আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয়বার ইউরোপ যাত্রা—বঙ্গভঙ্গ—বিজ্ঞান চর্চ্চায় উৎসাহ

 আমি এখন ইউরোপ ভ্রমণে যাত্রা করিব স্থির করিলাম। আমার উদ্দেশ্য, সেখানে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত কয়েকটি গবেষণাগার দেখিব এবং আধুনিক গবেষণা প্রণালীর সংস্পর্শে আসিয়া নূতন অনুপ্রেরণা লাভ করিব। প্রভাবশালী মনীষী ও আচার্যদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে না মিশিলে এরূপ অনুপ্রেরণা লাভ করা অসম্ভব। একটা সরকারী সার্কুলার ছিল যে, বৈজ্ঞানিক বিভাগের কোন ইউরোপীয় কর্মচারী ছুটী লইয়া বিলাত গেলে, এই সর্তে তাঁহাকে রাহাখরচ ভাতা ইত্যাদি সম্বন্ধে কতকগুলি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হইবে যে, তিনি ছুটীর কিয়দংশ গবেষণা কার্যে নিয়োগ করিবেন। আমার সহকর্মী জে, সি, বসু, (আচার্য জগদীশচন্দ্র) ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের লোক ছিলেন বলিয়া, কিন্তু প্রধানত “হার্জিয়ান ওয়েভ্‌স্” (বিদ্যুৎ সম্বন্ধীয়) এর গবেষণা ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন বলিয়া, এই সুবিধা পাইয়াছিলেন। কিন্তু আমার পক্ষে এই নিয়মের সুযোগ লাভে কিছু বাধা ছিল, কেন না আমি ‘প্রভিন্‌সিয়াল সার্ভিসের’ লোক ছিলাম। তথাপি আমি শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরের (পেড্‌লার) নিকট আমার ইউরোপীয় গবেষণাগার সমূহ দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া পত্র লিখি। কয়েকমাস চলিয়া গেল, কোনই উত্তর পাইলাম না। একদিন কার্জন, কিচনার প্রভৃতির স্বাক্ষরযুক্ত সপরিষৎ গবর্ণর জেনারেলের একটি মন্তব্যলিপি পাইয়া আমি সত্যই বিস্মিত হইলাম। মন্তব্যলিপির সারমর্ম এই যে, কোন ভারতবাসী যদি মৌলিক গবেষণা, কার্যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করে, তবে কেবলমাত্র প্রভিন্‌সিয়াল সার্ভিসের লোক বলিয়াই তাহার পক্ষে Study Leave বা অধ্যয়ন গবেষণা প্রভৃতির জন্য সবিধাজনক সর্তে ছুটী পাওয়ার বাধা হইবে না। আমি এখন ইউরোপ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইলাম। কিন্তু যাত্রার পূর্বে আমি পেড্‌লারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া আমার ইউরোপ যাত্রায় তিনি যে সহায়তা করিয়াছেন, তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলাম। কথাবার্তা প্রসঙ্গে তিনি তাঁহার দেরাজ হইতে, আমার জন্য তিনি যে ‘নোট’ বা মন্তব্য প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তাহা বাহির করিলেন। ঐ মন্তব্য পড়িতে পড়িতে আমি একটু বিব্রত বোধ করিলাম। কেন না পেড্‌লার উহাতে আমার খুব উচ্চ প্রশংসা করিয়াছিলেন। আমার রাসায়নিক গবেষণা এবং হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাসের কথাও উল্লেখ করিয়াছিলেন।

 ১৯০৪ সালে আগষ্ট মাসের মধ্যভাগে আমি কলিকাতা হইতে লণ্ডন যাত্রা করিলাম—প্রথম বিলাত যাত্রার ঠিক বাইশ বৎসর পরে। আমার সঙ্গে কয়েকজন ইংরাজ সহযাত্রী ছিলেন। তাঁহারা কলম্বোতে নামিলেন। তখন মনসুনের পূর্ণাবস্থা। আরব সমুদ্রে ১১।১২ দিন ধরিয়া আমাকে বড়ই বেগ পাইতে হইল। ঐ সময়ের কথা আমার বেশ মনে আছে। অসুস্থ হইয়া পড়াতে বাধ্য হইয়া অধিকাংশ সময়ই উপরের সেলুনে আমাকে শুইয়া থাকিতে হইত। এই অবস্থায় জাহাজের স্টুয়ার্ড আমাকে খাওয়াইত। তখন জাহাজে আমিই একমাত্র যাত্রী ছিলাম, সতেরাং সমগ্র সেলুনটা আমার দখলে ছিল। পোর্ট সৈয়দ এবং মাল্টাতে কয়েকজন যাত্রী উঠিলেন। তার মধ্যে একজন খুব রসিক লোক ছিলেন। ফুটবল খেলার প্রসঙ্গে তিনি বলিয়াছিলেন, উহাতে দুই পক্ষের বাইশজন খেলোয়াড়েরই কোন শারীরিক ব্যায়ামের সুযোগ হয়। কিন্তু যে হাজার হাজার লোক খেলা দেখে তাহাদের কি?[]

 এই জাহাজযাত্রা আমার পক্ষে বড় ক্লান্তিজনক হইল। আমি উদরাময়ে ভুগিতে লাগিলাম, তৎপূর্বে প্রায় পনর দিন যাবৎ আমি ঐ রোগে আক্রান্ত হইবার আশঙ্কা করিতেছিলাম। আমার পাকস্থলী বড়ই দুর্বল এবং তাজা খাদ্যদ্রব্য না পাইলে উহা বিগড়াইয়া যায়। সাধারণতঃ, মাংস, মাছ এবং শাকসব্জী “কোল্ড ষ্টোরেজে” রাখা হইয়া থাকে বটে, কিন্তু তাহাদের গুণের কিছু হ্রাস হয় এবং বলিতে গেলে ‘বাসি’ হইয়া যায়। ঐ সব খাদ্য খাইলে আমার পরিপাক শক্তির বিকৃতি ঘটে। আমি অত্যন্ত অসুবিধা বোধ করিতে লাগিলাম, এ আশঙ্কাও হইল যে লণ্ডনে গিয়া আমার অবস্থা আরও খারাপ হইবে। কিন্তু লণ্ডনে পৌঁছিয়া ২৪ ঘণ্টা হোটেলে থাকিবার পরই আমি পেটের অসুখের কথা একেবারে ভুলিয়া গেলাম। তারপরেও কয়েকবার আমি ইংলণ্ডে গিয়াছি, কিন্তু প্রতিবারেই সমুদ্রবক্ষে জাহাজে আমার ঐরূপ শোচনীয় অবস্থা হইয়াছে। ফলে আমাকে বাধ্য হইয়া বোম্বাই হইতে মার্সেলিস পর্যন্ত ডাকজাহাজে ভ্রমণ করিতে হইয়াছে, উদ্দেশ্য জাহাজে যতদূর সম্ভব কম সময় থাকা।

 লণ্ডনে কয়েকদিন থাকিবার পর আমার মনে অস্বস্তি বোধ হইতে লাগিল। সহরের নানারূপ দৃশ্য দেখিয়া বেড়াইবার জন্য আমার মনে কোন আকর্ষণ ছিল না। বস্তুত ছাত্রজীবনের আমি এই বিশাল লণ্ডন সহরে কয়েকমাস মাত্র কাটাইয়াছি। দৈনিক কয়েকঘণ্টা করিয়া লেবরেটরিতে কাজ করিতে যাহারা অভ্যস্ত, হাতে কাজ না থাকিলে সময় কাটানো তাহাদের পক্ষে কঠিন হইয়া পড়ে। সুতরাং আমি কোন লেবরেটরিতে গবেষণা করিবার সুযোগ খুঁজিতে লাগিলাম। জগদীশচন্দ্র বসু পূর্বে ডেভি-ফ্যারাডে রিসার্চ্চ লেবরেটরিতে কাজ করিয়াছিলেন। অধ্যাপক ক্রাম ব্রাউন এবং সার জেমস্ ডেওয়ারের সাহায্যে আমিও সহজে ঐ লেবরেটরিতে কাজ করিবার সুযোগ লাভ করিলাম। আমি এখন কাজে মগ্ন হইয়া পড়িলাম। মাঝে মাঝে ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স এবং ইউনিভার্সিটি কলেজের লেবরেটরিগুলি দেখিয়া আসিতাম। ডেওয়ার কয়েক বৎসর ধরিয়া তাঁহার যুগান্তকারী গ্যাস সম্বন্ধীয় গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন। ঐ সময় তিনি, আর্গন, নিওন এবং জেননকে কিরূপে বায়ু হইতে পৃথক করা যায়, তৎসম্বন্ধে পরীক্ষা করিতে ছিলেন। আমি তাঁহার এই সমস্ত পরীক্ষাকার্য দেখিবার সুযোগ লাভ করিলাম।

 ইউনিভার্সিটি কলেজ লেবরেটরিতে স্যর উইলিয়াম র‍্যামজে বায়ুর উল্লিখিত উপাদানসকল পৃথকীকরণের জন্য তাঁহার ও ডাঃ ট্রাভার্স কর্তৃক পরিকল্পিত যন্ত্রের কার্য আমাকে দেখাইলেন। এইরূপে আমি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ রাসায়নিকগণের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিবার সুযোগ পাইলাম। ১৯০৪ সালে বড়দিনের ছুটীর সময় এডিনবার্গে কাটাইলাম এবং তথায় কয়েকজন পুরাতন বন্ধুর সাক্ষাৎ পাইলাম। ভারতীয় ছাত্রেরা কালেডোনিয়ান হোটেলে একটি সভা করিয়া আমাকে সম্বর্ধনা করিলেন। অধ্যাপক ক্রাম ব্রাউন ঐ সভার সভাপতির আসন গ্রহণ করেন।[] রয়েল সোসাইটি অব এডিনবার্গ আমাকে একটি ভোজসভায় আমন্ত্রণ করিলেন। স্যার জেমস ডেওয়ার সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন। অধ্যাপক ক্রাম ব্রাউন স্যর জেমসের স্বাস্থ্যকামনা করিবার সময় আমার নামও সেই সঙ্গে জুড়িয়া দিলেন। স্যর জেমসের পরে উত্তর দিতে উঠিয়া আমি কিঞ্চিৎ বিব্রত হইয়া পড়িলাম, যাহা হউক, কোনরূপে যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর দিলাম।

 এডিনবার্গ হইতে আমার বন্ধু ও সহপাঠী জেমস ওয়াকারের লেবরেটরি দেখিবার জন্য আমি ডাণ্ডীতে গেলাম। তারপর দক্ষিণে লণ্ডন অভিমুখে যাত্রা করিলাম। পথে লিড্‌স, ম্যানচেষ্টার এবং বার্মিংহামের লেবরেটরি সমূহ দেখিলাম এবং অধ্যাপক স্মিথেল্‌স্, কোহেন, ডিক্সন, পার্কিন, ফ্র্যাঙ্কল্যাণ্ড এবং অন্যান্য রাসায়নিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহারা সকলেই সানন্দে আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন। লণ্ডনে ফিরিয়া আসিয়া আমি প্রায় একমাস কাল গবেষণার কাজ করিলাম, তারপর ইউরোপে যাত্রা করিলাম। র‍্যামজে অনুগ্রহপূর্বক ইউরোপের বিশিষ্ট রাসায়নিকদের নিকট পরিচয়পত্র দিয়াছিলেন। আমি বার্লিনের নিকট চালোটেনবার্গে এক সপ্তাহ থাকিলাম এবং বিখ্যাত ‘টেক্‌নিসে হক্‌সিউল’ ও ‘রাইক্‌সনষ্টল্ট’ দেখিলাম। এর্ডম্যান ‘হক্‌সিউলে’ অজৈব রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি আমাকে সাদরে অভ্যর্থনা করিলেন এবং সমস্ত দেখাইলেন। ভ্যাণ্ট হফ্, এবং তাঁহার লেবরেটরিও দেখিলাম। এই বিখ্যাত ডচ রাসায়নিক তখন ‘সাল্‌জবিলডাং’ (salzbildung) সম্বন্ধে গবেষণা করিতেছিলেন। ষ্টাস্‌ফার্টে সামুদ্রিক লবণ হইতে যে অবস্থায় পটাসিয়ম ও সোডিয়াম লবণের বিপুল স্তর সৃষ্টি হইয়াছে, তাহারই নাম “সাল্‌জবিল্‌ডাং”। মেয়ার হোফারও ভ্যাণ্ট হফের সহযোগীরূপে কাজ করিতেছিলেন। ভ্যাণ্ট হফ ইংরাজী ভাল বলিতে পারিতেন, সতরাং আমি তাঁহার সঙ্গে ইংরাজীতেই কথাবার্তা বলিতাম।[] রূঢ় ও অপ্রিয় প্রশ্ন হইতে পারে জানিয়াও, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, নিজ দেশ ত্যাগ করিয়া বিদেশে থাকিয়া গবেষণাকার্য করায় একজন দিনেমারের স্বদেশপ্রেমে আঘাত লাগে কি না?[] তিনি উত্তর দিলেন যে, জার্মান সম্রাট তাঁহার কাজের জন্য সর্বপ্রকার সুবিধা করিয়া দিয়াছেন, তাঁহার জন্য একটি স্বতন্ত্র লেবরেটরি দেওয়া হইয়াছে এবং তাঁহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র একঘণ্টা বক্তৃতা করিতে হয়, অবশিষ্ট সময় তিনি গবেষণাকার্যে ব্যয় করিতে পারেন। ভ্যাণ্ট হফ আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার স্বদেশবাসী অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়কে[] আমি চিনি কি না? নামের প্রত্যেক অক্ষর তিনি সুস্পষ্টরূপে উচ্চারণ করিলেন। ইহাতে আশ্চর্যের বিষয় কিছুই নাই। অঘোরনাথ ১৮৭৫ খৃস্টাব্দে “ডক্টর” ডিগ্রী লাভ করেন। তৎপূর্ব বৎসর ভ্যাণ্ট হফ এবং লে বেল প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে অথচ একই সময়ে Asymmetric carbon এর মতবাদ ব্যাখ্যা করেন। আমার মনে হয়, অঘোরনাথ এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের “ভ্যান্‌স ডানলপ” বৃত্তি লাভ করেন, এবং ইউরোপে রসায়ন বিজ্ঞান অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করিবার জন্য গমন করেন। তিনি অতীব মেধাবী ছিলেন এবং তাঁহার মনে বড় বড় কাজের কল্পনা ছিল। খুব সম্ভব অঘোরনাথ ভ্যাণ্ট হফের (তৎকালে ২৩ বৎসর বয়স্ক যুবক) সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁহার সঙ্গে নূতন থিওরির ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্বন্ধে আলোচনা করেন। বড়ই দুঃখের বিষয়, অঘোরনাথের মহৎ প্রতিভার দান হইতে ভারতবর্ষ, বলিতে গেলে বঞ্চিত হইয়াছে। অন্ততপক্ষে রসায়ন বিজ্ঞান সম্বন্ধে তিনি চেষ্টা করিলে অনেককিছু করিতে পারিতেন।

 অঘোরনাথ দেশে ফিরিয়া হায়দ্রাবাদ রাজ্যের শিক্ষাবিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি রাজনৈতিক দলাদলিতে লিপ্ত হন। ঐ সময়ে হায়দ্রাবাদ রাজ্যে সংগৃহীত মূলধন দ্বারা চান্দোয়া রেলওয়ে নির্মাণ করিবার জন্য আন্দোলন আরম্ভ হয় এবং অঘোরনাথ এই জাতীয় আন্দোলনের নেতা হন। তদানীন্তন পলিটিক্যাল এজেণ্টের নিকট ইহা ভাল লাগে নাই। উক্ত এজেণ্ট মহাশয় বোধ হয় মনে করিতেন যে, কেবল ব্রিটিশ ভারত নহে, দেশীয় রাজ্যও ব্রিটিশ শোষণনীতির কর্মক্ষেত্র হওয়া উচিত। সুতরাং ক্রুদ্ধ রেসিডেণ্ট বাঙালী যুবক অঘোরনাথকে হায়দ্রাবাদ হইতে বহিষ্কৃত করিলেন এবং তাঁহাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজামের রাজ্য ত্যাগ করিতে আদেশ দিলেন। আমার স্মরণ হয়, বাল্যকালে আমি ‘হিন্দু পেট্রিয়টে’ সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালের লেখা একটি প্রবন্ধ পড়িয়াছিলাম। তাহাতে স্কুলমাষ্টার অঘোরনাথকে রাজনীতির সংস্পর্শ ত্যাগ করিবার জন্য উপদেশ দেওয়া হইয়াছিল।

 আমি এমিল ফিসার এবং তাঁহার লেবরেটরিও দেখিলাম। তিনি এই সময়ে তাঁহার “Purine group” সম্বন্ধে গবেষণা শেষ করিয়াছেন মাত্র। প্রোটিন হইতে উৎপন্ন— ‘আমিনো-অ্যাসিডস্’ সম্বন্ধে গবেষণা করিতেছেন।

 বার্লিন হইতে আমি বার্ণ, জেনেভা এবং জুরিচে গেলাম, শেষোক্ত স্থানে আমি খুব যত্ন সহকারে ‘পলিটেকনিক’ বিদ্যালয় দেখিলাম। অধ্যাপক রিচার্ড লোরেঞ্জ একটি বৈদ্যুতিক বিভাগের কর্তা ছিলেন। আমি তাঁহার সঙ্গে পূর্বেই কয়েকবার পত্র ব্যবহার করিয়াছিলাম। কেননা তিনি জার্মান জার্নাল অব ইনরগ্যানিক কেমিষ্ট্রীর সম্পাদক ছিলেন এবং আমার কয়েকটি প্রবন্ধ ঐ জার্নালে প্রকাশিত হইয়াছিল। তৎপরে আমি ‘ফ্র্যাঙ্কফার্ট-অন-মেইন’ হইয়া পারি অভিমুখে যাত্রা করিলাম। ফ্র্যাঙ্কফার্টে গাইড আমাকে মহাকবি গ্যেটের স্মৃতিজড়িত একটি গৃহ দেখাইয়াছিলেন।

 ফ্রান্সের রাজধানী পারিকে আমি তীর্থক্ষেত্র রূপে গণ্য করিতাম। নব্য রসায়ন শাস্ত্রের উৎপত্তির ইতিহাস এই নগরীর সঙ্গে জড়িত। এই খানেই ল্যাভোসিয়ারের গবেষণার ফলে এমন সমস্ত সত্য আবিষ্কৃত হইয়াছিল, যাহাতে পুরাতন “ফ্লোজিস্টন মতবাদ” নিরাকৃত হয় এবং এই স্থানেই একে একে বহু কৃতী রাসায়নিক তাঁহার পতাকাতলে সমবেত হন এবং তাঁহার মতবাদ গ্রহণ করেন। আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতার (ল্যাভোসিয়ার) নামের সঙ্গে বার্থেলো, ফোরক্রয়, গ্যয়টন ডি মর্ভোর নাম চিরদিনই উল্লিখিত হইবে।[] পারি নগরী গেলুসাক, থেনার্ড, ক্যাভেণ্টো এবং পেলেটিয়ার (কুইনীনের আবিষ্কর্তাগণ) এবং আরও অনেক বৈজ্ঞানিকের কর্মক্ষেত্র। ইঁহারা সকলেই রসায়ন বিজ্ঞানের প্রথম যুগে জ্ঞানরূপে আলোক বর্তিকা হস্তে অগ্রসর হইয়াছিলেন। বস্তুত, গত শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত পারি সম্বন্ধে আডল্‌ফ্ ওয়ার্জের গর্বোক্তি সত্য বলিয়া গণ্য হইতে পারিত।[]

 পারিতে পৌছিয়া প্রথমেই আমি মাসিয়ে সিলভ্যাঁ লেভির সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম। আমার ‘হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাসে’ সিলভ্যাঁ লেভিকে আমি বৌদ্ধ সাহিত্য সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ এবং প্রামাণিক ব্যক্তি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলাম। কলিকাতা হইতে তাঁহার সঙ্গে আমি পত্র ব্যবহারও করিয়াছিলাম। তাঁহার কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম যে তিনি পতঞ্জলির “মহাভাষ্য” (সম্ভবতঃ গোল্ডষ্টুকারের সংস্করণ) অধ্যয়নে নিমগ্ন আছেন। স্থির হইল যে পরদিন সকালে আমি “কলেজ ডি ফ্রান্সে” তাঁহার সঙ্গে দেখা করিব এবং তিনি তাঁহার সহাধ্যাপক মঁসিয়ে বার্থেলোর সঙ্গে আমার পরিচয় করাইয়া দিবেন। আমি নির্দিষ্ট সময়ে ‘কলেজ ডি ফ্রান্সে’ উপস্থিত হইলাম এবং ঘটনাক্রমে কয়েক মিনিট পরেই বার্থেলো প্রাঙ্গণের বিপরীত দিক দিয়া তাঁহার গবেষণাগারে প্রবেশ করিলেন। অধ্যাপক লেভি উক্ত বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিলেন, আমার সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ বহিয়া গেল। মনে হইল আমি অবশেষে সেই বিখ্যাত মনীষী এবং বিজ্ঞানাচার্যের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছি যিনি সমস্ত জীবন পাশ্চাত্য রসায়ন বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ইতিহাসের রহস্য ভেদ করিতে ব্যয় করিয়াছেন এবং যিনি “সিনথেটিক রসায়ন শাস্ত্রের”—অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া গণ্য।

 বার্থেলো আমাকে তাঁহার লেবরেটরিতে লইয়া গেলেন এবং তাঁহার আবিষ্কৃত কাচাধারে রক্ষিত যন্ত্রাদি সযত্নে দেখাইলেন। অর্ধ্ব শতাব্দী পূর্বে ‘সিনথেটিক কমপাউণ্ড’ সমূহে বিশ্লেষণের জন্য তিনি এই সমস্ত যন্ত্র ব্যবহার করিয়াছিলেন। তাঁহার আমন্ত্রণে তাঁহার বাড়ীতে আমি গেলাম। ‘একাডেমি অব সায়েন্সের’ তিনি স্থায়ী সেক্রেটারী ছিলেন এবং সেই হিসাবে ইনষ্টিটিউটেরই একাংশে তাঁহার বাসস্থান নির্দিষ্ট ছিল। বার্থেলো পূর্ব হইতেই তাঁহার এক পুত্রকে সাক্ষাতের সময় উপস্থিত থাকিবার জন্য আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। পুত্র কিছুদিন বিলাতে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। সুতরাং ইংরাজীতে বেশ কথাবার্তা বলিতে পারিতেন। সুতরাং তাঁহার সাহায্যে বার্থেলোর সঙ্গে আমি প্রায় এক ঘণ্টাকাল কথাবার্তা বলিলাম। বার্থেলো আমাকে একাডেমীর অধিবেশনে উপস্থিত থাকিবার জন্যও নিমন্ত্রণ করিলেন। ৭১ বৎসর বয়স্ক প্রেসিডেণ্ট প্রসিদ্ধ রাসায়নিক মঁসিয়ে ট্রুষ্টের সঙ্গেও তিনি আমার পরিচয় করাইয়া দিলেন। ‘লা নেচার’ পত্রে ঐ অধিবেশনের যে বিবরণ বাহির হইয়াছিল তাহাতে আমার সম্বন্ধে উল্লেখ ছিল। পারিতে থাকিবার সময় আমি মাসিয়ে সিলভ্যাঁ লেভির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম। তিনি আমাকে একটি সান্ধ্য বৈঠকে নিমন্ত্রণ করেন, এবং আমার হোটেলে আসিয়া আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই স্থানে মঁসিয়ে পামির কর্ডিয়ারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। ইনি ফরাসী চন্দননগরে কয়েক বৎসর কাজ করেন এবং তিব্বতীয় ভাষা শিক্ষা করেন। বৌদ্ধ সাহিত্যের উপর ভিত্তি করিয়া তিনি ভারতীয় চিকিৎসা বিদ্যা সম্বন্ধে কয়েকখানি গ্রন্থ লিখেন। আমার যতদূর মনে পড়ে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সহযোগে তাঁহার সঙ্গে কলিকাতায় আমার পরিচয় হয়।

 আমি বৈজ্ঞানিক ময়সানের লেবরেটরিও দর্শন করি। সাধারণের নিকট তিনি কারবাইড অব ক্যালসিয়াম এবং কৃত্রিম হীরকের আবিষ্কর্তারূপেই অধিকতর পরিচিত। উক্ত প্রসিদ্ধ রসায়নবিৎ অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কৃত্রিম হীরকের কণাসমূহ আমাকে দেখাইয়াছিলেন। আমি দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিলাম যে, ময়সান তাঁহার অজৈব রসায়ন সম্বন্ধীয় বৃহৎ সংগ্রহ গ্রন্থে (এনসাইক্লোপিডিয়া) মৎকৃত মার্কিউরাস নাইট্রাইট বিষয়ক গবেষণার বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন।

 বার্থেলো এবং তাঁহার বহুমুখী প্রতিভার কিঞ্চিৎ পরিচয় না দিলে আমার পারি দর্শনের বিবরণ অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে। অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল তিনি রসায়ন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রধান কর্মী ছিলেন এবং তাঁহার লিখিত গ্রন্থ সমূহের নামের তালিকা প্রকাশ করিতেই ফরাসী “জার্নাল অব কেমিস্ট্রীর” এক সংখ্যা পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। তিনি অক্লান্তকর্মী ছিলেন এবং জ্ঞানেও অগাধ ও সর্বতোমুখী ছিলেন। ‘সিনথেটিক কেমিষ্ট্রীর’ তিনি একজন প্রধান প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁহাকে থার্মো-কেমিষ্ট্রীরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা যাইতে পারে। এ বিষয়ে তিনি তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী কোপেনহেগেনের প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক টমসনের সঙ্গে সমান গৌরবের অধিকারী। রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস সম্বন্ধেও তিনি একজন প্রামাণিক আচার্য এবং এই বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। কৃষিরসায়ন সম্বন্ধেও তিনি অনেক মূল্যবান গবেষণা করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত তিনি ফরাসী সেনেটের আজীবন সভ্য এবং দুইবার মন্ত্রিসভার সদস্যের আসন অধিকার করিয়াছিলেন। সমগ্র রসায়ন জগতে আমি এমন একজন ব্যক্তিও দেখি না, যাঁহার জ্ঞানের পরিচয় এত বিপুল, প্রতিভা এমন বহুমুখী এবং মানবসভ্যতার ভাণ্ডারে যিনি এত বিচিত্র দান করিয়াছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বার্থেলোর সঙ্গে রেনানের বন্ধুত্ব ফ্রান্সের মনীষার ইতিহাসে একটা স্মরণীয় অধ্যায়। সুতরাং ১৯০১ সালে বার্থেলোর অধ্যাপক জীবনের ৫০তম বার্ষিক স্মৃতি উৎসব উপলক্ষে প্রধানতঃ তাঁহার কৃতী শিষ্য ময়সানের চেষ্টায় যে অপূর্ব অনুষ্ঠান হইয়াছিল তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। সমগ্র ফরাসী জাতি তাহাদের প্রেসিডেণ্টের নেতৃত্বে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়াছিল, এবং ইউরোপীয় ও আমেরিকার বৈজ্ঞানিক সমিতি সমূহের প্রতিনিধিরাও উক্ত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়া তাঁহার সম্বর্ধনা করিয়াছিলেন। তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও জাতীয় ভাবেই হইয়াছিল।

 ইংলণ্ডের “নেচার” নামক প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক পত্রিকা এই উপলক্ষে লিখেন—“গত সোমবারে মঁসিয়ে বার্থেলোর অন্ত্যেষ্টি উপলক্ষ্যে যে জাতীয় অনুষ্ঠান হইয়াছিল তাহাতে পারিতে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা গিয়াছিল। এদেশে (ইংলণ্ডে) সেরূপ অনুষ্ঠান হইবার এখনও বহু বিলম্ব আছে। ফরাসী গবর্ণমেণ্ট এবং জনসাধারণ তাঁহাদের একজন দেশবাসীর মহত্ত্বের পূজা বিরাট ভাবেই করিয়াছিলেন। এদেশে (ইংলণ্ডে) রাজনীতিকগণ ও জনসাধারণ প্রতিভার মহত্ত্বকে খুব কম সম্মানই করেন। বার্থেলো যদি ফ্রান্সে না জন্মিয়া ইংলণ্ডে জন্মিতেন, তবে বৈজ্ঞানিক জগত তাঁহার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করিত বটে, কিন্তু গবর্ণমেণ্ট জাতীয় অনুষ্ঠানরূপে তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করিয়া তাঁহার স্মৃতির প্রতি যোগ্য সম্মান করিতেন না। কেন না আমাদের রাজনীতিকরা জানেন না যে জাতীয় চরিত্র ও জাতীয় উন্নতির উপর বৈজ্ঞানিকদের কার্যের প্রভাব কত বেশি, তাঁহাদের ধারণা এই যে, বৈজ্ঞানিকেরা বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্র হইতে বহু দূরে এক স্বতন্ত্র জগতে বাস করেন, এবং সেখানে নিজেদের কার্যাবলীই তাঁহাদের একমাত্র পুরস্কার।”—(বার্থেলো, জন্ম—১৮২৭, মৃত্যু—১৯০৭; নেচার, ২৮শে মার্চ, ১৯০৭, ৫১৪ পৃষ্ঠা)।

 কলিকাতায় ফিরিয়া আমি নূতন উৎসাহের সঙ্গে কার্যে প্রবৃত্ত হইলাম। আমি রসায়ন বিজ্ঞানের কয়েকজন প্রসিদ্ধ আচার্যের সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম এবং তাঁহারা তাঁহাদের লেবরেটরিতে যে সমস্ত মূল্যবান গবেষণা করিতেছিলেন, তাহারও পরিচয় পাইয়াছিলাম। আমি এখন যতদূর সাধ্য তাঁহাদের আদর্শ অননুসরণ করিতে লাগিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে আমার মনে কিছু নিরাশার সঞ্চারও হইল। ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে আমি তরুণ বৃদ্ধ সকলকেই প্রাণবন্ত ও শক্তিমান দেখিয়াছি। তাহারা কোন কার্যে প্রবৃত্ত হইলে, তাহা কখনই অর্দ্ধ সমাপ্ত রাখে না, সেই কাজেই লাগিয়া থাকে এবং শেষ না দেখিয়া ক্ষান্ত হয় না। অক্লান্ত অধ্যবসায়ের সঙ্গে তাহারা উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে অগ্রসর হয়। দুঃখের বিষয়, বাংলা দেশ সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন প্রকার। এখানে যুবকরাও দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে কার্যে অগ্রসর হয়। প্রাথমিক যে কোন বাধা-বিপত্তিতে তাহারা হতাশ হইয়া পড়ে। তাহাদের জীবনপথ কেহ কুসুমাস্তীর্ণ করিয়া রাখে, ইহাই যেন তাহাদের ইচ্ছা। পক্ষান্তরে ইংরাজ যুবক বাধা-বিপত্তিতে আরও দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়া উঠিবে। তাহার অন্তর্নিহিত শক্তি ইহাতে বিকাশপ্রাপ্ত হয়। বাঙালীরা নিরানন্দ জাতি, জীবনকে উপভোগ করিতে জানে না। তাহারা স্বপ্নাচ্ছন্ন এবং আধাঘুমন্ত জীবন যাপন করিতে ভালবাসে। সাধারণ বাঙালীকে দেখিলে টেনিসনের ‘কমলবিলাসী’ (Lotus Eaters) কবিতার কথা মনে পড়ে।

 বিষাদভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি আমাদের জাতীয় চরিত্রের এই দৌর্বল্যের কথা ভাবিতেছিলাম—এমন সময় এমন একটা ব্যাপার ঘটিল, যাহা ভাগবত ইচ্ছা বলিয়া মনে হইল। অন্তত তখনকার মত ইহা জীবন্মৃত বাঙালীর দেহে যেন নূতন প্রাণ সঞ্চার করিল। আমি লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গের কথাই বলিতেছি।

 আমার অনেক সময়েই বিশেষ করিয়া মনে হইয়াছে যে, বাংলা, আসাম ও উড়িয়া, জাতির দিক হইতে না হইলেও, ভাষার দিক হইতে এক। বাংলা, আসামী ও উড়িয়া ভাষা একই মূল ভাষা হইতে উদ্ভূত। ইহা কতকটা আশ্চর্যের বিষয়। কেন না পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র এই দুই বড় বড় নদী, পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছে। শ্রীচৈতন্যের শেষ জীবনে উড়িষ্যাই তাঁহার কর্মক্ষেত্র ছিল এবং উড়িষ্যার সম্রাট প্রতাপরুদ্র তাঁহার ধর্মমত গ্রহণ করিয়া শিষ্য হইয়াছিলেন। বাংলা ভাষায় রচিত শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, শ্রীচৈতন্য ভাগবত প্রভৃতি বৈষ্ণব গ্রন্থ এবং বাংলা কীর্তনের দ্বারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উড়িষ্যায় জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল। অপর পক্ষে যে কোন বাঙালী একটু চেষ্টা করিলেই আসামী ভাষা বুঝিতে পারে। বস্তুত ভাষার দিক হইতে এই তিন প্রদেশকে একই বলা যাইতে পারে।

 লর্ড কার্জন সাম্রাজ্যবাদের দূতরূপে শঙ্কিত হৃদয়ে দেখিলেন, বাংলা দেশে জাতীয় ভাব দ্রুতবেগে বৃদ্ধি পাইতেছে। বাঙালীর সাহিত্য ঐশ্বর্যশালী হইয়া উঠিয়াছে এবং তাহা ভারতের সমগ্র ভাষার মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছে। রাজা রামমোহন রায়ের সময় হইতে বাঙালীরা পাশ্চাত্য সাহিত্য বিশেষ যত্নসহকারে চর্চা করিয়াছে এবং বাংলার সন্তানেরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে। একটা জাতিগঠনের জন্য যাহা প্রয়োজন, তাহা নীরবে ধীরে ধীরে প্রবল হইয়া উঠিতেছে। ‘ভেদনীতি’ রোম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতাদের একটা প্রিয় নীতি ছিল এবং কার্জন তাহাদের আদর্শ অনুসরণ করিয়া ভারতে রোমক নীতি চালাইতে প্রবৃত্ত হইলেন। বাংলা দেশের মানচিত্র সর্বদা তাঁহার চোখের সম্মুখে ছিল এবং এমন একটা ভীষণ অস্ত্র নির্মাণ করিয়া তিনি বাঙালী জাতির উপর নিক্ষেপ করিলেন, যাহার আঘাত সামলাইতে তাহাদের বহুদিন লাগিবে। ম্যাকিয়াভেলির দুষ্ট বৃদ্ধি ও নিষ্ঠুর দূরদর্শিতার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া ফেলিলেন। এমন ব্যবস্থা করিলেন যাহাতে উত্তর পূর্ব ভাগে মুসলমান সংখ্যাধিক্য হয়। তিনি তাঁহার মোহমুগ্ধ পরিষদবর্গের সাহায্যে মুসলমান জনসাধারণের, বিশেষভাবে তাহাদের নেতাদের সম্মন্ধে, নানা প্রলোভন প্রদর্শন করিতে লাগিলেন, যাহাতে তাহারা হিন্দুদের নিকট হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। বাংলাদেশের হৃদয়ে এমন এক শাণিত অস্ত্র সন্ধান করা হইল, যাহার ফলে বাঙালী জাতির সংহতি শক্তি নষ্ট হয়, হিন্দু-মসলমানে চির বিরোধ উপস্থিত হয় এবং বাংলার জাতীয়তা ধ্বংস হয়।

 কৌশলী সাম্রাজ্যবাদী গোপনে যে অস্ত্র শানাইয়া প্রয়োগ করে, অধঃপতিত জাতি তাহার পরিণাম ফল প্রায়ই ভাবিতে ও বুঝিতে পারে না। সৌভাগ্যক্রমে, বাংলা দেশে তখন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিনায়কত্বে কয়েকজন শক্তিমান নেতা ছিলেন। দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদের প্লাবন বহিয়া গেল এবং দিন দিন উহা ক‍্রমেই বিরাট আকার ধারণ করিতে লাগিল। ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালী জাতির অন্তঃস্থল মথিত ও আন্দোলিত হইয়া উঠিল। বালক, বৃদ্ধ, যুবা সকলেই এই আন্দোলনে যোগদান করিল। যাহারা ঘুমাইয়াছিল, তাহারাও দীর্ঘনিদ্রা হইতে জাগিয়া উঠিল এবং কার্জন পরোক্ষভাবে বাঙালী জাতির জাগরণে সহায়তা করিলেন।

 সরকারী কর্মচারী হিসাবে প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে যোগ দিবার উপায় আমার ছিল না। কিন্তু আমার গবেষণাগার হইতে আমি এই আন্দোলনের গতি লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। বলা বাহুল্য, এই আন্দোলন আমার হৃদয় স্পর্শ করিল। এই নব জাগরণের ফলে বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞান-সাধনার আদর্শ জাতির সম্মুখে উপস্থিত হইল।

  1. সম্প্রতি (১৯২৬) যাঁহারা এ বিষয়ে বলিবার অধিকারী এমন কোন কোন ব্যক্তিও উক্তরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন:—যথা “আমরা খেলিবার পরিবর্তে খেলা দেখি”—এম. এন. জ্যাকসন, হেডমাষ্টার, মিল হিল।
  2. সম্প্রতি (১৯৩১ সালে) আমি জানিতে পারিয়াছি যে, ডাঃ আনসারী ঐ সভায় ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন।
  3. আমি পরে জানিতে পারি যে, ভ্যাণ্ট হফ তাঁহার প্রথম বয়সে ইংরাজী সাহিত্য ভাল করিয়া পড়িয়াছিলেন। বায়রণ, বার্টন এবং বাক্‌লের গ্রন্থ তাঁহার খুব প্রিয় ছিল।
  4. ভ্যাণ্ট হফের জীবনীতে আছে—ভ্যাণ্ট হফের স্বদেশ ত্যাগ করিয়া বার্লিন যাত্রার ফলে হল্যাণ্ডে বিরুদ্ধ সমালোচনা হইয়াছিল। তাঁহাকে দেশদ্রোহীরূপে চিত্রিত করা হইয়াছিল। ডচ “পাঞ্চ” পর্যন্ত তাঁহাকে রেহাই দেন নাই।
  5. প্রসিদ্ধ দেশসেবিকা এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি শ্রীযুক্তা সরোজিনী নাইডু ডাঃ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা।
  6. যাঁহারা এ বিষয়ে আরও বিস্তৃত রূপে জানিতে চান, তাঁহারা মৎকৃত Makers of Modern Chemistry গ্রন্থ পড়িতে পারেন।
  7. রসায়ন বিদ্যা ফরাসী বিজ্ঞান, ইহার প্রতিষ্ঠাতা অমরকীর্তি ল্যাভোসিয়ার।