আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
চরকার বার্তা—কাটুনীর বিলাপ
গত দশ বৎসর যাবৎ আমি চরকার বার্তা প্রচার করিবার জন্য বহু পরিশ্রম করিয়াছি। অনেকে আমার এই নূতন বাতিক দেখিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন। মহাত্মা গান্ধী যেদিন চরকার বার্তা প্রচার করেন, তখন হইতেই আমি ইহার সত্য উপলব্ধি করিয়াছি। আমি নিজে ক্ষুদ্রাকারে হইলেও একজন শিল্প ব্যবসায়ী, সুতরাং প্রথমতঃ আমি এই আদিম যুগের যন্ত্রটির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশই করিয়াছিলাম। কিন্তু বিশেষ চিন্তার পর আমি বুঝিতে পারিলাম—প্রত্যেক গৃহস্থের পক্ষে এই চরকা কত উপকারী, অবসর সময়ে এই চরকায় কত কাজ হইতে পারে। ভারতের যে সব লক্ষ লক্ষ লোক অতি কষ্টে অনশনে অর্দ্ধাশনে জীবন যাপন করে, তাহাদের পক্ষে এই চরকা জীবিকার্জনের একমাত্র গৌণ উপায়। চরকাকে দরিদ্রের পক্ষে দুর্ভিক্ষের কবল হইতে আত্মরক্ষার উপায় বলা হইয়াছে। এ উক্তি সঙ্গত। খুলনা দুর্ভিক্ষ এবং উত্তরবঙ্গ বন্যা সম্পর্কে সেবাকার্যে কাজ করিবার সময় আমি বুঝিতে পারিয়াছি যে, যদি এক শতাব্দী পূর্বে চরকা পরিত্যক্ত না হইত, তবে উহা অনাহারক্লিষ্ট জনসাধারণের পক্ষে বিধাতার আশীর্বাদ স্বরূপ হইতে পারিত। এই বিষয়টি সুস্পষ্ট করিবার জন্য আমি কয়েকজন দূরদর্শী, উদারচেতা, প্রসিদ্ধ ইংরাজ মনীষীর অভিমত উদ্ধৃত করিতেছি। ইঁহারা মহাত্মা গান্ধীর অভ্যুদয়ের পূর্বেই চরকার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। কোলব্রুকের নামই সসম্মানে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য।
মহাত্মা গান্ধীর জন্মের প্রায় ৭৫ বৎসর পূর্বে এই খ্যাতনামা শাসক এবং ততোধিক খ্যাতনামা প্রাচ্য-বিদ্যাবিশারদ চরকার গুণগান করিয়াছিলেন। সংস্কৃত বিদ্যার উন্নতির জন্য হেনরী টমাস কোলব্রুক একা যাহা করিয়াছেন, তাহা আর কোন ইংরাজ করিতে পারেন নাই। তিনিই প্রথমে বেদান্তের মহান্ সৌন্দর্য পাশ্চাত্য জগতের সম্মুখে উপস্থিত করেন; তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য মনীষিগণের নিকট হিন্দুর ষড়দর্শনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা করেন। তিনিই প্রথমে বহু প্রবন্ধ লিখিয়া প্রমাণ করেন যে, পাটীগণিত ও বীজগণিতে হিন্দুরাই সর্বাগ্রে পথ প্রদর্শন করিয়াছিল। কোলব্রুক ১৮ বৎসর বয়সে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে সামান্য একজন কেরাণী হইয়া ভারতে আসেন। অদম্য উৎসাহ ও অধ্যবসায়ের ফলে সংস্কৃত ভাষায় তিনি যেরূপ পাণ্ডিত্য লাভ করেন, তাহার তুলনা বিরল।
লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অল্প কাল পরে কোলব্রুক সিভিল কর্মচারী হিসাবে বাংলার সর্বত্র ভ্রমণ করেন এবং বাংলার কৃষকদের অবস্থা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ১৮০০ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত তৎকৃত Husbandry of Bengal নামক পুস্তক খানি বহু মূল্যবান্ তথ্যে পূর্ণ।
চরকাকে দরিদ্রের সহায় রূপে বর্ণনা করিয়া তিনি বলেন,—“ব্রিটিশভারত যে সভ্য গভর্ণমেণ্ট কর্তৃক শাসিত হইতেছে, তাঁহাদের পক্ষে এদেশের অতি দরিদ্রদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করা তুচ্ছ বিষয় নহে। বর্তমানে এই প্রদেশে সাধারণের পক্ষ হইতে দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্যের কোন ব্যবস্থা নাই। যে সব বিধবা ও অনাথা স্ত্রীলোকেরা রুগ্ন বলিয়া অথবা সামাজিক মর্যাদার জন্য কৃষিক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজ করিতে পারে না, তাহাদের পক্ষে জীবিকার্জনের একমাত্র উপায় চরকায় সূতাকাটা। পুরুষেরা যখন শারীরিক অক্ষমতা বা অন্য কোন কারণে শ্রমের কাজ না করিতে পারে, তখনও স্ত্রীলোকেরা কেবল মাত্র এই উপায়েই পরিবারের ভরণপোষণ করিতে পারে। ইহা সকলের পক্ষেই সহায় স্বরূপ, এবং জীবিকার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় না হইলেও, দরিদ্রের দুর্দশা অনেকটা লাঘব করিতে পারে। যে সমস্ত পরিবার এক কালে ধনী ছিল, দারিদ্র্যের দিনে তাহাদের দুর্দশাই সব চেয়ে বেশী মর্মান্তিক হয়। গবর্ণমেণ্টের নিকট আইনতঃ তাহাদের দাবী থাকুক আর নাই থাকুক, মনুষ্যত্বের দিক হইতে তাহারা নিশ্চয়ই গবর্ণমেণ্টের সহানভূতি দাবী করিতে পারে।
“এই সমস্ত বিবেচনা করিলে বুঝা যাইবে, দরিদ্রের পক্ষে সহায় স্বরূপ এমন একটি শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া নিশ্চয়ই উচিত। ইহা দ্বারা ব্যবসায়ের দিক হইতেও ইংলণ্ডের যে লাভ হইবে, তাহা প্রমাণ করা যায়। বাংলা দেশ হইতে তুলার সূতা, কাঁচা তূলা অপেক্ষা সস্তায় ইংলণ্ডে আমদানী করা যাইতে পারে। আয়র্লণ্ড হইতে বহুল পরিমাণে ‘লিনেন’ এবং পশমের সূতা বিনাশুল্কে ইংলণ্ডে আমদানী হয়। ইহা যদি ইংলণ্ডের পক্ষে ক্ষতিকর না হয়, তবে বাংলা হইতে আমদানী সূতার উপরে কেন অতিরিক্ত শুল্ক বসান হয়? ইহা ব্যতীত এই সূতা আমদানীর বিরুদ্ধে আরও নানা রূপ বাধা সৃষ্টি করা হইয়াছে।”
ইহার উপর মন্তব্য প্রকাশ নিষ্প্রয়োজন। ১৮০৮—১৮১৫ খৃঃ পর্যন্ত উত্তর ভারতের আর্থিক অবস্থা আলোচনা করিয়া বুকানন হ্যামিলটন একখানি বহি লিখেন। উহা হইতে কতকগুলি তথ্য আমি উদ্ধৃত করিতেছি।—
“কৃষির পরেই সূতাকাটা ও বস্ত্র বয়ন ভারতের প্রধান জাতীয় ব্যবসা। সমস্ত কাটুনীই স্ত্রীলোক এবং জেলায় (পাটনা সহর ও বিহার জেলা) ডাঃ কাননের গণনা মতে তাহাদের সংখ্যা ৩,৩০,৪২৬। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই কেবল বিকালে কয়েক ঘণ্টা মাত্র সূতা কাটে এবং প্রত্যেকে গড়ে বার্ষিক ৭৵৮ পাই মূল্যের সূতা কাটে। সুতরাং এই সমস্ত কাটুনীদের কাটা সূতার মোট মূল্য আনুমানিক (বার্ষিক) ২৩,৬৭,২৭৭ টাকা। এই ভাবে হিসাব করিলে দেখা যায়, ইহাদের সূতার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচা তুলার মূল্য ১২,৮৬,২৭২ টাকা এবং কাটুনীদের মোট লাভ থাকে ১০,৮১,০০৫ টাকা অর্থাৎ প্রত্যেক কাটুনীর বার্ষিক লাভ গড়ে ৩৷০ আনা। কয়েক বৎসর হইতে সূক্ষ্ম সূতার চাহিদা কমিয়া যাইতেছে। সুতরাং স্ত্রীলোক কাটুনীদের বড়ই ক্ষতি হইতেছে।
“সূতাকাটা ও বস্ত্র বয়ন সাহাবাদ জেলায় প্রধান জাতীয় ব্যবসা। এই জেলায় প্রায় ১,৫৯,৫০০ জন স্ত্রীলোক সূতাকাটার কাজে নিযুক্ত আছে এবং তাহাদের উৎপন্ন সূতার মোট মূল্য বার্ষিক ১২,৫০,০০০ টাকা।”[১]
সূতাকাটা ও বস্ত্রবয়নের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। পূর্ণিয়া জেলার সম্বন্ধে বলা হইয়াছে,— “কার্পাস বস্ত্র বয়নকারীর সংখ্যা বিস্তর এবং তাহারা গ্রামের লোকদের ব্যবহারের জন্য মোটা কাপড় বুনে। সূক্ষ্ম বস্ত্র বুনিবার জন্য সাড়ে তিন হাজার তাঁত আছে। তাহাতে ৫,০৬,০০০ টাকা মূল্যের বস্ত্র উৎপন্ন হয় এবং মোট ১,৪৯,০০০ টাকা লাভ হয় অর্থাৎ প্রত্যেক তাঁতে বার্ষিক গড়ে ৮৬ শিলিং লাভ হয়। মোটা কাপড় বুনিবার জন্য ১০ হাজার তাঁত নিযুক্ত আছে এবং তাহাদের উৎপন্ন কাপড়ের মোট মূল্য ১০,৮৯,৫০০ এবং মোট ৩,২৪,০০০ টাকা লাভ হয়; অর্থাৎ প্রত্যেক তাঁতে বার্ষিক গড়ে ৬৫ শিলিং লাভ হয়।”
রমেশ দত্ত কৃত ‘ভারতের আর্থিক ইতিহাস’ গ্রন্থ হইতে এই সমস্ত বিবরণের কিয়দংশ উদ্ধৃত হইয়াছে। তিনি উপসংহারে বলিয়াছেন—“ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত ভারতের লোকেরা নানা শিল্প কার্যে নিযুক্ত ছিল। বস্ত্র বয়ন তখনও তাহাদের প্রধান বৃত্তি ছিল। লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোক সূতা কাটিয়া জীবিকার্জন করিত।”
এইচ. এইচ. উইলসন মিল-কৃত ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের পরিশিষ্ট লিখেন। ভারতের বয়ন শিল্প কিভাবে ধ্বংস হইয়াছিল তৎসম্বন্ধে ক্ষোভের সঙ্গে তিনি নিম্নলিখিত রূপ বর্ণনা করিয়াছেন:—“পরাধীন ভারতবর্ষের উপর প্রভু ব্রিটেন যে অন্যায় করিয়াছে, ইহা তাহার একটি শোচনীয় দৃষ্টান্ত। কমিশনের সাক্ষ্যে (১৮১৩ খৃঃ) বলা হইয়াছে যে, ভারতের কার্পাস ও রেশমের বস্ত্রাদি ইংলণ্ডের ঐ শ্রেণীর বস্ত্রজাত অপেক্ষা শতকরা ৫০।৬০ টাকা কম মূল্যে বিক্রয় হইত। সুতরাং ভারতীয় আমদানী বস্ত্রের উপর শতকরা ৭০।৮০ ভাগ শুল্ক বসাইয়া অথবা ঐ গুলির আমদানী একেবারে নিষিদ্ধ করিয়া ইংলণ্ডের বস্ত্রজাতকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হইল। যদি এরূপ করা না হইত, যদি এই সমস্ত অতিরিক্ত শুল্ক ও নিষেধ বিধি জারি না হইত, তবে পেইসলি ও ম্যানচেষ্টারের কল-কারখানাগুলি গোড়াতেই বন্ধ হইয়া যাইত এবং বাষ্পীয় শক্তির দ্বারাও তাহাদিগকে চালানো যাইত না। ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসস্তুপের উপর এগুলি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ভারত যদি স্বাধীন হইত, তবে সে প্রতিশোধ লইত, ব্রিটিশ পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক বসাইত এবং এইরূপে নিজের শিল্পকে ধ্বংসমুখ হইতে রক্ষার ব্যবস্থা করিত। এই আত্মরক্ষার উপায় তাহাকে অবলম্বন করিতে দেওয়া হয় নাই,—তাহাকে বিদেশীর দয়ার উপরে নির্ভর করিতে হইয়াছিল। ব্রিটিশ পণ্য জোর করিয়া বিনা শুল্কে তাহার উপর চাপানো হইল এবং বিদেশী শিল্প ব্যবসায়ী অবৈধ রাজনৈতিক অস্ত্রের সাহায্যে তাহার প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেষণ করিল,—যে প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে বৈধ প্রতিযোগিতায় তাহার জয়লাভের কোন সম্ভাবনা ছিল না।”
ভারতের আর একটি শিল্পও ইংরাজ এই ভাবে ধ্বংস করিয়াছেন। ভারতের তাঁতে বোনা চট ও থলে ভারতের বাহিরে নানাদেশে চালান যাইত। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দেশীয় শিল্পটির খুব প্রসার হয়। ইংলণ্ড কিরূপে এই শিল্প ধ্বংস করে, আর একটি অধ্যায়ে তাহা বিবৃত করিব।
বাংলা দেশে হাতে বোনা মোটা কাপড়ের শিল্প আমদানী বিদেশী কাপড়ের প্রতিযোগিতায় বহু দিন পর্বেই লুপ্ত হইয়াছে। অন্যান্য প্রদেশও এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়াছে। কেন লোকে দিনের পর দিন কষ্ট করিয়া সূতা বুনিবে ও কাপড় তৈরী করিবে,—ল্যাঙ্কাশায়ার ও জাপান ত তাহাদের কলে তৈরী সূক্ষ্ম বস্ত্রজাত লইয়া, ঘরের দরজায় সর্বদাই হাজির আছে! বাংলার ঋণগ্রস্ত অনশনক্লিষ্ট কৃষকগণ, তোমরা তোমাদের দেশের ভদ্রলোকদের অনুসরণ করিয়া নিজেদের দুঃখকষ্ট বিস্মৃত হও! হুকা ছাড়িয়া সিগারেটের ধূম পান কর, পায়ে না হাঁটিয়া মোটর বাসে চড়, চা খাইয়া ক্ষুধা নষ্ট কর—তাহা হইলেই আহারের ব্যয় আর বেশী লাগিবে না। এবং এই সব বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিদেশী বণিকদের পকেট ভর্তি করিয়া দাও। যখন মামলামোকদ্দমা করিতে সহরে যাইবে, তখন সিনেমা দেখিতে ও টর্চলাইট কিনিতে ভুলিও না। পাঠকগণ ক্ষমা করিবেন, বড়দুঃখেই আমি এই সব কথা লিখিতেছি।
অর্থনীতি-বিদেরা আমাদের বলেন যে, দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য যখন সস্তায় বিদেশ হইতে আমদানী করা যায়, তখন সেইগুলি এদেশে উৎপাদন করা—পাগলামি ভিন্ন আর কিছুই নহে, এই কারণে তাঁহারা আমাদের লপ্ত স্বদেশী পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার প্রতি বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করেন। বর্তমান যুগে চরকা প্রচলন করিবার চেষ্টা, আদিম যুগের কোন লুপ্ত প্রণালীকে পুনরুজ্জীবিত করিবার চেষ্টার মতই হাস্যকর। কিন্তু ইহার ভিতর একটা যে মিথ্যা যুক্তি আছে, তাহা আশ্চর্যরূপে তাঁহাদের দৃষ্টি এড়াইয়া যায়। বাংলার অধিকাংশ স্থানে একমাত্র প্রধান ফসল আমন ধান্য এবং রোপণ ও বোনা, কাটা সমস্ত শেষ করিতে তিন মাস মাত্র সময় লাগে। বৎসরের বাকী নয় মাস কৃষকেরা আলস্যে কাটায়। বাংলায় কোন কোন অঞ্চলে ধান ও পাট ছাড়া সরিষা, মটর প্রভৃতি রবিশস্যও হয়। কিন্তু সেখানেও কৃষকদের বৎসরের মধ্যে ৫।৬ মাস কোন কাজ থাকে না। বর্তমান পৃথিবীর কঠোর জীবন সংগ্রামে যে জাতি বৎসরের অধিকাংশ সময় স্বেচ্ছায় আলস্যে কাল হরণ করে, তাহারা বেশী দিন ধরা পৃষ্ঠে টিকিতে পারে না। ইহার পরিণাম অনশন, অর্দ্ধাশন এবং বিপুল ঋণভার—এখনই বাংলাদেশে দেখা যাইতেছে। পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র বিধৌত পূর্ববঙ্গে বর্ষার পর পলিমাটী পড়িয়া জমি উর্বরা হয় এবং প্রচুর ধান, পাট, কলাই, মটর প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। কিন্তু সেখানেও, কৃষকেরা মোটের উপর স্বচ্ছল অবস্থাপন্ন হইলেও, মহাজনদের ঋণজালে আবদ্ধ।[২] বস্তুতঃ, এই সকল অঞ্চলে লোক সংখ্যা খুব বেশী হইয়া পড়িয়াছে, প্রতি বর্গ মাইলে লোক সংখ্যার পরিমাণ ৬০০ হইতে ৯০০। জমি বহু ভাগে বিভক্ত হওয়াতে ময়মনসিংহ অঞ্চল হইতে বহু বহু লোক আসামে যাইতেছে। ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি প্রভৃতি বাংলার পূর্বাঞ্চলের কৃষকেরা অধিকাংশই মুসলমান, তাহারা পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু। তাহাদের মধ্যে অনেকে জাহাজে লস্করের কাজ গ্রহণ করে। এই কারণেও লোক-সংখ্যার চাপ কিয়ৎ পরিমাণে হ্রাস হয়।
জমি উর্বরা হইলেই যে সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের অবস্থা ভাল হইবে, এমন কোন কথা নাই। বরং অনেক সময় তাহার বিপরীত দেখা যায়। এ বিষয়ে রংপুরের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই অঞ্চলের জমি খুব উর্বরা, এবং ধান, পাট, তামাক, প্রভৃতি কয়েক প্রকারের শস্য এবং শাকসব্জী এখানে উৎপন্ন হয়। কিন্তু এই জেলার অধিবাসীরা অত্যন্ত অশিক্ষিত ও অনুন্নত। অনেক সময়েই তাহারা জীবনধারণের উপযোগী সামান্য কিছু শস্য উৎপন্ন করিয়াই সন্তুষ্ট হয়। তাহারা অত্যন্ত অলস এবং বৎসরের মধ্যে কয়েক মাস বসিয়া থাকে। অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে, রংপুরে হিন্দু রাজবংশীদের পাশাপাশি মুসলমানেরাও বাস করে। কিন্তু তাহারা একই জাতির লোক হইলেও হিন্দুদের চেয়ে বেশী কর্মঠ।
পাঞ্জাব ও মীরাট জেলার কৃষকেরা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তাহারা এখনও চরকা কাটে এবং তাহাদের বোনা মোটা সূতায় তাহাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য মোটা কাপড় তৈরী হয়। ১৯২৯ সালে আমি মীরাটে যাই। খাটাউলি সহরের ২০ মাইল উত্তরে একটি গ্রামে গিয়া আমি বিস্ময় ও আনন্দের সঙ্গে দেখিলাম, প্রায় প্রত্যেক গৃহে চরকা চলিতেছে। গৃহকর্ত্রী, কন্যা এবং পত্রবধূ একত্র বসিয়া রোদ পোহাইতে পোহাইতে চরকা কাটিতেছে, এ দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু এখানেও তথাকথিত ‘সভ্যতা’ ধীরে ধীরে প্রবেশ করিতেছে। ধুতি, পাগড়ী পরা গ্রামবাসীরা সূক্ষ্ম বিদেশী দ্রব্য কিনিতে আরম্ভ করিয়াছে। স্থানীয় গান্ধী আশ্রমের কর্মীরা মেয়েদের হাতের তৈরী সূতা প্রভৃতি কিনিয়া তাহাদের উৎসাহিত করিতে চেষ্টা করে, কিন্তু আশ্রমের অর্থ সামর্থ্য বিশেষ নাই। যদি এই স্বদেশী শিল্পকে উৎসাহ দিবার জন্য উপযুক্ত সঙ্ঘ বা প্রতিষ্ঠান থাকিত, তবে খুবই কাজ হইতে পারিত। কিন্তু বাংলার ন্যায় ঐ প্রদেশেও সরকারী শিল্প বিভাগের নিকট চরকা ‘নিষিদ্ধ বস্তু’, কেননা এই শিল্প পুনরুজ্জীবিত হইলে ল্যাঙ্কাশায়ারের বস্ত্র শিল্পের সমূহ ক্ষতি হইতে পারে। মিঃ র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড তাঁহার গ্রন্থে নিছক সত্য কথাই লিখিয়াছেন—“গবর্ণমেণ্ট যখন গর্ব করেন যে, ভারতে পুরাতন দেশীয় শিল্পের পরিবর্তে তাঁহারা সস্তা কার্পাস বস্ত্রজাত যোগাইবার ব্যবস্থা করিয়াছেন, তখন সে কথা শুনিয়া মন বিষাদভারাক্রান্ত হয়। কিন্তু ইহার ফলে ভারতের যে বিষম ক্ষতি হইয়াছে, সে বিষয়ে তাঁহারা অন্ধ।” মীরাটে বহু জমিদার এবং ধনী বানিয়া আছে। কিন্তু বর্তমান যুগের চিন্তাধারা তাহাদের মন স্পর্শ করে নাই। তাহাদের মধ্যে অনেকে, ব্রিটিশ কমিশনার বা কালেক্টরের যে কোন বাতিকে উৎসাহ দিবার জন্য প্রচুর অর্থ দিতে পারে, নিজেদের ছেলে মেয়ের বিবাহে মিছিল ও তামাসার জন্য ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করিতে পারে; কিন্তু যাহাতে স্থায়ী উপকার হয়, এমন কোন কাজে তাহারা এক পয়সাও দিবে না। এই সমস্ত ব্যবহারের মূলে যে মনোভাব কার্য করিতেছে, তাহার কথাও কিছু বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশে দেখা যায়, যে সমস্ত কৃষকের অবস্থা ভাল তাহারা শ্রমের কাজ করিতে ঘৃণা করে এবং ভদ্রলোকদের অনুকরণ করে। বাংলার কোন কোন অঞ্চলে কৃষকেরা আমন ধান বুনিবার সময় এক মাস দেড় মাস খুবই পরিশ্রম করে, তাহার পরে কয়েক মাস বসিয়া থাকে। এমন কি, ধান কাটার সময়ে তাহারা পশ্চিম দেশীয় মজুরদের সাহায্য নেয়।
অবস্থা কিরূপ শোচনীয় ও কুৎসিত হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা ভাবিলে কষ্ট হয়। কৃষকেরা গৃহজাত মোটা কাপড় ছাড়িয়া ল্যাঙ্কাশায়ারের সূক্ষ্ম বস্ত্র কিনিতেছে। ঘরের তামাক ছাড়িয়া বিদেশী সিগারেট খাইতেছে। মামলা মোকদ্দমা করিতে হইলে ৪।৫ মাইল হাঁটিয়া নিকটবর্তী সহরে আর তাহারা যাইতে চাহে না, দুই আনা পয়সা খরচ করিয়া মোটর বাসে চড়ে। ইহার অর্থ এই যে, তাহারা জমির অতিরিক্ত উৎপন্ন ফসল প্রভৃতি বেচিয়া যে পয়সা পায়, তাহা আধুনিক সভ্যতার বিলাসোপকরণ প্রভৃতির জন্য ব্যয় করে। একথা সত্য যে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে অথবা প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন কৃষক নিজের মোটর গাড়ীতে চড়ে, কিন্তু ঐ সমস্ত কৃষকের নিকট প্রতি মিনিটের মূল্য আছে। তাহারা মোটের উপর সুশিক্ষিত,—কৃষিকার্যে আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রণালী অবলম্বন করে এবং এইরূপে জমির উৎপন্ন ফসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। কিন্তু বাংলার কৃষকেরা অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। একদিকে কৃষিকার্যে সেকেলে মান্ধাতার আমলের প্রণালী[৩] অবলম্বন করিয়া, অন্যদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতার বিলাস ভোগ করিতে গিয়া, তাহারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।[৪] সাগর সঙ্গমের নিকটবর্তী বদ্বীপ অঞ্চল ব্যতীত ভারতের অন্য সর্বত্র জমির উর্বরতা হ্রাস পাইতেছে, তাহার লক্ষণ স্পষ্টই দেখা যাইতেছে। ষাট বৎসর পূর্বে আমার বাসগ্রাম ও তন্নিকটবর্তী অঞ্চলে রবিশস্য এখনকার চেয়ে দ্বিগুণ হইত। জমি কিছুকাল পতিত রাখিতে দেওয়া তো হয়ই নাই, কোনরূপ সার দেওয়ার ব্যবস্থাও নাই। বৎসরের পর বৎসর একই জমিতে একই প্রকার শস্য উৎপাদন করা হয়। ফলে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হয়, ফসলের পরিমাণ কম হয় এবং ফসলের উৎকর্ষও হ্রাস পায়। সরকারী কর্মচারী প্রভৃতির ন্যায় যাহারা কেবল বাহির হইতে দেখে, তাহারা বলে যে, দেশে আমদানী পণ্যের পরিমাণ বাড়িতেছে, অতএব বুঝা যাইতেছে যে, কৃষকদের অবস্থা পূর্বের চেয়ে ভাল হইতেছে। যাহারা অনশনে বা অর্দ্ধাশনে থাকে, ঋণজালে জড়িত, জমিতে ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা যাহাদের হ্রাস পাইতেছে, তাহারা যদি বিদেশী পণ্যের মোহে মুগ্ধ হয়, তাহা হইলে আর্থিক হিসাবে তাহারা আত্মহত্যাই করে। ‘শ্বেতাঙ্গদের শিল্পজাত’ বিদেশী বস্ত্রের তথা নানারূপ বিদেশী দ্রব্যের প্রতি তাহাদের মোহের ফলে ভারতীয় কৃষকদের অবস্থা, বিষধর সর্পের (rattle snake) মোহিনী শক্তিতে আকৃষ্ট পক্ষীর মত হইয়া দাঁড়ায়—এই মোহ তাহাদিগকে ধ্বংসের মুখেই টানিয়া লইয়া যায়।
আধুনিক সভ্যতার জয়যাত্রার ফলে, লক্ষ লক্ষ কাটুনী, তাঁতি, ছুতার, কামার, মাঝি মাল্লা, গাড়োয়ান প্রভৃতি যে কিরূপে নিরন্ন হইয়া পড়িয়াছে, তাহার অধিক বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই।[৫]
১৮৮০ সালে স্যার জন বার্ডউড ভারতীয় ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের লক্ষ্য করিয়া লেখেন যে, তাঁহারা যেন কখন ভারত-জাত বস্ত্রে প্রস্তুত পোষাক ছাড়া অন্য কিছু না পরেন এবং ইহা তাঁহাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও মর্যাদাবোধের অন্যতম নিদর্শন স্বরূপ হওয়া উচিত।
আমি যাহা বলিয়াছি, তাহা হইতেই পাঠকেরা বুঝিতে পারিবেন যে, শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা এবং তাঁহাদের দৃষ্টান্তে কিয়ৎপরিমাণে কৃষকেরাও যদি ইয়োরোপীয়দের জীবনযাত্রা প্রণালী অনুকরণ করে এবং তাহার ফলে বিদেশী পণ্যের প্রচুর আমদানী হইতে থাকে, তবে উহাতে দেশের শ্রীবৃদ্ধির লক্ষণ প্রকাশ পায় না বরং তাহার বিপরীতই বুঝায়। দেশে যে খাদ্য উৎপন্ন হয়, তাহা সমগ্র লোক সংখ্যার পক্ষে যথেষ্ট নহে, তৎসত্ত্বেও বিদেশী বিলাসদ্রব্যের আমদানী বাড়িয়া চলিয়াছে! আমাদের অর্থনীতিবিদেরা, যাঁহারা কলেজের পড়ুয়া মাত্র, চরকার প্রতি বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহাদিগকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, কৃষকেরা বৎসরের মধ্যে ছয়মাস হইতে নয় মাসকাল যখন বসিয়া থাকে, তখন তাহারা কি করিবে, তবে তাঁহারা কোনই উত্তর দিতে পারেন না। এই আলস্য ও অকর্মণ্যতার ফলে বাংলা দেশ প্রতি বৎসর যে ত্রিশ কোটী টাকা দিতে বাধ্য হয়, তাহা পূর্বে এই দেশেরই কাটুনী ও তাঁতীরা পাইত। বাংলার এই জাতীয় শিল্প ধ্বংস হওয়াতে এই টাকাটা ল্যাঙ্কাশায়ার ও জাপানী শিল্প ব্যবসায়ীদের হস্তগত হইতেছে।
তোমার কর্ম করিবার অভ্যাস যদি নষ্ট হয়, তবে তোমার ভবিষ্যতের আর কোন আশা থাকিবে না। মনুষ্যজাতির পক্ষে ইহাই স্বাভাবিক নিয়ম। বাংলার কৃষক রমণীরা এবং ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকেরা পূর্বে যে সময়টায় সূতা কাটিতেন ও কারুশিল্পের কাজ করিতেন, এখন সেই সময় তাঁহারা বাজে গল্পগুজব করিয়া ও দিবানিদ্রা দিয়া কাটান। রেনান বলিয়াছেন, কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে যদি আলস্য প্রবেশ করে, তবে ফল অতি বিষময় হয়।
“যদি দরিদ্রদের বলা যায় যে, কোন কাজ না করিয়াই তাহারা সুখী হইতে পারিবে, তবে তাহারা মহা আনন্দিত হইয়া উঠিবে। ভিক্ষুককে যদি তুমি বল যে, জগৎ তাহারই এবং কোন কিছু না করিয়া সে গির্জায় পুণ্যবান্ বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার প্রার্থনা অধিকতর ফলপ্রসূ হইবে, তবে সে শীঘ্রই বিপজ্জনক হইয়া উঠিবে। টাস্কানিতে মার্সিয়ানিষ্টদের আন্দোলনের সময় এইরূপ ব্যাপার দেখা গিয়াছিল। লাজারেটির শিক্ষার ফলে, কৃষকগণ কর্মের অভ্যাস ত্যাগ করিয়াছিল, সাধারণ জীবন-যাত্রার কাজ করিতেও তাহারা অনিচ্ছা প্রকাশ করিত। ফ্র্যান্সিস অব আসিসির সময়ে গ্যালিলি ও আমরিয়াতে লোকে কল্পনা করিত যে, দারিদ্র্য দ্বারা তাহারা স্বর্গরাজ্য জয় করিতে পারিবে। এইরূপে কল্পনা ও স্বপ্নের ফলে তাহাদের পক্ষে স্বেচ্ছায় জীবন যাত্রার কাজ করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছিল। এরূপ অবস্থায় কর্মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া অপেক্ষা লোকের পক্ষে সাধু সাজিবার আগ্রহ হওয়াই স্বাভাবিক। তখন দৈনন্দিন কর্ম তাহার পক্ষে বিরক্তিকরই মনে হইবে।”— রেনান: মার্কাস অরেলিয়াস।
বোম্বাইয়ে কাপড়ের কলগুলিতে বড় জোর ৩।৪ লক্ষ লোকের কাজ জুটিতে পারে, হুগলী তীরবর্তী পাটের কলগুলি সম্বন্ধেও সেই কথা বলা যায়। কানপুরের মিলে হয়ত আরও ২ লক্ষ লোক কাজ পাইতে পারে। এইভাবে, ভারতের কলকারখানার কেন্দ্রস্থলগুলিতে বড় জোর ২০ লক্ষ লোক জীবিকা অর্জন করিতে পারে। কিন্তু বাকী ৩১ কোটী ৮ লক্ষ লোক কি করিবে? এই দেশে ম্যানচেষ্টার, লিভারপুল, গ্লাসগো, প্রভৃতির মত কল কারখানা পূর্ণ বড় বড় সহর কবে গড়িয়া উঠিবে এবং বাংলার গ্রাম হইতে শতকরা ৭০ জন লোক ঐ সব সহরে যাইয়া বাস করিবে,—আমরা কি সেই ‘শুভ দিনের’ প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকিব? কলিকাতা ও হাওড়া ব্যতীত বাংলাদেশে আর কোন সহর নাই। মফঃস্বলের সহরগুলি, নামে মাত্র সহর। এই সব মফঃস্বল সহরে থানা আদালত প্রভৃতি থাকার জন্য পরগাছা জাতীয় এক শ্রেণীর লোক সেখানে দেখা দিয়াছে। আমার আশঙ্কা হয় প্রলয়ান্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করিলেও, বাংলার মফঃস্বলে কলকারখানাপূর্ণ সহর গড়িয়া উঠিবে না। এইরূপ ‘সুখের দিন’ দেশে আনয়ন করা বাঞ্ছনীয় কি না, সে কথা না হয় ছাড়িয়া দিলাম, কিন্তু আমার স্বদেশবাসিগণ, আপনারা কি কোন দিন এ বিষয়ে যোগ্যতা প্রদর্শন করিয়াছেন? তবে বৃথা কেন বড় বড় কারখানা স্থাপন করিয়া বেকার সমস্যা সমাধানের লম্বা চওড়া কথা বলিতেছেন?
বস্তুতঃ, ভারত কৃষিপ্রধান দেশ এবং চিরদিন তাহাই থাকিবে। এখানকার প্রধান সমস্যা, কিরূপে উন্নত বৈজ্ঞানিক প্রণালী অবলম্বন করিয়া জমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করা যায় এবং গ্রামবাসী কৃষকদের স্বল্প আয় বৃদ্ধির জন্য অন্য কি আনুষঙ্গিক কাজের প্রবর্তন করা যায়। আমার দৃঢ় অভিমত, এই হিসাবে সূতাকাটা ও কাপড় বোনা—কুটীর শিল্পরূপে বাংলার সর্বত্র প্রচলিত হইতে পারে।
চরকার কার্যকরী শক্তি কতদূর, তাহা সহজ হিসাবের দ্বারাই বুঝা যাইতে পারে। কোলব্রুক এই কারণেই ১২৫ বৎসর পূর্বে চরকার গুণগান করিয়াছিলেন। ভারতের লোক সংখ্যা ৩২ কোটী। যদি গ্রামবাসী লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে কিয়দংশও—দৃষ্টান্ত স্বরূপ ১/৮ অংশ—দৈনিক ২ পয়সা করিয়া উপার্জন করে, তাহা হইলে তাহাদের মোট আয়ের পরিমাণ হইবে দৈনিক ১২ ১/২ লক্ষ টাকা অথবা বৎসরে ৪৫,৬২,৫০,০০০ টাকা। শিল্প ব্যবসায়ীরা এখন “Mass Production” বা এক সঙ্গে প্রচুর পণ্য উৎপাদনের কথা কহিয়া থাকেন, কিন্তু ভারতে আমরা একসঙ্গে বিশাল জন-সমষ্টির গণনা করিয়া থাকি। এই বিশাল জন-সমষ্টির আয় ব্যক্তিগতভাবে যতই অকিঞ্চিৎকর হউক না কেন—একসঙ্গে হিসাব করিলে কোটী কোটী টাকায় দাঁড়ায়। হিতোপদেশে আছে—‘তৃণৈর্গুণত্বমাপন্নে বর্ধ্যন্তে মত্তদন্তিনঃ’—তৃণরাশি একত্র করিয়া রজ্জু নির্মাণ করিলে তদ্দ্বারা মত্ত হস্তীও বাঁধা যায়। বর্তমান ক্ষেত্রে ঐ উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলিয়া মনে করা যাইতে পারে।
গত ৭।৮ বৎসরে খদ্দর সম্বন্ধে আমি যাহা লিখিয়াছি, তাহা একত্র করিলে একখানি বৃহৎ পুস্তক হইতে পারে। তৎসত্ত্বেও এবিষয়ে পুনঃ পুনঃ বলা প্রয়োজন; কেন না আমাদের মধ্যে এক শ্রেণীর শিক্ষিত লোক আছে যাহারা কোন কিছু করিবে না, কোন নূতন সৃষ্টি করিবে না অথচ সহরে আরাম চেয়ারে বসিয়া কেবল সর্বপ্রকার শুভ প্রচেষ্টার প্রতি বিদ্রুপবাণ বর্ষণ করিবে। চরকা যে কৃষকদের পক্ষে কেবল আশীর্বাদ স্বরূপ নহে, পরন্তু দুর্ভিক্ষের সময়ে বীমার কাজ করে, তাহা গত উত্তর বঙ্গ বন্যার সময় দেখা গিয়াছে। ১৯২২—২৩ সালে বন্যা সাহায্য কার্যের সময় উত্তর বঙ্গে আত্রাই (রাজসাহী) ও তালোরার (বগুড়া) নিকট কতকগুলি কেন্দ্র এই উদ্দেশ্যে কাজ করিবার জন্য নির্বাচিত হয়। অত্যন্ত দুর্দশার সময় এই সব কেন্দ্রে প্রায় এক হাজার চরকা বিতরণ করা হয় এবং ৪।৫ মাস পরে কয়েক মণ সূতা কাটুনীদের নিকট হইতে সংগ্রহ করা হয়। ঐ সূতা দিয়া ঐ সব কেন্দ্রেই খদ্দর তৈরী হয়, ফলে স্থানীয় জোলা ও তাঁতির দুর্দশার লাঘব হয়। কলিকাতা খাদি প্রতিষ্ঠানের মারফৎ ঐ সমস্ত খদ্দর অল্প সময়ের মধ্যেই বিক্রয় হইয়া যায়। ইহা বাংলার যুবকদের স্বদেশ প্রেমের পরিচয় বটে! অবস্থা বেশ আশাপ্রদ বোধ হইতেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, পর বৎসর ও তার পর বৎসর, ধান ও পাটের অবস্থা ভাল হওয়াতে কৃষকেরা চরকা ত্যাগ করিতে লাগিল এবং খদ্দর উৎপাদনের পরিমাণও কমিয়া গেল। সেই সময় হইতে খাদি প্রতিষ্ঠান প্রতিবৎসর ৪।৫ হাজার টাকা লোকসান দিয়া কোন প্রকারে টিকিয়া আছে। যাহা হউক, আমরা এই প্রচেষ্টা ত্যাগ করি নাই, কেন না কয়েকটি স্থানে অনাথা বিধবারা ও তাহাদের কন্যা, পুত্রবধূ, প্রভৃতি চরকার উপকারিতা বুঝিতে পারিয়া উহা অবলম্বন করিয়া আছে। ফলে যে স্থলে প্রথম অবস্থায় ৮।১০ নম্বরের সূতা হইত, সে স্থলে এখন ৩০।৪০ নম্বরের সূতা হইতেছে। কাটুনীরা পূর্বেকার মত দক্ষতা লাভ করাতে সূতার মূল্য হ্রাস করিতে পারা গিয়াছে। যাহারা পুরা সময়ে সূতা কাটে তাহারা দৈনিক দুই আনা রোজগার করে, আংশিক সময়ে সূতা কাটিলে এক আনা উপার্জন করিতে পারে। ১৯৩১ সালে পাটের মূল্য অসম্ভব রকমে হ্রাস হওয়াতে, আমরা বহু কাটুনীর নিকট হইতে আবেদন পাইয়াছি। জগদ্ব্যাপী মন্দার পরে, পুনর্বার বন্যা হওয়াতে দুর্দশা চরমে উঠে এবং চারিদিকে “চরকা দাও, চরকা দাও” রব উঠে। কলিকাতার বিভিন্ন সেবাসমিতি চাউল প্রভৃতি বিতরণ করিয়া যে সাহায্য করিতেছে, তাহাতে দুর্দশাগ্রস্ত অঞ্চলের দুঃখ অতি সামান্যই লাঘব হইতেছে। তাহার উপর ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা মন্দ হওয়াতে অর্থ সাহায্যও অতি সামান্য পাওয়া যাইতেছে। যদি চরকা প্রচলিত থাকিত, তবে ৭ বৎসর বয়সের ঊর্ধ্বে বালক বালিকা হইতে আরম্ভ করিয়া, প্রত্যেক কার্যক্ষম কাটুনী গড়ে এক আনা করিয়া উপার্জন করিতে পারিত, এবং উহার দ্বারা প্রত্যেক ব্যক্তির চাউল, তেল, লবণ, ডাল প্রভৃতির সংস্থান হইত। কাহারও নিকট অর্থের অফুরন্ত ভাণ্ডার নাই, ভাণ্ডার শূন্য হইয়া আসিলে সাহায্য কার্যও থামিয়া যায় এবং দুর্গতদের অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিতে হয়। তাহা ছাড়া, প্রথম প্রথম সাহায্য বিতরণের প্রয়োজন থাকিলেও, উহার একটা অনিষ্টকর দিকও আছে। উহার ফলে সাহায্যদাতা ও গ্রহীতা উভয়েরই নৈতিক অধঃপতন হয়। কিন্তু গ্রহীতা যদি সাহায্যের পরিবর্তে কোন একটি কাজ করিয়া দিতে পারে, তবে তাহার আত্মসম্মান বজায় থাকে। সূতার একটা বাজার মূল্যও আছে, সতরাং সূতা বিক্রয়ের পয়সা কাটুনীদের ভরণপোষণের কাজেই লাগে এবং এইরূপে কর্মচক্র আবর্তিত হইতে থাকে।
কলিকাতার রাস্তায় দুই তিন টন এমন কি চার পাঁচ টন ভারবাহী মোটর লরী চলে। কয়েক বৎসর হইতে কয়েক সহস্র মনুষ্য-বাহিত যানেরও আমদানী হইয়াছে। এগুলিতে পাঁচ, দশ, পনর, কুড়ি মণ পর্যন্ত মাল বহন করা হয়। ছোট যানগুলি একজন কি দুইজন লোকে টানে, বড় গুলির সম্মুখে দুই জন টানে, পিছনে দুই জন ঠেলে। এখানে দেখা যাইতেছে, মানষ কেবল গরু, বা মহিষের গাড়ীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিতেছে না, মোটর চালিত যানের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করিতেছে। প্রকৃত কথা এই যে, এই সমস্ত কঠোর পরিশ্রমী লোক বিহার ও যুক্তপ্রদেশ হইতে আসে, ঐ দুই প্রদেশে লোকসংখ্যা বেশী হওয়াতে, উহাদের পক্ষে জীবিকার্জন করা কঠিন। সুতরাং মানুষ শ্রমিক যে যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিতে পারে না, ভারত ও চীনে এই নিয়ম খাটে না। এই দুই দেশের অর্দ্ধাশন-ক্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ লোক এমন কম মজুরীতে কাজ করিবার জন্য আগ্রহান্বিত যে, শিল্প বাণিজ্যে সমৃদ্ধ অন্য কোন দেশে, তাহা অতি তুচ্ছ বলিয়া বিবেচিত হইবে।
শ্রীযুত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এক শতাব্দী বা ততোধিক পূর্বেকার সংবাদপত্র ঘাঁটিয়া যে সমস্ত মূল্যবান, তথ্য প্রকাশ করিতেছেন, সেজন্য তিনি দেশবাসীর ধন্যবাদার্হ। পুরাতন ‘সমাচার দর্পণ’ হইতে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত পত্রখানি হইতে বুঝা যাইবে চরকার জন্য কোলব্রুক সাহেবের বিলাপের কারণ কি এবং বিদেশী সূতা ভারতের কি বিষম আর্থিক ক্ষতি করিয়াছে।
“চরকা আমার ভাতার পুত
চরকা আমার নাতি—”
১৮২৮ সালে ‘সমাচার দর্পণে’ কোন সূতা কাটুনী স্ত্রীলোক নিম্নলিখিত পত্রখানি লিখিয়াছিলেন:—[৬]
(৫ই জানুয়ারী ১৮২৮। ২২ পৌষ ১২৩৪)
চরকাকাটনির দরখাস্ত।—শ্রীযুত সমাচার পত্রকার মহাশয়।
আমি স্ত্রীলোক অনেক দুঃখ পাইয়া এক পত্র প্রস্তুত করিয়া পাঠাইতেছি আপনারা দয়া করিয়া আপনারদিগের আপন ২ সমাচারপত্রে প্রকাশ করিবেন শুনিয়াছি ইহা প্রকাশ হইলে দুঃখ নিবারণকর্তারদিগের কর্ণগোচর হইতে পারিবেক তাহা হইলে আমার মনস্কামনা সিদ্ধ হইবেক অতএব আপনারা আমার এই দরখাস্তপত্র দুঃখিনী স্ত্রীর লেখা জানিয়া হেয়জ্ঞান করিবেন না।
আমি নিতান্ত অভাগিনী আমার দুঃখের কথা তাবৎ লিখিত হইলে অনেক কথা লিখিতে হয় কিন্তু কিছু লিখি আমার যখন সাড়ে পাঁচ গণ্ডা বয়স তখন বিধবা হইয়াছি কেবল তিন কন্যা সন্তান হইয়াছিল। বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ী আর ঐ তিনটি কন্যা প্রতিপালনের কোন উপায় রাখিয়া স্বামী মরেন নাই তিনি নানা ব্যবসায়ে কালযাপন করিতেন আমার গায়ে যে অলঙ্কার ছিল তাহা বিক্রয় করিয়া তাঁহার শ্রাদ্ধ করিয়াছিলাম শেষে অন্নাভাবে কএক প্রাণী মারা পড়িবার প্রকরণ উপস্থিত হইল তখন বিধাতা আমাকে এমত বুদ্ধি দিলেন যে যাহাতে আমারদিগের প্রাণ রক্ষা হইতে পারে অর্থাৎ আসনা ও চরকায় সূতা কাটিতে আরম্ভ করিলাম প্রাতঃকালে গৃহকর্ম অর্থাৎ পাটি ঝাটি করিয়া চরকা লইয়া বসিতাম বেলা দুই প্রহর পর্যন্ত কাটনা কাটিতাম প্রায় এক তোলা সূতা কাটিয়া স্নানে যাইতাম স্নান করিয়া রন্ধন করিয়া শ্বশুর শাশুড়ী আর তিন কন্যাকে ভোজন করাইয়া পরে আমি কিছু খাইয়া সরু টেকো লইয়া আসনা সূতা কাটিতাম তাহাও প্রায় এক তোলা আন্দাজ কাটিয়া উঠিতাম এই প্রকারে সূতা কাটিয়া তাঁতিরা বাটিতে আসিয়া টাকায় তিন তোলার দরে চরকার সূতা আর দেড় তোলার দরে সরু আসনা সূতা লইয়া যাইত এবং যত টাকা আগামি চাহিতাম তৎক্ষণাৎ দিত ইহাতে আমারদিগের অন্ন বস্ত্রের কোন উদ্বেগ ছিল না পরে ক্রমে২ ঐ কর্মে বড়ই নিপুণ হইলাম কএক বৎসরের মধ্যে আমার হাতে সাত গণ্ডা টাকা হইল এক কন্যার বিবাহ দিলাম ঐ প্রকার তিন কন্যার বিবাহ দিলাম তাহাতে কুটম্বতার যে ধারা আছে তাহার কিছু অন্যথা হইল না রাঁড়ের মেয়্যা বলিয়া কেহ ঘৃণা করিতে পারে নাই কেননা ঘটক কুলীনকে যাহা দিতে হয় সকলি করিয়াছি তৎপরে শ্বশুরের কাল হইল তাঁহার শ্রাদ্ধে এগার গণ্ডা টাকা খরচ করি তাহা তাঁতিরা আমাকে কর্জ দিয়াছিল দেড় বৎসরের মধ্যে তাহা শোধ দিলাম কেবল চরকার প্রসাদাৎ এতপর্যন্ত হইয়াছিল এক্ষণে তিন বৎসরাবধি দুই শাশুড়ী বধূর অন্নাভাব হইয়াছে সূতা কিনিতে তাঁতি বাটীতে আসা দূরে থাকুক হাটে পাঠাইলে পূর্বাপেক্ষা সিকি দরেও লয় না ইহার কারণ কি কিছু বুঝিতে পারি না অনেক লোককে জিজ্ঞাসা করিয়াছি অনেকে কহে যে বিলাতি সূতার আমদানি হইতেছে সেই সকল সূতা তাঁতিরা কিনিয়া কাপড় বুনে। আমার মনে অহঙ্কার ছিল যে আমার যেমন সূতা এমন কখনও বিলাতি সূতা হইবেক না পরে বিলাতি সূতা আনাইয়া দেখিলাম আমার সূতাহইতে ভাল বটে তাহার দর শুনিলাম ৩।৪ টাকা করিয়া সের আমি কপালে ঘা মারিয়া কহিলাম হা বিধাতা আমাহইতেও দঃখিনী আর আছে পূর্বে জানিতাম বিলাতে তাবৎ লোক বড় মানুষ বাঙ্গালি সব কাঙ্গালী এক্ষণে বুঝিলাম আমাহইতেও সেখানে কাঙ্গালিনী আছে কেননা তাহারা যে দঃখ করিয়া এই সূতা প্রস্তুত করিয়াছে সে দুঃখ আমি বিলক্ষণ জানিতে পারিয়াছি এমত দুঃখের সামগ্রী সেখানকার হাটে বাজারে বিক্রয় হইল না একারণ এ দেশে পাঠাইয়াছেন এখানেও যদি উত্তম দরে বিক্রয় হইত তবে ক্ষতি ছিল না তাহা না হইয়া কেবল আমাদিগের সর্বনাশ হইয়াছে সে সূতায় যত বস্ত্রাদি হয় তাহা লোক দুই মাসও ভালরূপে ব্যবহার করিতে পারে না গলিয়া যায় অতএব সেখানকার কাটনিরদিগকে মিনতি করিয়া বলিতেছি যে আমার এই দরখাস্ত বিবেচনা করিলে এদেশে সূতা পাঠান উচিত কি অনূচিত জানিতে পারিবেন। কোন দুঃখিনী সূতা কাটনির দরখাস্ত। —সং চং।
শান্তিপুর
- ↑ “সব সূতাই স্ত্রীলোকেরা কাটে এবং উহা তাহাদের অবসর সময়ের কাজ”।—
“ভারতীয় মসলিন ইংলণ্ডে ১৬৬৬ সালে প্রথম আমদানী হয়। মনে রাখিতে হইবে যে, ১৮০৮ সালের ১২॥০ লক্ষ টাকা বর্তমান কালের ৫০ লক্ষ টাকার সমান।
“সাম্রাজ্ঞী নূরজাহান এদেশের শিল্পিগণকে বিশেষ উৎসাহ দিতেন এবং তাঁহারই পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকাই মসলিন প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল।... পরবর্তী কালেও ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি অক্ষুন্ন ছিল। এমন কি বর্তমান কালে, বয়নশিল্প ইংলণ্ডে প্রভূত উন্নতি লাভ করিলেও, ঢাকাই মসলিন এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। স্বচ্ছতা, সৌন্দর্য এবং সূক্ষা বুনানী প্রভৃতি গুণের উৎকর্ষে ইহা জগতের যে কোন দেশের বয়নশিল্পজাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
“পূর্বকালে ঢাকা জেলার সর্বশ্রেণীর লোকই সূতা কাটার কাজ করিত। ১৮২৪ সাল হইতে এই শিল্পের অবনতি আরম্ভ হয় এবং তাহার পর হইতে ইহা দ্রুতগতিতে লোপ পাইতেছে। “ঢাকা জেলার প্রায় প্রত্যেক পরিবারই পূর্বকালে সূতা কাটিয়া উপার্জন করিত। কিন্তু সস্তার বিলাতী সূতা আমদানী হওয়াতে এই প্রাচীন শিল্প প্রায় সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হইয়াছে।
“এইরূপে যে সূতাকাটা ও বস্ত্রবয়ন শিল্প এদেশে অগণিত লোকের অন্নসংস্থান করিয়াছে, তাহা ৬০ বৎসরের মধ্যেই বিদেশীদের হাতে চলিয়া গিয়াছে।” Taylor: Topography of Dacca.
মোরল্যাণ্ড তাঁহার India at the Death of Akbar নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন:—
“বাংলাদেশ নেংটি পরিয়া থাকিত, এ সিদ্ধান্তও যদি আমরা করি, তাহা হইলেও স্বীকার করিতে হইবে, বস্ত্রবয়ন শিল্প ভারতে খুবই প্রসার লাভ করিয়াছিল এবং ১৬০০ খৃষ্টাব্দে ভারতের মোট উৎপন্ন বস্তুজাত শিল্প জগতের একটা প্রধান ব্যাপার ছিল। স্বদেশের সমস্ত অভাব তো পূরণ করিতই, তাহা ছাড়া বিদেশেও ভারতের বস্ত্র রপ্তানী হইত।”
র্যাল্ফ ফিচ তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্তে (১৫৮৩ খৃঃ) লিখিয়াছেন:—
“বাকোলা হইতে আমি ছিরিপুরে (শ্রীপুরে) গেলাম।... এখানে প্রচুর কার্পাস বস্ত্র উৎপন্ন হয়।
“সিনারগাঁও (সোণারগাঁও) ছিরিপুর হইতে ছয় লীগ দূরে একটি সহর। সেখানে ভারতের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সূক্ষ্ম বস্ত্র উৎপন্ন হয়।
“এখান হইতে প্রচুর পরিমাণে বস্ত্র ও চাউল রপ্তানী হইরা ভারতের সর্বত্র, সিংহল, পেগু, সুমাত্রা, মালাক্কা এবং অন্যান্য নানা স্থানে যায়।” - ↑ কৃষকেরা যে বিনা কাজে আলস্যে কালহরণ করে, তৎসম্বন্ধে কয়েকজন লেখক মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন,—যথা: পানাণ্ডিকর—Wealth & Welfare of the Bengal Delta, p. 150। জ্যাক বলেন,—“কৃষকদের কাজের সময়ের হিসাব করিলে দেখা যায় যে, তাহারা পাট চাষের জন্য তিন মাস কাজ করে এবং ৯ মাস বসিয়া থাকে। যদি ধান ও পাট উভয় শসাই তাহারা উৎপাদন করে, তবে জুলাই ও আগস্ট মাসে আর অতিরিক্ত দেড়মাস মাত্র কাজ তাহাদের করিতে হয়।” “যতদিন পর্যন্ত তাহাদের হাতে খাদ্য ও অর্থ থাকে, ততদিন তাহারা পরকুৎসা, দলাদলি, মামলা মোকদ্দমা এই সব করিয়া কাল কাটায়।”—Burrows.
ইয়োরোপের কৃষিপ্রধান দেশসমূহে কৃষকেরা অবসর সময়ে (যে সময়ে চাষের কাজ না থাকে) কি করে, তাহার বর্ণনা আমাদের দেশের লোকের পক্ষে বেশ শিক্ষাপ্রদ হইবে। বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমান স্ত্রীলোকেরা পর্দানশীন, তাহারা বাহিরে যাইয়া কাজ করিতে পারে না। কিন্তু ইয়োরোপের স্ত্রীলোকেরা সমস্ত প্রকার গৃহকার্য করিয়াও অন্য নানা কাজে বেশ দুপয়সা উপার্জন করে, যথা:—“পরিবারের সকলেই অতি প্রত্যূষে উঠে এবং গরম কফি ও রুটি খাইয়া কাজে লাগিয়া যায়। কৃষক, তাহার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা এবং পুরুষ শ্রমিক প্রভৃতি ক্ষেতের কাজে যায়। এই সব ক্ষেত্রে গম, রাই, ওট, যব প্রভৃতি শস্য হয়। আলু, মটর, বিটমূল, শাকসব্জী প্রভৃতি সর্বত্রই হয়। ‘হপ’ (hop) শস্য কেবল স্বচ্ছল কৃষকেরা উৎপন্ন করে।
“স্বামী যখন ক্ষেতের কাজ করে, সেই সময়ে স্ত্রী গৃহে তাহার ঝুড়িতে মাল ভর্তি করিয়া বাজারে বিক্রয় করিতে যায়। এই ঝুড়ি প্রায় এক গজ লম্বা এবং পিঠে ঝুলানো থাকে। ঝুড়িতে শাকসব্জী, ফল, গৃহে প্রস্তুত রুটী প্রভৃতি থাকে। সহরের লোকরা এগুলি খুব আগ্রহের সঙ্গে কেনে। পিঠের ঝুড়ি যখন ভর্তি হয়, তখন একটা ছোট ঝুড়ি ভর্তি করিয়া মাথার উপরে তাহারা নেয়। এই ঝুড়িতে সময় সময় ডিম থাকে, কিন্তু প্রায়ই বাজারে বিক্রীর জন্য মুরগী লওয়া হয়।
“শীতের মাঝামাঝিই কৃষকদের পক্ষে সুখের সময়। এই সময়ে তাহারা ক্ষেতের কাজ করিতে পারে না, ঘরে বসিয়াই বাসনপত্র মেরামত করে, কিছু ছুতারের কাজ করে, কাস্তে, কোদাল, ছুরি, করাত প্রভৃতি ধার দেয়। স্ত্রীলোকেরা সূতাকাটা, কাপড় বোনা ও কারুসূচীর (এমব্রয়ডারীর) কাজ করে।
“কেবল পুরুষেরা নহে, স্ত্রীলোকেরাও আশ্চর্যরকমের ভারবহন ক্ষমতার পরিচয় প্রদান করে। মাথার প্রকাণ্ড বোঝা লইয়া সোজাভাবে তাহারা পাহাড়ের উপর দিয়া চলিয়া যায়। বোঝা ভারী হইলে সময়ে সময়ে পিঠেও বহন করে। কোনো কোনো সময়ে আবার এই বোঝার উপরে ছোট শিশুকেও দেখা যায়। যাযাবর রমণীদের মত তাহারা শিশুকে সঙ্গে লইয়া চলে, চলিতে চলিতে তাহাকে স্তন্য পান করায়।
“ফ্রিউলির অধিবাসীদের মধ্যে যাযাবর প্রবৃত্তি বেশ লক্ষ্য করা যায়। এখানকার স্ত্রীলোকেরা ৩।৪ বা ৫।৬ জনে দলবদ্ধ হইয়া সমস্ত ইটালী ঘুরিয়া জিনিষ বিক্রয় করে। সঙ্গে ঝুড়ির ভিতরে অথবা পিঠের সঙ্গে থলিয়ায় বাঁধা অবস্থায় তাহাদের শিশু থাকে। পেয়ালা, সূতা, সেলাইয়ের বাক্স, গৃহস্থের প্রয়োজনীয় নানারূপ কাঠের বাসনপত্র এই সব তাহারা বিক্রয় করে। এগুলি পুরুষেরা শীতকালে ঘরে বসিয়া তৈরী করে। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই দীর্ঘ ভ্রমণকালে কোন কোন সময়ে তাহারা মাসের পর মাস ভ্রমণ করে এবং ইটালীসীমান্তও অতিক্রম করে—কোন পুরুষ তাহাদের সঙ্গে থাকে না। এই সব কষ্টসহিষ্ণু, কর্মঠ স্ত্রীলোকেরা স্বাধীনভাবেই নিজেদের ছোটখাট ব্যবসা চালায়।” Life of Benito Mussolini by Margheritta G. Sarfatti.
মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রদেশের সর্বত্র এবং যুক্তপ্রদেশ, বিহার ও পাঞ্জাবেও, কোন কোন শ্রেণীর কৃষক রমণীরা ক্ষেতের কাজে পুরুষদের সাহায্য করে। - ↑ ডাঃ ভোয়েলকার বলেন,—“তাহারা যে উপযুক্ত পরিমাণে ফসল উৎপাদন করিতে পারে না, তাহার প্রধান কারণ—জলসরবরাহ এবং সারের অভাব।” এ বিষয়ে ডাঃ ভোয়েলকারের সঙ্গে আমি একমত হইলেও, আমার পূর্বোল্লিখিত কথাগুলির কোন ব্যত্যয় হয় না। সম্প্রতি সারণ, মীরাট প্রভৃতি স্থানে আমি ভ্রমণ করিয়া আসিয়াছি। সেখানে উৎপন্ন ইক্ষুর শোচনীয় অবস্থা দেখিয়া আমার চোখে জল আসিল। যে ভাবে ইক্ষু হইতে রস নিঙড়ানো ও তাহা জাল দিয়া গুড় করা হয়, তাহাও অতি আদিম অনুন্নত প্রণালীর। জাভার ইক্ষু চাষীরা যে বৈজ্ঞানিক কৃষিপ্রণালী অবলম্বন করিয়া এবং উন্নত প্রণালীতে গুড় প্রস্তুত করিয়া এদেশের ইক্ষুচাষীদিগকে পরাস্ত করিবে, তাহা আর বিচিত্র কি?
- ↑ “আমেরিকার রেড-ইণ্ডিয়ানেরা যখন বন্যপ্রদেশের একমাত্র অধিবাসী ছিল, তখন তাহাদের অভাব অতি সামান্য ছিল। তাহারা নিজেরা অস্ত্র তৈরী করিত, স্রোতস্বিনীর জল ব্যতীত অন্য পানীয় খাইত না এবং পশুচর্ম দিয়া দেহ আচ্ছাদন করিত এবং ঐ পশুর মাংস খাইত।
“ইয়োরোপীয়েরা উত্তর আমেরিকার এই আদিম অসভ্য জাতিদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র, মদ্য এবং লৌহ আমদানী করিল। তাহাদের পশুচর্মের পোষাকের পরিবর্তে কলের বস্ত্রজাত যোগাইল। এইরূপে তাহাদের রুচির পরিবর্তন হইল, কিন্তু তদনুরূপ শিল্পজ্ঞান তাহাদের ছিল না, কাজেই শ্বেতাঙ্গদের প্রস্তুত পণ্যই তাহারা ক্রয় করিতে লাগিল। কিন্তু এই সব পণ্যের পরিবর্তে বন্যজাত ‘ফার’ (পশুলোম) ছাড়া আর তাহাদের কিছু দিবার ছিল না। সুতরাং কেবল নিজেদের জীবনধারণের জন্য নয়, ইয়োরোপীয় পণ্য ক্রয় করিবার নিমিত্তও তাহাদিগকে বনজঙ্গল ঢুড়িয়া পশুহননে প্রবৃত্ত হইতে হইল। এইরূপে রেড-ইণ্ডিয়ানদের অভাব বাড়িতে লাগিল, কিন্তু তাহাদের স্বাভাবিক বন্যসম্পদ ক্ষয় হইতে লাগিল।
“আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলবাসী ইণ্ডিয়ানদের পরিবারের খাদ্য সংগ্রহ করিবার জন্য অত্যধিক পরিশ্রম করিতে হয়। দিনের পর দিন শিকার অন্বেষণ করিয়া তাহাদের ব্যর্থ হইতে হয়, এবং ইতিমধ্যে তাহাদের পরিবারবর্গ গাছের বাকল, শিকড় প্রভৃতি খাইয়া জীবনধারণ করে অথবা অনাহারে মরে। তাহাদের চারিদিকে অভাব, দৈন্য ও দুর্দশা। প্রতি বৎসর শীতকালে তাহাদের অনেকে না খাইয়া মরে।” De Tocqueville—Democracy in America, p. 401.
উপরে উদ্ধৃত বর্ণনার রেড-ইণ্ডিয়ানদের জীবনের এক শতাব্দী পূর্বেকার চিত্র পাওয়া যায়। রেড-ইণ্ডিয়ানেরা এখন প্রায় লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। বাঙালী কৃষকেরাও এইভাবে ধ্বংসের মুখে চলিয়াছে। - ↑ “ভারতে বিশুদ্ধতম লৌহ এবং উৎকৃষ্ট ইস্পাত ছিল। তাহার নিদর্শনস্বরূপ এখন যে সব স্তম্ভ, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি আছে, তাহা বর্তমান ধাতুশিল্পীদের পক্ষে ঈর্ষার বস্তু। দেশীয় লৌহশিল্প যেভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহা ভাবিলে মন বিষাদভারাক্লান্ত হইয়া উঠে। লোহার সম্প্রদায় লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, কর্মকারেরাও ক্রমশঃ ক্ষয় পাইতেছে। কেবলমাত্র রাজারাই অস্ত্রশস্ত্র বর্মাদি তৈরী করাইবার জন্য কত লোক নিযুক্ত করিতেন। দরজার কব্জা, শিকল, তালা প্রভৃতি তৈরী করিবার কত কারখানা ছিল। প্রাচীন শিল্পগুলি লুপ্ত হইয়া যাওয়াতেই জমির উপর এই অত্যধিক চাপ পড়িয়াছে। চলাচলের যানবাহনাদির কথাই দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যাক। স্থলপথে ও জলপথে পণ্য বহন করিবার জন্য কত অসংখ্য লোক নিযুক্ত ছিল। রথ, গাড়ী এবং নৌকা তৈরী করিয়া লক্ষ লক্ষ লোক জীবন ধারণ করিত। বাষ্পচালিত যান এবং মোটর গাড়ী প্রভৃতি এখন সুদূর নিভৃত পল্লীতেও প্রবেশ করিয়াছে।”—জে. সি. রায়, কলিকাতা রিভিউ, অক্টোবর, ১৯২৭।
“পাশ্চাত্য সভ্যতা এই জাতির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও শ্রমবিভাগ রীতির উপর সহসা আক্রমণ করাতে যত কিছু আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটিয়াছে, সমাজের শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে এবং তাহার পুনরুদ্ধার করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। চারিদিক হইতে আমরা ইহারই প্রমাণ পাইতেছি। একদিকে কৃষকদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িতেছে এবং জমির উপর অত্যধিক চাপ পড়িতেছে, অন্যদিকে আধুনিক ধনতন্ত্র ও কলকারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পরাস্ত শিল্পীরা আর্থিক ধ্বংসের মুখে চলিয়াছে, এবং ইহার ফলে নানা রোগ ও মৃত্যুর হার বাড়িয়া যাইতেছে। বাংলার সমতল ভূমিতে বদ্বীপ অঞ্চলে প্রাচীন জলনিকাশ ব্যবস্থা পরিত্যক্ত হইয়াছে, তাহার উপর রেলওয়ে বাঁধ ও রাস্তা প্রভৃতি অবস্থা আরও সঙ্গীন করিয়া তুলিয়াছে। আর এই সকলের ফলে যে দেশ একদিন সুখ শান্তি ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ ছিল, তাহাই এখন দারিদ্র্য ও ম্যালেরিয়ার আবাসভূমি হইয়া উঠিয়াছে।”— স্যার নীলরতন সরকার; এই বিখ্যাত চিকিৎসক রোগের নিদান যথার্থই নির্ণয় করিয়াছেন।
“অনেকেই এখন রেলওয়ের আশ্রয় নেয়। বাঙালী মাঝিমাল্লার মুখে শুনিয়াছি, এই কারণে তাহাদের এক বিষম ক্ষতি হইয়াছে। তাহারা বলে, পূর্বে কোন কোন ভদ্রলোক পরিবারবর্গসহ কাশী, প্রয়াগ বা অন্য কোন তীর্থস্থানে যাইতে হইলে নৌকা ভাড়া করিতেন এবং এইরূপ ভ্রমণে কয়েক সপ্তাহ, এমন কি কয়েক মাসও লাগিত। কিন্তু এখন তাঁহারা রেলগাড়ীতে উঠেন এবং গন্তব্য স্থানে যাইতে একদিন মাত্র সময় লাগে।” বেভারিজ: বাখরগঞ্জ, ১৮৭৬।
বিদেশী পণ্য ও বিলাসদ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরকারী আদেশের দৃষ্টান্ত।
“সাংহাই (চীন) জেলা গবর্ণমেণ্ট ১লা আগষ্ট তারিখে হুকুম জারী করেন যে, চীনাদিগকে কেবলমাত্র দেশজাত পণ্য ব্যবহার করিতে হইবে এবং বিদেশী বিলাসদ্রব্য ত্যাগ করিতে হইবে। হুকুমনামায় আরো লিখিত ছিল যে, চীনা শিল্পব্যবসায়ীদিগকে তাহাদের উৎপন্ন পণ্যের মূল্য হ্রাস করিতে হইবে এবং প্রস্তুতপ্রণালীর উন্নতি করিতে হইবে।”—The China Weekly Review, Aug. 9, 1930.
জাতীয় গঠনকার্যে নিযুক্ত চীনা ছাত্রেরা দেশজাত বস্ত্রাদি পরিতে বাধ্য।
“ন্যান্কিংএর শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তর হইতে ১৬ই মে তারিখে দেশের সমস্ত সরকারী বিদ্যালয়ে এই আদেশ জারী করা হয় যে, সমস্ত ছাত্রদিগকে বস্ত্রনির্মিত ইউনিফরম বা উর্দি পরিতে হইবে এবং ঐ সমস্ত বস্ত্র যতদূর সম্ভব দেশজাত হওয়া চাই।”—The China Weekly Review, May 24, 1930.
চীনা শ্রমিকেরা নূতন সুইডিশ দেশলাই কারখানার বিরুদ্ধে আপত্তি জানাইয়াছে।
“সাংহাইয়ের চৌকাডু নামক স্থানে ‘সুইডিশ ম্যাচ ট্রাস্ট’ কর্তৃক একটি বড় দেশলাইয়ের কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব হয়। ইহার ফলে চীনা শ্রমিকদের মধ্যে ঘোর আন্দোলন উপস্থিত হয়। ‘সাংহাই জেনারেল লেবর ইউনিয়ন প্রিপারেটারি কমিটি’—তারযোগে একটি ঘোষণাপত্রে গবর্ণমেণ্ট ও দেশবাসীর নিকট আবেদন করেন যে, চীনদেশে বিদেশিগণ কর্তৃক দেশলাইয়ের কারখানা স্থাপন বন্ধ করা হোক এবং দেশীয় দেশলাই শিল্পকে রক্ষা করা হোক।”—The China Weekly Review, June 28, 1930. - ↑ দরিদ্র স্ত্রীলোকটি এই ধারণা হইতে পত্র লিখিয়াছিলেন যে, বিলাতী আমদানী সূতা তথাকার লোকের হাতে কাটা। তিনি স্বপ্নেও ভাবিতে পারেন নাই যে, ঐ সব সূতা বাষ্পশক্তি চালিত কলে তৈরী।