আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

গৃহে প্রত্যাগমন—প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক নিযুক্ত

 ঠিক ছয় বৎসর পরে ১৮৮৮ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি কলিকাতা পৌছিলাম। এডিনবার্গ থাকিবার সময়ে আমি আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে ১৫ দিন অন্তর পোস্টকার্ডে একখানি করিয়া পত্র লিখিতাম (জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ডায়মণ্ডহারবারের উকীল ছিলেন)। তিনি বাড়ীতে পিতা মাতাকে আমার খবর লিখিয়া পাঠাইতেন। আমি তাঁহাদিগকে আমার আসিবার নির্দিষ্ট তারিখ, ষ্টিমারের নাম প্রভৃতি জানাই নাই, কেন না আমার জন্য যে তাঁহারা অনাবশ্যক ব্যয় বহন করিবেন, ইহা আমার ইচ্ছা ছিল না। আমার মনে মনে বরাবরই আশঙ্কা ছিল, পিতার আর্থিক অবস্থা পূর্বাপেক্ষা আরও বেশী শোচনীয় হইয়াছে। আমি আমার লগেজ ক্যাবিনে রাখিয়া আসিলাম এবং জাহাজের ‘হেড পার্সারের’ নিকট আট টাকা ধার করিলাম, কেন না আমার তহবিলে এক পয়সাও ছিল না। কলিকাতায় আমার অনেক বন্ধু ছিলেন, আমি তাঁহাদের একজনের বাড়ীতে গিয়া উঠিলাম। আমার প্রথম কাজই হইল—ধুতি ও চাদর ধার করিয়া লইয়া পরা এবং বিদেশী পরিচ্ছদ ত্যাগ করা। দুই একদিন কলিকাতায় থাকিয়া আমি স্বগ্রামে গেলাম। শিয়ালদহ হইতে খুলনা এই আমি প্রথম রেলগাড়ীতে ভ্রমণ করিলাম। ১৮৮২ সালে যখন আমি বিলাত যাত্রা করি, তখন ঐ রেলপথের জন্য জরিপ প্রভৃতি হইতেছিল এবং প্রসিদ্ধ ধনী রথচাইল্ড উহার মূলধন জোগাইবেন বলিয়া শুনিয়াছিলাম। আমি আর এখন যশোরবাসী নহি, খুলনাবাসী। যশোর, ২৪ পরগণা এবং বরিশালের কিছু কিছু অংশ লইয়া নূতন খুলনা জেলা গঠিত হইয়াছিল।

 মাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন। আমার কনিষ্ঠা সহোদরা আমাকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য আর ইহজগতে উপস্থিত ছিল না। এইখানে আমি একটি ঘটনা বলিব, যাহার মূল্য পাঠকগণ নিজেরাই বিচার করিবেন। ইংরাজীতে একটা কথা আছে—‘ভবিষ্যতের ঘটনা বর্তমানের উপর ছায়াপাত করে’। আমার বর্ণিত ঘটনাকে তাহার দৃষ্টান্তস্বরূপও গণ্য করা যাইতে পারে। এডিনবার্গে একদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গিবার পূর্বে আমি অবিকল পূর্বোক্ত ঘটনা (আমার গৃহে প্রত্যাবর্তন এবং কনিষ্ঠা ভগ্নীর জন্য মাতার বিলাপ) স্বপ্নে দেখিয়াছিলাম। দুঃখের বিষয়, আমি স্বপ্নদর্শনের তারিখ লিখিয়া রাখি নাই। রাখিলে অতি-প্রাকৃত দর্শন সম্বন্ধে আর একটা প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারিতাম।[]

 কয়েকদিন বাড়ীতে থাকিয়া আমি কলিকাতায় চলিয়া আসিলাম এবং আমার বন্ধু ডাঃ অমূল্যচরণ বসু এম. বি.-এর গৃহে উঠিলাম। ইঁহার সম্বন্ধে অনেক কথা পরে বলিব। আমি এখন বঙ্গীর শিক্ষাবিভাগে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ পাইবার জন্য ব্যগ্র হইলাম এবং সেই উদ্দেশ্যে ক্রফ্‌ট এবং পেড্‌লারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম। আমি দার্জিলিং-এ গিয়া লেঃ গবর্ণর স্যার স্টুয়ার্ট বেলীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিলাম।

 এদেশের কলেজ সমূহে রসায়ন শাস্ত্রের আদর তখনও হয় নাই। একমাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজে নিয়মিত ভাবে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপনা হইত। লেবরেটরিতে ‘এক্সপেরিমেণ্ট’ (পরীক্ষা) করা হইত। বেসরকারী কলেজের সংখ্যা খুব কম ছিল। এবং তাহাদের তেমন সঙ্গতি না থাকাতে বিজ্ঞান বিভাগ তাহারা খুলিতে পারে নাই। কিন্তু এই সব কলেজের ছাত্রেরা নামমাত্র “ফি” দিয়া প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের ক্লাসে অধ্যাপকের বক্তৃতা শুনিতে পারিত। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁহা কর্তৃক ১৮৭৬ খৃঃ প্রতিষ্ঠিত Indian Association for the Cultivation of Science বা ভারতীয় বিজ্ঞান সমিতিতেও পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্রে বক্তৃতার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন এবং সাধারণে ইহাতে নামমাত্র ফি দিয়া যোগ দিতে পারিত। আমার স্মরণ হয়, ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার গবর্ণমেণ্টের নিকট এই মর্মে পত্র লিখেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানের ক্লাশে বেসরকারী কলেজের ছাত্রদের যোগদানের যে ব্যবস্থা আছে তাহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হউক নতুবা বিজ্ঞান সমিতির বক্তৃতা-গৃহ শূন্য পড়িয়া থাকিবে। ইহাতে বিজ্ঞান সমিতির উপর কোন দোষারোপ করা হয় নাই, বরং সাধারণ ভারতীয় যুবকদের মনের পরিচয়ই পাওয়া যাইতেছে। পরীক্ষার জন্য যদি কোন পাঠ্য বিষয় নির্দিষ্ট না করা হয়, তবে কোন ছাত্র তাহার জন্য পরিশ্রম করিবে না। গবর্ণমেণ্টেরও শীঘ্রই এইরূপ ব্যবস্থা করিতে হইত, কেন না বিজ্ঞান ক্লাশে ছাত্র সংখ্যা দিন দিন বাড়িতেছিল এবং “বি” কোর্স (বিজ্ঞান) ক্রমেই ছাত্রদের নিকট অধিক প্রিয় হইয়া উঠিতেছিল। গত শতাব্দীর আশীর কোঠায় রসায়ন শাস্ত্রের বিরাট পরিবর্তন হইয়াছিল এবং শিক্ষা বিভাগের কর্তৃপক্ষগণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে কেবলমাত্র কতকগুলি প্রাথমিক বিষয়ে বক্তৃতা দিলেই চলিবে না, পরীক্ষাগারে গবেষণা ও ব্যবহারিক শিক্ষার ব্যবস্থাও করিতে হইবে। এই সমস্ত কারণ প্রদর্শন করিয়া পেড্‌লার শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টরকে লিখিলেন তিনি যেন বাংলা গবর্ণমেণ্টকে একজন অতিরিক্ত অধ্যাপক মঞ্জুর করিবার জন্য অনুরোধ করেন। ঠিক এই সময়ে আমি এডিনবার্গ হইতে আসিয়া ঐ অধ্যাপকের পদের জন্য প্রার্থী হইলাম।

 উচ্চতর সরকারী পদে ভারতীয়দের নিয়োগের ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, ঐ বিষয়ে সদিচ্ছা ও বড় বড় প্রতিশ্রুতির অভাব নাই। কিন্তু কার্যত বিশেষ কিছুই ঘটে না। ১৮৩৩ ও ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেণ্ট ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে নূতন সনদ প্রদান উপলক্ষে যে আলোচনা হয়, তাহা পাঠ করিলে দেখা যাইবে অনেক উদারভাবপূর্ণ কথা বলা হইয়াছিল। ১৮৩৩ সালে মেকলের বক্তৃতা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা রূপে গণ্য হইয়া থাকে। মেকলে ১৮৩৪ সালে ভারত গবর্ণমেণ্টের আইন সচিব হইয়া আসিলে ইংরাজী শিক্ষিত ভারতবাসীদের সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। সম্ভবতঃ লণ্ডনে বিখ্যাত সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গেও তাঁহার পরিচয় হইয়াছিল। পাশ্চাত্য সাহিত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত ভারতীয় মেধা কতদূর শক্তিশালী হইতে পারে, তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলেন। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে নূতন সনদ প্রদান উপলক্ষে পার্লামেণ্টে তিনি যে আবেগময়ী বক্তৃতা করেন, তাহাতে নিম্নোদ্ধৃত চিরস্মরণীয় কথাগুলি আছে:—

 “আমাদের শাসন নীতিতে ভারতবাসীদের মন এতদূর প্রসারিত হইতে পারে যে শেষে ঐ নীতিকে সে অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে। সুশাসনের দ্বারা আমরা এদেশের জনসাধারণকে অধিকতর উন্নত গবর্ণমেণ্ট পরিচালনার উপযোগী করিয়া তুলিতে পারি। ইউরোপীর জ্ঞান বিজ্ঞানে সুশিক্ষিত হইয়া তাহারা ভবিষ্যতে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের জন্যই দাবী করিতে পারে। এমন দিন কখনও আসিবে কি না, আমি জানি না। কিন্তু ঐ দিন আসিবার পথে আমি কখনই বাধা দিব না বা উহাকে বিলম্বিত করিব না। যখন ঐ দিন আসিবে তখন উহা ব্রিটিশ ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় দিবস বলিয়া গণ্য হইবে।”

 দই হইতে সর তুলিয়া লইলে তাহা যেমন খেলো জিনিষ হইয়া পড়ে, সেইরূপ মেকলের সদিচ্ছাপূর্ণ বক্তৃতাও ইণ্ডিয়া আফিস ও আমলাতন্ত্রের দপ্তরের মধ্যে কেবল মাত্র শূন্য প্রতিধ্বনিতে পরিণত হইয়াছে। ভারতের কবি-বড়লাট লর্ড লিটন তাঁহার প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক পিতার বহু গুণ পাইয়াছিলেন। লর্ড লিটন অত্যন্ত খোলাখুলি ভাবেই ভারত সচিবকে এ বিষয়ে লিখিয়াছিলেন। ফলে একটা আপোস হয় এবং তাহার ফলেই “স্ট্যাটুটরী সিভিল সার্ভিসের” সৃষ্টি হয়।[]

 যোগ্যতা-সম্পন্ন এবং আভিজাত্য-পন্থী ভারতীয়দিগকে “স্ট্যাটুটরী” সিভিল সার্ভিসে লওয়া হইল, তবে সর্ত থাকিল যে তাহারা আসল সিভিল সার্ভিসের গ্রেডের তিন ভাগের দুই ভাগ বেতন পাইবে। বিলাতে যে প্রতিযোগিতা পরীক্ষা হইবে, তাহা কেবল ব্রিটিশদের জন্য (আইরিশরাও তাহার অন্তর্ভুক্ত) উন্মুক্ত থাকিবে। শিক্ষা-বিভাগেও এই নিয়ম প্রবেশ করিল। আমার তিন বৎসর পূর্বে জগদীশচন্দ্র বসু বিলাত হইতে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি লণ্ডন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহাকেও স্বদেশে শিক্ষাবিভাগে উচ্চতর পদ লাভের চেষ্টায় পদে পদে বাধা পাইতে হইয়াছিল। শেষে তাঁহাকে এই সর্তে উচ্চতর বিভাগে লওয়া হইল যে তিনি—ঐ ‘গ্রেডের’ পূরা বেতন দাবী করিতে পারিবেন না। মাত্র তাহার দুই তৃতীয়াংশ পাইবেন। সবে দুই একটি ক্ষেত্রে ভারতবাসীরা উচ্চতর সার্ভিসে প্রবেশ করিতে পারিয়াছেন, কিন্তু তাহার দ্বারা অবস্থাটা আরও বিসদৃশ হইয়া উঠিয়াছে। সাধারণতঃ যোগ্য ভারতবাসীরাও সার্ভিসের নিম্নস্তরে মাত্র প্রবেশ করিতে পারিতেন। এই ভাবে ভারতীয়গণকে উচ্চতর পদ হইতে বঞ্চিত করাতে ভারতে এবং ভারতবন্ধু ইংরাজগণ কর্তৃক ব্রিটিশ পার্লামেণ্টে আলোচনা হইতে লাগিল এবং তাহার কিছু ফলও হইল। লর্ড ডফরিনের গবর্ণমেণ্ট ভারত সচিবের পরামর্শে একটা “পাবলিক সার্ভিস কমিশন” নিযুক্ত করিলেন। এই কমিশনের উদ্দেশ্য, ভারতবাসীদিগকে কি ভাবে সরকারী কার্যে অধিকতর সংখ্যায় গ্রহণ করা যায়, তাহার উপায় নির্ধারণ করা। কমিশন যে সিদ্ধান্ত করিলেন তাহা কতকটা পূর্বতন নীতির সহিত আপোস রফা। ভারতবাসীদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিবার জন্য যাহাই করা যাক না কেন, প্রভু জাতির স্বার্থ ও সুবিধা যাহাতে অব্যাহত থাকে তাহা সর্বাগ্রে দেখিতে হইবে। “ইম্পিরিয়াল” ও “প্রভিন্‌সিয়াল” এই দুই শ্রেণীর পদের সৃষ্টি হইল,—প্রথম শ্রেণীর পদ ব্রিটিশদের জন্য এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর পদ ভারতীয়দের জন্য। ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের বেতনের পরিমাণ কার্যত প্রভিন্‌সিয়াল সার্ভিসের দ্বিগুণ করা হইল।

 ১৮৮৮ সালের আগষ্ট হইতে ১৮৮৯ সালের জুনের শেষ পর্যন্ত আমার কোন কাজ ছিল না। ঐ সময় আমার বড় অস্বস্তি বোধ হইয়াছিল। আমি টনীকে বলিয়াছিলাম, শ্যামসনের চুলের অভাবে যে দশা হইয়াছিল, লেবরেটরি না থাকিলে রসায়নবিদেরও ঠিক সেই দশা হয়, তাহার কোনই ক্ষমতা থাকে না। এই সময়ে আমি প্রায়ই ডাঃ জগদীশচন্দ্র বসু এবং তাঁহার পত্নীর আতিথ্য গ্রহণ করিতাম। রসায়ন শাস্ত্র ও উদ্ভিদবিদ্যা চর্চ্চা করিয়া প্রধানত আমার সময় কাটিত। কলিকাতার নিকটবর্তী অঞ্চল হইতে আমি কয়েক প্রকার উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করিয়াছিলাম। অবশেষে প্রেসিডেন্সি কলেজের জন্য একটি অধ্যাপকের পদ মঞ্জুর হইল এবং আমি ২৫০ টাকা বেতনে অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হইলাম। স্থানীয় গবর্ণমেণ্টের এর বেশী বেতন মঞ্জুর করিবার ক্ষমতা ছিল না।

 আমি স্বীকার করি যে, ছয় বৎসর বিলাতে থাকিয়া এবং সেখানকার স্বাধীন আবহাওয়ার অননুপ্রাণিত হইয়া আমার মধ্যে যথেষ্ট তেজস্বিতা ছিল এবং আমার দেশবাসীর অধিকার সম্বন্ধে একটা উচ্চ ধারণা মনে পোষণ করিয়াছিলাম। আমি সোজা দার্জিলিংএ গেলাম এবং ক্রফ্‌ট সাহেবকে আমার প্রতি যে অবিচার হইয়াছে, তাহা বলিলাম। আমার মত যোগ্যতাসম্পন্ন কোন ব্রিটিশ রাসায়নিককে যদি আনিতে হইত তবে ভারত সচিব তাঁহাকে একেবারে ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে নিয়োগ করিতেন এবং ভারতে আসিবার জন্য জাহাজ ভাড়া পর্যন্ত দিতেন: ক্রফ্‌ট ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “আপনার জন্য জীবনে অনেক পথ খোলা আছে। কেহ আপনাকে এই পদ গ্রহণ করিবার জন্য বাধ্য করিতেছে না।” আমি যথাসম্ভব প্রশান্ত ভাবে এই অপমান হজম করিলাম। ক্রফ্‌টের অনুকূলে এই কথা বলা উচিত হইবে যে তাঁহার ক্রোধ কতকটা বাহ্যিক, আন্তরিক নহে। তিনি বেশ জানিতেন যে তিনি গবর্ণমেণ্টের নির্মম শাসনতন্ত্রের একটা অংশমাত্র এবং তাঁহার পক্ষে আদেশ পালন করাই একমাত্র কর্তব্য, তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিবার অধিকার তাঁহার ছিল না। দুই বৎসর পরে ঘটনাক্রমে আমি জানিতে পারি যে, ক্রফ্‌ট নিজে অন্ততঃ আমাকে ইম্পিরিয়াল বিভাগে লইবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমার একজন দূর আত্মীয় সেক্রেটেরিয়েটের জনৈক—“কন্‌ফিডেন্‌শিয়াল” কেরাণীর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি আমাকে এক টুকরা কাগজ দেন, উহাতে শিক্ষা বিভাগের কর্তার রিপোর্ট হইতে নিম্নলিখিত কয়েক লাইন উদ্ধৃত করা ছিল:—“মল্লিক ও বেলেটের অবসর গ্রহণের পর ইম্পিরিয়াল বিভাগে আরও দুইটি পদ খালি হইবে। তাহার একটা ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে দিতে হইবে। মিঃ পেডলার ইঁহার খুব প্রশংসা করিয়াছেন।” ইহা হইতে দেখা যাইবে, যদিও আমি মাসিক ২৫০ টাকা বেতনে “unclassified” তালিকায় নিযুক্ত হইয়াছিলাম, কিন্তু আমাকে যথাসময়ে ভারত সচিবের অনুমোদনক্রমে ইম্পিরিয়াল বিভাগে লইবার উদ্দেশ্য ছিল।

 কিন্তু ভাগ্য আমার প্রতি বিশেষ প্রসন্ন ছিল না। এই সময়ে স্যার চার্লস ইলিয়ট বাংলা দেশের শাসন ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি সভয়ে দেখিলেন যে আরও কয়েকজন বাঙালী কেম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড ও লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হইয়া শিক্ষাবিভাগে নিযুক্ত হইয়াছেন এবং ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতেছেন। আমাকে যদি ইম্পিরিয়াল বিভাগে লওয়া হয়, তবে আদর্শটা বড় খারাপ হইবে এবং অন্য সকলকে বিমুখ করা কঠিন হইবে। সুতরাং শিক্ষা বিভাগে “অবাঞ্ছনীয়” লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করিয়া বিভ্রাট ঘটাইতে না পারে, তাহার উপায় উদ্ভাবন করিতে হইবে। তিনি একটি ফতোয়া জারী করিলেন যে, ভারত সচিব যত দিন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রস্তাবাবলী অনুমোদন না করেন, ততদিন পর্যন্ত ভারতীয়দিগকে ইম্পিরিয়াল বিভাগে গ্রহণ করা স্থগিত রহিল।

 কিন্তু ভারত সচিবের দপ্তরে আমাদের জন্য তাড়াতাড়ি কোন সিদ্ধান্ত করিবার জন্য মাথা ব্যথা ছিল না। ব্রিটিশ কর্মচারীদের একচেটিয়া সিভিল বা মিলিটারী সার্ভিসের পক্ষে ক্ষতিকর কোন ব্যাপার যদি হইত, তবে ভারত সচিবের জীবন দুর্বহ হইয়া উঠিত, পার্লামেণ্টে তাঁহাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হইত। ডেপুটেশানের পর ডেপুটেশান যাইয়া প্রতিকারের ব্যবস্থা করিবার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করিত। লণ্ডন “টাইমস” আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া উঠিতেন, ভারতসচিবকে ভীতি প্রদর্শন করিতেন। আধুনিক কালের “লী কমিশনের” ব্যাপার অনুধাবন করিলেই কথাটা বুঝা যাইবে। যাহোক, এখন আমি এ বিষয়ের আলোচনা বন্ধ রাখিয়া প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার অধ্যাপক জীবনের কথাই বলিব।

 আমি ১৮৮৯ সালে সেসনের প্রথমে কাজে যোগদান করি। আমার পক্ষে সত্যই এ আনন্দের কথা। লেবরেটরীতে গবেষণার কাজই আমার জীবনের প্রধান অবলম্বন এবং ইহার জন্য সাগ্রহ প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। রসায়ন বিভাগ তখন একটা একতলা দালানে ছিল। ১৮৭২ সালে বর্তমানের নূতন বাড়ীতে উঠিয়া যাইবার পূর্বে হেয়ার স্কুল ঐ একতলা বাড়ীতে ছিল। রসায়ন বিভাগের বর্তমান বাড়ীতে যে স্থান, তাহার তুলনায় অতি সামান্য স্থানই পুরাতন একতলা বাড়ীতে ছিল। এই বিজ্ঞান শাস্ত্র কতটা উন্নতি করিয়াছে, উপরোক্ত ঘটনা হইতে তাহাও অনুমান করা যাইতে পারে।[] একটা অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, ১৮৭০ সালে প্রথম যখন আমি হেয়ার স্কুলে প্রবেশ করি, তখন যে স্থানে বেঞ্চের উপর বসিতাম, এখন আমার নিজের বসিবার ঘরে চেয়ারখানা ঠিক সেই স্থানেই পাতা হইয়াছিল।

 যাহারা রসায়নশাস্ত্র প্রথম শিখিতেছে, এমন সব ছাত্রের শিক্ষকতায় সাফল্যলাভ করিতে হইলে, ‘এক্সপেরিমেণ্ট’ বা পরীক্ষার কাজে নৈপুণ্য চাই। এমনভাবে এক্সপেরিমেণ্ট সাজাইতে হইবে যে তাহা একদিকে যেমন চিত্তাকর্ষক হইবে, অন্যদিকে বিষয়টিও সহজে বুঝা যাইবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিত্ব বিবেচনা করিয়া অনেক সময় অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়। কোন পদপ্রার্থী হয়ত গবেষণায় প্রশংসনীয় কাজ করিয়াছেন। কিন্তু এই সব ব্যক্তি অধ্যাপকের কাজে সকল সময়ে সাফল্যলাভ করিতে পারেন নাই। ইহার অনেক দৃষ্টান্ত আমি দেখিয়াছি। রসায়নের লেকচারারের পক্ষে সহকারীরূপে কিছুদিন শিক্ষানবিশী করা অত্যাবশ্যক। যাঁহারা এটর্নি বা উকীল হইতে চান, তাঁহাদিগকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া কোন এটর্নির কার্যে বা প্রবীণ উকীলের নিকটে কিছুকাল শিক্ষানবিশী করিতে হয়। তারপর স্বাধীনভাবে ব্যবসা করিতে পারেন। কোন “থিসিস” বা গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখিয়া যাঁহারা বিজ্ঞানে ‘মাষ্টার’ বা “ডক্টর” উপাধি লাভ করেন, তাঁহাদিগকে যদি অকম্মাৎ ছাত্রদের অধ্যাপনা করিতে হয়, তবে তাঁহারা হয়ত মুস্কিলে পড়িবেন। লেবরেটরিতে অতি সাধারণ পরীক্ষা কার্যেও তাঁহাদিগকে ইতস্ততঃ করিতে হয়। একটা সঙ্কোচের ভাব আসে, ফলে তাঁহারা ঐ সব ‘পরীক্ষা’ বাদ দিয়াই যান এবং কেবলমাত্র যন্ত্রটি দেখাইয়া অথবা তদভাবে বোর্ডের উপর চিত্র আঁকিয়াই তাঁহাদের কর্তব্য শেষ করেন। আমার সৌভাগ্যক্রমে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগে পূর্ব হইতেই একটা বনিয়াদ গড়িয়া উঠিয়াছিল। পেডলার বাষ্প (গ্যাস) বিশ্লেষণে বিশারদ ছিলেন এবং পরীক্ষা কার্যে তাঁহার অসীম দক্ষতা ছিল। তাঁহার হাতের নৈপুণ্যও আমাদের সকলের প্রশংসার বিষয় ছিল। দুই একজন সহকারীকে তিনি বেশ শিক্ষিত করিয়া তুলিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি শিক্ষানবীশরূপে প্রথমে কাজ আরম্ভ করেন। অধ্যাপনায় সাফল্যলাভেই আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল, সুতরাং সেজন্য মিথ্যা গর্ব আমি ত্যাগ করিলাম। বিলাত ফেরত গ্রাজুয়েটদের মনে কোন কোন স্থলে বেশ একটু অহমিকার ভাব থাকে। তাহারা মনে করে যে সহকারী বা অধীনস্থদের নিকট হইতে কিছু শিখিতে হইলে তাহাদের জাত যাইবে বা মর্যাদা নষ্ট হইবে। আমার সৌভাগ্যক্রমে এরূপ কোন দৌর্বল্য আমার মনে ছিল না। আমি চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ী এবং পেড্‌লারের সহায়তা গ্রহণ করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইতাম না। এইরূপেই আমি অধ্যাপক জীবন আরম্ভ করিলাম। ক্লাসে কিরূপে নিপুণতার সহিত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করিতে হয়, আমি পুনঃ পুনঃ তাহার মহড়া দিতে লাগিলাম। শীঘ্রই আমি সঙ্কোচের ভাব কাটাইয়া উঠিলাম এবং পরবর্তী সেসন আরম্ভ হইলে দেখিলাম, আমি আমার দায়িত্ব পালনে অপটু নহি।

 লেবরেটরির কাজে এবং ব্যবহারিক ক্লাস চালাইতে আমার অন্যের নিকট শিখিবার বিশেষ কিছু ছিল না। কেননা এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল। “হোপ প্রাইজ স্কলার”রূপে অধ্যাপকের সহকারীরূপে আমাকে কাজ করিতে হইয়াছে, ইহা আমি পূর্বেই বলিয়াছি। প্রথম তিনমাস আমাকে খুব পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল। কিন্তু তাহাতে আমার আনন্দই হইয়াছিল। ক্লাসে যাইয়া বক্তৃতা করিবার পূর্বে প্রায়ই বক্তৃতার সারমর্ম লিখিয়া লইতাম। এই নূতন কাজে আমার খুব আগ্রহ ও উৎসাহ হইল, কেননা এই কাজ আমার পক্ষে বেশ স্বাভাবিক এবং মনোমত বলিয়া বোধ হইল। আমাদের দেশের যুবকেরা জীবনের বৃত্তি অবলম্বনে অনেক সময় বিষম ভুল করিয়া বসে। যাহা পরে আর সংশোধন করা যায় না। কোনরূপ চিন্তা না করিয়া তাহারা একটা পথ অবলম্বন করে এবং অনেক পরে বুঝিতে পারে যে, তাহারা ভুল পথে গিয়াছে। এই শোচনীয় ব্যাপারের জন্য অভিভাবকরাই বেশী দায়ী, এমারসন একস্থলে যথার্থই বলিয়াছেন যে, অভিভাবকরা তাঁহাদের সাবালক সন্তানদের উপর বেশী রকম মনোযোগ দিয়া তাহাদের ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্টই বেশী করেন। একটা চৌকা ছিদ্রের মধ্যে হাতুড়ী পিটিয়া একটা গোলমুখ পেরেক বসাইতে যে অবস্থা হয়, এ ঠিক সেইরকম। সেসনের প্রথম তিনমাস অর্থাৎ জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের পর পূজার ছুটী আসিল। পেডলার তিন মাসের ছুটী লইয়া বিলাতে গেলেন এবং রসায়ন বিভাগের সমস্ত ভার আমার উপর পড়িল। এক হিসাবে আমার শিক্ষক জীবনে সর্বাপেক্ষা কার্য বহুল সময় এই,—কখনও কখনও আমাকে পর পর তিনটি ক্লাসে বক্তৃতা করিতে হইত। কিন্তু কাজেই ছিল আমার আনন্দ এবং যেহেতু এই কাজে আমি এক নূতন উন্মাদনা বোধ করিলাম, সেইজন্য এই গুরুভার বহন করিতে আমার কোন ক্লান্তি হইল না।

 শিক্ষকরূপে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিলাম। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাসহ বক্তৃতা দেওয়াতেও একটু নৈপুণ্য লাভ করিলাম। এখন আমি অবসর সময়ে গবেষণা কার্য করিতে লাগিলাম। বর্তমান সভ্যতার একটা আনুষঙ্গিক ব্যাধি খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ক্রমশঃ বাড়িয়া উঠিতেছিল। ঘি এবং সরিষার তেল, বাঙ্গালীর খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে এই দুইটাই বলিতে গেলে কেবল স্নেহ পদার্থ। বাজারে ঘি ও তেল বলিয়া যাহা বিক্রয় হয়, তাহা বিশুদ্ধ নহে। বাজারে বিক্রীত এই সব দ্রব্যে ভেজাল পদার্থ কতটা পরিমাণে আছে তাহা রাসায়নিক বিশ্লেষণ দ্বারা নির্ণয় করা সহজ কাজ নহে।

 আমি এই শ্রেণীর খাদ্যদ্রব্য বিশেষভাবে পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিলাম। বিশ্বাসযোগ্য স্থান হইতে এই সব দ্রব্য সংগ্রহ করিলাম। নিজের তত্ত্বাবধানেও তৈরী করাইয়া লইলাম। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আমার সাক্ষাতে গরু ও মহিষ দোহান হইল এবং সেই দুধ হইতে আমি মাখন তৈরী করিলাম। সরিষা ভাঙাইয়া তেল তৈরী করাইয়া লইলাম, এবং যে সব তেল সরিষার তেলের সঙ্গে ভেজাল দেওয়া হয়, তাহাও সংগ্রহ করিলাম। এদেশের গরুর দুধ হইতে যে মাখন হয় তাহার স্নেহ উপাদান ব্রিটিশ গরুর দুধের মাখনের চেয়ে একটু স্বতন্ত্র রকমের। সেই কারণে ইংরাজী খাদ্য সম্বন্ধীয় গ্রন্থে ঐ দেশের মাখনের যে বিশ্লেষণাদির পরিচয় থাকে, তাহা আমাদের পক্ষে নির্ভরযোগ্য নহে। কয়েক প্রকারের তেলের নমুনাও বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করিলাম। এই কাজ হাতে লইয়া আমাকে প্রভূত পরিশ্রম করিতে হইল। আমি তিন বৎসর পর্যন্ত এই কার্যে ব্যাপৃত ছিলাম এবং আমার গবেষণার ফলাফল “জার্নাল অব দি এসিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল” পত্রিকায় (১৮৯৪), “কয়েক প্রকার ভারতীয় খাদ্যদ্রব্যের রাসায়নিক পরীক্ষা-প্রথম ভাগ, —চর্বি ও তেল” এই নামে প্রকাশিত হইয়াছিল।[]

 সমাজ সেবা কার্যে ও আমার বেশ উৎসাহ ছিল। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হিসাবে আমি উহার সব কাজে আন্তরিকতার সঙ্গে যোগ দিয়াছিলাম। “ব্রাহ্মবন্ধু সভা” ও তাহার “সান্ধ্যসম্মিলনী” গঠন করিবার ভার আমার উপরেই পড়িয়াছিল, ইহার উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যগণকে একত্রিত করা। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ইহাকে “commonwealth of church of God” বলা যাইতে পারে। ভগবানের এই মন্দিরে সকলেরই সমান অধিকার। আমি ব্রাহ্মসমাজের কার্য নির্বাহক সমিতির (Executive Committee) একজন সদস্য নির্বাচিত হইলাম এবং কয়েক বৎসর সেই পদে কাজ করিলাম।

 ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে সেসনের প্রথমে আমি পুনর্বার সেই পুরাতন অনিদ্রারোগে আক্রান্ত হইলাম এবং ক্রমাগত তিন মাস ভুগিলাম। শান্তিদায়িনী নিদ্রা আমার চক্ষুকে পরিত্যাগ করিল এবং রাত্রির পর রাত্রি জাগ্রত অবস্থায় শয্যায় এপাশ ওপাশ করিয়া আমি অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করিতে লাগিলাম। দূরে গির্জার ঘণ্টা বাজিত—আমি গণিতাম। কার্লাইল এবং হার্বাট স্পেন্‌সারের মত দার্শনিকরাও অনিদ্রারোগে ভুগিয়াছেন, একথা মনে করিয়া আমি সান্ত্বনা পাইলাম না; এবং তাহাতে আমার যন্ত্রণাও কমিল না। কলিকাতার রাস্তার ফুটপাতে যে দিন-মজুর গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া রাত্রি কাটায় তাহার সৌভাগ্যকে আমি ঈর্ষা করিতে লাগিলাম। এক রাত্রি নিদ্রার পর প্রভাতে জাগরণ—আমার নিকট সে কি দুর্লভ বিলাস বলিয়া মনে হইত! অমর কবি সেক্সপীয়রের সেই চিরস্মরণীয় পংক্তিগুলির মর্ম আমি উপলব্ধি করিতে পারিলাম—

“How many thousands of my poorest subjects
Are at this hour asleep! O sleep, O gentle sleep

* * * *

Uneasy lies the head that wears a Crown.”

 আমার ব্যাধি অবশ্য রাজমুকুটের জন্য নহে, অজীর্ণের দরুণ! অক্টোবর মাসে পূজার ছুটীর সময় আমি দেওঘরে হাওয়া বদলাইতে গেলাম। কলিকাতার অপেক্ষাকৃত নিকটে ঐ স্থান স্বাস্থ্যকর বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল। ১৮৯১ সালে বেশি লোক ছুটী কাটাইবার জন্য সেখানে যাইত না। বাসগৃহের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না। যে ২। ৪ খানি ছিল, তাহাও খুব দূরে দূরে অবস্থিত ছিল। খোলা জায়গা যথেষ্ট ছিল। আমার জনৈক বন্ধু আমার জন্য একখানি খড়ো বাড়ী ঠিক করিলেন; উহার জরাজীর্ণ অবস্থা। পূর্বে একজন বাগিচাওয়ালা ঐ বাড়ীতে থাকিতেন। কিন্তু আমি ঐ বাড়ী পাইয়া খুব খুসী হইলাম। কেননা উহার চারিদিকে উন্মুক্ত প্রান্তর ও শস্যক্ষেত্র। রাজনারায়ণ বসু তখন দেওঘর বাসীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। সহস্র সহস্র যাত্রী এই পথে বৈদ্যনাথের মন্দিরে মহাদেবকে দর্শন করিতে যাইত। শিক্ষিত বাঙালীদের নিকট দেওঘরও এক প্রকার তীর্থক্ষেত্র ছিল। তাঁহারা সাধু রাজনারায়ণ বসুকে দর্শন ও তাঁহার সঙ্গ লাভ করিতে আসিতেন। রাজনারায়ণ পারিবারিক জীবনে শোক পাইয়াছিলেন। বয়সেও তিনি অতি বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার কথাবার্তা সরস ও বিবিধ জ্ঞানের ভাণ্ডার স্বরূপ ছিল।

 আমাদের বন্ধু হেরম্বচন্দ্র মৈত্র দেওঘরে আসিয়া শীঘ্রই আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। দেওঘর স্কুলের হেড মাষ্টার যোগেন্দ্রনাথ বসু আর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তখন মধুসূদন দত্তের জীবনচরিতের উপাদান সংগ্রহ করিতেছিলেন। এই অ-পূর্ব জীবনচরিত পরে তাঁহাকে বাংলা সাহিত্যে প্রসিদ্ধ করিয়াছে। রাজনারায়ণ ও মধসূদনের মধ্যে যে সব পত্র ব্যবহার হইয়াছিল, জীবনচরিতের তাহা একটা প্রধান অংশ। রাজনারায়ণ বাবু এগগুলি চরিতকার যোগেন্দ্রবাবুকে দিয়াছিলেন। ঐ সময়ে শিশিরকুমার ঘোষও তাঁহার বাংলোতে বাস করিতেছিলেন। তিনি ‘অমৃতবাজার পত্রিকার’ সম্পাদকীয় দায়িত্ব হইতে সে সময় বস্তুত অবসর গ্রহণ করিয়াছিলেন। সতরাং আমি সৎসঙ্গ লাভ করিলাম। আমরা সকলে মিলিয়া নিকটবর্তী পাহাড়গুলিতে বেড়াইতে যাইতাম। যোগেন্দ্রনাথ বসু তাঁহার মধুসূদন দত্তের জীবনচরিতের পাণ্ডুলিপি হইতে অনেক সময় আমাকে পড়িয়া শুনাইতেন। এখানে একটা করুণ রস মিশ্রিত কৌতুককর ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে। দেওঘরের সর্বত্র “ভেলার” গাছ। একদিন আমি ঐ গাছের একটী ফল চিবাইয়া খাইলাম। উদ্ভিদ তত্ত্ব অনুসারে ভেলা আমের জাতীয়, সতরাং আমি উহাকে অনিষ্টকর মনে করি নাই। তখনই আমার কিছু হইল না। কিন্তু পরদিন আমার মুখ খুব ফলিয়া গেল, এমন কি চোখ পর্যন্ত ঢাকা পড়িল। বন্ধুরা বিষম শঙ্কিত হইলেন। স্থানীয় চিকিৎসক আমাকে বেলেডোনা ঔষধের প্রলেপ দিলেন। তাহাতেই আমি ভাল হইলাম। এক পর্যায়ের উদ্ভিদের মধ্যে অনেক সময় নির্দোষ ও অনিষ্টকর দুই রকমই থাকে, সে কথা আমার স্মরণ থাকা উচিত ছিল। যথা, আলু, বেগুন, লঙ্কা, বেলেডোনা প্রভৃতি একই উদ্ভিদ পর্যায়ের অন্তর্গত।

 পূজার ছুটীর পর আমি সহরে ফিরিলাম। ইহার এক বৎসর পূর্বে আমি ৯১ নং অপার সার্কুলার রোডের বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলাম। পরবর্তী ২৫ বৎসর উহাই আমার বাসস্থান ছিল। এইখানেই বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে কাজ আরম্ভ করিবার কিছু দিন পর হইতেই বিজ্ঞান বিভাগে বাংলা সাহিত্যের দারিদ্র্য দেখিয়া আমার মন বিচলিত হয় এবং রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যা সম্বন্ধে প্রাথমিক পুস্তিকা লিখিবার আমি সঙ্কল্প করি। স্বভাবত প্রথমেই রসায়ন শাস্ত্র সম্বন্ধে পুস্তক লিখিতে আমি প্রবৃত্ত হইলাম। কিন্তু কিছুদূর পর্যন্ত বইখানি লিখিয়া আমি উহা হইতে বিরত হইলাম। আমার মনে হইল প্রাকৃতিক বিষয় অধ্যয়নই বালক বালিকাদের চিত্ত বেশী আকর্ষণ করিবে এবং প্রাণিজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ এই আলোচনার বিপুলক্ষেত্র। জীবজন্তুর গল্প, তাহাদের জীবনযাপন প্রণালী, ভাব, বিশেষত্ব, এই সমস্ত বালক বালিকাদের মন মুগ্ধ করে। ইংরাজীতে এক একটা জীব-গোষ্ঠী সম্বন্ধেই অনেক গ্রন্থ আছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বানর পরিবারের অন্তর্গত গরিলা, শিম্পাঞ্জি ওরাং আউটাং প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। ঐ সমস্ত গ্রন্থই প্রত্যক্ষ জ্ঞানলব্ধ তথ্য লইয়া লিখিত। কৃত্রিম উপায়ে অর্কিডের প্রজনন সাধন (fertilization) প্রভৃতির কৌশলময় বৈচিত্র্য দেখিয়া মন বিস্ময় ও আনন্দে পূর্ণ হয়। কীটের রূপান্তর জীবজগতের একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। এখানে সত্য ঘটনা গল্পের চেয়েও মনোমুগ্ধকর। বাংলা দেশ প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। বৃক্ষলতা এখানে প্রাচুর্যের গৌরবে ভরপুর। ইংলণ্ডে প্রকৃতি কঠোর, রুক্ষ, তুহিনাচ্ছন্ন, কিন্তু বাংলা দেশে শীতকালেও প্রকৃতি তাহার ঐশ্বর্যের মহিমায় বিকশিত হয়।

 শীতপ্রধান দেশে গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ার বৃক্ষলতার জীবন্ত নমুনা সংগ্রহ করা কি কঠিন ব্যাপার! ইহাদিগকে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য কনজারভেটরী বা রক্ষণাগার প্রভৃতির ব্যবস্থা করিতে হয়। ইহার প্রমাণ একবার ‘কিউ গার্ডেনে’ গেলেই দেখা যায়। আর বাংলাদেশে প্রকৃতি মুক্তহস্ত হইয়া তাহার অজস্র দান চারিদিকে বিতরণ করে। কলিকাতা ছাড়িয়া দিলে, বাংলার সমস্ত স্থানই গ্রাম এবং যাহারা এই কলিকাতা সহরে বাস করে, তাহারা মাণিকতলার সেতু পার হইলে বা গঙ্গা পার হইয়া শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলেই ইচ্ছামত বৃক্ষলতার নমুনা সংগ্রহ করিতে পারে। বাংলার নদীসমূহ বিচিত্র প্রকারের মৎস্যে পূর্ণ এবং বনজঙ্গলে বিচিত্র রকমের জীবজন্তুর বাস। এক কথায়—সমস্ত বাংলা দেশটাই একটা বীক্ষণাগার বিশেষ। তরুণবয়স্কদিগকে প্রাথমিক বিজ্ঞান শিক্ষা দিবার একটা প্রধান উদ্দেশ্য, তাহাদের অন্তর্নিহিত পর্যবেক্ষণ শক্তিকে উদ্বোধিত করা এবং বৃক্ষলতা ও জীবজন্তুর জীবন ইতিহাসের মধ্য দিয়া যে শিক্ষা পাওয়া যায়, তাহাতে এই উদ্দেশ্য সুন্দররূপে সিদ্ধ হয়। বাহ্য আকার প্রকারে কুকুর হইতে বিড়ালের পার্থক্য কি? আর একটু ভিতরে তলাইয়া এই দুই প্রাণীর নখ, দাঁত প্রভৃতি পরীক্ষা করা যাক। আরও ভিতরে নামিয়া তাহাদের স্বভাব ও অভ্যাস, মুখভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য, থাবা প্রভৃতি পরীক্ষা করা যাইতে পারে, যথা রন্ধনশালায় দুধের সর, মাছভাজা, প্রভৃতি রাখিয়া পোষা বিড়ালকেও কি বিশ্বাস করা যায়? এইদিকে আরও অনেক আলোচনা করা যাইতে পারে। বিড়াল ও কুকুর পর্যায়ের যে সব মাংসাশী প্রাণী বনে থাকে তাহাদের আকৃতি প্রকৃতি, কোন, কোন অঞ্চলে তাহাদের বাস ইত্যাদি। মোট কথা, জীবজন্তুর কাহিনী তরুণবয়স্কদের চিত্ত সহজেই অধিকার করে এবং সচিত্র প্রাণিবিজ্ঞানের বহি তাহাদের নিকট গল্পের চেয়েও মনোরম।

 এই সব কথা ভাবিয়া বাংলাভাষায় প্রাণিবিজ্ঞান সম্বন্ধে আমি একখানি প্রাথমিক গ্রন্থ লিখি। বি, এস-সি, পড়িবার সময় আমি এই বিজ্ঞান সম্বন্ধে যাহা শিখিয়াছিলাম তাহা কাজে লাগিল, কিন্তু এবিষয়ে আরও আমাকে পড়িতে হইল। প্রাণিবিজ্ঞান সম্বন্ধে আমি বহু প্রামাণিক গ্রন্থ অধ্যয়ন করিলাম এবং জীবজন্তুদের কার্যকলাপ ও অস্থিসংস্থান পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রায়ই পশুশালা এবং যাদুঘরে যাইতাম। আমার বন্ধু নীলরতন সরকার এবং প্রাণকৃষ্ণ আচার্য তখন নূতন ডাক্তারী পাশ করিয়াছেন। তাঁহাদের সাহায্যে আমি কয়েকটি প্রাণীর দেহব্যবচ্ছেদও করিলাম। আমার স্মরণ আছে, একদিন প্রাতর্ভ্রমণের সময় আমি একটি ‘ভাম’ (Indian Palm Civet) রাস্তার ধারে দেখিতে পাইলাম। বোধ হয় সহরের প্রান্তভাগে কোন বাড়ীতে নিশীথ অভিযান করিতে গিয়া সে নিহত হইয়াছিল। আমি এই “নমুনাটি” সংগ্রহ করিয়া বিজয়গৌরবে বাড়ী লইয়া গেলাম এবং তৎক্ষণাৎ আমার পূর্বোক্ত ডাক্তার বন্ধুদ্বয়কে উহা ব্যবচ্ছেদ করিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলাম। আমরা একটি “নেচার ক্লাব”ও খুলিলাম। ডাক্তার নীলরতন সরকার এবং ডাঃ প্রাণকৃষ্ণ আচার্য ব্যতীত রামব্রহ্ম সান্যাল (আলিপুর পশুশালার সুপারিনটেণ্ডেণ্ট), প্রিন্সিপাল হেরম্বচন্দ্র মৈত্র এবং ডাঃ বিপিনবিহারী সরকার ঐ ক্লাবের সদস্য ছিলেন। আমরা নিয়মিতভাবে মাসে একবার করিয়া সভা করিতাম। গ্রীষ্মের ছুটীতে গ্রামের বাড়ীতে গিয়া আমি কয়েকটা গোখুরা সাপ ধরাইলাম এবং তাহাদের বিষদাঁত পরীক্ষা করিলাম। ফেরারের Thanatophidia এর সাহায্যে সর্পদংশনের রহস্য সম্বন্ধেও আলোচনা করিলাম।

 এই সময়ে (১৮৯১—৯২) আর একটি বিষয় গুরুতর ভাবে আমার চিত্ত অধিকার করিল। আমাদের দেশের ধ্রুবকেরা কলেজ হইতে বাহির হইয়াই কোন আরামপ্রদ সরকারী চাকরী, তদভাবে ইউরোপীয় সওদাগরদের আফিসে কেরাণীগিরি খোঁজে। আইন, ডাক্তারী প্রভৃতি বৃত্তিতেও খুব ভিড় জমিতে আরম্ভ হইয়াছিল। কেহ কেহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হইতে পাশ করিয়া বাহির হইত, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাহারাও অসহায়ভাবে চাকরী খুঁজিত। এই অবসরে কর্মকুশল, পরিশ্রমী অ-বাঙালীরা বিশেষভাবে রাজপুতানার মরুভূমি হইতে আগত মাড়োয়ারীরা, কেবল কলিকাতায় নয়, বাংলার অভ্যন্তরে দূরে গ্রাম পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িতেছিল, আমদানি রপ্তানি ব্যবসায়ের সমস্ত ঘাঁটি তাহারা দখল করিয়া বসিতেছিল; সংক্ষেপে কঠোর প্রতিযোগিতায় বাঙালীরা পরাস্ত হইতেছিল এবং যে সব ব্যবসা-বাণিজ্য তাহাদের দখলে ছিল, ক্রমে ক্রমে সেগুলির অধিকার ছাড়িয়া দিয়া তাহাদের সরিয়া পড়িতে হইতেছিল। কলেজে শিক্ষিত বাঙালী যুবকেরা সেক্সপিয়রের বই হইতে মুখস্থ বলিতে পারিত এবং মিল ও স্পেন্সারও খুব দক্ষতার সঙ্গে আওড়াইতে পারিত, কিন্তু জীবনযুদ্ধে তাহারা পরাস্ত হইত। তাহাদের চারিদিকে অনাহারের বিভীষিকা। তবু হাইস্কুলের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িতেছিল এবং ব্যাঙের ছাতার মত কলেজ গজাইয়া উঠিতেছিল। এই সমস্ত যুবকদের লইয়া কি করা যাইবে? বিজ্ঞান শিক্ষা ক্রমে ক্রমে যুবকদের প্রিয় হইয়া উঠিতেছিল। কিন্তু যুবকদের এবং তাহাদের অভিভাবকদের মনে একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল যে, লজিক, দর্শনশাস্ত্র বা সংস্কৃতের পরিবর্তে রসায়ন বা পদার্থ বিদ্যা প্রভৃতি শিখিলে তাহারা কোন না কোন প্রকারে ব্যবসা-বাণিজ্য ফাঁদিয়া বসিতে পারিবে, অন্ততঃ জীবিকার জন্য চাকরী খুঁজিয়া বেড়াইতে হইবে না। কিন্তু শীঘ্রই দেখা গেল, এই ধারণা ভুল। গত শতাব্দীর ৯০এর কোঠায় যাহারা রসায়ন শাস্ত্রে এম, এ পড়িত (এম, এস-সি ডিগ্রী তখনও হয় নাই) তাহারা সঙ্গে সঙ্গে আইনও পড়িত। আমি প্রায়ই তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতাম, রসায়নের সঙ্গে আইনের সম্বন্ধ কি? অধিকাংশস্থলে উত্তর পাওয়া যাইত যে, “আর্ট কোর্সে” বহু বই মুখস্থ করিতে হয়। কিন্তু রসায়ন শাস্ত্রে কম বই পড়িতে হয়। লেবরটারির কষ্টকর কার্যেও তাহাদের আপত্তি নাই! অবশ্য কেহ কেহ রসায়ন শাস্ত্র ভালবাসিত বলিয়াই উহা পড়িত। এ সম্বন্ধে আমি একটি বিশেষ দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতেছি। একজন বি, এল উপাধিধারী ছাত্র রসায়নে এম, এ, পড়িত, আদালতে সে কিছু দিন ওকালতীও করিয়াছিল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে সে আদালত ছাড়িয়া কলেজে আসিল কেন? ছাত্রটি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল “আমি এম, এ, পাস করিলে আমার নামের শেষে এম, এ, বি, এল উপাধি যোগ করিতে পারিব এবং তাহার ফলে আমার ‘মুন্সেফী’ চাকরী পাইবার যোগ্যতা বাড়িবে।” আমি বেদনাহত চিত্তে বলিয়া ফেলিলাম—“হায়, রসায়ন শাস্ত্র, কি উদ্দেশ্যে তোমাকে ব্যবহার করা হইতেছে!”

  1. ইটালীর স্বাধীনতার যোদ্ধা গ্যারিবল্ডী আমেরিকা থাকিবার সময় তাঁহার মাতার মৃত্যু সম্বন্ধে এইরূপ অতি-প্রাকৃত স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন।
  2. লর্ড লিটন ‘স্ট্যাটুটরী সিভিল সার্ভিস’ প্রবর্তনের কারণ প্রদর্শন করিয়া ভারতসচিবকে এই পত্র লিখেন।
  3. Fifty years of Chemistry at the Presidency College, “Presidency College Magazine” vol. I., 1914, p. 106.
  4. এখন খাদিপ্রতিষ্ঠানে এই সকল খাঁটি দ্রব্য সরবরাহ করিবার ভার লওয়া হইয়াছে।