আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ
বেঙ্গল কেমিক্যাল এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস—তাহার উৎপত্তি
ইউরোপে শিল্প ও বিজ্ঞান পাশাপাশি চলিয়াছে। উভয়েরই এক সঙ্গে উন্নতি হইয়াছে। একে অপরকে সাহায্য করিয়াছে। বস্তুত আগে শিল্পের উদ্ভব হইয়াছে, তাহার পরে আসিয়াছে বিজ্ঞান। সাবান তৈয়ারী, কাচ তৈয়ারী, রং এবং খনি হইতে ধাতুর উৎপত্তি বিগত দুই হাজার বৎসর ধরিয়া লোকে জানিত। রসায়ন শাস্ত্রের সঙ্গে ঐ সমস্ত শিল্পের সম্বন্ধ আবিষ্কৃত হইবার বহুপূর্ব হইতেই ঐ গুলির উদ্ভব হইয়াছিল। অবশ্য, বিজ্ঞান শিল্পকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় শিল্পের যে বিরাট উন্নতি হইয়াছে, তাহার সঙ্গে বীক্ষণাগারে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। বাংলাদেশে কতকগুলি “টেকনোলজিক্যাল বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠিত করাই সর্বাপেক্ষা বেশী প্রয়োজনীয় নহে; সফল ব্যবসায়ী বা শিল্পপ্রবর্তক হইতে হইলে যে সাহস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, কর্মকৌশলের প্রয়োজন, বাংলার যুবকদের পক্ষে তাহাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। কলেজে শিক্ষিত যুবক এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়াছে, তাহার মধ্যে কার্য পরিচালনার শক্তি নাই,—বড় জোর সে অন্যের হাতের পুতুল বা যন্ত্রদাসরূপে কৃতিত্ব দেখাইতে পারে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপকরূপে প্রবেশ করিয়া এই সব চিন্তা আমার মনকে বিচলিত করিয়াছিল। বাংলার সর্বত্র প্রকৃতির যে অজস্র দান ছড়াইয়া আছে, তাহাকে কিরূপে শিল্পের উপাদান রূপে ব্যবহার করা যায়? মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অনাহারক্লিষ্ট যুবকদের মুখে অন্ন যোগাইবার ব্যবস্থা করা যায় কিরূপে? এই উদ্দেশ্যে লেবুর রস বিশ্লেষণ করিয়া সাইটিক অ্যাসিড প্রস্তুত করিলাম। কিন্তু কলিকাতার বাজারে লেবু এমন প্রচুর পরিমাণে বা সস্তায় পাওয়া যায় না, যাহাতে সাইট্রিক অ্যাসিড বিক্রয় করিয়া লাভ হইতে পারে। সুতরাং আমি এমন সমস্ত দ্রব্য প্রস্তুত করিতে মনস্থ করিলাম যাহা অপেক্ষাকৃত অল্প পরিমাণ উৎপাদন করা যায়—এবং বাজারে সহজে কাট্তি হয়। এই ব্যবসায়ে বেশী মূলধন লাগিলে চলিবে না এবং আমার অন্য কাজেও ইহাতে ব্যাঘাত হইবে না। কয়েকবার চেষ্টা করিয়া শেষে ভেষজ বা ঔষধ সংক্রান্ত দ্রব্য প্রস্তুত করাই উপযোগী বলিয়া স্থির হইল। কলিকাতার ঔষধের দোকানগগুলি আমি পরীক্ষা করিলাম এবং ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার ঔষধগুলি কি পরিমাণ এদেশে আমদানী হয়, তাহাও আমদানিকারকদের নিকট হইতে অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম। মেসার্স বটকৃষ্ণ পাল এণ্ড কোং তখন (বোধহয় এখনও) সর্বপ্রধান ঔষধ ব্যবসায়ী এবং তাঁহাদের ব্যবসা খুব বিস্তৃত ছিল। এই ফার্মের প্রাণস্বরূপ পরলোকগত ভূতনাথ পাল আমাকে ভরসা দিলেন যে যদি ঠিক জিনিস সরবরাহ করা যায় তবে ক্রেতার অভাব হইবে না।
এডিনবার্গে বিশ্ববিদ্যালয় কেমিক্যাল সোসাইটীর সদস্য রূপে আমরা বিবিধ রাসায়নিক কারখানা দেখিতে যাইতাম—যথা পুলরস ডাই ওয়ার্কস (পার্থ), ম্যাক ইউয়েনস ব্রুয়ারী (এডিনবার্গ), ডিসটিলেশন অব শেলস (বার্ণটিসল্যাণ্ড) ইত্যাদি। কিন্তু আমাদিগকে কোন ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসে (ঔষধ তৈরীর কারখানা) প্রবেশ করিতে দেওয়া হইত না, যদি কোন ব্যবসাঘটিত গুপ্তকথা প্রকাশ হইয়া পড়ে এই আশঙ্কা। প্রথম দৃষ্টিতে এই ঈর্ষা নিন্দনীয় বিবেচিত হইতে পারে, কিন্তু তবু ইহা ক্ষমার যোগ্য। এই সমস্ত ফার্ম বিপুল অর্থ ব্যয় ও বহু বৎসর ধরিয়া অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া তবে হয়ত এমন কোন প্রণালী আবিষ্কার করে, যাহার বলে তাহারা প্রতিযোগিতায় সাফল্যলাভ করিতে পারে। সতেরাং আমি ঐ সকল যাহা দেখিয়াছিলাম তাহা কোন কাজে লাগিল না। ইংল্যাণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডে রাসায়নিক কারখানাগুলি খুব বড় আকারে চালানো হয়। উহার আনুষঙ্গিক অন্যান্য শিল্প থাকে এবং তাহাদের পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ বর্তমান। আমি পাঠ্যগ্রন্থে পড়িয়াছিলাম যে সালফিউরিক অ্যাসিড, অন্যান্য সমস্ত শিল্পের মূল স্বরূপ। সেণ্ট রোলক্স (গ্লাসগোতে) টেনাণ্ট এণ্ড কোম্পানির বিরাট সালফিউরিক অ্যাসিডের কারখানা দেখিয়া আমি ঐ কথা বেশ বুঝিতে পারিলাম।
আমি যখন এই কাজে প্রথম প্রবৃত্ত হই, তখন আমার পশ্চাতে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার পথপ্রদর্শকও কেহ ছিল না। তাহার পর শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশ অতীত হইয়াছে। আমদানি রপ্তানির কাজ আশ্চর্যরূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে—কিন্তু এই সময়ের মধ্যে রাসায়নিক শিল্পে বাংলায় খুব কম উন্নতিই হইয়াছে! আমি ‘সাল্ফেট অব আয়রন’ (হীরাকস) লইয়া কাজ আরম্ভ করিলাম। কলিকাতার বাজারে ইহার চাহিদা ছিল। কুচা লৌহ (Scrap Iron) প্রচুর পরিমাণে প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া যাইত এবং আমি সালফিউরিক অ্যাসিড সম্বন্ধে সন্ধান করিলাম। কলিকাতায় কলেজে পড়িবার সময় পরীক্ষা কার্যের জন্য আমি স্থানীয় জনৈক ঔষধ-ব্যবসায়ীর নিকট সালফিউরিক অ্যাসিড সংগ্রহ করিতাম। আমি তখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছিলাম যে, বিদেশ হইতে সালফিউরিক অ্যাসিড আমদানী করিতে হয় না, কেন না কাশীপুরের ডি ওয়াল্ডি এণ্ড কোং প্রচুর পরিমাণে সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিয়াছে। এখন অনুসন্ধান করিয়া আমি জানিতে পারিলাম যে, ডি ওয়াল্ডির কারখানা ব্যতীত কলিকাতার আশে পাশে আরও ৩।৪টী কারখানায় সালফিউরিক অ্যাসিড তৈয়ারী হয়। এই সব কারখানার মালিক কার্তিকচন্দ্র সিংহ, মাধবচন্দ্র দত্ত প্রভৃতি। ইউরোপ ও আমেরিকায় সালফিউরিক অ্যাসিড কি পরিমাণে ব্যবহৃত হয়, ইহা যাঁহারা জানেন, কলিকাতার এই সব কারখানার প্রস্তুত সালফিউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ শুনিয়া তাঁহাদের মনে অবজ্ঞার ভাবই আসিবে। এখানে গড়ে এক একটা কারখানায় দৈনিক ১৩ হন্দরের (cwts) বেশী সালফিউরিক অ্যাসিড তৈয়ারী হইত না। সালফিউরিক অ্যাসিড হইতে আর দুইটী ধাতব অ্যাসিড—নাইট্রিক ও হাইড্রোক্লোরিক তৈয়ারী হইত। এগুলি মাটীর কলসীতে চোঁয়ানো হইত। এই প্রাথমিক ধরণে অ্যাসিড তৈয়ারীর ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে বিরক্তি হইল। এই সব ধাতব অ্যাসিড ‘বিপজ্জনক পদার্থ’ বলিয়া জাহাজে আমদানি করিতে খুব বেশী খরচা পড়িত, সেই কারণেই এ দেশে প্রস্তুত অ্যাসিড বিক্রয় করিয়া কিছু লাভ হইত। আমার যে কিছু সালফিউরিক অ্যাসিড দরকার হইত, ডি ওয়াল্ডির নিকট হইতেই তাহা আনাইতাম। কিন্তু এই সময় একটা অচিন্তিতপূর্ব ঘটনায় আমার কার্যের পরিধি বিস্তৃত হইল।
আমার গ্রামবাসী যাদবচন্দ্র মিত্র আলিপুর ফৌজদারী আদালতে মোক্তারী করিতেন। তিনি এই শ্রেণীর একটি সালফিউরিক অ্যাসিডের কারখানা কিনিয়াছিলেন। আসগর মণ্ডল নামক একব্যক্তি কারখানাটির প্রতিষ্ঠাতা। টালিগঞ্জের প্রায় তিনমাইল দক্ষিণে সোদপুর নামক গ্রামে বাঁশবনের মধ্যে এই কারখানা অবস্থিত ছিল। মিত্র আমাকে কারখানা দেখিবার জন্য অনুরোধ করিলেন এবং বলিলেন যে আমার রাসায়নিক জ্ঞানের দ্বারা আমি ইচ্ছা করিলে কারখানাটির উন্নতি সাধন করিতে পারি। আমার সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের ডেমনাষ্ট্রেটার চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ীকে লইলাম। চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ীর রাসায়নিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার একটা সহজ প্রতিভা ও দূরদৃষ্টি ছিল। চন্দ্রভূষণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুলভূষণ ভাদুড়ীও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। কুলভূষণ রসায়ন শাস্ত্রে এম, এ, এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে স্বর্ণপদক পাইয়াছিলেন।
৩৭ বৎসর পরে আমি এই বিবরণ লিখিতেছি। কিন্তু এখনও আমার স্পষ্ট মনে পড়িতেছে একদিন শনিবার অপরাহ্ণে ছুটীর পর কলেজ হইতেই আমরা কারখানা দেখিতে রওনা হইলাম। ১০×১০×৭ ফিট এই মাপের দুইটি সিসার কামরা লইয়া কারখানা। বলা বাহুল্য এরূপ কারখানাতে ‘গ্লোভার’ বা ‘গে লুসাকের’ টাওয়ার বসাইবার কোন উপায় ছিল না। যে অশিক্ষিত মিস্ত্রী কারখানা তৈরী করিয়াছিল, তাহার এসব জ্ঞানও ছিল না। আমরা খুব ভাল করিয়া কারখানাটি পরীক্ষা করিলাম এবং কি উপায়ে উহার উন্নতি করা যায়, তাহা চিন্তা করিতে লাগিলাম। এইটি এবং অন্যান্য কয়েকটি ছোট ছোট অ্যাসিডের কারখানায় যে দৃশ্য দেখিলাম, তাহা আমার মনে দৃঢ়ভাবে অঙ্কিত হইল। মনে মনে ক্ষোভ ও গ্লানি অনুভব করিলাম, এমন কথাও বলিতে পারা যায়। ইউরোপের যন্ত্রশিল্প এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, এক একজন লোক কি বিপুল বাধাবিঘ্নের মধ্য দিয়া কাজ করিয়াছে এবং শেষে আপনার অক্লান্ত সাধনার ফল জগৎকে দান করিয়া শিল্প জগতে হয়ত যুগান্তর আনয়ন করিয়াছে, অথচ তাহাদের প্রায় সকলেই উচ্চশিক্ষার সংযোগ হইতে বঞ্চিত। লে ব্ল্যাঙ্ক বিদেশে হাসপাতালে দারিদ্র্যের মধ্যে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, কিন্তু আধুনিক ‘অ্যালকালির’ (alkali) তিনিই আবিষ্কর্তা, জেমস ওয়াট, স্টিফেনসন, আর্করাইট, হারগ্রিভ্স, বার্নার্ড পালিসি প্রভৃতি সকলেরই দরিদ্রের ঘরে জন্ম। কিন্তু তবু তাঁহারা পর্বতপ্রমাণ বাধাকে জয় করিয়া অবশেষে সাফল্য লাভ করিয়াছিলেন। স্মাইল্সের “ইঞ্জিনিয়ারদের জীবন চরিত” গ্রন্থে দেখি, ঐ সব ইঞ্জিনিয়ারদের প্রায় কেহই ধনীর ঘরে জম্মেন নাই। সাধারণ গৃহস্থের সন্তান তাঁহারা। রাস্তানির্মাতা জন মেটকাফ গরীব মজুরের ছেলে, ছয় বৎসর বয়সে তিনি অন্ধ হন। মিনাই সেতুর নির্মাতা টেলফোর্ড এক বৎসর বয়সে অনাথ হন এবং তাঁহার বিধবা মাতাকে সংসারের সঙ্গে বিষম সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল।
আমি ইহার পর সাজিমাটি লইয়া পরীক্ষা আরম্ভ করিলাম এবং ইহা হইতে কার্বনেট অব সোডা প্রস্তুত করিতে চেষ্টা করিলাম। উত্তর ভারতে সাজিমাটি স্মরণাতীত কাল হইতে বস্ত্র প্রভৃতি পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। কিন্তু আমি দেখিলাম যে ইহাতে খরচ পোষায় না, কেননা তাহা অপেক্ষা ভাল সাজিমাটি সস্তায় বিক্রয় হয়। ব্রানার মণ্ড এণ্ড কোম্পানির কারখানায় এই সোডা তৈয়ারী হইত। ঔষধ-ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, এই ফার্ম কার্যত এসিয়ার বাজার একচেটিয়া করিয়া ফেলিয়াছে। চীন ও জাপানেও ইহাদের সোডাই চালান যাইত।
ফস্ফেট অব সোডা এবং সুপার ফস্ফেট অব লাইম লইয়া পরীক্ষা করিলাম। এই সব দ্রব্য বিদেশ হইতে কেন আমদানি করিতে হয়! অথচ যে উপকরণ (গবাদি পশুর হাড়) হইতে এই সব দ্রব্য তৈয়ারী হয়, তাহাতো প্রচুর পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি করা হইতেছে। আমার তখনকার কাজের জন্য মাত্র ১০। ১৫ মণ হাড়ের গুঁড়ার প্রয়োজন। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম যে আমারই বাসস্থানের নিকটে রাজাবাজারে যে সব কসাইয়ের দোকান আছে, ঠিকাদারেরা সেখান হইতে গাড়ী বোঝাই করিয়া হাড় লইয়া যায়। রাজাবাজারে বহু অশিক্ষিত পশ্চিমা মসলমান থাকিত এবং গোমাংস ইহাদের প্রধান খাদ্য ছিল। কয়েক বস্তা কাঁচা হাড় সংগ্রহ করিয়া আমার বাড়ীর ছাদে শুকাইতে দেওয়া হইল। তখন শীতকাল, বাংলাদেশে সাধারণতঃ এই সময়ে আকাশ পরিষ্কার থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বৎসর জানুয়ারী মাসে পনর দিন ধরিয়া ক্রমাগত বৃষ্টি হইল। তাহার ফলে হাড়ের সংলগ্ন মাংস পচিয়া দুর্গন্ধ বিকীর্ণ করিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে সেই পচা মাংসে সূতার মত পোকা দেখা দিল। সন্ধান পাইয়া ঝাঁকে ঝাঁকে কাকের দল আমার গৃহ আক্রমণ করিল এবং মনের আনন্দে পচা মাংস ও পোকা ভোজন করিতে লাগিল এবং হাড়গুলি টানাটানি করিয়া আমার প্রতিবাসীদের গৃহেও ছড়াইতে লাগিল। আমার বাড়ীর চারিদিকেই নিষ্ঠাবান হিন্দুদের বাস। তাঁহারা সানুনয়ে আমাকে হাড়গুলি অন্যত্র সরাইতে বলিলেন। এমন আভাষও দিলেন যে, আমি স্বেচ্ছায় না সরাইলে তাঁহারা করপোরেশনের হেল্থ অফিসারের সাহায্য গ্রহণ করিবেন। সতরাং হাড়গুলি আমাকে তৎক্ষণাৎ সরাইবার ব্যবস্থা করিতে হইল। সৌভাগ্যক্রমে, আমার পরিচিত একজন নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবসায়ী আমার সাহায্যার্থ অগ্রসর হইলেন। মুরারিপুকুরের[১] নিকট মানিকতলায় তিনি একখণ্ড জমি ইজারা লইয়াছিলেন। আমাকে হাড়গুলি সেই স্থানে পাঠাইয়া দিতে বলিলেন। হাড়গুলি সেখানে পাঠাইয়া দেওয়া হইল, এবং ইঁটের পাঁজার মত স্তুপাকার করিয়া তাহাতে অগ্নি সংযোগ করা হইল। মধ্যরাত্রিতে সেই হাড়ের স্তুপ জ্বলিয়া উঠিল। স্থানীয় বিটের পুলিশ ব্যাপার সন্দেহজনক মনে করিয়া “ইয়া ক্যা লাস জলতা হ্যা” বলিতে বলিতে দৌড়াইয়া আসিল। তাহার ভ্রম দূরে করিবার জন্য একটা লম্বা বাঁশ দিয়া ভিতর হইতে কতকগুলি হাড় টানিয়া বাহির করিয়া তাহাকে দেখানো হইল। পুলিশ কনেষ্টবল সন্তুষ্ট হইয়া চলিয়া গেল। হাড়ের ভস্ম এখন কাজে লাগানো হইল। সালফিউরিক অ্যাসিড যোগে উহা সুপার ফস্ফেট অব লাইমে পরিণত হইল এবং তাহার পর সোডার প্রতিক্রিয়ায় ফস্ফেট অব সোডা হইল।
ছাত্রদিগকে আমার অধ্যাপনার প্রণালী সম্বন্ধে এইখানে একটু বলিব। আমি টেবিলের উপরে পোড়ানো হাড়ের গুঁড়ার নমুনা রাখিতাম। যে উপকরণ হইতে ইহা প্রস্তুত তাহার সঙ্গে এখন আর কোন সম্বন্ধ নাই। গরু, ঘোড়া অথবা মানুষের কঙ্কাল হইতেও উহার উৎপত্তি হইতে পারিত। হাড় ভস্ম রাসায়নিক হিসাবে বিশুদ্ধ মিশ্রপদার্থ, রাসায়নিকদের নিকট ইহা “ফস্ফেট অব ক্যালসিয়ম” এবং চূর্ণ আকারে ইহা স্নায়বিক শক্তিবর্ধক ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয়; আমি অনেক সময় খানিকটা হাড়ভস্ম আমার মুখে ফেলিয়া দিতাম এবং চিবাইয়া গিলিয়া ফেলিতাম এবং ছাত্রদেরও তাহাই করিতে বলিতাম। কেহ কেহ বিনা দ্বিধায় আমার অনুকরণ করিত; কিন্তু অন্য কেহ কেহ আবার ইতস্ততঃ করিত, তাহাদের মন হইতে গোঁড়ামির ভাব দূর হইত না। অল্পদিন পূর্বে আমার একজন ভূতপূর্ব ছাত্রের সঙ্গে দেখা হইয়াছিল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র এবং এখন মাড়োয়ারী সমাজের অলঙ্কার, রাজনীতিক, অর্থনীতিবিৎ এবং ব্যবসায়ী হিসাবে খ্যাতনামা। তিনি হাসিতে হাসিতে কলেজ জীবনের এই পুরাতন কথা আমাকে স্মরণ করাইয়া দিলেন (শ্রীযুক্ত দেবীপ্রসাদ খৈতান)।
যে সমস্ত রাসায়নিক দ্রব্য বিদেশ হইতে আমদানী হয়, তাহার কতকগুলি এই দেশেই প্রস্তুত করিবার সমস্যা সমাধান করিয়া, আমি ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার ঔষধ তৈয়ারীর দিকে মনোযোগ দিলাম। Syrup Ferri Iodidi, Liquor Arsenicalis প্রভৃতি কতকগুলি ঔষধ প্রস্তুত করা একজন শিক্ষিত রাসায়নিকের পক্ষে শক্ত নহে, ইহা দেখিয়া আমি আশ্বস্ত হইলাম। ইথার তৈয়ারী করিতেও আমি প্রবৃত্ত হইলাম। কিন্তু ঐ কার্য করিতে করিতে ভীষণ বিস্ফোরণে কাচপাত্র ভাঙিয়া চুরমার হইল দেখিয়া আমি সতর্ক হইলাম। বাজারের সোরাকেও বিশুদ্ধ করিয়া পটাস নাইট্রস বি, পি, তে পরিণত করা গেল।
পুরাতন বোতল, শিশি প্রভৃতি বহুবাজারের বিক্রীওয়ালাদের নিকট হইতে যত ইচ্ছা সংগ্রহ করা যায়, আমি তাহাদের গুদাম পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিলাম। আমার প্রয়োজনের মত জিনিস যে এখান হইতেই সংগ্রহ করা যাইবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত হইলাম।
এই সমস্ত গোড়ার কথা ঠিক করিয়া একটা ঔষধের কারখানা খুলিবার জন্য আমি মনস্থ করিলাম। এই কারখানার কি নাম হইবে, তাহা লইয়া বহু চিন্তার পর অবশেষে বর্তমান নামটি (বেঙ্গল কেমিক্যাল এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস) দেওয়াই স্থির করিলাম। নামটি একটু লম্বা, কিন্তু রাসায়নিক ও ভেষজ উভয় প্রকার পদার্থের পরিচয়ই নামের মধ্যে থাকা চাই, ইহাই আমার ইচ্ছা ছিল। নামটি যে ঠিকই হইয়াছিল, তাহা সময়ে প্রমাণিত হইয়াছে। অন্ততঃপক্ষে এই নামের সম্বন্ধে কেহ কোন আপত্তি করে নাই।
এখন আমার প্রস্তুত ঔষধাদি বাজারে কিরূপে চালানো যায়, সেই চিন্তা করিতে লাগিলাম। আমি একজনকে ‘দালালের’ কাজে শিক্ষিত করিয়া তুলিয়াছিলাম। সে আমার ঔষধ তৈয়ারীর জন্য কাঁচামাল কিনিত এবং আমার প্রস্তুত দ্রব্য বাজারে বিক্রয় করিত। একটী যুবক আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতার (ডাক্তার) নিকট কম্পাউণ্ডারের কাজ করিত। বর্তমানে সে বসিয়া ছিল। আমি তাহাকে গ্রাম হইতে লইয়া আসিলাম। ডিস্পেন্সারিতে যে সব সাধারণ ঔষধ ব্যবহৃত হয়, সেগগুলির নাম সে জানিত। তাহার নিকট আমি আমার ঔষধ তৈয়ারীর কল্পনার কথা বলিলাম। যুবকটি প্রাইমারি ষ্ট্যাণ্ডার্ড পর্যন্ত পড়িয়াছিল, লেখাপড়া সামান্য শিখিয়াছিল,—ইংরাজীও কিঞ্চিৎ জানিত। তাহার দ্বারা আমার কাজ বেশ চলিতে লাগিল। তখনকার দিনে ম্যাট্রিক পাশ ছেলে বেশি ছিল না, যাহারা ইংরাজী স্কুলের উচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত পড়িত, অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে কোন কলেজের দরজা পার হইত, তাহাদের একটা ভ্রান্ত মর্যাদাজ্ঞান জন্মিত এবং এই জাতিভেদের দেশে, তাহাদের মনে এক নূতন জাত্যভিমানের সৃষ্টি হইত। আমার নির্বাচিত যুবকটির এসব দোষ ছিল না। সে আমার সঙ্গেই থাকিত এবং সামান্য পারিশ্রমিক লইত। তবে জিনিস বিক্রয়ের উপর তাহাকে কিছু কমিশন দিব বলিয়াছিলাম। সে তরুণবয়স্ক, সুতরাং তাহার মধ্যে উৎসাহ বা আদর্শবাদের অভাব ছিল না। আমার মনের ছোঁয়াচও তাহার লাগিয়াছিল। লোহার উপর সালফিউরিক অ্যাসিডের প্রতিক্রিয়ায় সবজে রঙের দানাদার ফেরি সালফ (বি, পি,) হইতে দেখিয়া সে একদিন উচ্ছসিতভাবে বলিয়াছিল—“ভগবান, কি আশ্চর্য এই রসায়ন বিজ্ঞান!” আবার দুর্গন্ধধময় গলিত হাড় হইতে সোডি ফস্ফ (বি, পি,) এর উদ্ভব দেখিয়া সে ভয়ে এ বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল। আমার প্রস্তুত ঔষধগুলি ইউরোপীয় কায়দায় বোতলে পুরিয়া লেবেল আঁটা ও প্যাক করা হইত। সেগুলি লইয়া আমার দালাল এখন ঔষধের বাজারে ঘুরিতে লাগিল।
স্থানীয় ঔষধবিক্রেতাগণের সাধারণত রসায়নশাস্ত্রে কোন জ্ঞান নাই। তাহারা বড়জোর হিসাব করিয়া ব্যবসায়ে লাভ ক্ষতি গণনা করিতে পারে। তাহারা আমার প্রস্তুত ঔষধ দেখিয়া প্রশংসা করিল, কিন্তু মাথা নাড়িয়া বলিল,—“বড় বড় নামজাদা বিলাতি ফার্মের ঔষধ সহজেই বিক্রয় হয়, কিন্তু দেশি ঔষধ লোকে চায় না।” সতরাং গোড়া হইতেই আমাদিগকে কঠোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছে।
এই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটিল, যাহা কেবল যে আমার প্রচেষ্টার নূতন শক্তি সঞ্চার করিল তাহা নহে,—আমাদের ব্যবসায়ের উপরও উহার ফল বহুদূরপ্রসারী হইল।
একদিন আমার এক পুরাতন সতীর্থ আমার এই নূতন প্রচেষ্টার কথা শুনিয়া আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। তাঁহার মনে খুব স্বদেশানুরাগ ছিল এবং তিনি উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন যে, আমাদের যুবকদের জন্য যদি নূতন নূতন জীবিকার পথ উন্মুক্ত না হয়, তবে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারসমস্যা প্রবল হইয়া আর্থিক ধ্বংস ও জাতীয় দুর্গতি আনয়ন করিবে। ইনিই ডাঃ অমূল্যচরণ বসু। চিকিৎসা ব্যবসায়ে তিনি তখন বেশ সাফল্যলাভ করিয়াছেন এবং এই সময় হইতে আমাদের নূতন ব্যবসায়ে যোগ দিয়া তিনি অনেক কাজ করিয়াছিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে ভিতরের দিকের ঘরে লইয়া গেলাম, যেখানে বড় বড় কটাহ ও ভাটিতে ফেরি সাল্ফ, সোডি ফস্ফ এবং অন্যান্য কয়েকটি রাসায়নিক দ্রব্য দানা বাঁধিতেছিল। আমার নূতন ব্যবসায়ের প্ল্যান আমি তাঁহাকে বলিলাম এবং তাহা যে সম্ভবপর তাহাও বুঝাইয়া দিলাম। অমূল্যচরণ উৎসাহী লোক ছিলেন। তিনি আমার কথায় আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন এবং সাগ্রহে আমার সঙ্গে যোগ দিলেন।
তাঁহার সহযোগিতা আমাদের পক্ষে খুবই মূল্যবান হইল। তিনি যে কেবল ব্যবসায়ে মূলধন হিসাবে আর্থিক সাহায্যই করিলেন তাহা নয়, আমাদের প্রস্তুত ঔষধগুলি যাহাতে ডাক্তারদের সহানভূতি লাভ করিতে পারে, তাহার জন্যও চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সোদপুরের অ্যাসিডের কারখানা যাদব মিত্র লাভজনক ব্যবসারূপে চালাইতে পারিলেন না, কেন না যে লোকটির উপর তিনি এই কারখানার ভার দিয়াছিলেন, তাহার বেতন অতি সামান্য ছিল, কাজও সে কিছু বুঝিত না। যাদব মিত্র এক হাজার টাকায় আমাকে এই কারখানা বিক্রয় করিতে চাহিলেন। কিন্তু টাকা কোথায় পাওয়া যায়? তিন বৎসর চাকরী করিয়া ব্যাঙ্কে আমার ৮০০৲ টাকা জমিয়াছিল, সে টাকা গোড়ার দিকে পরীক্ষার কাজেই ব্যয় হইয়া গিয়াছিল। মিত্র আমার আর্থিক অবস্থা ভালই জানিতেন। আমি যদি টাকার জন্য হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া দিই তাহা হইলেই তিনি কারখানা ছাড়িয়া দিতে রাজী হইলেন। দুই এক মাস পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিযুক্ত পরীক্ষক হিসাবে আমার প্রায় ছয় শত টাকা পাওয়ার কথা। অবশিষ্ট টাকা আমি কয়েক কিস্তিতে শোধ করিতে পারিব। এই সমস্ত ভাবিয়া আমি মিত্রের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া চুক্তি পাকা করিলাম এবং তৎক্ষণাৎ অ্যাসিডের কারখানার দখল লইলাম। কিন্তু আর একটা নূতন বাধা উপস্থিত হইল। আমার বাসস্থান হইতে এই কারখানা ছয় মাইল দূরে, স্থানটিও সুগম নয়। সুতরাং কারখানার কাজ কিরূপে চালানো যাইবে। চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ীরও এ বিষয়ে উৎসাহ ছিল, আমি তাঁহার সঙ্গে পরামর্শ করিলাম। তিনি আমার সঙ্গে একমত হইলেন। ১৮৯৩ সালের গ্রীষ্মের ছুটী কেবল আরম্ভ হইয়াছে, মে ও জুন এই দুই মাস ছুটী। চন্দ্রভূষণ, তাঁহার ভ্রাতা কুলভূষণ এবং তাঁহাদের একজন আত্মীয়, সোদপুরের এই দুর্গম স্থানে গেলেন। যেখানে তাঁহারা বাসা লইলেন সে একটা মাটির কুটীর। নিকটে কোন বাজার ছিল না, কোন মাছ তরকারিও পাওয়ার উপায় ছিল না। সতরাং তাঁহাদিগকে কয়েক বস্তা চাল এবং আলু সংগ্রহ করিয়া লইয়া যাইতে হইয়াছিল। এই দিয়া বাঁশবনে তাঁহারা মহানন্দে চড়ুইভাতি করিতে লাগিলেন। তাঁহারা অ্যাসিডের ঘরগুলি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলেন এবং এই ‘আদিম’ প্রণালীতে কার্য করাতে কাঁচামালের যে পরিমাণ অপচয় হইতেছে, তাহা দেখিয়া দঃখিত হইলেন। এইরূপে একটি ছোট কারখানা যদি কোন মূলধনী নিজে চালায় এবং সমস্ত খুটিনাটি দেখাশুনা করে, তাহা হইলে লাভজনক হইতে পারে। কিন্তু কোন শিক্ষিত রাসায়নিকের এরূপ স্থানে কোন কাজ নাই।
ভাদুড়ীভ্রাতাগণ জুলাই মাসে কলেজ খুলিতেই সোদপুর হইতে চলিয়া আসিলেন। কিন্তু কিরূপে আধুনিক প্রণালীতে একটি অ্যাসিডের কারখানা স্থাপন করা যায়, তৎসম্বন্ধে তাঁহারা রিপোর্ট আমাকে দিলেন। কিন্তু তখনও ঐরূপ কোন কারখানা স্থাপনের সময় হয় নাই। আমি প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করিতে পারিলাম না এবং ঔষধ প্রস্তুতের দিকেই আমাকে সমস্ত অবসর সময় ব্যয় করিতে হইত। ইহার দশ বৎসর পরে বৃহদাকারে কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানা কার্যে পরিণত করা হইল। তাহার সঙ্গে একটি অ্যাসিড তৈরীর বিভাগও যুক্ত হইল।
ইতিমধ্যে আমি ঔষধ প্রস্তুতের কাজে ডুবিয়া গেলাম। ‘ফার্মাসিউটিক্যাল জার্নাল’, ‘কেমিষ্ট এণ্ড ড্রাগিষ্ট’ প্রভৃতি সাময়িক পত্র হইতে এই বিষয়ে খুব সাহায্য পাওয়া যাইত। আমার নিজের চেষ্টাতেই নানা কঠিন সমস্যার সমাধান করিতে হইত। একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। আমি যে সিরাপ অব আইওডাইড অব আয়রন প্রস্তুত করিতাম তাহা কিছুদিন রাখিলে ঈষৎ পীতাভ হইত। বিলাত হইতে যে ঔষধ আমদানী হইত তাহাতে অনেকদিন পর্যন্ত ঈষৎ সবজে রং থাকিত। কিরূপে এই সমস্যার সমাধান করা যায়? একদিন পূর্বোক্ত সাময়িক পত্রগুলি উল্টাইতে উল্টাইতে আমি ইহার সমাধানের পন্থা খুঁজিয়া পাইলাম। ফেরাস আইওডাইড প্রস্তুত হইলে, তাহার সঙ্গে একট, হাইপো ফস্ফরাস অ্যাসিড যোগ করিলেই উহাতে যতদিন ইচ্ছা ঈষৎ সবুজ রং থাকিবে। এইরূপে আমি ঔষধ প্রস্তুতের কাজে অভিজ্ঞতা লাভ করিতাম এবং কোন সমস্যা উপস্থিত হইলে, তাহার সমাধানে তৎপর হইতাম।
এই সময়ে আমাদের জিনিস বাজারে বেশ চলিতে আরম্ভ করিল, এবং স্থানীয় ঔষধ বিক্রেতাদের আলমারিতে স্থান পাইল। প্রথম প্রথম ঔষধের নমুনা লইয়া যাওয়া মাত্র অনেকে আমাদের বিরুদ্ধতা করিতেন, আমাদের কাজের সম্বন্ধে শ্লেষ বিদ্রূপ করিতেন। তাঁহাদের মধ্যে কাহারও কাহারও এখন মত পরিবর্তন হইতে লাগিল এবং তাঁহারা আমাদের তৈয়ারী জিনিসের প্রশংসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তবু তাঁহারা তাঁহাদের গ্রাহকদের এই বলিয়া নিন্দা করিতে ত্রুটি করিতেন না যে, তাঁহাদের দেশি জিনিসের উপর আস্থা নাই। ইতিমধ্যে অমূল্যচরণ ডাক্তার-মহলে আমাদের জিনিসের জন্য খুব প্রচারকার্য করিতে লাগিলেন। একটা প্রবাদ আছে, “চোর ধরিবার জন্য চোরকেই লাগাও”। প্রবাদটির মূলে কিছু সত্য আছে। পরলোকগত রাধাগোবিন্দ কর, অমূল্যচরণ বসু, প্রভৃতিকে কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের প্রবর্তকরূপে গণ্য করা যাইতে পারে। তাঁহাদিগকে আমাদের পক্ষে আনা কঠিন হইল না। তাঁহাদের সমব্যবসায়ী অন্যান্য উদীয়মান চিকিৎসকগণ—নীলরতন সরকার, সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী প্রভৃতিও স্বদেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হইয়া ক্রমে আমাদের প্রস্তুত এট্কিন্স্ সিরাপ, সিরাপ অব হাইপোফস্ফাইট অব লাইম, টনিক গ্লিসেরোফসফেট, প্যারিশ কেমিক্যাল ফুড প্রভৃতিও ব্যবহারের ব্যবস্থা দিতে লাগিলেন।
স্মরণাতীত কাল হইতে আমাদের কবিরাজেরা যে সব দেশি ভেষজ ব্যবহার করিয়া আসিতেছেন, অমূল্যচরণ ও রাধাগোবিন্দের সে সমস্তের উপর একটা সহজ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। যে সমস্ত ডাক্তারি ঔষধ প্রচলিত ছিল, আমি সেইগুলিই প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করি, কিন্তু অমূল্যচরণ আমাদের ব্যবসায়ে নূতন পথ প্রদর্শন করিলেন। তিনি কয়েকজন কবিরাজের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আয়ুর্বেদীয় ঔষধের প্রস্তুত প্রণালী সংগ্রহ করিলেন। কালমেঘের সার, কুচ্চির সার, বাসকের সিরাপ, জোয়ানের সার প্রভৃতি ভেষজের প্রস্তুত প্রণালী তিনি আমার নিকট উপস্থিত করিলেন। এতদ্ব্যতীত তিনি নিজে এই সমস্ত দেশীয় ভেষজের জন্য প্রচারকার্য করিতে লাগিলেন। ডাক্তারদিগকে তিনি বলিতেন যে, এই সমস্ত ঔষধের গুণ বাংলার ঘরে ঘরে বহু বৎসরব্যাপী ব্যবহারের ফলে প্রমাণিত হইয়াছে। এখন কেবল আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে উহাদের ভেষজ শক্তিকে কাজে লাগাইতে হইবে এবং ডাক্তারদিগকে উহা ব্যবহার করিতে হইবে। অমূল্যচরণ নিজে ঐ সব দেশীয় ঔষধ ব্যবহার করিয়া পথ প্রদর্শন করিলেন। ধীরে ধীরে এই সব দেশীয় ঔষধের উপকারিতা স্বীকৃত হইতে লাগিল। তখনকার দিনে ‘টলুর সিরাপ’ ব্যবহার করা সর্বত্র প্রচলিত ছিল। কিন্তু দেখা গেল, বাসকের সিরাপ উহা অপেক্ষা অধিকতর ফলপ্রদ। আমাদের নবপ্রবর্তিত দেশীয় ভেষজ এইভাবে নিজের গুণেই সর্বত্র প্রচারিত হইতে লাগিল।
এস্থলে উল্লেখযোগ্য যে, ১৮৪১ সালে ও, সোগনেসী দেশীয় ভেষজ ব্যবহারের কথা বলেন; তারপর কানাইলাল দে, মদীন শেরিফ, উদয়চাঁদ দত্ত ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ায় কতকগগুলি দেশীয় ভেষজ অন্তর্ভুক্ত করিবার জন্য বহু চেষ্টা করেন। অর্ধ শতাব্দী পরে ঐ সমস্ত চিকিৎসকগণের প্রস্তাবের প্রতি চিকিৎসকগণের মনোযোগ আকৃষ্ট হইল। ১৮৯৮ সালে কলিকাতায় ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল কংগ্রেসের যে অধিবেশন হইল, তাহাতে আমরা একটি ষ্টল খুলিয়া আমাদের প্রস্তুত দেশীয় ভেষজ প্রদর্শন করিয়াছিলাম। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে আগত ডাক্তারদের দৃষ্টি উহার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইল। ডাঃ কানাই লাল দে তখন মৃত্যুর দ্বারে অতিথি বলিলেও হয়। কিন্তু তাঁহারই অনুপ্রেরণায় মেডিক্যাল কংগ্রেসের কাউন্সিল কতকগুলি দেশীয় ভেষজকে গ্রহণ করিবার জন্য চিকিৎসক সঙ্ঘের নিকট আবেদন করিলেন। ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার কর্তারা অবশেষে সে আবেদন গ্রাহ্য করিলেন এবং দেশীয় ভেষজ ফার্মাকোপিয়ার ‘পরিশিষ্টে’ স্থান লাভ করিল।
বাজারে এখন আমরা প্রবেশ করিবার সুযোগ পাইলাম। পাইকারী ব্যবসায়ীরা আমাদের জিনিস সম্বন্ধে খোঁজ করিতে লাগিলেন। দেশি জিনিস প্রচলন করিবার বিরুদ্ধে একটা প্রধান বাধা ছিল এই যে, কলিকাতায় ঔষধের বাজার প্রধানত অশিক্ষিত স্থানীয় এবং পশ্চিমা মুসলমানদের হাতে ছিল। ইহাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র স্বদেশপ্রীতি ছিল না এবং ইহারা স্থানীয় ভেষজপ্রস্তুতকারকদের উপর অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করিতে ছাড়িত না। ‘দেশি চিজ’এর বাজারে চাহিদা ছিল না, সুতরাং মূল্য না কমাইলে, তাহারা ঐ সব জিনিস বাজারে চালাইতে চাহিত না। মূল্য কমাইলেও, নগদ দাম তাহারা দিত না, নির্দিষ্ট কালের জন্য টাকা ফেলিয়া রাখিতে হইত। সৌভাগ্যক্রমে বাঙালীদের পরিচালিত দুই একটি ফার্ম প্রথম হইতেই আমাদের প্রস্তুত জিনিসের আদর করিতেন। একদিন আমরা বেশি পরিমাণে কতকগুলি কাঁচামাল খরিদ করিয়াছিলাম— যথা আইওডিন, টলু, বেলেডোনা প্রভৃতি। কলিকাতার প্রধান ঔষধ ব্যবসায়ী মেসার্স বটকৃষ্ণ পাল অ্যাণ্ড কোম্পানির পরলোকগত ভূতনাথ পাল, আমরা এত অধিক পরিমাণে আইওডিন কিনিতেছি দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। আমরা ৭ পাউণ্ড আইওডিন কিনিয়াছিলাম। কলিকাতার বা মফঃস্বলের কোন সাধারণ ঔষধালয় মাসে, এমন কি বৎসরে এক পাউণ্ডের বেশি আইওডিন কিনিত না। ভূতনাথবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা একবারে এত বেশি আইওডিন কিনিয়া কি করিবেন?” আমরা যখন তাঁহাকে বুঝাইয়া দিলাম যে আইওডিন হইতে ‘সিরাপ ফেরি আইওডাইড’ প্রস্তুত হইবে, তখন তাঁহার কৌতূহল বর্ধিত হইল। তাঁহার কাছে আমাদের জিনিসের ‘অর্ডার’ দেওয়ার জন্য পূর্বেই অনুরোধ করা হইয়াছিল, কিন্তু তিনি উহাতে তেমন গুরুত্ব দান করেন নাই, কেন না স্বভাবতই আমাদের প্রচেষ্টার উপর তাঁহার বিশ্বাস জন্মে নাই, কিন্তু এখন তাঁহার চোখ খুলিল। ৭ পাউণ্ড আইওডিন এবং টলু প্রভৃতির দ্বারা ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার ঔষধ তৈরারী হইবে, ব্যাপারটা তুচ্ছ নয়! পাল তৎক্ষণাৎ এক হন্দর সিরাপ ফেরি আইওডাইডের জন্য অর্ডার দিলেন এবং আমার যতদূর স্মরণ হয়, এক হন্দর ফেরি সাল্ফের জন্যও তিনি অর্ডার দিয়াছিলেন।
যখন আমার হাতে এই অর্ডার আসিল, আমার আনন্দের আর সীমা রহিল না। কলেজ হইতে ফিরিয়া প্রত্যহ অপরাহ্ণে (প্রায় ৪॥০টার সময়) আমি পূর্বদিনের প্রাপ্ত অর্ডারগুলি দেখিতাম এবং যাহাতে ঐ সব জিনিস শীঘ্র সরবরাহ হয় তাহার ব্যবস্থা করিতাম। কলেজ লেবরেটরী হইতে আমার ফার্মেসীর লেবরেটরীতে যাওয়া আমার পক্ষে বিশ্রামের মতই ছিল। আমি তৎক্ষণাৎ আমার নূতন কাজে প্রবৃত্ত হইতাম এবং অপরাহ্ণ ৪॥০টা হইতে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খাটিয়া কাজ শেষ করিতাম। কাজের সঙ্গে আনন্দ থাকিলে তাহাতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় না। যে সমস্ত ঔষধ বিদেশ হইতে আমদানী হইত, তাহাই এদেশে প্রস্তুত করিতে পারিতেছি, এই ধারণাই আমার মনে বল দিত। সিরাপ ফেরি আইওডাইড, স্পিরিট অব নাইট্রিক ইথর, টিংচার অব নক্সভমিকা প্রভৃতি প্রকৃতপক্ষে লেবরেটরীতে তৈরী হয়, কেন না ঐগুলি প্রস্তুত করিতে শিক্ষিত রাসায়নিকের প্রয়োজন। প্রত্যেকটি নমুনার জন্য গ্যারাণ্টি দিতে হইবে, ইহার জন্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা চাই।
এই সময় আমার পক্ষে একটা বিষম অনর্থপাত হইল। অমূল্যের ভগ্নীপতি সতীশচন্দ্র সিংহ রসায়ন শাস্ত্রে এম, এ, পাশ করিয়া আইনের পড়াও শেষ করে। মামুলী প্রথায় আইন পরীক্ষায় পাশ করিয়া সে হয়ত ওকালতী আরম্ভ করিত। কিন্তু অমূল্যের আদর্শে তাহার চিত্ত অনুপ্রাণিত হইল, সে নিজের রাসায়নিক জ্ঞান কাজে লাগাইতে ইচ্ছুক হইল এবং এই উদ্দেশ্যে আমাদের নূতন ব্যবসায়ে যোগ দিল। একটা নূতন ব্যবসায়, ভবিষ্যতে যাহার দ্বারা বিশেষ কিছু লাভের আশা নাই, তাহার কাজে এইভাবে আত্মোৎসর্গ করা কম আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহসের পরিচায়ক নহে। এরূপ কাজে কঠোর পরিশ্রমের জন্য প্রস্তুত হইতে হয় এবং কিছু কালের জন্য লাভের কোন আশাও মন হইতে দূর করিতে হয়। যুবক সতীশ আমার একজন প্রধান সহকারী হইল, সে কিছু মূলধনও ব্যবসায়ে দিয়াছিল। রাসায়নিক কাজে এ পর্যন্ত বলিতে গেলে আমি এককই ছিলাম এবং আমার পক্ষে অত্যন্ত বেশী পরিশ্রমও হইত। তাছাড়া যে অবসর সময়টুকুতে আমি অধ্যয়ন করিতাম, তাহাও লোপ হইয়াছিল, আমি সতীশকে আমার উদ্ভাবিত নূতন প্রণালীর রহস্য বুঝাইতে লাগিলাম এবং সে শিক্ষিত রাসায়নিক বলিয়া শীঘ্রই এ কাজে পটুতা লাভ করিল। আমরা দুইজন একসঙ্গে প্রায় দেড় বৎসর উৎসাহসহকারে কাজ করিলাম এবং আমাদের প্রস্তুত বহু দ্রব্যের বাজারে বেশ চাহিদা হইল। কোন কোন চিকিৎসক তাঁহাদের ব্যবস্থাপত্রে যতদূর সম্ভব আমাদের ঔষধ ব্যবহার করিতে লাগিলেন। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা আমাকে ভীষণ অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়া উত্তীর্ণ হইতে হইবে। একদিন বৈকালে আমি অভ্যাসমত ভ্রমণে বাহির হইয়াছিলাম। রাত্রি ৮॥টার সময় বাড়ী ফিরিয়া শুনিলাম, সতীশ আর নাই। বজ্রাঘাতের মতই এই সংবাদে আমি মুহ্যমান হইলাম। দৈবক্রমে হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড বিষে তাহার মৃত্যু হইয়াছে। আমি প্রায় জ্ঞানশূন্যে অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দিকে ছুটিলাম। সেখানে সতীশের মৃতদেহ স্ট্রেচারের উপরে দেখিলাম। আমি নিশ্চল প্রস্তরমূর্তির মত বাহ্যজ্ঞান শূন্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম—বহুক্ষণ পরে প্রকৃত অবস্থা আমি উপলব্ধি করিতে পারিলাম। এই তরুণ যুবক জীবনের আরম্ভেই কালগ্রাসে পতিত হইল, পশ্চাতে রাখিয়া গেল তাহার শোকসন্তপ্ত বৃদ্ধ পিতামাতা এবং তরুণী বিধবা পত্নী। অমূল্য ও আমার মানসিক যন্ত্রণা বর্ণনার ভাষা নাই। আমাদের বোধ হইল, আমরাই যেন সতীশের মৃত্যুর কারণ। সেই ভীষণ দুর্ঘটনার পর ৩২ বৎসর অতীত হইয়াছে, কিন্তু এখনও এই সমস্ত কথা লিখিতে আমার সমস্ত শরীর যেন বিদ্যুৎস্পর্শে শিহরিয়া উঠিতেছে।
কিছুকালের জন্য মনে হইল যে আমাদের সমস্ত আশা ভরসা চূর্ণ হইয়া গেল। প্রথম শোকের উচ্ছ্বাস প্রশমিত হইলে, অমূল্য ও আমি সমস্ত অবস্থা ভাবিয়া দেখিলাম; “ভগবান যাহাকে দিয়াছিলেন, ভগবানই তাহাকে ফিরাইয়া লইলেন” এই কথা ভাবিয়া আমি সান্ত্বনালাভের চেষ্টা করিলাম। আমি আর পশ্চাতে ফিরিতে পারি না। পুনর্বার আমাকেই সমস্ত গুরু দায়িত্ব স্কন্ধে তুলিয়া লইতে হইল। কঠোর দৃঢ়সঙ্কল্পের সঙ্গে আমি সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিবার জন্য প্রস্তুত হইলাম।
সৌভাগ্যক্রমে কর্মের বৈচিত্র্যই আমার পক্ষে বিশ্রাম, জীবনের সান্ত্বনাস্বরূপ ছিল। ফরমাইস মত দ্রব্য যোগাইতেই হইবে। বস্তুত এক একটা বড় অর্ডার কাজের উৎসাহ বৃদ্ধি করিত। এবং সে সময়ে কঠোর পরিশ্রম করিয়াও আমার স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হইত না। সকালবেলা দুই ঘণ্টা আমি রসায়ন শাস্ত্র এবং সাধারণ সাহিত্য সম্পর্কীয় গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করিবার জন্য নির্দিষ্ট রাখিতাম। যদি ঘটনাক্রমে ঐ সময়ে পড়াশুনায় কোন ব্যাঘাত হইত তাহা হইলে আমি আর্তস্বরে বলিতাম—“একটা দিন নষ্ট হইল!” রবিবার এবং ছুটির দিনে আমি একাদিক্রমে ১০। ১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করিতাম। মাঝে কেবল একঘণ্টা স্নানাহারের জন্য ব্যয় করিতাম। কাজ অনেকটা বাঁধাধরা ছিল, মস্তিষ্ক চালনার বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। কখনও কখনও আমি আরাম কেদারায় শুইয়া থাকিতাম এবং আমার নির্দেশ মত ২।১ জন কম্পাউণ্ডার বিভিন্ন উপাদান ওজন করিয়া একত্র মিশাইয়া নির্দিষ্ট ঔষধ প্রস্তুত করিত, আমি মাঝে মাঝে নমুনা পরীক্ষা করিয়া দেখিতাম এবং বিশ্লেষণের পর সেগুলির ‘ষ্ট্যাণ্ডার্ড’ ঠিক করিয়া দিতাম। ঔষধ প্রস্তুতকারকদের পরামর্শ অনুসারে এবং ঐ সম্বন্ধে বিপুল সাহিত্য ঘাঁটিয়া আমি আমার লেবরেটরীতে কতকগুলি প্রয়োজনীয় তরল সার এবং সিরাপ প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলাম। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি আমাকে একশত পাউণ্ড ‘এট্কিনের সিরাপ’ প্রস্তুত করিতে হইত, তবে কেবল মাত্র নির্দিষ্ট ওজন অনুসারে তরল সার ও প্রয়োজনীয় সিরাপ মিশাইয়া লইতে হইত এবং এইভাবে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি ফরমাইসমত জিনিস যোগাইতে পারিতাম।
যাহাতে যান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োজন আছে, এমন কোন সমস্যা যদি কোন রাসায়নিকের হাতে পড়ে, তবে তাহার পক্ষে অনেক সুযোগ আছে। সে কখনই বিচলিত হয় না, যে কোন বাধাবিঘ্নই উপস্থিত হোক না কেন, সে তাহা অতিক্রম করিতে পারে। সে নূতন নূতন কার্যপ্রণালী আবিষ্কার করিতে পারে, যাহা তাহার পক্ষে ব্যবসায়ের গুহ্যকথা হিসাবে খুবই মূল্যবান হইয়া উঠে। কিন্তু আমাদের পক্ষে বড় একটা বাধা ছিল। এ পর্যন্ত আমরা যে মূলধন খাটাইয়াছিলাম, তাহার পরিমাণ তিন হাজার টাকার বেশী হইবে না। আমার মাহিনা হইতে আমি বিশেষ কিছুই জমাইতে পারিতাম না। অমূল্যের ভাল পসার হইতেছিল, কিন্তু সে একটি বৃহৎ একান্নবর্তী হিন্দুপরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোক ছিল,—তাহার উপর তাহার আবার পরোপকার প্রবৃত্তিও যথেষ্ট ছিল। সতরাং সেও বিশেষ কিছু সঞ্চয় করিতে পারে নাই। আমরা যে মূলধন দিয়াছিলাম, তাহার কতকাংশ যন্ত্রপাতি, শিশি, বোতল এবং অন্যান্য মালমশলা, সরঞ্জাম প্রভৃতিতেই ব্যয় হইয়াছিল। ওদিকে সোদপুরের সালফিউরিক অ্যাসিডের কারখানাটির অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। ইহাতে দৈনিক গড়ে দশ মণের বেশি অ্যাসিড প্রস্তুত হইত না এবং কলিকাতা হইতে অত দূরে উহাকে লাভজনক ব্যবসায়রূপে চালাইবার কোন সম্ভাবনা ছিল না।
১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মের ছুটীর সময় আমি আমার পিতার মৃত্যু সংবাদ পাইয়া জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে বাড়ী ছুটিলাম। আমাদের যে ভূসম্পত্তি অবশিষ্ট ছিল, তাহা দেনার দায়ে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। খুলনা লোন আফিস এবং অন্যান্য মহাজনদের সঙ্গে একটা আপোষ করিলাম; কতক ঋণ কিস্তিবন্দী হিসাবে শোধের ব্যবস্থা হইল এবং অবশিষ্ট ঋণ কিছু সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া পরিশোধ করিলাম। এইরূপে এক সপ্তাহের মধ্যেই সমস্ত কাজ মিটাইয়া আমি কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম এবং গ্রীষ্মের ছুটীর যে ছয় সপ্তাহ বাকী ছিল,—সেই সময়ের জন্য সোদপুরে অ্যাসিডের কারখানাতেই প্রধান আড্ডা করিলাম,—উদ্দেশ্য স্বচক্ষে কারখানার অবস্থা দেখিব। কিন্তু প্রত্যহ আমাকে দুর্গম পথ অতিক্রম করিয়া কলিকাতা যাইতে হইত এবং ৩।৪ ঘণ্টা সদর আফিসের কাজকর্ম দেখিতে হইত। সোদপরে বিশ্রাম সময়ে আমি আমার প্রিয় গ্রন্থ Kopp’s History of Chemistry (জার্মান) পড়িতাম। ছুটী শেষ হইলে আমাকে কলিকাতায় ফিরিতে হইল। আমি বুঝিতে পারিলাম যে এরূপ ছোট আকারে একটা অ্যাসিডের কারখানা লাভজনক হইতে পারে না এবং অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে আমাকে ঐ কারখানা ছাড়িয়া দিতে হইল। পুরাতন সিসার পাতগুলি বেচিয়া মাত্র ৩।৪ শত টাকা পাওয়া গেল। এই ব্যাপারে আমার কিছু লোকসান হইল বটে, কিন্তু যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিলাম তাহা কয়েক বৎসর পরে কাজে লাগিয়াছিল।
ইহার কিছু পরে আমাদের নূতন ব্যবসায়ের পক্ষে আর এক বিপত্তি ঘটিল। অমূল্য একজন বিউবনিক প্লেগগ্রস্ত রোগীকে চিকিৎসা করিয়াছিল। এই রোগ সংক্রামক এবং অমূল্য চিকিৎসা করিতে গিয়া নিজেও এই রোগে আক্রান্ত হইল। একদিন রবিবার অপরাহ্ণে (৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮) আমি আফিসে বসিয়া ঔষধের তালিকা মিলাইতেছিলাম, এমন সময় সংবাদ পাইলাম যে, অমূল্য আর ইহলোকে নাই এবং তাহার মৃতদেহ সৎকারার্থে নিমতলা শ্মশানঘাটে লইয়া গিয়াছে। আমি তৎক্ষণাৎ কাজ ছাড়িয়া উঠিলাম এবং একখানা গাড়ী ভাড়া করিয়া নিমতলার দিকে ছুটিলাম, সেখানে কিছুক্ষণ থাকিয়া গভীর শোক কোনরূপে সংযত করিয়া আবার আফিসে ফিরিয়া আসিলাম এবং অসমাপ্ত কার্য শেষ করিলাম। অমূল্যের মৃত্যুর পর আমাকেই সমস্ত কাজের ভার লইতে হইল। এই ইতিহাস আর বেশি বলিবার প্রয়োজন নাই। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে পাঁচ বৎসর পরে ব্যবসায়টি লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করা হইল এবং কার্যের প্রসারের জন্য সদর আফিস হইতে তিন মাইল দূরে সহরতলীতে ১৩ একর জমি খরিদ করিয়া কারখানা নির্মিত হইল।
ইণ্ডিয়া ইনষ্টিটিউট অব সায়েন্সের প্রথম ডিরেক্টর ডাঃ ট্রাভার্স এই রাসায়নিক কারখানা নির্মাণের সময় (১৯০৪-৭) উহা দেখিতে আসিয়াছিলেন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট একটি রিপোর্টে লিখিয়াছেন:—
“প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগের ভূতপূর্ব ছাত্রগণই এই কারখানা নির্মাণ ও পরিচালনা করিতেছেন। সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুতের যন্ত্র এবং অন্যান্য ঔষধ প্রস্তুতের যন্ত্রের নির্মাণ ও পরিকল্পনার মূলে প্রভূত গবেষণার পরিচয় আছে এবং উহার দ্বারা এদেশের সবিশেষ উপকার হইবে। যাঁহারা এই বিরাট কার্য করিতেছেন, তাঁহাদের পক্ষে ইহা গৌরবের কথা।”
মিঃ (পরে স্যার জন) কামিং বলিয়াছেন—
“বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড বাংলার একটি শক্তিশালী নব্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায় ডি, এস-সি, এফ, সি, এস, ১৫ বৎসর পূর্বে অপার সার্কুলার রোডের একটি গৃহে ব্যক্তিগত ব্যবসায়রূপে ইহা আরম্ভ করেন এবং দেশীয় উপাদান হইতে ঔষধাদি প্রস্তুত করিতে থাকেন। ছয় বৎসর পূর্বে দুই লক্ষ টাকা মূলধনসহ লিমিটেড কোম্পানিতে ইহা পরিণত হয়। কলিকাতার বহু বড় বড় রাসায়নিক ইহার অংশীদার। বর্তমানে ৯০, মাণিকতলা মেন রোডে এই কোম্পানির সুপরিচালিত বৃহৎ কারখানা আছে। সেখানে প্রায় ৭০ জন শ্রমিক কার্য করে। ম্যানেজার শ্রীযুত রাজশেখর বস,, রসায়নশাস্ত্রে এম, এ,। লেবরেটরীর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যাহার জন্য ধাতু ও কাঠের শিল্পকার্যে অভিজ্ঞ লোকের দরকার তাহাও এখানে নির্মিত হইতেছে। অধুনা গন্ধদ্রব্যও প্রস্তুত করা হইতেছে। এই প্রতিষ্ঠান যে কার্যশক্তি ও ব্যবসাবদ্ধির পরিচয় দিতেছে, তাহা এই প্রদেশের ধনী ব্যবসায়ীদের পক্ষে অননুকরণযোগ্য।” (Review of the Industrial Position and prospects in Bengal in 1908, pp. 30-81)। এস্থলে উল্লেখযোগ্য যে ডাঃ কার্তিকচন্দ্র বস, ও পরলোকগত চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ী এই সময়ে যথেষ্ট সাহায্য করেন।
কলিকাতা হইতে ১২ মাইল দক্ষিণে পাণিহাটিতে যে নতন আর একটি শাখা কারখানা হইয়াছে, তাহা ৬০ একর জমি লইয়া। এখানে যে সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুতের যন্ত্র এবং “গ্লোভার্স ও গে-লুসাক্স টাওয়ার” নির্মিত হইয়াছে, তাহা ভারতে একটি বৃহৎ অ্যাসিড কারখানা বলিয়া গণ্য। এই কোম্পানিতে বর্তমানে দুই হাজার শ্রমিক কার্য করে এবং ইহার মোট সম্পত্তির মূল্য প্রায় অর্ধ কোটী টাকা।
- ↑ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যুগে বিপ্লবীদের বোমার কারখানা ছিল বলিয়া মুরারিপুকুর প্রসিদ্ধ হইয়াছে।