প্রভৃতি প্রসিদ্ধ লেখকদের উপন্যাস পড়িয়া অবশ্য লাভ আছে। কিন্তু অধিকাংশ সময় কেবলই উপন্যাস পড়িলে, গভীর বিষয় অধ্যয়ন করিবার শক্তি হ্রাস পায়। বিশ্রামের সময়েই লঘু সাহিত্য পাঠ করা উচিত। গত পাঁচ বৎসরে ভাল উপন্যাস অপেক্ষা ইতিহাস ও জীবনচরিতই আমি বেশী পড়িয়াছি এবং তাহার ফলে উপন্যাস পাঠের উপর আমার এখন কতকটা বিরাগ জন্মিয়াছে। কোন নূতন পুস্তক আমি গভীরভাবেই পাঠ করিতে আরম্ভ করি। যাঁহাকে দূর হইতে সসম্ভ্রমে দেখিয়াছি, তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় করিতে হইলে মনে যেমন উত্তেজনার ভাব আসে, নূতন গ্রন্থ পড়িবার সময়ে আমারও মনের ভাব সেইরূপ হয়। উদ্দেশ্যহীনভাবে পড়িতে আমি ভালবাসি না, বস্তুতঃ আমার অধ্যয়ন অল্প সীমার মধ্যে আবদ্ধ। অনেক সময় আমার প্রিয়-গ্রন্থগুলি আমি পুনঃ পুনঃ পাঠ করি।

 হ্যাল্‌ডেন বলেন,—“আমি শিখিয়াছি যে, কোন বই যদি পড়ার যোগ্য হয়, তবে উহা ভাল করিয়া পড়িয়া উহার মতামত আয়ত্ত করিতে হইবে। তাহাতে আর একটি লাভ হয়, পড়িবার বইয়ের সংখ্যাও হ্রাস হয়।” (আত্মচরিত, ১৯পৃঃ)।

 স্পেনসারের প্রসঙ্গে মর্লিও এই কথা অল্পের মধ্যে সুন্দরভাবে বলিয়াছেন, “একটা প্রচলিত অভ্যাস তিনি কোনদিনই মানিতেন না, তিনি কোন বই পড়িতেন না। যিনি কোন নূতন মত প্রচার করিতে চান, তাঁহার পক্ষে ইহার কিছু প্রয়োজনীয়তা আছে, সন্দেহ নাই। অনেক লোক বই পড়িয়া পড়িয়া নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারাইয়া ফেলেন। তাঁহারা দেখেন যে সব কথাই বলা হইয়াছে, নূতন কিছু বলিবার নাই। প্যাস্কাল, ডেকার্ট, রুসো প্রভৃতির মত ‘অজ্ঞ লোক’ যাঁহারা খুব কম বই-ই পড়িয়াছেন, কিন্তু চিন্তা করিয়াছেন বেশী, নূতন কথা বলিবার যাঁহাদের সাহস ছিল বেশী, তাঁহারাই জগতকে পরিচালিত করিয়াছেন।” (মর্লির স্মৃতিকথা)।

 গোল্ডস্মিথের ‘ভাইকার অব ওয়েকফিল্ড’-এর প্রতি আমার আকর্ষণের কথা পূর্বেই বলিয়াছি। ইহার চরিত্রগুলি কি মানবিকতায় পূর্ণ! ঊনবিংশ শতাব্দীর দুইজন প্রসিদ্ধ লেখক এই বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন। স্কট বলেন,—“ভাইকার অব ওয়েকফিল্ড” আমার যৌবনে ও পরিণত বয়সে পড়ি, পুনঃ পুনঃ ইহার শরণ লই এবং যে লেখক মানব প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের এমন সহানুভূতিসম্পন্ন করিয়া তোলেন, তাঁহার স্মৃতির প্রতি স্বভাবতঃই শ্রদ্ধা হয়।” গ্যেটে বলেন,—“তরুণ বয়সে আমার মন যখন গঠিত হইয়া উঠিতেছিল, তখন এই বই আমার মনের উপর কি অসীম প্রভাব বিস্তার করিতেছিল, তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ইঁহার মার্জিতরুচিপ্রসত শ্লেষ ও বিদ্রূপ, মানবচরিত্রের ত্রুটী ও দুর্বলতার প্রতি উদার সহানভূতি, সর্বপ্রকার বিপদের মধ্যে শান্তভাব, সমস্ত বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনের মধ্যে চিত্তের সমতা এবং উহার আনুষঙ্গিক গুণাবলী হইতে আমি যথেষ্ট শিক্ষা পাইয়াছিলাম।”

 অনেক পুস্তককীট আছেন, মেকলে তাঁহাদের বলেন—‘মস্তিষ্ক-বিলাসীর দল’। ইঁহারা একটির পর একটি করিয়া পুস্তক পাঠ শেষ করেন, কিন্তু গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে কখনও চিন্তা বা আলোচনা করেন না। ফলে এইসব গ্রন্থকীট শীঘ্রই তাঁহাদের চিন্তাশক্তি হারাইয়া ফেলেন। তাঁহাদের কেবল লক্ষ্য, কতকগুলি বই পড়িবেন, আর কোন বিষয়ে চিন্তা করিবার সময় তাঁহাদের নাই।

 এইখানে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলিব। ১৯২০ সালে লণ্ডনে থাকিবার সময়ে J. M. Keynes প্রণীত The Economic Consequence of the Peace বা ‘সন্ধির অর্থনৈতিক পরিণাম’ নামক সদ্যপ্রকাশিত গ্রন্থ পাঠ করি। সন্ধিসর্তের ফলে জার্মানির নিকট কঠোরভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করিবার যে ব্যবস্থা হইয়াছিল, তাহা হ্রাস না করিলে, কেবল মধ্য ইয়োরোপ নয়, সঙ্গে সঙ্গে ইংলণ্ড ও আমেরিকার যে অসীম আর্থিক দুর্গতি ঘটিবে, গ্রন্থকার ভবিষ্যৎদর্শী ঋষির দৃষ্টিতেই তাহা দেখিয়াছিলেন। পুস্তকের এই অংশের প্রুফ যখন আমি সংশোধন করিতেছি (এপ্রিল, ১৯৩২), আমি দেখিতেছি কেসের ভবিষ্যদ্‌বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়াছে। পরে আমি পুনর্বার ঐ পুস্তক মনোযোগ সহকারে পড়িয়াছি।

 কেবল সময় কাটাইবার জন্য নয়, জীবনের আনন্দ বৃদ্ধি করিবার জন্যও প্রত্যেকের রুচি অনুযায়ী একটা আনুষঙ্গিক কাজ বা ‘বাতিক’ (hobby) থাকা চাই। যাঁহারা অবসর বিনোদনের উপায় রূপে বিজ্ঞানচর্চা করিয়া জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করিয়াছেন, এমন কতকগুলি লোকের নাম করা যাইতে পারে, যথা—ল্যাভোয়াসিয়ার, প্রিষ্টলে, শীলে, এবং ক্যাভেন্‌ডিশ। ডায়োক্লিশিয়ান এবং ওয়াশিংটন কার্যময় জীবন হইতে অবসর লইয়া বৃদ্ধবয়সে পল্লিজীবনের নির্জনতায় কৃষিকার্য করিয়া সময় কাটাইতেন। গ্যারিবল্ডিও ঐরূপ করিতেন। অন্য অনেকে, মানব-হিতে, রুগ্ন ও দরিদ্রের দুঃখমোচনে, এবং অন্যান্য নানারূপ সমাজ সেবায় আনন্দ অনুভব করিয়াছেন। কেহ কেহ বা শিল্পকলা—যথা সঙ্গীত, চিত্রবিদ্যা প্রভৃতির চর্চায় সময় কাটাইয়াছেন। এ-বিষয়ে কোন বাঁধাধরা নিয়ম নাই, লোকের রুচির উপর ইহা নির্ভর করে। কথায় বলে—অলস মন, শয়তানের আড্ডা। যে সব কাজের কথা উল্লেখ করিলাম, তরল আমোদ প্রমোদ হইতে আত্মরক্ষা করিবার উহাই শ্রেষ্ঠ উপায়। ‘আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টঃ’—অর্থাৎ নিজের মধ্যে নিজেই সর্বদা সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

 অন্যের উপর যতই নির্ভর করা যায়, দুঃখ ততই বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ লোক দিনের কাজকর্ম শেষ হইলে, ক্লাবের জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠে, অথবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডায় গল্প করিয়া সময় কাটায়। তাহারা সময়কে বধ করে বলিলেই ঠিক হয়। সর্বোপরি, সন্তোষ অভ্যাস করিতে হইবে। বাল্যকালে এডিসনের প্রবন্ধে পড়িয়াছিলাম—“আমোদ অপেক্ষা আনন্দই আমি চিরদিন বেশী পছন্দ করি।” আনন্দ জীবনের চক্রে যেন তৈলের ন্যায় কাজ করে। এমন সব লোক আছে, সামান্য কারণেই যাহাদের মেজাজ চটিয়া যায়। তুচ্ছ কারণে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠে। এই সমস্ত লোক সর্বদাই দুঃখ পায়। যাহারা অপ্রিয় ব্যাপার হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারে, তাহাদের সৌভাগ্য আমি কামনা করি, অন্যের মনোভাব সম্বন্ধে সব সময়ে ভাল দিকটাই দেখিতে হয়। ঈর্ষাকে পরিহার করিতে হইবে, ঈর্ষা লোকের জীবনীশক্তি নষ্ট করে। যাহাকে ঈর্ষা করা যায়, তাহার কোন ক্ষতি হয় না, কিন্তু যে ঈর্ষা করে, তাহার হৃদয় দগ্ধ হয়। হিংসা ও বিদ্বেষ মনের সন্তোষ নষ্ট করে। আর মনের সঙ্গে দেহের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। যে অন্যের প্রতি হিংসা করে, সে ভুলিয়া যায় যে তাহাতে তাহার নিজের মনের শান্তিও দূর হয়।

 “মিল বলেন, বৈষয়িক কার্যের অভ্যাস সাহিত্য-চর্চার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে, ইহাতে শক্তি বৃদ্ধি পায়।” তাঁহার (মিলের) তরুণ বয়সের অভিজ্ঞতা এই যে, সমস্ত দিনের কাজের পর দুই ঘণ্টায় অনেক বেশী সাহিত্যসেবা করিতে পারিতেন; যখন তিনি প্রচুর অবসর লইয়া সাহিত্যচর্চা করিতে বসিতেন, তখন তেমন বেশী দূর অগ্রসর হইতে পারিতেন না। বৈষয়িক কার্যের সঙ্গে সাহিত্যচর্চার সমন্বয়ের প্রসিদ্ধ দৃষ্টান্ত বেজহটের জীবন। গিবন বলিতেন যে, শীতকালে লণ্ডনসমাজ ও পার্লামেণ্টের কর্মচঞ্চল জীবনের মধ্যে তিনি অধিক মানসিক শক্তি অনুভব করিতেন, রচনাকার্য তাঁহার পক্ষে বেশী সহজ হইত। গ্রোট প্রতিদিন তাঁহার ‘গ্রীসের ইতিহাস’ লিখিবার জন্য আধ ঘণ্টা সময় ব্যয় করিতেন, দুই খণ্ড গ্রন্থ বাহির হইবার পূর্বে ব্যাঙ্কের কাজে তাঁহাকে কঠোর পরিশ্রম করিতে হইত। আমাদের সমসাময়িক জনৈক লোকপ্রিয় ঔপন্যাসিক ডাকঘরের কর্মচারী ছিলেন। প্রত্যহ সকাল বেলা ৫টা-৬টার সময় তিনি ডাকঘরের কাজের মতই সময় নির্দিষ্ট করিয়া উপন্যাস লিখিতে বসিতেন।” (মর্লির স্মৃতি কথা, প্রথম খণ্ড, ১২৫ পূঃ।

 বৈষয়িক কার্যে কঠোর পরিশ্রম করিয়াও, কিরূপে সাহিত্য সেবা এবং বিদ্যানুশীলন করা যায়, তাহার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত, গ্রীসের ইতিহাসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থকার জর্জ গ্রোটের জীবন। দশ বৎসর বয়সে তিনি ‘চার্টার হাউসে’ ভর্তি হন এবং ১৬ বৎসর বয়সে তাঁহার পিতা তাঁহাকে ব্যাঙ্কে শিক্ষানবীশ নিযুক্ত করেন। গ্রোটের বিদ্যাচর্চার প্রতি তাঁহার পিতার একটা অবজ্ঞার ভাবই ছিল। তিনি ব্যাঙ্কে ৩২ বৎসর কাজ করেন এবং ১৮৩০ সালে উহার প্রধান কর্মকর্তা হন। কিন্তু এই কার্যব্যস্ততার মধ্যেও তিনি অবসর সময়ে নিয়মিত ভাবে সাহিত্যসেবা ও রাজনীতি আলোচনা করিতেন। ১৮৪৩ সালে ব্যাঙ্ক হইতে অবসর গ্রহণের পর তিনি তাঁহার গ্রীসের ইতিহাস (১২ খণ্ড) শেষ করেন বটে; কিন্তু ১৮২২ সালেই তিনি ঐ গ্রন্থ লিখিবার সঙ্কল্প করেন এবং বরাবর উহার জন্য অধ্যয়ন ও মালমশলা সংগ্রহ কার্যে লিপ্ত ছিলেন। গ্রোট নূতন লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান প্রবর্তক। তিনি কয়েক বৎসর পার্লামেণ্টের সদস্যও ছিলেন।

 আমার নিজের অভিজ্ঞতা হইতেই জানি যে, যাহারা কাজের লোক, তাহাদের সময়ের অভাব হয় না। যাহারা অলস, যাহাদের কাজে শৃঙ্খলা নাই, তাহারাই কেবল দৈনন্দিন কাজে বা কোন জরুরী কাজের জন্য সময়ের অভাবের কথা বলে।

 ক্রমওয়েল ১৬৫০ খৃঃ ৩রা সেপ্টেম্বর ডানবারের যুদ্ধ পরিচালনা করেন। সমস্ত দিন যুদ্ধ করিয়া ও পলাতক শত্রুর পশ্চাৎ ধাবন করিয়া কাটে। “পরদিন ৪ঠা সেপ্টেম্বর সকালে লর্ড জেনারেল (ক্রমওয়েল) বসিয়া পর পর সাতখানি পত্র লেখেন। তাহার মধ্যে একখানি স্পীকার লেন্‌থলের নিকট আট পৃষ্ঠাব্যাপী ডেসপ্যাচ। আর একখানি তাঁহার ‘প্রিয়তমা পত্নী’ এলিজাবেথের নিকট এবং তৃতীয়খানি ‘প্রিয় ভ্রাতা’ রিচার্ড মেয়রের নিকট। রিচার্ড মেয়র ক্রমওয়েলের পুত্রের শ্বশুর বা বৈবাহিক ছিলেন। (ক্রমওয়েল, দ্বিতীয় খণ্ড, ২০৯—২৫ পঃ)

 ১৬৫১ খৃঃ ৩রা সেপ্টেম্বর ওরষ্টারের যুদ্ধ হয়। ক্রমওয়েল স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করেন। সমস্ত দিন স্কচেরা ভীষণ যুদ্ধ করে। ক্রমওয়েল রণক্ষেত্রে নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া সৈন্য চালনা করেন। ৪।৫ ঘণ্টা তুমল সংগ্রাম হয়।

 ঐ দিন রাত্রি ১০টার সময় হঠাৎ যুদ্ধ-বিরতির পরই ক্রমওয়েল স্পীকার লেনথলকে যুদ্ধের একটি বর্ণনা প্রেরণ করেন। “আমি ক্লান্ত, লিখিতে ইচ্ছা হইতেছে না, তবু আপনাকে এই বিবরণ প্রেরণ করা কর্তব্য বোধ করিতেছি।” (৩২৫—৩২৯ পৃঃ।)

 আমি উপরোক্ত দৃষ্টান্তগুলির দ্বারা ইহাই দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে, মহৎ ব্যক্তিদের সংযম-শক্তি ও আত্মসমাহিত ভাব অসাধারণ; তাঁহাদের কার্যপ্রণালীর মধ্যে নিয়ম ও শৃঙ্খলা আছে, এবং সেই জন্যই তাঁহারা বহু বিষয়ে মন দিতে পারেন ও সব কাজই সুসম্পন্ন করিতে পারেন। কার্লাইল বীর উপাসক ছিলেন। তিনি ক্রমওয়েলকে বলিয়াছেন, ‘ইংলণ্ডের সর্বাপেক্ষা মহৎ চরিত্র।’ এ বিষয়ে অবশ্য মতভেদ থাকিতে পারে। জনৈক প্রসিদ্ধ কবি বলিয়াছেন, “ক্রমওয়েল তাঁহার দেশবাসীর রক্তপাতের কলঙ্ক হইতে মুক্ত ছিলেন না।”

 আর একটি দৃষ্টান্ত দেই! মুস্তাফা কামাল পাশার স্বদেশবাসিগণ তাঁহাকে নব্য তুরস্কের রক্ষাকর্তা বলিয়া পূজা করেন। কামাল পাশা একাধারে যোদ্ধা, রাজনীতিক, সমাজ-সংস্কারক। তিনি আঙ্গোরা সম্পর্কে সমস্ত কাজই করিবার সময় পান, মন্ত্রীদের সঙ্গে সমস্ত গুরুতর বিষয়ে আলোচনা করেন এবং তাঁহাদিগকে কার্যে অনুপ্রাণিত করেন। তাঁহার বহমুখী কার্যশক্তির গুপ্ত রহস্য কি? মিস গ্রেস এলিসন সেই কথাটি সংক্ষেপে বলিয়াছেন:—“মোস্তাফা কামাল পাশার মনঃসংযোগ শক্তি অসাধারণ। তিনি মূহূর্তের মধ্যে যে কোন বিষয়ে মন দিতে পারেন এবং সেই সময়ে পূর্ব মুহূর্তের সমগ্র চিন্তা ভুলিয়া যান।”—বর্তমান তুরস্ক, ১৮ পৃঃ।

 আর একটি জীবন্ত দৃষ্টান্ত দিতেছি, তিনি প্রেম ও অহিংসা সংগ্রামের মূর্ত বিগ্রহ। মহাত্মা গান্ধীর কর্মশঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা অসাধারণ, তিনি গুরুতর বিষয় সম্পর্কে বড়লাট ও স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করিতেছেন, পত্র লিখিতেছেন, প্রত্যহ তাঁহার নিকট দেশদেশান্তর হইতে শত শত পত্র টেলিগ্রাম আসিতেছে। বহু লোক বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতেছে; তিনি তাহাদের কথা শুনিতেছেন, ‘ইয়ং ইণ্ডিয়া’র জন্য প্রবন্ধ লিখিতেছেন এবং আরও বহু কাজ করিতেছেন,—কিন্তু এই সমস্ত গুরুতর কাজের মধ্যেও তাঁহার অসংখ্য বন্ধু ও সহকর্মীদের নিকট নিজে উদ্যোগী হইয়া পত্র লিখিবার সময় তিনি পান। আমি চিরদিনই তাঁহার মূল্যবান সময় নষ্ট করিতে দ্বিধা বোধ করিয়াছি। গত দুই বৎসরের মধ্যে তাঁহাকে কোন পত্র লিখিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সংবাদ পত্রে, বোম্বাই সহরবাসীদের প্রতি বাংলার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যের জন্য আমার নিবেদনপত্র দেখিয়া, আমাকে এবং বন্যা সেবাকার্যে আমার প্রধান সহকারীকে, মহাত্মাজী দুইখানি দীর্ঘ পত্র লিখেন। অদ্য—১৯৩১ সালের ৩০শে আগষ্ট সকালে, এই কয়েক ছত্র লিখিবার সময় আমি সংবাদপত্রে দেখিতেছি, তিনি বোম্বাই প্রদেশের অধিবাসীদের নিকট একটি বিদায়বাণী দিয়াছেন:—

ইংলণ্ড যাত্রার পূর্বে

বন্যা-পীড়িতদের সাহায্যের জন্য গান্ধীজীর আবেদন

 “আমি আশা করি, বোম্বাই প্রদেশের লোকেরা বাংলার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যের জন্য অগ্রসর হইবে এবং ডাঃ পি. সি. রায়ের নিকট তাহাদের দান প্রেরণ করিবে।” অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, বোম্বে, ২৯শে আগষ্ট, ১৯৩১।

 মনকে এইভাবে চিন্তামুক্ত করিয়া বিষয়ান্তরে অভিনিবেশ করিবার ক্ষমতা, আমাকেও কিয়ৎপরিমাণে প্রকৃতি দান করিয়াছেন এবং এই শক্তিবলে আমি সময়ে সময়ে একাদিক্রমে ৬।৭টি বিভিন্ন কাজে মনঃসংযোগ করিয়াছি।

 আমাকে যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন, আমার জীবনের কোন অংশ সর্বাপেক্ষা কর্মব্যস্ত?—আমি বিনা দ্বিধায় উত্তর দিব ষাট বৎসরের পর। এই সময়ের মধ্যে আমি ভারতের একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত, প্রায় দুই লক্ষ মাইল ভ্রমণ করিয়া স্বদেশী শিল্পপ্রদর্শনী, জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির উদ্বোধন করিয়াছি, স্বদেশীর কথা প্রচার করিয়াছি। দুইবার ইউরোপেও গিয়াছি। কিন্তু আমার দৈনন্দিন কার্যতালিকা হইতে দেখা যাইবে যে, এইরূপ বিভিন্ন কর্মে লিপ্ত থাকিলেও বিজ্ঞানাগারে আমার গবেষণাকার্য ত্যাগ করি নাই,— যদিও এদেশের অনেকেরই ধারণা যে বহুপূর্বেই আমি গবেষণাকার্য পরিত্যাগ করিয়া থাকিব। একথা সত্য যে, কাহারও কর্মক্ষেত্র যদি বহুবিস্তৃত হয়, তবে নির্জনতাপ্রিয় ধ্যানমগ্ন তপস্বীর মত সে গবেষণাকার্যে তত বেশী মনোযোগ দিতে পারে না। এই ক্ষতি পূরণ করিবার জন্য আমি আমার অবকাশের সময় সংক্ষেপ করিতে বাধ্য হইয়াছি। পূর্বে গরমের ছুটীর পুরা একমাস আমি স্বগ্রামে কাটাইতাম, এখন কখন কখন খুলনা ও অন্যান্য স্থানে বেড়াইয়াই সন্তুষ্ট থাকিতে হয়। গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটীতে (১২।১৪ দিন ব্যতীত) এবং পূজা, বড়দিন ও ইস্টারের ছটীতে আমি লেবরেটরিতে কাজ করিয়া থাকি। বস্তুতঃ, বোম্বাই, নাগপুর, মাদ্রাজ, বাঙ্গালোর[], লাহোর প্রভৃতি স্থানে যাতায়াত এখন আমার নিকট ছুটী বলিয়া গণ্য। সতরাং দেখা যাইবে যে, আমি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সময়ের ক্ষতিপূরণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। গত ২১ বৎসর যাবৎ আমি প্রত্যহ দুই ঘণ্টা ময়দানে কাটাইয়া আসিতেছি। ইহার ফলে স্বাস্থ্যলাভের জন্য শৈলবিহারে গমন করা আমার পক্ষে নিষ্প্রয়োজন। এতদ্ব্যতীত, যে কাজে দীর্ঘকালব্যাপী অবিরাম মানসিক শ্রমের প্রয়োজন, এমন কাজে আমি কখনও হাত দিই নাই। ঐরূপ অবিরত শ্রমেই স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইতে পারে এবং স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য সেই কারণে দীর্ঘকালব্যাপী বিশ্রামেরও প্রয়োজন।

 গত অর্ধশতাব্দী কাল, স্বাস্থ্যের জন্য, অপরাহ্ণ ৫টা, সাড়ে ৫টার পর আমি কোনপ্রকার মানসিক শ্রম করি নাই। শীতপ্রধান দেশে এই নিয়ম কিঞ্চিৎ ভঙ্গ করিয়াছি, যথা,—শুইতে যাইবার পূর্বে দু’ এক ঘণ্টা কোন লঘু সাহিত্য পাঠ করিয়াছি। বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার জন্য আমাকে বহু সময় দিনে পরিশ্রম করিতে হইয়াছে, সন্দেহ নাই, কিন্তু এমনভাবে আমি সে সমস্ত ব্যবস্থা করিয়াছি যে, আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কোন ব্যাঘাত হয় না, দৈনন্দিন কার্যতালিকা অনুসারে যথাযথ কাজ করিবার ফলেই,—বৈজ্ঞানিক গবেষণা করিবার যথেষ্ট অবসর আমি পাইয়াছি। গ্যেটে সত্যই বলিয়াছেন,—“সময় দীর্ঘ, যদি আমরা ইহার সদ্ব্যবহার করি, তবে অধিকাংশ কাজই এই সময়ের মধ্যেই করা যাইতে পারে।”

 বস্তুতঃ, মানুষের প্রতি ভগবানের এই মহৎ দান সম্বন্ধে প্রসিদ্ধ প্রাণিতত্ত্ববিৎ লুই আগাসিজ যাহা বলিয়াছেন, তাহার মর্ম আমি বেশ উপলব্ধি করিতে পারি।

 “দশ বৎসর বয়সে আগাসিজ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তৎপূর্বে গৃহেই তিনি শিক্ষালাভ করেন। অতঃপর বিয়েন সহরের একটি বালকদের বিদ্যালয়ে তিনি ও তাঁহার ভ্রাতা অগাষ্ট চার বৎসর পড়েন। কিন্তু লুইয়ের সত্যকার জ্ঞানপিপাসা ছিল এবং দীর্ঘ অবকাশের সুযোগ তিনি সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করিতেন। বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে ডুবিয়া থাকিয়া এই সময়ে তিনি আনন্দলাভ করিতেন।” বাঙালী ছেলেরা কবে এরূপ প্রকৃতিপ্রিয়তা লাভ করিবে?

 আগাসিজ বলিয়াছেন—“লোকে কেন অলস হয়, আমি ঝুঝিতে পারি না; সময় কাটাইবার উপায় খুঁজিয়া পায় না, লোকের এরূপ অবস্থা কিরূপে হইতে পারে, তাহা বুঝা আমার পক্ষে আরও শক্ত। নিদ্রার সময় ব্যতীত, এমন এক মূহুর্তও নাই, যখন আমি কর্মের আনন্দের মধ্যে ডুবিয়া না থাকি। তোমার নিকট যে সময় বিরক্তিকর বা ক্লান্তিজনক মনে হয়, সেই সময়টা আমাকে দাও, আমি উহা মূল্যবান উপহার বলিয়া মনে করিব। দিন যেন কখন শেষ হয় না, ইহাই আমি ইচ্ছা করি।”

 পরলোকগত রসায়নাচার্য স্যার এডোয়ার্ড থর্প আমার Essays and Discourses নামক গ্রন্থ সমালোচনাপ্রসঙ্গে বলিয়াছেন :―

“হিন্দু রাসায়নিকের জীবন-ব্রত”

 ....“স্যার পি. সি. রায় যে শীঘ্রই ‘সাধারণের সম্পত্তি’ বলিয়া গণ্য হইবেন, ইহা পূর্ব হইতেই বুঝা গিয়াছিল। বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সম্মেলন, সাময়িক পত্র, সংবাদপত্র ও দেশের সামাজিক, শিল্পবাণিজ্যগত এবং রাজনৈতিক উন্নতি প্রচেষ্টার সহিত যাহারা সংসৃষ্ট তাহারা জাতীয় কল্যাণের পথ নির্দেশ করিবার জন্য তাঁহাকে বক্তৃতা করিবার জন্য আহ্বান করিতে লাগিল।.......অজীর্ণ-রোগ-গ্রস্ত, ক্ষীণদেহ এই ব্যক্তি দেশের সেবাতেই নিজের জীবন ক্ষয় করিবেন।” (নেচার, ৬ই মার্চ, ১৯১৯)।

 তিনি যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতেন, তবে বুঝিতে পারিতেন যে, ভগবানের ইচ্ছায় আমার জীবনের কার্য এখনও শেষ হয় নাই। গত ত্রয়োদশবর্ষকাল আমি আমার জীবনে পূর্বের চেয়ে আরও বেশী পরিশ্রম করিয়াছি।

 যদি কেহ আমার দৈনিক কার্যক্রম পাঠ করেন, তবে দেখিতে পাইবেন যে, আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সঙ্গেও আলাপ পরিচয় করিবার সময় আমার হয় নাই। ২৫ বৎসর পূর্বে, জগদীশচন্দ্র বসু, নীলরতন সরকার, পরেশনাথ সেন (বেথুন কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক), হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য প্রভৃতি বন্ধুগণের বাড়ীতে দু এক ঘণ্টা কাটাইতে পারিতাম, তাঁহাদের বাড়ী আমার নিজগৃহতুল্যই ছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রকারের এত বেশী কাজের সঙ্গে জড়িত হওয়াতে, আমার সামাজিক আনন্দের অবসর লোপ পাইয়াছে। সন্ধ্যাবেলাই সাধারণতঃ বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের সময়, কিন্তু এই সময়টাতে আমি ‘ময়দান ক্লাবে’ কাটাই। অবস্থাচক্রে বাধ্য হইয়া, নিকটতম আত্মীয়দের কাছেও আমি অপরিচিত হইয়া পড়িয়াছি। লেবরেটরি ও অন্যান্য স্থানে আমার প্রিয়তম ছাত্রগণের সাহচর্ষে আমি অন্য সমস্ত জিনিষ, এমনকি বার্ধক্যের আক্রমণও ভুলিয়া গিয়াছি।

 পূর্বেই বলিয়াছি অধ্যক্ষতার কার্য আমি চিরদিন পরিহার করিয়াছি, কেননা ইহাতে অত্যন্ত সময় ব্যয় করিতে হয়। গত ২৫ বৎসরকাল আমি পরীক্ষকের কাজ গ্রহণ করি নাই। মাঝে মাঝে কেবল দুই একটি থেসিস (মৌলিক রচনা) দেখিয়াছি বা প্রশ্নপত্র প্রস্তুত করিয়াছি। আমার জনৈক ইংরাজ সহকর্মী বলিতেন, পরীক্ষকের কাজে কিঞ্চিৎ অর্থাগম হয়,—কিন্তু একঘেয়ে পরিশ্রমসাধ্য কাজে সময়ের যথেষ্ট অপব্যয় হয় এবং স্নায়ু পীড়িত হয়।

  1. The lapse of time and rivers is the same:
    Both speed their journey with a restless stream;
    But time that should enrich the nobler mind
    Neglected, leaves a dreary waste behind.

  2. মুসোলিনী যখন লিখেন, তখন কেহ তাঁহাকে বিরক্ত করিবে, এ তিনি ইচ্ছা করেন না। ... তিনি যে ইহাতে কিরূপ ক্ষুদ্ধ হন, তাহা রসাটোর একটি বর্ণনায় বুঝা যায়। তাঁহার (মুসোলিনীর) লিখিবার টেবিলের উপর ২০ রাউণ্ডের একটি বড় রিভলভার এবং একখানি চকচকে ধারালো বড় ছুরি থাকে। কালির আধারের উপর একটি ছোট রিভলভার থাকে। * * “কেহই এখানে আসিতে পারিবে না, যদি কেহ আসে তাহাকে গুলি করিয়া মারিব।”
  3. কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাদ্রাজ থাকিবার সময় (১৮৪৮-৫৬) তাঁহার দৈনিক কার্যতালিকা এইরূপে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন: স্কুলের ছাত্রের চেয়েও আমার জীবন পরিশ্রমপূর্ণ। আমার কার্যতালিকা ৬-৮ হিব্রু; ৮—১২ স্কুল; ১২—২ গ্রীক; ২৫ তেলেগু ও সংস্কৃত; ৫—৭ লাটিন; ৭-১০ ইংরাজী। মাতৃভাষার উন্নতি সাধনের মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য আমি কি প্রস্তুত হইতেছি না? (যোগীন্দ্র বসু কৃত জীবনী, ১৬৪ পৃঃ)।
  4. গত চারি বৎসর হইল, সায়েন্স ইনস্টিটিউটের কাউন্সিল সভায় আমি বৎসরে ৩।৪ বার যোগদান করিয়া আসিতেছি।