আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ
গোখেল ও গান্ধীর স্মৃতি
এই স্থানে আমার জীবনকাহিনীর বর্ণনা কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রাখিয়া জি, কে, গোখেল এবং এম, কে, গান্ধীর সম্বন্ধে আমার স্মৃতিকথা বলিতে চাই। দুইজনের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হইয়াছিল। আমি কেবল এই দুইজন মহৎ ব্যক্তির কথাই এখানে উল্লেখ করিতেছি। আমি যে সমস্ত মহচ্চরিত্র ভারতবাসীর সংস্পর্শে আসিয়াছি, তাঁহাদের কথা বলিতে গেলে আর একখণ্ড বৃহৎ গ্রন্থের প্রয়োজন হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় যে, আনন্দমোহন বসু ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল এবং ইঁহাদের দুইজনকে আমি গুরুর মত শ্রদ্ধা করিতাম। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আমি কত শিক্ষা লাভ করিয়াছিলাম, তাহাও এখানে উল্লেখ করিব না।
১৯০১ সালে বড়লাটের ব্যবস্থাপরিষদের অধিবেশনে যোগদান করিবার জন্য গোপালকৃষ্ণ গোখেল কলিকাতায় আসেন। একদিন সকালবেলা ডাঃ নীলরতন সরকার আমার নিকটে আসিয়া বলেন যে, প্রসিদ্ধ মারাঠা রাজনীতিক গোখেল কলিকাতায় আসিতেছেন এবং তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য হাওড়া ষ্টেশনে যাইতে হইবে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই গোখেলের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও বন্ধুত্ব হইল। গোখেলের সঙ্গে তাঁহার অবৈতনিক প্রাইভেট সেক্রেটারী জি, কে, দেওধর ছিলেন। ইনি এখন সার্ভেণ্ট অব ইণ্ডিয়া সোসাইটি বা ভারত সেবক সমিতির অধ্যক্ষ। আমাদের দুইজনের প্রকৃতির মধ্যে কোন কোন বিষয়ে সাদৃশ্য ছিল। এই কারণে আমরা দুইজন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ে পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব ও সহানুভূতির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করিতে পারিতাম।
তথ্য এবং সংখ্যাসংগ্রহ বিদ্যায় গোখেল অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বলিলেই হয়, এবং পর পর কয়েক বৎসর ভারত গভর্ণমেণ্টের বার্ষিক বাজেট সমালোচনা করিয়া তিনি যে বক্তৃতা দিয়াছিলেন, তাহা প্রসিদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। দাম্ভিক লর্ড কার্জন পর্যন্ত তাঁহার অকাট্য যুক্তিপূর্ণ তীক্ষ্ণ সমালোচনাকে ভয় করিতেন এবং তাঁহার সম্মুখে বিচলিত হইতেন। কিন্তু গোখেলকে তাঁহার পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার জন্য লর্ড কার্জন মনে মনে খুব শ্রদ্ধা করিতেন। লর্ড কার্জন স্বহস্তে গোখেলকে একখানি পত্র লিখেন, গোখেল আমাকে উহা দেখাইয়াছিলেন। পত্রের উপসংহারে গোখেলের প্রতি নিম্নলিখিতরূপে উচ্চ প্রশংসাপত্র ছিল—“আপনার ন্যায় আরও বেশী লোকের ভারতের প্রয়োজন আছে।” ১৯১৫ সালে গোখেলের অকালমৃত্যু হয়। বড়লাটের ব্যবস্থাপরিষদে এ পর্যন্ত তাঁহার স্থান কেহ পূর্ণ করিতে পারেন নাই। গোখেলের বক্তৃতা সুযুক্তিপূর্ণ, ধীর এবং সংযত হইত। সেই জন্য উচ্চ রাজকর্মচারীদেরও তিনি প্রিয় ছিলেন। বাংলা দেশ ও বাঙালী জাতিকে তিনি ভালবাসিতেন এবং এখানে তাঁহার বহু বন্ধু ছিল। ১৯০৭ সালে বাঙালীদিগকে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করিয়া তিনি ব্যবস্থাপরিষদে যে বক্তৃতা দেন, তাহা চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে।
৯১ নং অপার সার্কুলার রোডে আমার বাসস্থানে গোখেল মাঝে মাঝে আসিতেন। এই বাড়ীতেই তখন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের আফিস ও কারখানা ছিল। আমাকে তিনি “বৈজ্ঞানিক সন্ন্যাসী” বলিতে আনন্দবোধ করিতেন। তখনকার দিনে কলেজের গবেষণাগার এবং আমার নিজের শয়নঘর ও পাঠগৃহ—ইহাই আমার কার্যক্ষেত্র ছিল।
“সার্ভেণ্ট-অব-ইণ্ডিয়া সোসাইটির” অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা এবং পুণা ফার্গুসান কলেজের অধ্যাপকদের ন্যায় তিনিও স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি মাসিক মাত্র ৭৫৲ টাকা বেতন লইয়া ফার্গুসান কলেজে কাজ করিতেন। তিনি নিজেকে দাদাভাই নৌরজীর ‘মানসিক পৌত্র’ বলিয়া অভিহিত করিতেন। দাদাভাই নৌরজীই ভারতের অর্থ নৈতিক অবস্থা বিশেষভাবে অধ্যয়ন ও আলোচনা করেন। দাদাভাই নৌরজীর পর মহাদেব গোবিন্দ রাণাড়েও ভারতের অর্থনৈতিক সমস্যার আলোচনায় আত্মনিয়োগ করেন। মহাদেব গোবিন্দ রাণাড়েকে দাদাভাই নৌরজীর শিষ্যরূপে গণ্য করা যায় এবং গোখেল ছিলেন এই রাণাড়ের শিষ্য—সুতরাং এই দিক দিয়া গোখেল নৌরজীর ‘মানসিক পৌত্র’ ছিলেন বলা যায় এবং ইহা তিনি সগর্বে বলিতেন।
গোখেল আমার কয়েক বৎসরের ছোট ছিলেন এবং প্রাচ্যরীতি অনুসারে আমি কনিষ্ঠের মতই তাঁহাকে সস্নেহ ব্যবহার করিতাম। একদিন আমি একটুকরা কাগজে পেন্সিল দিয়া কবি বায়রণের অনুকরণে লিখিলাম—“রাজনীতি ভূপেনের জীবনের একাংশ মাত্র, কিন্তু গোখেলের জীবনের সর্বস্ব।” প্রকৃতপক্ষে গোখেলের জীবনকালে এবং তাহার বহু পরে পর্যন্ত, ফেরোজ শা মেহতা, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, ডবলিউ সি, ব্যানার্জী, মনমোহন ঘোষ, আনন্দমোহন বসু প্রভৃতি আমাদের রাজনৈতিক নেতারা আইন ব্যবসায়ে প্রভূত অর্থ উপার্জন করিতেন। রাজনীতি তখন কতকটা বিলাসের মত ছিল। এমন কি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও অধ্যাপক ও সাংবাদিকের কাজ করিতেন। জাতীয় কংগ্রেসকে তখন লোকে বড়দিনের সময়কার ‘তিনদিনের তামাসা’ বলিত।
গোখেলই প্রথম রাজনীতিক যিনি তাঁহার জীবনের শেষভাগে সমস্ত সময় ও শক্তি রাজনৈতিক সমস্যার আলোচনায় প্রয়োগ করিয়াছিলেন। এই উদ্দেশ্যে, তিনি অর্থনীতি, রাজনৈতিক ইতিহাস, ষ্ট্যাটিসটিকস (সংখ্যা সংগ্রহ) প্রভৃতি বিষয়ে নির্বাচিত গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন—যাহাতে ‘ভারত সেবক সমিতির’ ভবিষ্যৎ সদস্যেরা ঐ সমস্ত বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান সঞ্চয় করিতে পারে। একবার তিনি শ্রীযুত শ্রীনিবাস শাস্ত্রীকে আমার নিকট লইয়া আসেন এবং তাঁহাকে একজন দরিদ্র স্কুল মাষ্টার বলিয়া আমার সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দেন। সেই সময় আমার কানে কানে তিনি বলেন—শাস্ত্রীকে তিনি তাঁহার কার্যের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী বলিয়া মনে করেন। বলা বাহুল্য, গোখেলের এই দূরদৃষ্টি ও ভবিষ্যৎবাণী সার্থক হইয়াছে। এই দুইজন বিখ্যাত ভারতীয় রাজনীতিক—যাঁহারা স্বদেশে ও বিদেশে সর্বত্র শ্রদ্ধা ও সম্মান লাভ করিয়াছেন—তাঁহারা জীবনের প্রথম ভাগে আমারই মত বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন—একথা ভাবিতে আমার আনন্দ হয়।
১৯১২ সালের ১লা মে আমি তৃতীয়বার বোম্বাই হইতে ইংলণ্ড যাত্রা করি। ঘটনাচক্রে গোখেল জাহাজে আমার সহযাত্রী ছিলেন এবং তাঁহার সঙ্গ আমার পক্ষে আনন্দদায়ক ও শিক্ষাপ্রদ হইয়াছিল। একটি ঘটনা আমার বেশ স্পষ্ট মনে পড়িতেছে। একজন ইংরাজ বণিক যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন। প্রাচ্যদেশে তাঁহার ব্যবসা ছিল এবং স্বদেশে ফিরিতেছিলেন। একদিন সকালবেলা, ভারত গবর্ণমেণ্ট শিক্ষার জন্য কত টাকা ব্যয় করেন সেই কথা উঠিল। ইংরাজ বণিকটি কিঞ্চিৎ উদ্ধতভাবে বলিলেন—“আমরা কি শিক্ষার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করিতেছি না?” গোখেল উত্তেজিতভাবে বলিলেন—“মহাশয়, ‘আমরা’ এই শব্দ দ্বারা আপনি কি বলিতে চাহেন? ইংলণ্ড চাঁদা করিয়া অর্থ সংগ্রহ করে এবং কৃপাপূর্বক সেই অর্থ ভারতের শিক্ষার জন্য দান খয়রাত করে—ইহাই কি বুঝিতে হইবে? আপনি কি জানেন না যে, ঐরূপ কিছু করা দূরে থাকুক, ইংলণ্ড ভারতের রাজস্বের নানা ভাবে অপব্যয় করে এবং সামান্য কিছু অংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করে?” গোখেল ধীর গম্ভীর প্রকৃতির লোক ছিলেন, কিছুতেই উত্তেজিত হইতেন না। এই একবার মাত্র আমি তাঁহাকে ধৈর্যচ্যুত হইতে দেখিয়াছি। প্রাতভোজনের টেবিলে ইহার ফলে যাদুমন্ত্রের কাজ হইল। সকলেই নীরব হইলেন। ইহার কিছুক্ষণ পরে ডেকে গেলে কয়েকজন ভদ্রলোক আমার নিকট ইংরাজ বণিকটির ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করিলেন এবং বলিলেন যে, ইংরাজ বণিকটি যদি জানিতেন যে কাহার সঙ্গে কথা বলিতেছেন, তবে তিনি নিশ্চয়ই এমন সরফরাজী করিতেন না।
১৯০১ সালের শেষ ভাগে গোখেলের অতিথিরূপে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি কলিকাতায় আসেন—ইনিই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। বলাবাহুল্য, প্রথম হইতেই তাঁহার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আমি তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। আমাদের দুইজনের প্রকৃতির মধ্যে একটি বিষয়ে সাদৃশ্য ছিল—ত্যাগ ও তিতিক্ষার প্রতি নিষ্ঠা। এই কারণেও তাঁহার প্রতি আমি আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। তাহার পর বহু বৎসর অতীত হইয়াছে এবং মহাত্মাজীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও তাঁহার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতাও সঙ্গে সঙ্গে বর্দ্ধিত হইয়াছে।
মহাত্মাজী তাঁহার আত্মজীবনীতে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের বিবরণ দিয়াছেন, সতরাং তাহা আর এখানে বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ২৫ বৎসর পরেও, আমাদের কথাবার্তা সমস্তই তাঁহার স্মরণ আছে। একটি প্রয়োজনীয় বিষয়, তাঁহার মনে নাই। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয়দের দঃখ দুর্দশার মর্মস্পর্শী কাহিনী তাঁহার মুখেই আমি প্রথম শুনি। আমি ভাবিলাম এবং গোখেলও আমার সঙ্গে একমত হইলেন যে, যদি কলিকাতায় একটি সভা আহ্বান করা যায় এবং শ্রীযুত গান্ধী সে সভার প্রধান বক্তা হন, তাহা হইলে উপনিবেশ-প্রবাসী ভারতীয়দের দঃখ দুর্দশার কথা আমাদের দেশবাসী ভাল করিয়া উপলব্ধি করিতে পারিবে। এই উদ্দেশ্যে, প্রধানতঃ আমার উদ্যোগে অ্যালবার্ট হলে একটি জনসভা আহূত হইল এবং ‘ইণ্ডিয়ান মিররের’ প্রধান সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন তাহার সভাপতির পদ গ্রহণ করিলেন। “ইংলিশম্যান” সংবাদপত্রও গান্ধীর পক্ষ উৎসাহের সহিত সমর্থন করিলেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্যা সম্বন্ধে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখিলেন। ২০শে জানুয়ারী, ১৯০২, সোমবারের ‘ইংলিশম্যান’ হইতে—ঐ সভার একটি বিবরণ উদ্ধৃত হইল:—
দক্ষিণ আফ্রিকা সমস্যায় মিঃ এম, কে, গান্ধী
“গতকল্য সন্ধ্যাকালে অ্যালবার্ট হলে মিঃ এম, কে, গান্ধী তাঁহার দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একটি চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা করেন। সভায় বহু জনসমাগম হইয়াছিল। মিঃ নরেন্দ্রনাথ সেন সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। রাজা প্যারীমোহন মুখার্জি, মাননীয় প্রোঃ গোখেল, মিঃ পি, সি, রায়, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, পৃথ্বীশচন্দ্র রায়, জে, ঘোষাল, অধ্যাপক কাথাভাতে প্রভৃতি সভায় উপস্থিত ছিলেন। মিঃ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা প্রথমতঃ সাধারণ ভাবে বর্ণনা করিয়া সেখানে প্রবাসী ভারতীয়দের অবস্থা বিশেষ ভাবে আলোচনা করেন। তিনি বলেন যে, নেটালে ইমিগ্রেশন রেস্ট্রিকশান অ্যাক্ট, লাইসেন্স সম্বন্ধীয় আইন এবং ভারতীয় ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারই প্রধান সমস্যা। ট্রান্সভালে ভারতীয়েরা কোন ভূসম্পত্তির মালিক হইতে পারে না এবং দুই একটি বিশেষ স্থান ব্যতীত কোথাও ব্যবসা-বাণিজ্য চালাইতে পারে না। তাহারা ফুটপাথ দিয়া হাঁটিতে পর্ষন্ত পারে না। অরেঞ্জ নদী উপনিবেশে, ভারতীয়েরা মজুর ব্যতীত অন্য কোন ভাবে প্রবেশ করিতে পারে না, সেজন্যও বিশেষ অনুমতি লইতে হয়। বক্তা বলেন কোন বিশেষ উদ্দেশ্য লইয়া যে এরূপ অবস্থার সৃষ্টি করা হইয়াছে তাহা নহে, বুঝিবার ভুলের দরুণই এরূপ হইয়াছে। ইংরাজী ভাষাভিজ্ঞ ভারতীয়দের অভাবে দুই জাতির মধ্যে এই বুঝিবার ভুল দাঁড়াইয়া গিয়াছে। এই সমস্ত অভিযোগ দূর করার জন্য তাঁহারা (ভারতীয়েরা) দুইটি নীতি অনুসারে কার্য করিতেছেন, প্রথমতঃ সকল অবস্থাতেই সত্যকে অনুসরণ করা, দ্বিতীয়তঃ প্রেমের দ্বারা ঘৃণাকে জয় করা। বক্তা শ্রোতাগণকে এই উক্তি কেবলমাত্র কথার কথা বলিয়া গণ্য না করিতে অনুরোধ করেন। এই নীতি কার্যকরী করিবার জন্য তাঁহারা দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘নেটাল ইণ্ডিয়ান কংগ্রেস’ নামে একটী সঙ্ঘ গঠন করিয়াছেন। এই সঙ্ঘ তাহার কার্য দ্বারা নিজের শক্তি প্রমাণ করিয়াছে এবং গভর্ণমেণ্টও ইহাকে অপরিহার্য মনে করেন। গভর্ণমেণ্ট কয়েকবার এই সঙ্ঘের সাহায্য গ্রহণ করিয়াছেন। দুঃস্থ ও অনাহারক্লিষ্টদের জন্য এই সঙ্ঘ অর্থ সংগ্রহ করিয়াছেন। বক্তা এই বলিয়া উপসংহার করেন যে, সভার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র দুই জাতির সৎবৃত্তিগুলিরই সাধারণের সম্মুখে আলোচনা করা। নিকৃষ্ট বৃত্তিও আছে, কিন্তু সৎবৃত্তির আলোচনা করাই শ্রেয়ঃ। ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাম্বুলেন্স’ দল, এই ভাবের উপরেই গঠিত হইয়াছে। যদি তাহারা ব্রিটিশ প্রজার অধিকার দাবী করে, তবে তাহার দায়িত্বও গ্রহণ করিতে হইবে। এই অ্যাম্বুলেন্স দলে ভারতীয় শ্রমিকরা অবৈতনিক ভাবে কাজ করিয়া থাকে এবং জেনারেল বুলার তাঁহার ‘ডেস্প্যাচে’ ইহার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করিয়াছেন।
“রাজা প্যারীমোহন মুখার্জি বক্তাকে ধন্যবাদ দিবার প্রস্তাব করেন এবং মাননীয় অধ্যাপক গোখেল তাহা সমর্থন করেন। মিঃ ভূপেন্দ্রনাথ বসু এবং মাননীয় অধ্যাপক গোখেলও সভায় বক্তৃতা করেন। সভাপতিকে ধন্যবাদ দিবার পর সভাভঙ্গ হয়।” এইরূপে কলিকাতার জনসভায় গান্ধিজীর প্রথম আবির্ভাবের জন্য আমিই বস্তুত উদ্যোক্তা। উপরোক্ত বিবৃতি হইতে দেখা যাইবে যে, যে সত্যাগ্রহ ও নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ পরবর্তীকালে জগতে একটি প্রধান শক্তিরূপে গণ্য হইয়াছে, এই শতাব্দীর প্রথমেই তাহার উন্মেষ হইয়াছিল।
গান্ধিজীর সঙ্গে এই সময়ে আমার প্রায়ই কথাবার্তা হইত এবং তাহা আমার মনের উপর গভীর রেখাপাত করিয়াছে। গান্ধিজী তখন ব্যারিস্টারিতে মাসে কয়েক সহস্র মুদ্রা উপার্জন করিতেন। কিন্তু বিষয়ের উপর তাঁহার কোন লোভ ছিল না। তিনি বলিতেন— “রেলে ভ্রমণ করিবার সময় আমি সর্বদা তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ীতে চড়ি, উদ্দেশ্য—যাহাতে আমার দেশের সাধারণ লোকদের সংস্পর্শে আসিয়া তাহাদের দঃখ দুর্দশার কথা জানিতে পারি।”
এই ত্রিশ বৎসর পরেও কথাগুলি আমার কানে বাজিতেছে। যে সত্য কেবলমাত্র বাক্যে নিবদ্ধ, তদপেক্ষা যে সত্য জীবনে পালিত হয় তাহা ঢের বেশি শক্তিশালী।