আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
বর্তমান সভ্যতা—ধনতন্ত্রবাদ—যান্ত্রিকতা এবং বেকার সমস্যা
(১) পণ্যের অতি উৎপাদন এবং তাহার পরিণাম—বেকার সমস্যা
ইয়োরোপ ও আমেরিকা হইতে সম্প্রতি যে শোচনীয় বেকার সমস্যার বিবরণ পাওয়া যাইতেছে, তাহা হইতেই বুঝা যায়, পাশ্চাত্য দেশসমূহে কিরূপ আর্থিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হইয়াছে।
সকলেই জানেন, পৃথিবীব্যাপী আর্থিক মন্দা চারিদিকে কি অনিষ্টকর ফল প্রসব করিতেছে। ইংলণ্ড, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী প্রভৃতি দেশে বেকার সমস্যা অতিমাত্রায় বাড়িয়া চলিয়াছে। ভারতেও বেকার সমস্যার অন্ত নাই, কিন্তু এখানে হতভাগ্য বেকারদের সংখ্যা নির্ণয়ের কোন চেষ্টা হয় নাই। শুনা যায়, আমেরিকায় বেকারের সংখ্যা প্রায় ৮০ লক্ষ। ‘টাইমসে’র নিউইয়র্কের সংবাদদাতা বলেন, “বহু স্থানে মধ্যবিত্ত লোকের অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে। সহস্র সহস্র কেরাণী মজুরের কাজ করিতেছে বা ঐ কাজ পাইবার জন্য চেষ্টা করিতেছে।...এরপ বহু পরিবার তাহাদের সন্তানদের সমস্ত দিন বিছানাতেই শোয়াইয়া রাখিতেছে। কেননা ঘর গরম করিবার জন্য প্রয়োজনীয় ইন্ধন সংগ্রহের ক্ষমতা তাহাদের নাই।”
“এর চেয়েও শোচনীয় কাহিনী আছে। একটি সংবাদে আছে যে, সহরের কর্তারা সমস্ত জঞ্জালাধার তালাবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, পাছে লোকে রাত্রিতে ঐ সমস্ত স্থান হইতে ক্ষুধার জ্বালায় পচা খাদ্য সংগ্রহ করিয়া খায় এবং তাহার ফলে তাহাদের দেহ বিষাক্ত হয়! একটি লোক একটুকরা রুটি চুরী করিয়া ধরা পড়ে। এই ঘৃণা ও অপমানের ফলে শেষে সে আত্মহত্যা করে। দুর্ভিক্ষ বা বন্যা প্রভৃতির সময়ে আমাদের দেশেও এরপ ঘটনা ঘটিতে দেখা যায়। চরম দুর্দশায় পড়িয়া এদেশের লোক স্ত্রী পুত্র কন্যা বিক্রয় করিয়াছে, আত্মহত্যা পর্যন্ত করিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমেরিকার মত ঐশ্বর্যশালী দেশেও এরপ দূরবস্থা হইতে পারে। শুনা যায়, এই সব বেকারদের অভাব মোচন করিবার জন্য ২২ লক্ষ পাউণ্ডের প্রয়োজন। আমেরিকার কোটিপতিদের পক্ষে এই টাকা সংগ্রহ করা কঠিন নহে। আমেরিকায় এত লক্ষপতি, কোটিপতি থাকিতেও, সে দেশে এরপ হৃদয়বিদারক ব্যাপার কেন ঘটিতেছে?” (স্থানীয় কোন সংবাদপত্র হইতে উদ্ধৃত—তাং ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৩০)
সৌভাগ্যক্রমে এক দল নূতন অর্থনীতিবিদের উদ্ভব হইয়াছে। ইঁহারা সমস্যাটি গভীরতর ভাবে দেখিয়া জগদ্ব্যাপী বেকার সমস্যার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করিয়াছেন। প্রায় দুই বৎসর পূর্বে (১৯২৮) কলিকাতার স্টেটসম্যানে নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশিত হয়:—
“পাশ্চাত্য দেশ সমূহে শিল্প বাণিজ্যের যে সঙ্গীন অবস্থা হইয়াছে, তাহার প্রতিকারের একমাত্র পথ উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ হ্রাস করা। কিন্তু ইহার ফলে বেকার সমস্যার সৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী। দুইটি শিল্পের কথাই ধরা যাক, আমেরিকা ছয় মাসে যে পরিমাণে বুট ও জুতা তৈরী করে তাহাতে তাহার এক বৎসর চলে, এবং সতের সপ্তাহে এক বৎসরের উপযোগী কাচ তৈরী করে। কাজেই প্রয়োজনাতিরিক্ত মাল হয়; তাহাকে কম মূল্যে অন্য দেশে চালান করিতে হইবে, অথবা কারখানার কাজ বন্ধ করিয়া দিতে হইবে। ল্যাঙ্কাশায়ার ও ইয়র্কশায়ারেরও এইরূপ দুর্দশা। প্রত্যেক দেশেই কারখানা স্থাপিত হইতেছে এবং যন্ত্র শক্তিতে উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ বহু গুণে বাড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু তদনুপাতে জিনিষ বিক্রয় হইবার সম্ভাবনা নাই। জগতের জন সাধারণ অত্যন্ত দরিদ্রই রহিয়া গিয়াছে, সুতরাং উৎপন্ন মাল কাটিতেছে না। বিশেষতঃ এশিয়া ও আফ্রিকায় পাশ্চাত্যের তুলনায় আর্থিক উন্নতি কমই হইয়াছে, সুতরাং এই দুই মহাদেশে লোকসংখ্যা খুব বেশী হইলেও, সে তুলনায় পণ্য দ্রব্যাদি সামান্যই বিক্রয় হয়। সেখানকার লোক সমূহের অভাবও সামান্য।” আর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। হেন্রি ফোর্ডের কারখানা হইতে ১৯২০-২১ সনে ১২ ১/২ লক্ষ মোটর গাড়ী তৈরী হইয়াছে,[১] মাসে গড়ে ত্রিশ দিন কাজের সময় ধরিলে প্রত্যহ ৪ হাজার মোটর গাড়ী ফোর্ডের কারখানা হইতে তৈরী হইত। পরে হেন্রি ফোর্ড তাঁহার প্রতিবেশীদের পরাস্ত করিবার জন্য প্রত্যহ গড়ে ৬ হাজার মোটর গাড়ী তৈরী করিতে থাকেন। অন্যান্য কারখানার মালিকেরাও তাঁহার সঙ্গে উন্মত্তের মত পাল্লা দিতে থাকে। ফলে সঙ্কটজনক অবস্থার সৃষ্টি হইল। জগতবাসীরা কি ক্রমাগত মোটরগাড়ী কিনিতে পারে? বর্তমানে জগদ্ব্যাপী যে আর্থিক দুর্দশা হইয়াছে, তাহার একটা প্রধান কারণ এই অতি উৎপাদন।”
প্রায় দুই বৎসর পূর্বে উপরোক্ত কথাগুলি লিখিত হয়। পুস্তক মুদ্রণের পূর্বে স্থানীয় একখানি সংবাদপত্রে আমি নিম্নলিখিত মন্তব্য পাঠ করিলাম (১১-৩-৩২):—
“হেন্রি ফোর্ডের ব্যবসায়ের মূল নীতি এই যে, কলের দ্বারা কাজে শ্রমিক সংখ্যার হ্রাস হয় না, বরং তাহাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হয় এবং তাহাদের মজুরীও বাড়ে। তিনি আরও বলেন যে, শ্রমিকদের যত বেশী মজুরী দেওয়া যায়, ততই ব্যবসায়ের উন্নতি হয়। কিন্তু গত দুই বৎসরের ঘটনাবলীর ফলে তাঁহার সেই মূল নীতি রক্ষা করা কঠিন হইয়াছে। আমরা শুনিতেছি যে, তাঁহার কৃষিক্ষেত্রে তিনি কল বর্জন করিয়া সনাতন প্রণালীতে কাজ করাইতেছেন, যাহাতে অধিক সংখ্যক লোক কাজ পাইতে পারে। বেশী মজুরী অতীতের কথা হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং তিনিও ঘটনাচক্রে বাধ্য হইয়া অন্য সকলের মত শ্রমিকদের মজুরী হ্রাস করিতেছেন।”
(২) কলের দ্বারা মানুষ কর্মচ্যুত হইয়াছে
জগতে আবার সঙ্গীন বেকার সমস্যা দেখা দিয়াছে। ইহা কতকটা নূতন ও অপ্রত্যাশিত রকমের। আর্থিক মন্দা, পণ্য উৎপাদন হ্রাস এবং কারখানা বন্ধ করার সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ নাই। পক্ষান্তরে অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদনের ফলেই এই অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে। সম্প্রতি ইভান্স ক্লার্ক, ‘নিউইয়র্ক টাইমস্’ পত্রে এই কথাই লিখিয়াছেন। মিঃ ক্লার্ক বলেন, মানুষের কাজ এখন কলে করিতেছে, কাজেই অনেক লোক কাজ পাইতেছে না এবং তাহারই ফলে শ্রমিকদের বর্তমান দুর্দশা। তিনি বলেন, “আর্থিক কৃচ্ছতার সময়েই বেকার সমস্যা দেখা গিয়াছে। যখন ব্যবসা ভাল চলে না, তখনই কারখানা হইতে শ্রমিকদের ছাড়াইয়া দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যবসার অবস্থা ভাল হইলেই আবার লোক নিযুক্ত করা হয়।
“কিন্তু বর্তমানের বেকার সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। আর্থিক মন্দার সময়ে যেরূপ হয়, ব্যবসায়ের বাজারে সেরূপ কোন অবনতির লক্ষণ দেখা যায় নাই। ‘ইউনাইটেড স্টেট্স্ ষ্টীল করপোরেশান’ এইমাসে গত বৎসরের তুলনায় বরং বেশী কাজ করিতেছে।
“বৈদ্যুতিক শক্তির ব্যবহার গত বৎসরের তুলনায় শতকরা ৭ ভাগ বাড়িয়া গিয়াছে।
“আরও একটি কারণ ভিতর হইতে প্রভাব বিস্তার করিতেছে। এতদিন ইহাকে আমরা লক্ষ্য করি নাই, কিন্তু এখন ক্রমে ক্রমে শক্তি সংগ্রহ করিয়া ইহা একটি প্রধান জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি করিয়াছে। যন্ত্র আমাদের শিল্প ক্ষেত্রের সর্বত্র যেরূপ দখল করিয়াছে তাহার ফলে মানুষ কর্মহীন বেকার হইয়া পড়িতেছে। এই দিক দিয়া চিন্তা করিলেই কেবল বর্তমান সমস্যার মূল আবিষ্কার করা যাইতে পারে।
“এতাবৎকাল পর্যন্ত যন্ত্র কার্যক্ষেত্রের বিস্তার করিয়া এবং আনুষঙ্গিক নানা শিল্পের সৃষ্টি করিয়া, মানুষকে কাজ যোগাইয়াছে। কিন্তু চিরদিনই এইরূপ সুখকর অবস্থা থাকিতে পারে না, বর্তমানের দুর্দশাই তাহার প্রমাণ।
“তিন দিক হইতে জিনিষটির বিচার করা যাইতে পারে। প্রথমতঃ, বর্তমানে কি বেকার সমস্যা সঙ্গীন হইয়া দাঁড়াইয়াছে? আমেরিকায় বহুসংখ্যক কল কারখানা বন্ধ হইয়া যাওয়ার ফলেই কি এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে? যদি পণ্য উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস না হইয়া থাকে, তবে ধরিয়া লইতে হইবে বর্তমান বেকার সমস্যার মূলে যন্ত্রের প্রভাব রহিয়াছে।
“তারপর পণ্য উৎপাদনের কথা। কারখানাতে পণ্য উৎপাদন হ্রাস হওয়াতেই কাজের পরিমাণ কমিয়া গিয়াছে, সাধারণতঃ এরূপ মনে করা যাইতে পারে। কিন্তু অবস্থা ইহার বিপরীত। ১৯২৭ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কল কারখানাগুলি এত অধিক পণ্য উৎপাদন করিয়াছে, গত বৎসর ব্যতীত আর কখনও এমন হয় নাই। একদিকে পণ্য উৎপাদন যেমন বাড়িয়াছে, অন্যদিকে তেমন ১৯১৯ সাল হইতে উৎপাদনকারী শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পাইয়া আসিতেছে।
“গৃহনির্মাণ শিল্পে এই শ্রমিক সংখ্যা হ্রাসের কৌশল বেশী পরিমাণে অগ্রসর হইয়াছে; পরিখা খনন, ভারী বস্তু উত্তোলন, বাতি-বহন প্রভৃতি অনেক কাজই এখন যন্ত্র-সাহায্যে হইতেছে। এই শিল্প সম্পূর্ণরূপেই যন্ত্রশিল্প হইয়া উঠিয়াছে।
“কয়লার খনির কাজেও যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়া গিয়াছে। ইতিমধ্যেই আমেরিকায় শতকরা ৭১ ভাগ কয়লার কাজ কলের দ্বারা হইতেছে। ১৮৯০ সালে যে পরিমাণ শ্রমের প্রয়োজন হইত, বর্তমানে তাহা অপেক্ষা প্রায় অর্ধেক শ্রম খাটাইয়া কয়লার কোম্পানীগুলি এক বৎসরের উপযোগী কয়লা খনি হইতে তুলিতেছে। ইস্পাত কোম্পানীগুলি ১৯০৪ সালের তুলনায় বর্তমানে ঠিক সেই পরিমাণ শ্রমিক খাটাইয়া তিন গুণ বেশী পিণ্ডলৌহ তৈরী করিতেছে।
“হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে, আমেরিকার কৃষিফার্মসমূহে ৪৫ হাজার শস্য সংগ্রহ ও পেষণের যন্ত্র একলক্ষ ত্রিশ হাজার শ্রমিককে কর্মচ্যুত করিয়াছে। ইহারা উচ্চ হারে মজুরী পাইত।
“যন্ত্রের দ্বারা যে কত লোক কর্মচ্যুত হইয়াছে, তাহার ইতিহাস এখনও লিখিত হয় নাই। যন্ত্রের দ্বারা যে সমস্ত লোক কর্মচ্যুত হইতেছে, তাহাদের কতকাংশকে ঐ ব্যবসায়েরই বিভিন্ন বিভাগে কাজ দেওয়া হয় বটে, কিন্তু কলের প্রসার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রও তদনুপাতে বাড়ে, তবেই এরূপ সম্ভব হইতে পারে। এই সমস্ত বিবেচনা করিলে বুঝা যাইবে, ১৯২১ সালের তুলনায় বর্তমানে ব্যবসায়ের অবস্থা তত বেশী খারাপ না হইলেও, বেকার সমস্যা কেন এমন অধিকতর ভয়াবহ হইয়া উঠিয়াছে।”[২]
দুর্দশা এখন চরমে উঠিয়াছে। সম্প্রতি একদল বেকার প্রেসিডেণ্ট হুভারের নিকট দরবার করিতে গিয়াছিল। তাহাদের আবেদন হইতেই প্রকৃত অবস্থা বুঝা যাইবে।
“আমাদের এই দেশে ভূমি উর্বরা, প্রচুর ফসল উৎপন্ন হইতেছে, গোলায় শস্য ধরে না, ভাণ্ডার পণ্যভারে পূর্ণ। তোষাখানায় প্রভূত পরিমাণে স্বর্ণ সঞ্চিত, কল কারখানা ও ফার্মে অতিরিক্ত উৎপন্ন পণ্য, বিক্রয় হইতে না পারিয়া, চারিদিকের বাণিজ্য প্রবাহ যেন রোধ করিয়া ফেলিয়াছে। তৎসত্ত্বেও ১ কোটী দশ লক্ষ নরনারী তাহাদের দেহ ও মস্তিষ্ক কর্মে নিয়োগ করিবার কোনই সুযোগ পাইতেছে না। তাহারা প্রচুর সঞ্চিত খাদ্য সম্ভারের পার্শ্বে আর্থিক বিপর্যয়ের প্রতীক স্বরূপ অনাহারে দাঁড়াইয়া আছে”—স্টেট্সম্যান, ১৬ই জানুয়ারী, ১৯৩২।
(৩) শ্রম বাঁচাইবার কৌশল
“মানুষের শ্রমকে কি ভাবে বাদ দেওয়া হইয়াছে, তাহার বহু দৃষ্টান্ত স্টুয়ার্ট চেজ দিয়াছেন। এক রকম নূতন বৈদতিক হাত করাত হইয়াছে, যাহার দ্বারা একজন লোক ৪ জনের কাজ করিতে পারে। বৈদ্যুতিক বাটালি দ্বারা একজন মিস্ত্রী দশজনের কাজ করিতে পারে। টেলিফোনে ‘ডায়াল সিস্টেম’ হওয়াতে সুইচবোর্ডে তরুণীদের নিযুত করিবার প্রয়োজন নাই। একটি সপ্তাহেই ১৪টি নূতন যন্ত্রের আবিষ্কার উদ্ভাবন হইতে দেখা গিয়াছে। পিণ্ডলৌহ ঢালাই করিতে যেখানে ষাট জন লোকের দরকার হইত, সে স্থলে এখন সাত জনেই কাজ চলে। কারখানার বড় চুল্লীতে ৪২ জন লোকের স্থলে এখন একজন কাজ করিতেছে। ইট তৈয়ারী কলে ঘণ্টায় ৪০ হাজার ইট তৈরী হইতেছে। পূর্বে একজন লোকে রোজ ৪৫০ খানি ইট তৈরী করিত। সিমপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স যন্ত্র দ্বারা টেলিগ্রাফ আফিসে তারবার্তা স্বতঃই গৃহীত হইতেছে, তজ্জন্য শিক্ষিত কর্মীদের প্রয়োজন নাই। টাইপ বসাইবার যন্ত্র দ্বারা একটি প্রধান কেন্দ্রে বসিয়া একজন লোক পাঁচশত মাইল পর্যন্ত দূরে টাইপ বসাইতে পারে। ইহার ফলে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার মুদ্রাকরের কাজ গিয়াছে।
“তামাক ব্যবসায়ে, একটি সিগারেট তৈরী কলে প্রতি মিনিটে ১২ হাজার সিগারেট তৈরী হয়।....সিগারেট পাকাইতে মাত্র তিনজন শ্রমিকের প্রয়োজন হয় এবং একটি যন্ত্র সাত শত লোকের কাজ করিতে পারে।
“‘স্ট্যাটিষ্ট’ বলেন—প্রত্যেক কর্মী যন্ত্রযোগে যত অধিক দ্রব্য উৎপাদন করিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে ততই বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছে।” Demant: This Unemployment.
ম্যানচেষ্টারের অর্থনীতিবিদেরা এই একটি ভ্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করিয়া আলোচনা আরম্ভ করেন যে, ল্যাঙ্কাশায়ারের বস্ত্রশিল্প চিরকাল অক্ষুণ্ণ থাকিবে। একথা তাঁহাদের মনে হয় নাই যে, ভবিষ্যতে ইয়োরোপ, আমেরিকা, এমন কি ‘অচল’ এশিয়াও জাগ্রত হইয়া তাঁহাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দাঁড়াইতে পারে। সুতরাং প্রায় অর্ধ শতাব্দী বেশ নির্বিবাদে কাটিয়া গেল এবং ইংলণ্ডের পল্লীগুলি হইতে শতকরা ৮০ ভাগ লোক আসিয়া সহর অঞ্চলে বসতি করিল। কিন্তু কর্মফল ভোগ করিতেই হয়, এবং বর্তমানে গুরুতর বেকার সমস্যা লইয়া ইংলণ্ডের রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদ্দের মাথা ঘামাইতে হইতেছে।
কিছুদিন হইতে আমি চীনের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করিতেছি, কেন না ভারত ও চীনের আর্থিক অবস্থা অনেকটা এক রকম। চীনের লোক সংখ্যা প্রায় ৪৮ কোটী। আমি জনৈক আমেরিকা দেশীয় বিশেষজ্ঞের অভিমত উদ্ধৃত করিতেছি। ইঁহাকে চীনের প্রতি বন্ধুত্বভাবাপন্ন বলা যায় না।
“এই সমস্ত কার্য প্রণালী অবলম্বনের ফল নানা দিকে দেখা যাইতে লাগিল। রেলওয়েগুলি সহস্র সহস্র ভারবাহী কুলীকে কর্মচ্যুত করিল। চীনের যে হাজার হাজার লোক জলপথে নৌকা বাহিয়া জীবিকা অর্জন করিত, বাষ্পীয় পোত তাহাদিগকে বেকার করিয়া তুলিল। ইয়াংসি নদীর মুখে যাহারা নৌকায় করিয়া পণ্যদ্রব্য বহন করিত, তাহাদের কাজ গেল। বিদেশী কারখানা হইতে কলে তৈরী নানা পণ্য চীনে আমদানী হইতে লাগিল, বিদেশী মূলধনে চীনা সহরগুলিতে আধুনিক ধরণে কল কারখানা হইতে লাগিল। তাহার ফলে যে সব কুটীর-শিল্প ও ছোট ছোট ব্যবসা বহু শতাব্দী ধরিয়া টিকিয়া ছিল, সেগুলি ধ্বংস হইতে লাগিল। আর এই সব কারণের সমবায়ে চীনে বেকার সমস্যা ও আর্থিক অভাবের সৃষ্টি হইল।” Abend: Tortured China. pp. 234—5.
পুনশ্চ—“পাশ্চাত্যের যান্ত্রিক সভ্যতার সংস্পর্শ চীনের পক্ষে শোচনীয় দুর্গতির কারণ হইল।”—Abend.
জনৈক প্রসিদ্ধ চীনা মনীষী এ সম্বন্ধে কি বলেন শুনুন:—
“বিদেশী যন্ত্র এবং বিদেশী যন্ত্রজাত পণ্যের আক্রমণ হইতে চীন আত্মরক্ষা করিতে পারে নাই এবং ঐ দুই আক্রমণের ফলে আমাদের লক্ষ লক্ষ দক্ষ কারিগর এবং শ্রমিক অলস ও কর্মচ্যুত হইয়াছে; চীন হইতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আমেরিকায় গিয়া উপস্থিত হইলে ঐ দেশের যেরূপ দুর্দশা আমাদেরও তাহাই হইয়াছে, আমরা ধ্বংসের মুখে চলিয়াছি।”
আর একজন বিশেষজ্ঞও ঠিক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। একটি উন্নতিশীল, শিল্প বিজ্ঞানে সমধিক অগ্রসর জাতির সঙ্ঘর্ষে আসিয়া, আর একটি অতিমাত্রায় রক্ষণশীল জাতির আর্থিক দুর্গতি কিরূপে ঘটে, চীনে তাহারই দৃষ্টান্ত দেখা যাইতেছে।
“জেচেওয়ান প্রদেশ এবং পশ্চিম চীনের লোক সংখ্যা প্রায় ১০ কোটী। এই অঞ্চলে মাল আমদানী রপ্তানীর একমাত্র পথ ইয়াংসি নদী। এইখানে পার্বত্য পথে প্রবল স্রোতস্বতী নদীর উপর দিয়া নৌকা লইতে হইলে বহু নাবিকের প্রয়োজন, এক একখানি নৌকার সঙ্গে পঞ্চাশ হইতে একশত জন নাবিক থাকে। এই ব্যবসায়ে পাঁচ লক্ষ হইতে দশ লক্ষ লোক নিযুক্ত ছিল। সম্প্রতি আবিষ্কার করা গিয়াছে যে, বৎসরের কোন কোন সময়ে বাষ্পীয় পোত এই নদী দিয়া নিরাপদে যাতায়াত করিতে পারে। ইহার পর ব্রিটিশ ও আমেরিকান স্টীমার নদীতে নিয়মিত ভাবে যাত্রী ও মাল বহনের কাজ আরম্ভ করে। কাজ এত লাভজনক যে, একবার যাতায়াতেই ষ্টীমারের খরচা উঠিয়া যায়। স্টীমারে চলাচল বা মাল বহন খুব নিরাপদও হইল। দেশীয় নৌকাগুলি ষ্টীমারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হঠিয়া যাইতে লাগিল। কেন না তাহাদের খরচা বেশী। তাছাড়া, ষ্টীমারের ঢেউ লাগিয়া নৌকাগুলি অনেক সময় ডুবিয়া যাইতেও লাগিল। সুতরাং নৌকার ব্যবসা প্রায় বন্ধ হইল, বহু সংখ্যক মাঝি বেকার হইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে মালবাহী কুলী, দড়িওয়ালা, হোটেল ও রেস্তোরাঁর মালিক প্রভৃতিরও কাজ গেল। অবস্থা অতি শোচনীয়; চীনের সহস্র সহস্র লোকের দৈনিক জীবিকার উপায় হরণ করিয়া মুষ্টিমেয় আমেরিকাদেশীয় জাহাজওয়ালা লাভবান্ হয় এবং এইরূপে তাহারা বহু শতাব্দী হইতে প্রচলিত বৃত্তি ও ব্যবসায়গগুলিকে ধ্বংস করে।”—China: A Nation in Evolution—Monroe.
ভারতেও ধনতান্ত্রিকতা—বিশেষতঃ ব্রিটিশ ধনতান্ত্রিকতা—নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, ভারতীয় প্রাচীন কুটীর শিল্পগুলি ধ্বংস করিয়াছে, কিন্তু তৎপরিবর্তে কর্মচ্যুত নিরন্ন লোকদের কোন নূতন জীবিকার পথ প্রদর্শন করে নাই।” একটি সহজ দৃষ্টান্ত দিলেই কথাটা বুঝা যাইবে।
এতাবৎকাল বাংলার গ্রামের বহু অনাথা বিধবা ধান ভানিয়া কোন মতে জীবিকা অর্জন করিত, নিজেদের শিশু সন্তানগুলির ভরণপোষণ করিত। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার কৃপায় বাংলার নানা স্থানে অসংখ্য চাউলের কল দ্রুত গতিতে চলিতেছে। এক একটি চাউলের কল শত শত অনাথা বিধবার অন্ন কাড়িয়া লইতেছে। এইরূপে জন কয়েক ধনিক সহস্র সহস্র দরিদ্র ভগিনীর জীবিকা হরণ করিয়া নিজেরা ফাঁপিয়া উঠিতেছে। এই কারণেই ভারতের জনসাধারণের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা মহাত্মা গান্ধী সকল সময়েই কলের বিরুদ্ধে অভিযান করিয়াছেন।
“কলের প্রতি—ধনতন্ত্রের প্রতি গান্ধীর প্রবল ঘৃণা আছে। ধনতন্ত্রের ফলে যে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় কৃষক ও শিল্পীর জীবিকার উপায় নষ্ট হইয়াছে, গান্ধীর ঘৃণা তাহারই প্রতিচ্ছায়া মাত্র।
“গান্ধী সর্বত্র কলের অপব্যবহারই দেখিতে পান, বর্তমান যুগের কল-কারখানা জনকয়েক ধনিকের স্বার্থের জন্য সহস্র সহস্র লোককে কিরূপে ক্রীতদাসে পরিণত করিয়াছে, তাহাই তাঁহার চোখে পড়ে। ধনিকের এই শোষণনীতির ফলেই গান্ধীর মনে কল-কারখানার প্রতি ঘৃণার ভাব জন্মিয়াছে। কলের অপব্যবহারের বিরুদ্ধেই গান্ধীর অভিযান। গান্ধী বলেন—‘শুধু মাত্র কলের প্রতি আমার কোন ক্রোধ নাই,—কিন্তু কলের দ্বারা বহু শ্রম বাঁচিয়া যায় এই অস্বাভাবিক ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধেই আমার আক্রমণ। মানুষ কলের দ্বারা শ্রম বাঁচায়, কিন্তু অন্যদিকে তাহার ফলে সহস্র সহস্র লোক কর্মচ্যুত হয়, এবং অনাহারে মরে। আমি কেবল মানব সমাজের একাংশের জন্য কাজ ও জীবিকা চাই না, সমগ্র মানব সমাজের জন্যই চাই। আমি সমগ্র সমাজের ক্ষতি করিয়া মুষ্টিমেয় লোকের ঐশ্বর্য চাই না। বর্তমানে যন্ত্রের সহায়তায় মুষ্টিমেয় লোক জনসাধারণকে শোষণ করিতেছে। এই মুষ্টিমেয় লোকের কর্মের প্রেরণা মানবপ্রীতি নয়, লোভ ও লালসা। এই অবস্থাকে আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়া আক্রমণ করিতেছি।......যন্ত্র মানষকে পঙ্গু ও অক্ষম করিবে না, ইহাই আমি চাই। এমন একদিন আসিবে, যখন যন্ত্র কেবলমাত্র ঐশ্বর্য সংগ্রহের উপায় রূপে গণ্য হইবে না। তখন কর্মী ও শ্রমিকদের এরূপ দুর্দশা থাকিবে না এবং যন্ত্রও মানুষের পক্ষে দুঃখজনক না হইয়া আশীর্বাদস্বরূপ হইবে। আমি অবস্থার এরূপ পরিবর্তন সাধন করিবার চেষ্টা করিতেছি যে, ঐশ্বর্যের জন্য উন্মত্ত প্রতিযোগিতা দূর হইবে এবং শ্রমিকেরা কেবল যে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাইবে তাহা নয়, তাহাদের কাজও তাহাদের পক্ষে দাসত্বের বোঝার মত হইবে না। এই অবস্থায় কল কব্জা কেবল রাষ্ট্রের পক্ষে নয়, যাহারা ঐ সব কল কব্জা চালাইবে, তাহাদের পক্ষেও সত্যকার প্রয়োজনে লাগিবে।” (Lenin and Gandhi by Rene Fillöp Miller).
গান্ধীর অভিমত যে ভ্রান্ত এ কথা কে বলিতে পারে? নিউইয়র্কের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ওয়েসলি-ও-হাওয়ার্ড ধনতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত আধুনিক সভ্যতা সম্বন্ধে কি বলিতেছেন, শুনুন—
“মানুষ আধুনিক সহরগুলি গড়িয়া তুলিয়াছে; নিউইয়র্ক, লণ্ডন, শিকাগো, পারি, বার্লিন, ভিয়েনা, বুয়েনস আয়ার্স—এগুলি সভ্যতার এক একটা বড় চক্র—মানব পরমাণু এখানে চলিতেছে, ঘুরিতেছে, ছুটিতেছে, আসিতেছে, যাইতেছে, অদৃশ্য হইতেছে। সে আকাশস্পর্শী বড় বড় হর্ম্য নির্মাণ করিয়াছে,—যেগুলির মাথা মেঘে যাইয়া ঠেকিয়াছে। বাজ চিল যতদূর উড়িতে পারে, তাহার চেয়েও ৭০০ ফিট উপরে এই সব হর্ম্যের চূড়া, এবং সেখানে মানুষ বাস করে, নিঃশ্বাস ফেলে, বংশবৃদ্ধি করে; এবং এই সমস্ত সহরের নীচে যে বড় বড় রাস্তা তৈরী হইয়াছে, এগুলি প্রশস্ত, আলোকিত, পাথর বাঁধানো। পিপীলিকার সারির মত সহস্র সহস্র প্রাণী এই সব পাতালপুরীর রাস্তা দিয়া তাহাদের গন্তব্য স্থানে যাতায়াত করে।
“মানুষ তাহাদের আধুনিক সহরে চওড়া, খোলা ‘বালুভার’, সুন্দর, স্বাস্থ্যকর যাতায়াতের পথ নির্মাণ করে। তাহারা আবার অন্ধকার, সঙ্কীর্ণ, পার্বত্য গহ্বরের মত গলিও তৈরী করে এবং তাহার মধ্য দিয়া বন্যার মত সহস্র সহস্র মানুষের স্রোত চলে। তাহারা বড় বড় উদ্যান নির্মাণ করে, মর্মর মূর্তি বসায়, পশুশালা তৈরী করে, হাঁসপাতাল স্থাপন করে। অন্যদিকে আবার স্যাঁতসেতে জনবহুল বস্তী, অন্ধকারময় ঘর, অস্বাস্থ্যকর পল্লী, অনাথালয়, পাগলা গারদ, জেলখানা—ইহাও তাহাদের কীর্তি! এই সব বস্তীর স্বল্পালোক কক্ষে যে সব শিশু জন্মগ্রহণ করে, তাহারা কখন নীল আকাশ দেখে না, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলিতে পায় না, এবং যাহারা কখনও শ্যামল শস্যক্ষেত্র দেখে নাই, বা শান্তিপূর্ণ বনভূমিতে ভ্রমণ করিবার সৌভাগ্য লাভ করে না এরূপ প্রসূতিরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ইহারই নাম সভ্যতা!!
পাতালপুরী
“মানুষের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পাতালপুরীর সৃষ্টি হইয়াছে। এই পাতালপুরী কল-কারখানার আবর্জনা, মানব জগতের আবর্জনা, সমাজের পরগাছা। এই পাতালপুরীতে ছেলেরা চুরী করিতে শিখে, মেয়েরা রাস্তায় বিচরণ করিতে শিখে। এখানে মদ্যপ বন্ধু, দুশ্চরিত্র, পতিত, গণিকা, গাঁট-কাটা, নিঃস্ব, বেকার, ভবঘুরেদের আড্ডা। যাহারা রাত্রির অন্ধকারে শ্বাপদের মত বিচরণ করে, সকালের আলোতে অদৃশ্য হয়; যাহারা শতছিন্ন, কীটদষ্ট, দুর্গন্ধময় কাপড় চোপড় পরিয়াই ঘুমায়, জঞ্জাল, আবর্জনা, অভাব, দারিদ্র্য, অনাহার, দুদশা ও ব্যাধির মধ্যে বাস করে—এই পাতালপুরী তাহাদেরই বিহার ক্ষেত্র।
“এই দুঃখময় পুরীতে, সমাজের বিধি ব্যবস্থা, দয়া ও সহানুভূতির বাহিরে শিশুদের গলা টিপিয়া মারা হয়, জরাজীর্ণ বৃদ্ধেরা পথে পরিত্যক্ত হয়, দুর্বল নিপীড়িত হয়, বিকৃত মস্তিকদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন হয়। তরুণেরা কলুষিত হয়। এই জনবহুল দরিদ্র বস্তীতে স্ত্রীলোকদের আঁতুড় ঘরেই প্রতারক ও গুণ্ডারা জুয়া খেলে, হল্লা করে। একদিকে মুমূর্ষুরা বাঁচিবার জন্য আঁকুপাঁকু করে, অন্যদিকে চোরেরা নেশা খাইয়া মারামারি করে। শিশুরা খেলা করে, কলরব করে; অন্যদিকে গণিকারা মদ খায়, মাতলামি করে। এই পাতালপুরীতে শ্রেণিভেদ নাই, জাতিভেদ নাই। সকলেই এক ভাষায় কথা বলে, নর্দমা ও আস্তাকুঁড়ের ভাষা। চীনাম্যান, শ্বেতাঙ্গিনী, তরুণ তরুণী, নিগ্রো, জিপ্সী, জাপানী, মেক্সিকোবাসী, নাবিক, ভবঘুরে, পলাতক, নৈরাজ্যবাদী, বন্দুকধারী ডাকাত, ভিক্ষুক, গাঁটকাটা জুয়াচোর, গুপ্ত ব্যবসায়ী—সকলেই এখানে বন্ধু।
“সুতরাং দেখা যাইতেছে, যান্ত্রিক সভ্যতা ও ‘র্যাশনালিজেশান্’[৩] উভয় মিলিয়া পৃথিবীকে দুঃখময় করিয়া তুলিয়াছে। যথা,—যুক্তরাষ্ট্রের গবর্ণমেণ্টের সম্মুখে বিষম সমস্যা, তাহার বাজেটে ২০ কোটী ডলার ঘাট্তি। ১৯৩০ সালে অক্টোবর মাসে যত মোটর যান তৈরী হইয়াছে, এবৎসর (১৯৩১) অক্টোবর মাসে তাহা অপেক্ষা শতকরা ৪০ ভাগ কম হইয়াছে, এবং এ বৎসরের প্রথম দশ মাসে ১৯৩০ সালের তুলনায় শতকরা ২৯ ভাগ কম হইয়াছে। নভেম্বর মাসে শতকরা ৮০ ভাগ কম মোটর যান তৈরী হইয়াছে। ২৯টি কারখানার মধ্যে ১০টি একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানী বাণিজ্য বহুল পরিমাণে হ্রাস পাইয়াছে, ১৯২৯ সালে জানুয়ারী হইতে আগষ্ট পর্যন্ত উহার মূল্যের পরিমাণ ছিল ৬৮ কোটী ১০ লক্ষ পাউণ্ড, ১৯৩০ সালে ঐ সময়ে হইয়াছিল ৫১ কোটী ৯০ লক্ষ পাউণ্ড, এবৎসর হইয়াছে মাত্র ৩২ কোটী ৬০ লক্ষ পাউণ্ড। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারের সংখ্যা এক কোটীরও বেশী।
“ধনতন্ত্রের উন্মত্ততা কতদূর চরমে উঠিয়াছে, তাহার নিদর্শন,—দেশে প্রচুর কাঁচা মাল থাকিতেও মানুষ দুর্দশা ভোগ করিতেছে, না খাইয়া মরিতেছে। গম গুদামে পচিতেছে। চিনি নষ্ট করিয়া ফেলা হইতেছে। কফি সমুদ্রের জলে ফেলিয়া দেওয়া হইতেছে, ভুট্টা পোড়ান হইতেছে, তুলা পোড়ান হইতেছে। কিন্তু এই অতি-প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ খাইতে পাইতেছে না, তাহার জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যক জিনিষ মিলিতেছে না। এই বিবৃতি বাস্তব ঘটনার হুবহু, চিত্র। স্থানীয় সংবাদপত্র (Deutsche Allgemeine Zeitung) সম্প্রতি ‘পৃথিবীতে ১ কোটী ১২ লক্ষ টন অতিরিক্ত গম’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখিয়াছেন যে, আমেরিকাতে গম বাষ্পীয় যন্ত্রে পোড়ান হইতেছে। ব্রাজিল সব চেয়ে বেশী কফি উৎপন্ন করে,—সেই দেশে এই বৎসরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৫,৯৮,৭৫,২০০ কিলো কফি নষ্ট করিয়া ফেলা হইয়াছে।”—লিবার্টির বার্লিনের সংবাদদাতা, ৭ই জানুয়ারী, ১৯৩২।
ধনতান্ত্রিকতা ও কল-কারখানার পরিণাম অতি-উৎপাদনের আর একটা কুফল হয়। অতিরিক্ত মজুদ পণ্য বিক্রয়ের জন্য সিনেমা, বায়স্কোপ প্রভৃতির সহযোগে বিরাট ভাবে প্রচার করিবার প্রয়োজন হয়,—সরল প্রকৃতির কৃষকদের মনে নানা রূপে বিকৃত রুচি, কুচিন্তা ও হীন লালসার ভাব জাগ্রত করা হয়। এই প্রকার দুর্নীতিপূর্ণ মিথ্যা প্রচার কার্য দ্বারা লোকের অপরিসীম ক্ষতি হয়। জনসাধারণের মধ্যে চা’এর প্রচলন করিবার জন্য যে সব কৌশলপূর্ণ প্রচার করা হয় এবং তাহার ফলে যে ঘোর অনিষ্ট হয়, তৎসম্বন্ধে ইতিপূর্বে আমি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছি। কিছুদিন হইল, ইয়োরোপে চা’এর বাজার সস্তা হওয়াতে নিরক্ষর জনসাধারণের মধ্যে ইহার প্রচলনের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করা হইতেছে। তাহাদের মধ্যে ৫।৬ কোটী লোক যে অসীম দুর্গতির মধ্যে বাস করে, পেট ভরিয়া খাইতে পায় না, অনাহারে থাকে, তাহাতে কি? ধনতন্ত্র নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে কোন হীন উপায় অবলম্বন করিতে প্রস্তুত এবং হতভাগ্য দরিদ্রদের নানা প্রলোভনে ভুলাইয়া তাহারা ফাঁদে ফেলে। চা ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক, ইহা ফুসফুসের রোগ নিবারণ করে—ইত্যাদি নানারূপ অলীক যুক্তি প্রদর্শন করা হয়। পাঁচ বৎসর পূর্বে জার্মানী ভ্রমণকালে আমি একটি বৃহৎ রাসায়নিক কারখানায় গিয়াছিলাম। সেখানে প্রভূত পরিমাণে কোকেন তৈরী হইতেছে দেখিয়া আমি বিস্মিত হইলাম। আরও কয়েকটি কারখানায় এইভাবে কোকেন তৈরী হয়, জাপানেও কোকেন তৈরী হইয়া থাকে। এই সব কোকেনের সবটাই ঔষধার্থ প্রয়োজন হয় না। বিশ্বরাষ্ট্রসঙ্ঘ কিছুদিন হইল গোপনে কোকেন চালান নিবারণের জন্য প্রশংসনীয় চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও পৃথিবীর নানা দেশে গোপনে কোকেন চালানীর ব্যবসা চলিতেছে। ধনতন্ত্র নির্দয়, নিষ্ঠুর, সে কেবল নিজের পকেট ভর্তি করিতে জানে।[৪]
প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির পত্নী মিসেস হার্ডি নিজেও একজন লেখিকা। আধুনিক সভ্যতা সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলিয়াছেন:—
“অনেকের নিকট সভ্যতার অর্থ ধনৈশ্বর্য। যাহাদের মোটর গাড়ী আছে, টেলিফোন আছে, যাহারা প্রতি রাত্রে বেতারবার্তা শোনে, সেই সমস্ত লোকই তাহাদের দৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা বেশী সভ্য। যাহারা নানা প্রকারের যান্ত্রিক আবিষ্কারকে নিজেদের আমোদ প্রমোদের কাজে লাগাইতে পারে,—অধিকাংশ লোক তাহাদিগকেই সভ্য মনে করে।
“যদি কোন ব্যক্তি এই সমস্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্র ও কল কব্জার সাহায্য গ্রহণ না করে, তবে তাহার পক্ষে উহা আত্মত্যাগের পরিচয় হইবে, সন্দেহ নাই, কিন্তু তৎসত্ত্বেও, বিবেচনা করিলে বুঝা যাইবে যে—এই সব কলকব্জা মানুষের প্রকৃত উন্নতির পক্ষে বাধা স্বরূপ। এই যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে মানুষের জীবন কলকব্জার দাস হইয়া পড়িতে পারে, ইহাই সর্বাপেক্ষা বড় বিপদ।
“এই বিষয়ে আলোচনা করিবার সময় আমার মন স্বভাবতঃই গান্ধীর উপদেশের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল; মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় সংস্কারক—কেহ কেহ তাঁহাকে বিপ্লববাদীও বলিয়া থাকেন। এই যান্ত্রিক যুগের ঐশ্বর্যের প্রতি তাঁহার অসীম বিরাগ, কেননা মানুষের প্রকৃত সুখ ও উন্নতির পক্ষে তিনি এ সমস্তকে বাধা স্বরূপই মনে করেন। তাঁহার উপদেশ এই যে, সরল স্বাভাবিক জীবনই মানুষের আত্মাকে বিশুদ্ধ ও পবিত্র করে। যীশু খৃষ্টের “সার্মন অন্ দি মাউণ্ট”-এ কথিত উপদেশের সঙ্গে ইহার বহুল সাদৃশ্য আছে।
“এক্ষেত্রে তিনি একাকী নহেন। আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান চিন্তানায়কের মুখে শুনিয়াছি যে, মানব সভ্যতার রক্ষা পাইবার একমাত্র উপায় প্রাচীন সহজ সরল জীবনযাত্রা প্রণালীতে প্রত্যাবর্তন করা। তিনি ইংরাজ। এই দুইজন ব্যক্তির (মহাত্মা গান্ধী ও ইংরাজ মনীষী) চরিত্র ও জীবন প্রণালী সম্পূর্ণ বিভিন্ন—তৎসত্ত্বেও তাঁহাদের আদর্শ এক—চিন্তায়, কার্যে ও লক্ষ্যে সব দিক দিয়া নিঃস্বার্থ পবিত্র জীবন। খৃষ্টধর্ম প্রবর্তক এইরূপ আদর্শই প্রচার করিয়াছিলেন।”
জাপানও পাশ্চাত্যদেশকে অনুকরণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে, ফলে সে ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ফর্মোজা ও কোরিয়া তাহার কবলিত হইয়াছে, এখন মাঞ্চুরিয়ার উপর তাহার শ্যেনদৃষ্টি পড়িয়াছে। তবুও, জগদ্ব্যাপী আর্থিক দুর্দশা তাহাকেও আক্রমণ করিয়াছে এবং সেও ইহার প্রভাব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতেছে।
‘ইংলিশম্যানের’ টোকিওস্থিত সংবাদদাতা ১৯৩১ সালের ৯ই অক্টোবর তারিখে লিখিয়াছেন,—
“৪০ বৎসর পূর্বে জাপান কাজের অভাব বোধ করিত না, অতীত কাল হইতে সেখানে এমনই একটি সুন্দর সরল সভ্যতা গড়িয়া উঠিয়াছিল। লোকে আলু খাইয়া সানন্দে জীবন যাপন করিত, ছুটীর দিনে কখন কখন ভাত খাইত, কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার যান্ত্রিক হাওয়ার সংস্পর্শে আসিয়া তাহারা ক্রমেই সেই প্রাচীন সভ্যতা হইতে দূরে সরিয়া যাইতেছে। এখন তাহারা কাজ করে, তাহাদিগকে কাজ করিতেই হইবে, অন্যথা না খাইয়া মরিতে হইবে। এমনই ঘটিয়া থাকে।”
এই অধ্যায় মুদ্রিত হইবার পূর্বে নরম্যান অ্যাঞ্জেল ও হ্যারল্ড রাইট কর্তৃক লিখিত “গবর্ণমেণ্ট কি বেকার সমস্যার প্রতিকার করিতে পারেন?” নামক গ্রন্থখানির প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। উক্ত গ্রন্থ হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া আমি এই অধ্যায় শেষ করিব:—
“ভারমণ্টের কোন পার্বত্য অঞ্চলে গেলে দেখা যাইবে যে, একটি বৃহৎ কৃষিক্ষেত্র ও তৎসংশ্লিষ্ট বাড়ী ইমারত প্রভৃতি খালি পড়িয়া রহিয়াছে, মালিকেরা ঐ সব পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে,—সামান্য কিছু বাকী খাজনা দিলেই উহা এখন পাওয়া যাইতে পারে। নিউ ইংলণ্ড ও কানাডার সমুদ্রোপকূলেও এইরূপ দৃশ্য চোখে পড়ে। কিন্তু এই কৃষিক্ষেত্র, বাড়ী ইমারত প্রভৃতির আয়েই পূর্বে একটি বৃহৎ পরিবারের সুখ স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইত। ঐ পরিবারে পিতামাতা, তেরটি সন্তান, দুইজন গরীব আত্মীয় ছিল। তাহারা কৃষিকার্যের জন্য যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করিত, তাহা আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির তুলনায় আদিম যুগের ছিল বলিলেই হয়। আমরা এখন বাষ্পীয় ও বৈদ্যুতিক শক্তি, হারভেষ্টর, ট্রাক্টর, সেপারেটর প্রভৃতি যন্ত্র ব্যবহার করি,—তাহারা ব্যবহার করিত মানুষের পেশী, বলদ, কাস্তে, কোদালি প্রভৃতি। তবু তাহারা ভাল খাদ্য খাইত, ভাল পোষাক পরিত, ভাল গৃহে আরামে থাকিত। তাহাদের কোন শারীরিক অভাব ছিল না। কৃষিক্ষেত্র সুদূর অঞ্চলে অবস্থিত, এবং এখনকার যানবাহনের কোন ব্যবস্থা না থাকিলেও, স্ব-সম্পূর্ণ ছিল।
“এই বিংশ শতাব্দীর লোকেদের উন্নততর যন্ত্রপাতি, প্রাকৃতিক শক্তির উপর অধিকতর অধিকার, এবং বহু গুণে অধিক উৎপাদিকা শক্তি থাকা সত্ত্বেও, জীবিকা অর্জন করিতে তাহারা সক্ষম নহে কেন? তাহাদের অন্য অনেক বিষয়ে বেশী সুবিধা থাকিতে পারে, কিন্তু আদিম যুগের যন্ত্রপাতি ব্যবহারকারী ভারমণ্ট কৃষকদের তুলনায় এ ক্ষেত্রে তাহারা পশ্চাৎপদ।
“প্রকৃত ব্যাপার এই যে, এখন আর পণ্য উৎপাদক ও পণ্য ব্যবহারকারী এক ব্যক্তি নহে। পণ্য উৎপাদনকারী এখন জানে না বাজারে কি জিনিষ প্রয়োজন হয়, এবং কি জিনিষ প্রয়োজন হইবে। কি জিনিষের চাহিদা আছে, কি জিনিষ সরবরাহ করিতে হইবে, কি কাজ করিতে হইলে, কত কর্মী প্রয়োজন হইবে,—ঐ সব বিষয় ভারমণ্টবাসীদের আয়ত্তের মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন বহ,— বিস্তৃত শ্রমবিভাগের ফলে, উহা আয়ত্তের বাহিরে গিয়া পড়িয়াছে। ভারমণ্টে যখন গম ও ভুট্টা উৎপাদন করা হইত, তখন কৃষক পরিবার জানিত যে, তাহাদের শ্রম বৃথা যাইবে না, কেননা ঐগুলি প্রধানতঃ তাহাদের ব্যবহারেই লাগিবে, নিজেদের নিকটেই তাহারা লাভের মূল্যে উহা বিক্রয় করিতে পারিবে। কিন্তু ডাকোটাতে যখন দশ বৎসরের সঞ্চিত মূলধন লইয়া দুই তিন হাজার একর জমিতে গম উৎপাদন করা হয়,—বিক্রয়লব্ধ অর্থ হইতে বহুব্যয়সাধ্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়, তখন পারি, মস্কো বা বুয়েনস-আয়ার্সের কোন ঘটনায়— ফসলের দাম এত নামিয়া যাইতে পারে যে, উৎপাদনের ব্যয়ও তাহাতে উঠে না। ফসলের উপযুক্ত মূল্য পাইতে হইলে যে সব ব্যবস্থার প্রয়োজন, তাহা বিংশ শতাব্দীর কৃষকদের আয়ত্তের বাহিরে।”
ইহা দঃখজনক, কিন্তু ইহা সত্য এবং অবস্থা ক্রমেই মন্দের দিকে যাইতেছে। একজন প্রসিদ্ধ আমেরিকাবাসী লেখক বলিয়াছেন (১৯১৮):—“আমরা শিল্পোন্নতির জন্য নানারূপ বৈজ্ঞানিক উপাদান, যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করিতেছি, কিন্তু তাহার মূল্যস্বরূপ মানুষের দুঃখ ও বেকার সমস্যা আমদানী করিতেছি।”
- ↑ Henry Ford: My Life and Work.
- ↑ “কলকারখানা করিয়া শিল্প গঠনের ঝোঁক আমাদের দেশের বহু নেতা ও কর্মীর মধ্যে দেখা দিয়াছে। কিন্তু ইয়োরোপ ও আমেরিকার অবস্থা দেখিয়া তাঁহাদের সাবধান হওয়া উচিত। জনৈক মনীষী বলিয়াছেন—শিল্পপ্রধান দেশের অর্ধেক লোক যন্ত্রযোগে শ্রম বাঁচাইবার কৌশল আবিষ্কারের জন্য মাথা ঘামাইতেছে, আর অপরার্দ্ধ বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা করিতেছে।— অধুনাতন হিসাবে ইংলণ্ডের বেকার সংখ্যা ২০ লক্ষ। মিঃ টমাসের মতে জার্মানীর বেকার সংখ্যা ৩০ লক্ষ, ইটালীর ৫ লক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার বেকার সংখ্যা ৩০ লক্ষ হইতে ৬০ লক্ষ।”— মাদ্রাজ দেশী শিল্প প্রদর্শনী উদ্বোধন উপলক্ষে আমার বক্তৃতা, ১৫ই জুলাই, ১৯৩০।
- ↑ ‘র্যাশনালিজেশানের’ উদ্দেশ্য বিদেশী শিল্প-ব্যবসায়ীর আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার্থ কোন দেশের শিল্প বাণিজ্যকে সংঘবদ্ধ করা।
- ↑ “কৃত্রিম উপায়ে মানুষের অভাব ও প্রয়োজন সৃষ্টি করিবার জন্য বিপুল চেষ্টা করা হয় এবং এইভাবে বেকার সমস্যাকে স্থায়ী করা হয়।...... জনসাধারণকে আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক শিল্পজাত ব্রুয় করাইবার জন্য নানাভাবে প্রচারকার্য চলিয়া থাকে এবং সেজন্য যথেষ্ট শক্তি ব্যয় করিতে হয়”—Demant. স্যার এ. স্লেটার এবং আরও অনেকে পণ্য বিক্রয়ের জন্য “কৃত্রিম উপায়ে মানুষের মনে নূতন নূতন অভাব সৃষ্টি করা” সম্বন্ধে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন—The Causes of War.