আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/একাদশ পরিচ্ছেদ
একাদশ পরিচ্ছেদ
বাংলায় জ্ঞানরাজ্যে নব জাগরণ
হিন্দুদের প্রতিভা অতীব সূক্ষ্ম এবং তাহাদের মনের গতি দার্শনিকতার দিকে। জেমস্ মিলের নিম্নলিখিত কথাগুলিতে কিছুমাত্র অতিরঞ্জন নাই: “কোন একটি দার্শনিক সমস্যার আলোচনায় হিন্দু বালকরা আশ্চর্য বুদ্ধির খেলা দেখাইতে পারে, কিন্তু একজন ইংরাজ বালকের নিকট তাহাই দুর্বোধ্য প্রহেলিকা বলিয়া বোধ হয়।” কিন্তু কেবলমাত্র দার্শনিক বিদ্যা দ্বারা যে হিন্দুজাতির উন্নতি হইবে না, ইহা বহুদিন হইতেই বুঝিতে পারা গিয়াছিল। এক শতাব্দীরও অধিককাল পূর্বে রাজা রামমোহন রায় বড়লাট লর্ড আমহার্স্টের নিকট যে পত্র লিখেন, তাহাতে তিনি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন:—
“আমরা দেখিতেছি যে, গভর্ণমেণ্ট হিন্দু পণ্ডিতদের শিক্ষকতায় সংস্কৃত বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য উদ্যোগী হইয়াছেন। এদেশে যেরূপ শিক্ষা প্রচলিত আছে, তাহাই এই সমস্ত বিদ্যালয়ে শিখাইবার ব্যবস্থা হইবে। ইউরোপে লর্ড বেকনের অভ্যুদয়ের পূর্বে যেরূপ বিদ্যালয় ছিল, ইহা ঠিক সেই শ্রেণীর এবং ইহাতে যে ব্যাকরণের কূটতর্ক এবং দার্শনিক সূক্ষ্মতত্ত্ব শিখান হইবে, তাহা ঐ বিদ্যার অধিকারী বা সমাজের পক্ষে কোন কাজে লাগিবে না। দুই হাজার বৎসর পূর্বে যাহা জানা ছিল, এবং পরে তাহার সঙ্গে তার্কিক লোকেরা আরও যে সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার বিতর্ক যোগ করিয়াছেন, ছাত্রেরা তাহারই জ্ঞান লাভ করিবে। ভারতের সর্বত্র এখন সাধারণতঃ এইরূপে শিক্ষাই প্রদত্ত হইয়া থাকে।.....ব্রিটিশ জাতিকে যদি প্রকৃত জ্ঞান হইতে বঞ্চিত করিবার ইচ্ছা থাকিত, তবে পাদরীদের প্রচারিত বিদ্যার পরিবর্তে বেকন কর্তৃক প্রচারিত বিদ্যা তাহাদিগকে শিখিতে দেওয়া হইত না। কেন না পাদরীদের প্রচারিত বিদ্যার দ্বারা মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে চিরদিনের জন্য আচ্ছন্ন রাখা যাইতে পারিত। ঠিক সেইভাবে সংস্কৃত বিদ্যার দ্বারা ভারতকে চিরদিনের জন্য অজ্ঞতায় নিমজ্জিত রাখা যাইতে পারে—তাহাই যদি ব্রিটিশ পার্লামেণ্টের অভিপ্রায় হয়। কিন্তু গবর্ণমেণ্টের উদ্দেশ্য এদেশবাসীর উন্নতিসাধন করা, সুতরাং তাঁহাদের অধিকতর উদার এবং উন্নত শিক্ষা প্রণালী প্রবর্তন করা উচিত। ইহাতে গণিত, প্রাকৃতদর্শন, রসায়নশাস্ত্র, জ্যোতিষ এবং অন্যান্য কার্যকরী বিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকিবে। সংস্কৃত বিদ্যা শিখাইবার জন্য যে অর্থব্যয়ের প্রস্তাব হইতেছে, ঐ অর্থ দ্বারা যদি ইউরোপে শিক্ষিত কয়েকজন যোগ্য পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হয় এবং প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সমন্বিত একটি কলেজ স্থাপন করা হয়, তাহা হইলেই ঐ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে।
নব্য বাংলা, তথা নব্য ভারতের প্রবর্তক বিখ্যাত সংস্কারক রাজা রামমোহন নিজে সংস্কৃত বিদ্যায় প্রগাঢ় পণ্ডিত ছিলেন, এই কথা স্মরণ রাখিলে, আমরা উদ্ধৃত পত্রখানির মূল্য বুঝিতে পারিব। রাজা রামমোহনই বাংলা দেশে প্রথম উপনিষদ আলোচনার পথ প্রদর্শন করেন। তিনি নিজে বাংলা ও ইংরাজীতে কয়েকখানি উপনিষদের অনুবাদ করেন। যদিও বেদান্তশাস্ত্রে রাজা রামমোহনের গভীর জ্ঞান ছিল, তথাপি তিনি যে নব্য ভারতের স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, তাহাতে প্রাকৃতবিজ্ঞানই প্রধান স্থান গ্রহণ করিবে।
ষাট বৎসর পরে বঙ্কিমচন্দ্রও তাঁহার “আনন্দমঠে” ভবিষ্যৎ ভারতের ভাগ্যগঠনের ব্যাপারে প্রাকৃতবিজ্ঞানের স্থান নির্ণয় করিতে ভুলেন নাই। যে যুগে ষড়দর্শনের সৃষ্টি হইয়াছিল, ভারতের সে যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল— ‘চিন্তার সরলতা।’ কিন্তু সে যুগ বহুদিন হইল অতীত হইয়াছিল। হিন্দু প্রতিভা টোলের পণ্ডিতদের প্রভাবে আচ্ছন্ন হইয়াছিল এবং চুলচেরা বিচার বিতর্কই ছিল, তাহার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তখন যে বিদ্যা প্রচলিত ছিল, বাক্লের ভাষায় তৎসম্বন্ধে বলা যায়—“যাহারা যত বেশি পণ্ডিত হইত, তাহারা তত বেশী মূর্খ হইয়া দাঁড়াইত।”
ভারতের সৌভাগ্যক্রমে রামমোহন ঠিক সময়েই সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছিলেন, চারিদিকের দুর্ভেদ্য অন্ধকাররাশির মধ্যে সুদক্ষ নাবিকের ন্যায় তিনি দিকনির্ণয় করিয়া দিয়াছিলেন। মেকলের প্রসিদ্ধ মন্তব্যলিপি (১৮৩৫) ভারতের জ্ঞানরাজ্যে নব জাগরণের মূলে কম প্রভাব বিস্তার করে নাই। নব্য হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরা উহার কোন কোন মন্তব্যে যতই ক্ষুব্ধ হউন না কেন, প্রাচ্যশিক্ষাবাদীদের সহিত সঙ্ঘর্ষে পাশ্চাত্য-শিক্ষাবাদীদের এই জয়লাভ, বর্তমান ভারতের ইতিহাসে নবযুগের সূচনা করিয়াছে। বাংলার যুবকগণ কিরূপে উৎসাহের সঙ্গে পাশ্চাত্যবিদ্যা আয়ত্ত করিবার জন্য প্রবৃত্ত হইয়াছিল তাহা এখানে বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই। সেক্সপিয়র ও মিল্টন, বেকন, লক, হিউম এবং আডাম স্মিথ; গিবন ও রলিন্স, নিউটন ও ল্যাপ্লেস, তাহাদের চক্ষে এক নব জগতের দ্বার খুলিয়া দিয়াছিল। এই নূতন মদিরাপানে তাহারা যে মত্ত, এমন কি বিভ্রান্ত হইয়া উঠিবে তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছু নাই।
সৌভাগ্যক্রমে পাশাপাশি আর একটি ভাবের প্রবাহ বহিয়া চলিয়াছিল এবং তাহাতে এই উত্তেজনা ও উম্মাদনাকে ধীরে ধীরে সংযত করিয়া তুলিতেছিল। ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও রাজনারায়ণ বসু, যদিও পাশ্চাত্য সরস্বতীমন্দিরের উপাসক ছিলেন, তবুও প্রাচ্যভাব একেবারে ত্যাগ করিতে পারেন নাই। হিন্দু কলেজের আর একজন পুরাতন ছাত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ের ফল এবং রাজা রামমোহন রায়ের শিষ্য। ব্রাহ্মসমাজের এই প্রথম পতাকাবাহীর জীবনে বেদান্তদর্শন বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।
জাতির ইতিহাসে দেখা যায়, বিভিন্ন সভ্যতার সঙ্ঘর্ষ অনেক সময় অদ্ভূত ফল প্রসব করে, কিন্তু মোটের উপর পরিণাম কল্যাণকরই হয়। গর্বিত রোম পরাজিত গ্রীসের পদতলে বসিয়া শিক্ষালাভ করিতে লজ্জা বোধ করে নাই। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গমস্থল আলেকজেন্দ্রিয়া “নিওপ্লেটনিজমে”র জন্মভূমি এবং তাহার বিপণীতে কেবল পণ্যবিনিময়ই হইত না, চিন্তা ও ভাবেরও আদানপ্রদান হইত। এরাসমাস, স্কেলিগার ভ্রাতৃদ্বয়, বাড এবং আরও বহু পণ্ডিত সহস্র বৎসর ধরিয়া বিস্মৃতির গর্ভে প্রোথিত, প্রাচীন গ্রীস ও রোমের জ্ঞানভাণ্ডার আবিষ্কারে কম সাহায্য করেন নাই। যে জ্ঞানের আলোক কেবলমাত্র সন্ন্যাসীদের মঠের অন্ধকার কক্ষে স্তিমিতভাবে জ্বলিতেছিল, তাহাই এখন সর্বসাধারণের দৃষ্টিগোচর হইল। ইটালীয় পেট্রার্ক এবং বোকাসিওর রচনাবলী ইংরাজ কবি চসারের কাব্যসাহিত্যের উপর কম প্রভাব বিস্তার করে নাই। মিল্টন দান্তের নিকট বিশেষভাবে ঋণী ছিলেন। তিনি (মিল্টন) অনুপ্রেরণা লাভের জন্য ইটালী দেশেও গিয়াছিলেন, তাঁহার কবিতায় ভালামব্রোসা নদীর বর্ণনা হইতে তাহা আমরা বুঝিতে পারি।
মোলিয়ারের belles letters -এ ল্যাটিনই খুব বেশী, গ্রীকও কিছু আছে, কিন্তু ফরাসী ভাষা একেবারেই নাই। তখনকার দিনে মার্জিতরুচি পণ্ডিতদের সাহিত্যে মাতৃভাষার স্থান ছিল না। এই অমরকীর্তি প্রহসনকারের প্রথম জীবনের রচনায় ইটালীয়স্পেনীশ প্রভাব যথেষ্ট দেখা যায়, কিন্তু তাঁহার পরিণত বয়সের শ্রেষ্ঠ রচনাসমূহে ‘গেলিক’ প্রভাব স্পষ্টই পড়িয়াছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। নব্য বাংলার কাব্যসাহিত্যের ‘জনক’ পুরাতন হিন্দু স্কুলের ছাত্র এবং মাতৃভাষার প্রতি তাঁহার অত্যন্ত অবজ্ঞা ছিল দান্তে ও মিলটনের কাব্যরসেই তিনি আনন্দ পাইতেন এবং তাঁহার প্রথম কাব্য “দি ক্যাপটিভ লেডী” তিনি ইংরাজী ভাষাতেই রচনা করেন। মিল্টনও প্রথমে ল্যাটিন কবিতা রচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু পরে তিনি তাঁহার ভ্রম বুঝিতে পারেন। মেকলে যথার্থই বলিয়াছেন যে, কোন মৃত ভাষায় কবিতা রচনা করা, এক দেশ হইতে আনীত চারাগাছ অন্য দেশে ভিন্ন মাটিতে লাগানোর মত। বিদেশে নূতন জমিতে সে গাছ কিছুতেই স্বাভাবিকরূপে শক্তিশালী হইতে পারে না। যে দেশে এইরূপ ‘বিদেশী কবিতা’ রচিত হয়, সেখানে মাতৃভাষায় কোন শক্তিশালী কাব্যের সৃষ্টি হইতে পারে না। যেমন ফলগাছের টবে ওক বৃক্ষ জন্মে না।
মিল্টনের ন্যায় মধুসূদন দত্তও শীঘ্রই বুঝিতে পারিলেন যে, সাহিত্যে স্থায়ী আসন এবং যশোলাভ করিতে হইলে, তাঁহাকে মাতৃভাষাতেই কাব্য রচনা করিতে হইবে। তাহার ফলে তিনি বাংলা ভাষায় তাঁহার অমর কাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ দান করিয়া গিয়াছেন। অবশ্য, এই অমর কাব্যে স্বর্গ ও নরকের বর্ণনা এবং কয়েকটি চরিত্র চিত্রনে আমরা হোমর, ভার্জিল, দান্তে, তাসো, মিল্টন প্রভৃতি পাশ্চাত্য কবিদের ভাবের ছায়াপাত দেখিতে পাই। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্রকে পরবর্তী যুগের লোক বলা যাইতে পারে। কিন্তু তাঁহারও ইংরাজী ভাষার প্রতি ঐরূপ মোহ ছিল এবং তাঁহার প্রথম উপন্যাস Rajmohan’s Wife (রাজমোহনের পত্নী) তিনি ইংরাজী ভাষাতেই রচনা করেন। কিন্তু তিনি শীঘ্রই তাঁহার ভ্রম বুঝিতে পারেন এবং বিদেশী ভাষা ত্যাগ করিয়া মাতৃভাষাতেই সাহিত্য সৃষ্টি করিতে আরম্ভ করেন। ফলে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে অবিনশ্বর কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন।
অন্য সাহিত্য হইতে কিছু গ্রহণ করার অর্থ কেবলই অন্ধ অনুকরণ বা মৌলিকতার অভাব নয়। এমার্সন বলিয়াছেন—“সর্ব প্রধান প্রতিভাও অন্যের নিকট অশেষরূপে ঋণী।... এমন কথাও বলা যায় যে প্রতিভার শক্তি আদৌ মৌলিক নয়।” অন্যত্র এমার্সন বলিয়াছেন,—“সেক্সপীয়র তাঁহার অন্যান্য সাহিত্যিক সহকর্মীদের ন্যায় অপ্রচলিত পুরাতন নাটকের দোষগুণ বিচার করিয়া তাহা হইতে উৎকৃষ্ট অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন, কেন না এরূপ ক্ষেত্রেই যথেচ্ছ পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ চলিতে পারে।” দৃষ্টান্ত স্বরূপ ‘হ্যামলেট’ নাটকের কথা উল্লেখ করা যায়। খুব সম্ভব, ১৫৮৯ খৃষ্টাব্দে কীড নামক জনৈক নাট্যকার কর্তৃক ঐ বিষয়ে একখানি নাটক রচিত হইয়াছিল। জাতির নবজাগরণের ইতিহাসে দেখা যায়, প্রচুর অনুকরণের সঙ্গে সঙ্গে, চিন্তা ও ভাবের গ্রহণ ও সমীকরণ চলিতে থাকে এবং ইহা শীঘ্রই জাতীয় সাহিত্যের অংশ হইয়া উঠে।
আরব সাহিত্যের উন্নতি ও বিকাশেও ইহার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। রক্ষণশীল উমায়েড খলিফাগণ মানসিক শক্তির দিক হইতে অলস বলা যাইতে পারে। এই সময়ে আরবে সাহিত্য বলিতে বিশেষ কিছু ছিল না। বেদুইনদের জীবনের ঘটনাবলীই প্রধানত আরবীয় কবিতার বিষয় ছিল। কিন্তু আবাসিদদের শাসনকালে আরব সাহিত্যে মোসলেম জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ দেখা যায়। প্রধানত গ্রীক সাহিত্যের অনুকরণ করিয়াই এই আরব সাহিত্য ঐশ্বর্যশালী হইয়া উঠিয়াছিল। খলিফা মনসুর ও মামুনের সময়ে আরব সাহিত্যের উপর গ্রীক সাহিত্যের প্রভাব পূর্ণরূপে বিস্তৃত হইয়াছিল। এরিষ্টোটল, প্লেটো, গ্যালেন, টোলেমী এবং নব্য প্লেটোনিষ্ট প্লোটিনাস ও পোরফিরির গ্রন্থাবলী মূল গ্রীক এবং সীরিয় ভাষা হইতে অনূদিত হইয়াছিল। ফালাসিফা-পন্থীদের (অর্থাৎ যাঁহারা মূল গ্রীক ভাষা হইতে গ্রহণ করিয়াছিলেন) মধ্যে আলকিণ্ডী, আল ফোরাবি, ইবন সিনা, আল রাজি এবং স্পেনীয় দার্শনিক ইবু রসদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
“বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানরাজ্যেরও প্রসার হইতে লাগিল—প্রাচ্যে তৎপূর্বে যাহা কখনও দেখা যায় নাই। বোধ হইল যেন খলিফা হইতে আরম্ভ করিয়া অতি সাধারণ লোক পর্যন্ত সকলেই শিক্ষার্থী এবং সাহিত্যের উৎসাহদাতা হইয়া উঠিল। জ্ঞানের অন্বেষণে লোকে তিনটি মহাদেশ ভ্রমণ করিয়া গৃহে ফিরিত। মধুমক্ষিকা যেমন নানা স্থান হইতে মধু আহরণ করিয়া আনে, ইহারাও তেমনি নানা দেশ হইতে অমূল্য বিদ্যা আহরণ করিয়া আনিত,—শিক্ষার্থীদের দান করিবার জন্য। কেবল তাহাই নহে,—তাহারা অক্লান্ত অধ্যবসায় সহকারে বিরাট বিশ্বকোষসমূহ সঙ্কলন করিতে লাগিল—যেগগুলি বলিতে গেলে অনেকস্থলে বর্তমান বিজ্ঞানের জন্মদাতা।” (নিকলসন, আরব সাহিত্যের ইতিহাস, ২৮১ পৃঃ)। মধ্যযুগে আরবেরা গণিত ও দর্শনের জ্ঞানভাণ্ডারে যাহা দান করিয়াছিল, এখানে তাহার উল্লেখ করিবার প্রয়োজন নাই। আরবেরা যে আবার গণিত ও চিকিৎসাবিদ্যার জন্য ভারতের নিকট ঋণী, সে কথাও এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন।[১]
আরবদের চরম উন্নতির সময়ে, তাহারা মধ্যযুগের ইউরোপে জ্ঞানের প্রদীপ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল এবং ল্যাটিন সাহিত্যের উপর অশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। জ্ঞানরাজ্যে এসিয়া ও ইউরোপের পরস্পর আদান প্রদানের উপর একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ই লেখা যাইতে পারে।
উইলিয়াম কেরী ও তাঁহার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য গোষ্ঠীর সময় হইতে (১৮০০-২৫) ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যাইবে যে, এই সময়ে যে সমস্ত গ্রন্থ লিখিত হইয়াছিল, তাহার অধিকাংশই উচ্চশ্রেণীর ইংরাজী সাহিত্যের অনুবাদ, কতকগুলি আবার সংস্কৃত, পারসী এবং উর্দু গ্রন্থের অনুবাদ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম বয়সের লেখা “বেতাল পঞ্চবিংশতি” হিন্দী গ্রন্থ এবং তাঁহার পরিণত বয়সের লেখা “শকুন্তলা” ও “সীতার বনবাস” কালিদাস ও ভবভূতির গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “কথামালা” “ঈসপস্ ফেবলস্”-এর আদর্শে রচিত। তাঁহার “জীবন চরিত” বহুলাংশে চেম্বার্সের “বাইওগ্রাফির” অনুবাদ।
সেক্সপীয়রের নাটকাবলীও বাংলাতে অনূদিত হইয়াছিল। প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক অক্ষরকুমার দত্তই প্রথমে জ্যোতিষ ও প্রাকৃত বিজ্ঞানের গ্রন্থ অনুবাদ করিয়া বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রাকৃতিক ভূগোল, ভূবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ক গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বিদ্যা কল্পদ্রুম”-এর নাম পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি। ইহা বাংলা ও ইংরাজী ভাষায় লিখিত সংগ্রহ-গ্রন্থ। মূল ইংরাজী গ্রন্থ হইতে উৎকৃষ্ট অংশসমূহ বাছিয়া বাংলা অনুবাদসহ ইহাতে প্রকাশ করা হইয়াছিল। এইরূপ হওয়াই উচিত। প্লটার্কের গ্রন্থ যদি নর্থ ইংরাজীতে অনুবাদ না করিতেন, তবে সেক্সপীয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’, ‘কোরিওলেনাস’, এবং ‘অ্যাণ্টনি ও ক্লিওপেট্রা’ নাটক লিখিত হইত না। দিনেমার লেখক গ্র্যামাটিকাসের গ্রন্থ যদি ইংরাজীতে অনূদিত না হইত, তবে জগৎ হয়ত “হ্যামলেট” নাটক হইতে বঞ্চিত হইত। আমাদের সাহিত্যের পূর্বাচার্যগণ পরবর্তী লেখকদের জন্য পথ প্রস্তুত করিয়া গিয়াছিলেন। প্রথম বয়সে বিদেশী ধাত্রীর স্তন্যপান করিয়া শিশু ক্রমে পরিপুষ্ট হইয়াছিল। শেষে তাহার পক্ষে আর বাহিরের খাদ্যের প্রয়োজন ছিল না। বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ ও অনুকরণের যুগের পর মৌলিক প্রতিভার যুগ আসিল। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ মৌলিক প্রতিভায় পূর্ণ; ইহা ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের বাঙালী সমাজের নিখুঁত চিত্র। ইহাতে প্রথম যুগের বাংলা গদ্যের ন্যায় সংস্কৃত সাহিত্যের আদর্শে শব্দালঙ্কারের আড়ম্বর নাই—প্যারীচাঁদ মিত্রের সরল সহজ শক্তিশালী চলিত ভাষা। শ্লেষ ও বিদ্রূপবাণ প্রয়োগেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনিও হিন্দু কলেজের ছাত্র এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতির সহাধ্যায়ী ছিলেন। প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সঘর্ষে বাংলার জ্ঞানরাজ্যে এক আশ্চর্য নব জাগরণের বিকাশ দেখা গিয়াছিল।
ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জাতিভেদ প্রথার উচ্ছেদ, সামাজিক বৈষম্য বিলোপ এবং নারীজাতির মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করিয়া তাহাদের কল্যাণসাধন। বিশাল হিন্দু সমাজ যদিও ব্রাহ্ম মত ও কার্যধারা সম্পূর্ণরূপে অনুমোদন করিত না, তবু তাহার হৃদয়ের যোগ ঐ আন্দোলনের সঙ্গে ছিল এবং হিন্দু সমাজ ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন দ্বারা প্রভাবাম্বিত হইয়াছিল তাহাতেও সন্দেহ নাই।
চারিদিকেই ভাববিপ্লব দেখা যাইতেছিল। একটা নূতন জগতের দ্বার খুলিয়া গিয়াছিল, নূতন আশা আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হইয়াছিল। বহুযুগের সুপ্তি ও আলস্য জাগ্রত হইয়া নব্য বাংলা অনুভব করিতে লাগিল, হিন্দু জাতির মধ্যে ভবিষ্যতের একটা বিপুল সম্ভাবনা আছে। এই সময়ের সাহিত্য দেশপ্রেমের মহৎভাবে পূর্ণ। লোকের মনের রুদ্ধভাব প্রকাশ এবং অধীন জাতির অভাব-অভিযোগ ব্যক্ত করিবার জন্য সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক সভা-সমিতিও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উৎসাহ ও আনুকূল্যে দেশের নানাস্থানে স্কুল ও কলেজসমূহ স্থাপিত হইতেছিল। তৎসত্ত্বেও বিজ্ঞান তাহার যোগ্য মর্যাদা পায় নাই। কতকগুলি সরকারী কলেজে উদ্ভিদ্ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা এবং পদার্থ বিদ্যা পড়ান হইত বটে, কিন্তু বিজ্ঞান তখনও তাহার যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বিজ্ঞানের অনুশীলন কেবল বিজ্ঞানের জন্যই করিতে হইবে, এবং তাহার জন্য সানন্দে আত্মোৎসর্গ করিতে পারে, এমন লোকের প্রয়োজন। কেবল তাহাই নহে, জাতীয় সাহিত্যে বিজ্ঞান তাহার যোগ্য স্থান লাভ করিবে, এবং তাহার আবিষ্কৃত সত্যসমূহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কাজে লাগিবে। বিজ্ঞান জাতীয় সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির সহায়স্বরূপ হইবে। মানুষ ও পশু উভয়েই যে সব ব্যাধির আক্রমণে কাতর, বিজ্ঞান তাহা দূর করিবার ব্রত গ্রহণ করিবে। প্রত্যেক উন্নতিশীল জাতির জীবনের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ঠ এবং তাহার কর্মক্ষেত্র ক্রমেই প্রসার লাভ করিতেছে। এককথায় বিজ্ঞানকে মানুষের সেবায় নিযুক্ত করা হইয়াছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, হিন্দু মস্তিষ্কক্ষেত্র বহুকাল অকর্মণ্য অবস্থায় থাকিয়া নানা আগাছা কুগাছায় পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি পরীক্ষায় বিজ্ঞান পাঠ্যরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছিল বটে, কিন্তু, হিন্দু যুবক গতানুগতিক ভাবে বিজ্ঞান শিখিত, ইহার প্রতি তাহাদের প্রকৃত অনুরাগ ছিল না। তাহার উদ্দেশ্য কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ছাপ’ নেওয়া, যাহাতে ওকালতী, কেরাণীগিরি, সরকারী চাকুরী প্রভৃতি পাইবার সুবিধা হইতে পারে। ইউরোপে গত চার শতাব্দী ধরিয়া বিজ্ঞানের এমন সব সেবক জন্মিয়াছেন, যাঁহারা কোনরূপ আর্থিক লাভের আশা না করিয়া বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞান চর্চা করিয়াছেন। এমন কি সময়ে সময়ে তাঁহারা বিজ্ঞানের জন্য ‘ইনকুইজিশান’ বা প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ‘ধর্মের অত্যাচার’ সহ্য করিয়াছেন। প্রকৃতির রহস্য আবিষ্কার করিবার অপরাধে রোজার বেকন (১২১৪—১২৮৪) কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন। কোপারনিকস তাঁহার অমর গ্রন্থ চল্লিশ বৎসর প্রকাশ করেন নাই, পাছে পাদরীরা উহা আগুনে পোড়াইয়া ফেলে এবং তাঁহাকেও অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে। প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক কেপ্লার একবার সক্ষোভে লিখিয়াছিলেন,—“আমি আমার গ্রন্থের পাঠকলাভের জন্য একশত বৎসর অপেক্ষা করিতে পারি, কেন না স্বয়ং ভগবান আমার মত একজন সত্যানুসন্ধিৎসার জন্য ছয় হাজার বৎসর অপেক্ষা করিয়াছেন।” ইংলণ্ডের জ্ঞানরাজ্যে নবজাগরণের পর, এলিজাবেথীয় যুগে বহু প্রতিভাশালী কবি এবং গদ্য সাহিত্যের স্রষ্টাই কেবল জন্মগ্রহণ করেন নাই, আধুনিক বিজ্ঞানের বিখ্যাত প্রবর্তকও অনেকে ঐ সময়ে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। গিলবার্ট ডাক্তারী করিয়া জীবিকার্জন করিতেন, এবং অবসর সময়ে বিদ্যুৎে সম্বন্ধে গবেষণা করিতেন। হার্ভে রক্তসঞ্চালনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। ফ্র্যান্সিস বেকনের কৃতিত্ব অতিরঞ্জিত হইলেও, তাঁহাকে নূতন বৈজ্ঞানিক প্রণালীর প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
প্যারাসেলসাস (১৪৯৩-১৫৪১) ধাতুঘটিত ঔষধের ব্যবস্থা দিয়া রসায়ন বিজ্ঞানের চর্চায় উৎসাহ দিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। তাঁহার সময় হইতে রসায়ন বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি হইতে থাকে এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের অধীনতা পাশ হইতে মুক্ত হইয়া ইহা একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান রূপে গণ্য হয়। এগ্রিকোলার (১৪৯৪—১৫৫৫) ধাতুবিদ্যা এবং খনিবিদ্যা সম্বন্ধীয় গ্রন্থ De Re Metallica দ্বারা ব্যবহারিক রসায়নশাস্ত্রের যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছে।
কিন্তু ভারতের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নপ্রকার। হিন্দু জাতি প্রায় সহস্রাধিক বৎসর জীবন্মৃত অবস্থায় ছিল। ধর্মের সজীবতা নষ্ট হইয়াছিল এবং লোকে কতকগুলি বাহ্য আচার অনুষ্ঠান লইয়াই সন্তুষ্ট ছিল। দুই হাজার বৎসর পূর্বে ঐ সকলের হয়ত কিছু উপযোগিতা ছিল, কিন্তু এ যুগে আর নাই। হিন্দুর মস্তিষ্ক সুপ্ত ও জড়বৎ হইয়া ছিল। আমাদের পূর্বপুরষদের মৌলিক চিন্তাশক্তি নষ্ট হইয়া গিয়াছিল এবং তাঁহারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধভাবে নবদ্বীপের রঘুনন্দন কর্তৃক ব্যাখ্যাত শাস্ত্রের অনুসরণ করিতেছিলেন। জাতিভেদ প্রথা হিন্দু সমাজে শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছিল। এই সমস্ত কারণে আমাদের জাতির মনোভাবের পরিবর্তন হইয়া বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা জাগ্রত হইতে বহু সময় লাগিয়াছিল।
গত শতাব্দীর সত্তরের কোঠায় ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার মহাশয় দেশপ্রেমিক ধনী ব্যক্তিদের নিকট হইতে অর্থসংগ্রহ করেন এবং “ভারত বিজ্ঞান অনুশীলন সমিতি” (Indian Association for the Cultivation of Science) প্রতিষ্ঠিত করেন। সন্ধ্যাকালে ঐ সমিতির গৃহে রসায়ন বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান এবং পরে উদ্ভিদ বিদ্যা সম্বন্ধে বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়। প্রথমে এই সমিতিকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করিবার অভিপ্রায় ছিল না। যে কেহ কিছু দক্ষিণা দিলে সমিতিগৃহে যাইয়া পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞান সম্বন্ধে বক্তৃতা নিতে পারিত। সমিতির প্রথম অবৈতনিক বক্তাদের মধ্যে ডাঃ মহেন্দ্ররাল সরকার, ফাদার লার্ফো এবং তারাপ্রসন্ন রায় ছিলেন। ১৮৮০-৮১ সালে আমি প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞানের ক্লাসে ভর্তি হইলেও, অধিকতর জ্ঞানলাভের জন্য ঐ দুই বিষয়ে সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশানের বক্তৃতা শুনিবার জন্য যোগদান করিয়াছিলাম। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, ডাঃ সরকারের চেষ্টা তেমন সফল হয় নাই। সম্ভবতঃ ঐরূপ চেষ্টা করিবার সময় তখনও আসে নাই, দেশে বিজ্ঞান অনুশীলন করিবার স্পৃহাও জাগ্রত হয় নাই। সেই সময়ে বেসরকারী কলেজ অর্থাভাবে বিজ্ঞানবিভাগ খুলিতে পারিত না, তাহারা কেবলমাত্র ‘আর্টস্’ বা সাহিত্যশিক্ষার কলেজ মাত্র ছিল। যে সমস্ত ছাত্র ইণ্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উদ্ভিদবিদ্যা, রসায়ন বা পদার্থবিজ্ঞান লইতে চাহিত, তাহারাই সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশানে বক্তৃতা নিতে যাইত। গত ২৫ বৎসরের মধ্যে বেসরকারী কলেজসমূহ নিজেদের বিজ্ঞানবিভাগ খুলিয়াছে এবং তাহার ফলে সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশানের ক্লাস ছাত্রশূন্য হইয়াছে বলিলেই হয়।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ অথবা সাধারণ কলেজসমূহে ছাত্রেরা বৈজ্ঞানিক বিষয় অধ্যয়ন করিত, যেহেতু উহা তাহাদের পাঠ্য তালিকাভুক্ত এবং পরীক্ষায় পাশ করিয়া উপাধিলাভের জন্য অপরিহার্য ছিল। ইহাতে বুঝা যায় যে, বিজ্ঞানচর্চার জন্য প্রকৃত স্পৃহা ছিল না—অথবা সোজা কথায় জ্ঞানলাভের আগ্রহ ছিল না। পক্ষান্তরে ইংলণ্ডে, আর্ল অব কর্কের পুত্র দি অনারেবল রবার্ট বয়েল সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তাঁহার নিজের গবেষণাগারে কেবল যে পদার্থবিজ্ঞান সম্বন্ধেই নানা যুগান্তকারী আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাহা নহে, পরন্তু তাঁহার Sceptical Chymist গ্রন্থে নব্য রসায়ন শাস্ত্র কিভাবে উন্নতি লাভ করিবে, তাহারও পথ প্রদর্শন করিয়াছিলেন।
এক শতাব্দী পরে, ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ডেভনশায়ার বংশের জনৈক কৃতী সন্তান, ১ মিলিয়ান স্টার্লিং (বর্তমান মদ্রা মূল্যে অন্ততঃপক্ষে ৬। ৭ কোটি) ব্যাঙ্কে জমা থাকা সত্ত্বেও, তাঁহার নিজের সুসজ্জিত লেবরেটরিতে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন শাস্ত্রের গবেষণায় তন্ময় হইয়া গিয়াছিলেন এবং জগতকে তাঁহার জ্ঞানের অপূর্ব অবদান উপহার দিয়া অমর কীর্তি অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার কোন কোন সমসাময়িক—যথা প্রিস্টলে এবং শীল দারিদ্র্যের মধ্যে কোনরূপে জীবিকা নির্বাহ করিয়া, এমন সমস্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কার করিয়াছিলেন, যাহার ফল বহুদূরপ্রসারী। তাঁহাদের কোন মূল্যবান যন্ত্রপাতি ছিল না, ভাঙ্গা কাচের নল, মাটীর তৈরী তামাকের পাইপ, বিয়ারের খালি পিপা—এই সবই তাঁহাদের যন্ত্র ছিল, কিন্তু সেই সময়ে বাংলাদেশে চারিদিক নিবিড় অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল।
বাংলার সমাজ কি ঘোর অবনতির গর্ভে ডুবিয়া গিয়াছিল জনৈক চিন্তাশীল লেখক তাহার বিশদ বর্ণনা করিয়াছেন। রামমোহন রায়ের আবির্ভাবের সময়ে বাংলার সমাজের অবস্থা কিরূপ ছিল, রামমোহনের জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনা হইতে তাহা বুঝা যায়। হিন্দু সমাজ সে সময়ে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।[২] দেশের সর্বত্র কুসংস্কারের রাজত্ব চলিতেছিল। নৈতিক ব্যভিচার করিয়াও কাহারও কোন শাস্তিভোগ করিতে হইত না, পরন্তু তাহারা সমাজে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিত। এইরূপে পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে রামমোহনের মত একজন প্রখর প্রতিভাশালী, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং অশেষ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লোকের আবির্ভাব হইতে পারে, তাহা বাস্তবিকই দুর্জ্ঞেয় রহস্যময়। যে হিন্দু মনোবৃত্তি দুই হাজার বৎসর ধরিয়া কেবল দার্শনিকতার স্বপ্ন দেখিতেছিল, তাহার গতি ফিরাইয়া দেওয়া বড় সহজ কাজ নহে এবং ঐ কার্য একদিনে হইবার নহে। কেবল মাত্র ব্রাহ্মণদের মধ্যেই প্রায় দুই হাজার শাখা উপশাখা আছে, তাহারা কেহ কাহারও সঙ্গে খায় না, পরস্পরের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিবাহও দেয় না। বাংলার ব্রাহ্মণেতর জাতি সমূহের মধ্যে নানা সামাজিক উচ্চনীচ স্তরভেদ আছে; উহাদের মধ্যে কেহ জল-আচরণীয় অথবা উচ্চবর্ণদের জল যোগাইবার অধিকারে অধিকারী। হিন্দুর মনে পাশ্চাত্য ভাবের বীজ বপন করিয়া অন্ততপক্ষে দুই পরুষ অপেক্ষা করিতে হইয়াছিল এবং তাহার পরে মৌলিক বিজ্ঞান চর্চার যুগে আসিয়াছিল। ক্ষেত্র বহুদিন পতিত থাকিয়া উচ্চচিন্তার জন্ম দিবার অযোগ্য হইয়া উঠিয়াছিল এবং সেই জন্য প্রথমে নূতন ফসলের আবাদ করিবার পূর্বে তাহাতে ভাল করিয়া ‘সার’ দিতে হইয়াছিল। আমি এতক্ষণ প্রকৃত বিষয় হইতে দূরে চলিয়া গিয়া, অবান্তর কথার অবতারণা করিয়াছিলাম। যাহাতে বাংলায় নব যাগের আবির্ভাব পাঠকগণ ভাল করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন, তাহার জন্যই আমি এই সমস্ত কথা বলিতেছিলাম।