আত্মশক্তি/ব্রতধারণ
ব্রতধারণ।[১]
আজ এই স্ত্রীসমাজে আমি যে উপদেশ দিতে উঠিয়াছি বা আমার কোনো নূতন কথা বলিবার আছে, এমন অভিমান আমার নাই।
আমার কথা নূতন নহে বলিয়াই, কাহাকেও উপদেশ দিতে হবে না বলিয়াই, আমি আজ সমস্ত সঙ্কোচ পরিহার করিয়া আপনাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়াছি।
যে কথাটি আজ দেশের অন্তরে অন্তরে সর্ব্বগ্র জাগ্রত হইয়াছে, তাহাকেই নারীসমাজের নিকট সুস্পষ্টরূপে গোচর করিয়া তুলিবার জন্যই আমাদের অদ্যকার এই উদ্যোগ।
আমাদের দেশে সম্প্রতি একটি বিশেষ সময় উপস্থিত হইয়াছে, তাহা আমরা সকলেই অনুভব করিতেছি। অল্পদিনের মধ্যে আমাদের দেশে আঘাতের পর আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছে। হঠাৎ বুঝিতে পারিয়াছি যে, আমাদের যাত্রাপথের দিক্পরিবর্ত্তন করিতে হইবে।
যে সময়ে এইরূপ দেশব্যাপী আঘাতের তাড়না উপস্থিত হইয়াছে, যে সময়ে আমাদের সকলেরই হৃদয় কিছু না কিছু চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে সেই সময়কে যদি আমরা উপেক্ষা করি, তবে বিধাতার প্রেরণাকে অবজ্ঞা করা হইবে।
ইহাকে দুর্যোগ বলিব কি? এই যে দিগ্দিগন্তে ঘন মেঘ করিয়া শ্রাবণের অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল, এই যে বিদ্যুতের আলোক এবং বজ্রের গর্জ্জন আমাদের হৃৎপিণ্ডকে চকিত করিয়া তুলিতেছে, এই যে, জলধারাবর্ষণে পৃথিবী ভাসিয়া গেল—এই দুর্যোগকেই যাহারা সুযোগ করিয়া তুলিয়াছে, তাহারাই পৃথিবীর অন্ন যোগাইবে। এখনি স্কন্ধে হল লইয়া কৃষককে কোমর বাঁধিতে হইবে। এই সময়টুকু যদি অতিক্রম করিতে দেওয়া হয়, তবে সমস্ত বৎসর দুর্ভিক্ষ এবং হাহাকার।
আমাদের দেশেও সম্প্রতি ঈশ্বর দুর্যোগের বেশে যে সুযোগকে প্রেরণ করিয়াছেন, তাহাকে নষ্ট হইতে দিব না বলিয়াই আজ আমাদের সামান্য শক্তিকেও যথাসম্ভব সচেষ্ট করিয়া তুলিয়াছি। যে এক বেদনার উত্তেজনায় আমাদের সকলের চেতনাকে উৎসুক করিয়া তুলিয়াছে, আজ সেই বিধাতার প্রেরিত বেদনাদূতকে প্রশ্ন করিয়া আদেশ জানিতে হইবে,—কর্ত্তব্য স্থির করিতে হইবে।
নিজেকে ভুলাইয়া রাখিবার দিন আর আমাদের নাই। বড় দুঃখে আজ আমাদিগকে বুঝিতে হইয়াছে যে, আমাদের নিজের সহায় আমরা নিজেরা ছাড়া আর কেহ নাই। এই সহজ কথা যাহারা সহজেই না বুঝে, অপমান তাহাদিগকে বুঝায়,—নৈরাশ্য তাহাদিগকে বুঝায়। তাই আজ দায়ে পড়িয়া আমাদিগকে বুঝিতে হইয়াছে যে, “ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ”। আজ আসন্নবিচ্ছেদশঙ্কিত বঙ্গভূমিতে দাঁড়াইয়া বাঙালী এ কথা সুস্পষ্ট বুঝিয়াছে যে, যেখানে স্বার্থের অনৈক্য, যেখানে শ্রদ্ধার অভাব, যেখানে রিক্ত ভিক্ষার ঝুলি ছাড়া আর কোনই বল বা সম্বল নাই, সেখানে ফললাভের আশা কেবল যে বিড়ম্বনা, তাহা নহে, তাহা লাঞ্ছনার একশেষ।
এই আঘাত আবার একদিন হয় ত সহ্য হইয়া যাইবে—অপমানে যাহা শিখিয়াছি, তাহা হয়ত আবার ভুলিয়া-গিয়া আবার গুরুতর অপমানের জন্য প্রস্তুত হইব। যে দুর্ব্বল, নিশ্চেষ্ট, তাহার ইহাই দুর্ভাগ্য—দুঃখ তাহাকে দুঃখই দেয়, শিক্ষা দেয় না। আজ সেই শঙ্কায় ব্যাকুল হইয়া সময় থাকিতে এই দুঃসময়ের দান গ্রহণ করিবার জন্য আমরা একত্র হইয়াছি।
কোথায় আমরা আপনারা আছি, কোথায় আমাদের শক্তি এবং কোন্দিকে আমাদের অসম্মান, ও প্রতিকূলতা, আজ দৈবকৃপায় যদি তাহা আমাদের ধারণা হইয়া থাকে, তবে কেবল তাহাকে ক্ষীণ ধারণার মধ্যে রাখিয়া দিলে চলিবে না। কারণ, শুদ্ধমাত্র ইহাকে মনের মধ্যে রাখিলে ক্রমে ইহা কেবল কথার কথা এবং অবশেষে একদিন ইহা বিস্মৃত ও তিরোহিত হইয়া যাইবে। ইহাকে চিরদিনের মত আমাদিগকে মনে গাঁথিতে এবং কাজে খাটাইতে হইবে। ইহাকে ভুলিলে আমাদের কোনোমতেই চলিবে না— তাহা হইলে আমরা মরিব।
কাজে খাটাইতে হইবে। কিন্তু আমরা স্ত্রীলোক—পুরুষের মত আমাদের কার্য্যক্ষেত্র বাহিরে বিস্তৃত নহে। জানি না, আজিকার দুর্দ্দিনে আমাদের পুরুষেরা কি কাজ করিতে উদ্যত হইয়াছেন? জানি না, এখনো তাঁহারা যথার্থ মনের সঙ্গে বলিতে পারিয়াছেন কি না যে—
“আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু, হায়,
তাই ভাবি মনে!”
যে নির্জ্জীব, যে সহজ পথ খুঁজিয়া আপনাকে ভুলাইয়া রাখিতেই চায়, তাহাকে ভুলাইবার জন্য আশাকে অধিক-বেশি ছলনা বিস্তার করিতে হয় না। সে হয়ত এখনো মনে করিতেছে, যদি এখানকার রাজদ্বার হইতে ভিক্ষুককে তাড়া খাইতে হয়, তবে ভিক্ষার ঝুলি ঘাড়ে করিয়া সমুদ্রপারে যাইতে হইবে। সমুদ্রের এ পারেই কি, আর ও-পারেই কি, অনন্যশরণ কাঙাল সেই একই চরণ আশ্রয় করিয়াছে।
কি এ দশা আমাদের পুরুষদের মধ্যে সকলের নহে—তাঁহাদের বহুদিনের বিশ্বাসক্ষেত্রে ভূমিকম্প উপস্থিত হইয়াছে, তাঁহাদের ভক্তি টলিয়াছে, তাঁহাদের আশা খিলানে-খিলানে ফার্টিয়া ফাঁক হইয়া গেছে—এখন তাঁহারা ভাবিতেছেন, ইহার চেয়ে নিজের দীনহীন কুটীর আশ্রয় করাও নিরাপদ্। এখন তাই সমস্ত দেশের মধ্যে নিজের শক্তিকে অবলম্বন করিবার জন্য একট। মর্ম্মভেদী আহ্বান উঠিয়াছে।
এই আহ্বানে পুরুষেরা কে কি ভাবে সাড়া দিবেন, তাহা জানি না—কিন্তু আমাদের অন্তঃপুরেও কি এই আহ্বান প্রবেশ করে নাই? আমরা কি আমাদের মাতৃভূমির কন্যা নহি? দেশের অপমান কি আমাদের অপমান নহে? দেশের দুঃখ কি আমাদের গৃহপ্রাচীরের পাষাণ ভেদ করিতে পারিবে না?
ভগিনীগণ, আপনারা হয় ত কেহ কেহ জিজ্ঞাসা করিবেন, আমরা স্ত্রীলোক, আমরা কি করিতে পারি—দুঃখের দিনে নীরবে অশ্রুবর্ষণ করাই আমাদের সম্বল।
এ কথা, আমি স্বীকার করিতে পারিব না। আমরা যে কি না করিতেছি, তাই দেখুন! আমরা পরণের শাড়ী কিনিতেছি বিলাত হইতে, আমাদের অনেকের ভূষণ জোগাইতেছে হ্যামিল্টন্, আমাদের গৃহসজ্জা বিলাতী দোকানের, আমরা শয়নে-স্বপনে বিলাতের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া আছি। আমরা প্রতিদিন আমাদের জননীর অল্প কাড়িয়া তাঁহার ভূষণ ছিনাইয়া বিলাতদেবতার পায়ে রাশিরাশি অর্ঘ্য যোগাইতেছি।
আমরা লড়াই করিতেও যাইব না, আমরা ভিক্ষা করিতেও ফিরিব না, কিন্তু আমরা কি এ কথাও বলিতে পারিব না যে, না, আর নয়; আমাদের এই অপমানিত উপবাসক্লিষ্ট মাতৃভূমির অন্নের গ্রাস বিদেশের পাতে তুলিয়া-দিয়া তাহার পরিবর্ত্তে আমাদের বেশভূষার, সখ্ মিটাইব না? আমরা, ভাল হউক্, মন্দ হউক্, দেশের কাপড় পরিব, দেশের জিনিষ ব্যবহার করিব।
ভগিনীগণ, সৌন্দর্য্যচর্চ্চার দোহাই দিবেন না! সৌন্দর্য্যবোধ অতি উত্তম পদার্থ, কিন্তু তাহার চেয়েও উচ্চজিনিষ আছে। আমি এ কথা স্বীকার করিব না যে, দেশী জিনিষে আমাদের সৌন্দয্যবোধ ক্লিষ্ট হইবে; কিন্তু যদি শিক্ষা ও অভ্যাসক্রমে আমাদের সেইরূপই ধারণা হয়, তবে এই কথা বলিব, সৌন্দর্য্যবোধকেই সকলের চেয়ে বড় করিবার দিন আজ নহে—সন্তান যখন দীর্ঘকাল রোগশয্যায় শায়িত, তখন জননী বেনারসি শাড়ীখানা বেচিয়া তাহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে কুণ্ঠিত হন না—তখন কোথায় থাকে সৌন্দর্য্যবোধের দাবী?
জানি, আমাকে অনেকে বলিবেন, কথাটা বলিতে যত সহজ, করিতে তত সহজ নহে। আমাদের অভ্যাস, আমাদের সংস্কার, আমাদের আরামস্পৃহা, আমাদের সৌন্দর্য্যবোধ—ইহাদিগকে ঠেলিয়ানড়ানো বড় কম কথা নহে।
নিশ্চয়ই তাহা নহে। ইহা সহজ নহে, ইহার চেয়ে একদিনের মত চাঁদার খাতায় সহি দেওয়া সহজ। কিন্তু বড় কাজ সহজে হয় না। যখন সময় আসে, তখন ধর্ম্মের শঙ্খ বাজিয়া উঠে, তখন, যাহা কঠিন তাহাকেই বরণ করিয়া লইতে হয়। বস্তুত তাহাতেই আনন্দ, সহজ নহে বলিয়াই আনন্দ, দুঃসাধ্য বলিয়াই সুখ।
আমরা ইতিহাসে পড়িয়াছি, যুদ্ধের সময় রাজপুতমহিলারা অঙ্গের ভূষণ, মাথার কেশ দান করিয়াছে, তখন সুবিধা বা সৌন্দর্য্যচর্চ্চার কথা ভাবে নাই—ইহা হইতে আমরা এই শিখিয়াছি যে, জগতে স্ত্রীলোক যদি বা যুদ্ধ না করিয়া থাকে, ত্যাগ করিয়াছে—সময় উপস্থিত হইলে ভূষণ হইতে প্রাণ পর্য্যন্ত ত্যাগ করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। কর্ম্মের বীর্য্য অপেক্ষা ত্যাগের বীর্য্য কোনো অংশেই ন্যূন নহে। ইহা যখন ভাবি, তখন মনে এই গৌরব জন্মে যে, এই বিচিত্রশক্তিচালিত সংসারে স্ত্রীলোককে লজ্জিত হইতে হয় নাই—স্ত্রীলোক কেবল সৌন্দর্য্যদ্বারা মনোহরণ করে নাই, ত্যাগের দ্বারা শক্তি দেখাইয়াছে।
আজ আমাদের বঙ্গদেশ রাজশক্তির নির্দ্দয় আঘাতে বিক্ষত হইয়াছে, আজ বঙ্গরমণীদের ত্যাগের দিন। আজ আমরা ব্রতগ্রহণ করিব। আজ আমরা কোনো ক্লেশকে ডরিব না, উপহাসকে অগ্রাহ্য করিব, আজ আমরা পীড়িত জননীর রোগশয্যায় বিলাতের সাজ পরিয়া সৌখীনতা করিতে যাইব না।
দেশের জিনিষকে রক্ষা করা— এও ত রমণীর একটা বিশেষ কাজ। আমরা ভালবাসিতে জানি! ভালবাসা চাক্চিক্যে ভুলিয়া নূতনের কুহকে চারিদিকে ধাবমান হয় না। আমাদের যাহা আপন, সে সুশ্রী হউক্ আর কুশ্রী হউক্, নারীর কাছে অনাদর পায় না,—সংসার তাই রক্ষা পাইতেছে।
একবার ভাবিয়া দেখুন, আজ যে বঙ্গসাহিত্য বলিষ্ঠভাবে অসঙ্কোচে মাথা তুলিতে পারিয়াছে, একদিন শিক্ষিতপুরুষসমাজে ইহার অবজ্ঞার সীমা ছিল না। তখন পুরুষেরা বাংলা বই কিনিয়া লজ্জার সহিত কৈফিয়ৎ দিতেন যে, আমরা পড়িব না, বাড়ীর ভিতরে মেয়েরা পড়িবে। আচ্ছা আচ্ছা, তাঁহাদের সে লজ্জার ভার আমরাই বহন করিয়াছি, কিন্তু ত্যাগ করি নাই। আজ ত সে লজ্জার দিন ঘুচিয়াছে! যে বাড়ীর ভিতরে মেয়েদের কোলে বাংলাদেশের শিশুসন্তানেরা তাহারা কালোই হউক্ আর ধলোই হউক্—পরম আদরে মানুষ হইয়া উঠিতেছে—বঙ্গসাহিত্যও সেই বাড়ীর ভিতরে মেয়েদের কোলেই তাহার উপেক্ষিত শিশু-অবস্থা যাপন করিয়াছে, অন্নবস্ত্রের দুঃখ পায় নাই।
একবার ভাবিয়া দেখুন, যেখানে বাঙালিপুরুষ বিলাতী কাপড় পরিয়া সর্ব্বত্র নিঃসঙ্কোচে আপনাকে প্রচার করিতেছেন, সেখানে তাঁহার স্ত্রীকন্যাগণ বিদেশীবেশ ধারণ করিতে পারেন নাই। স্ত্রীলোক যে উৎকট বিজাতীয়বেশে আপনাকে সজ্জিত করিয়া বাহির হইবে, ইহা আমাদের স্ত্রীপ্রকৃতির সঙ্গে এতই একান্ত অসঙ্গত যে, বিলাতের মোহে আপাদমস্তক বিকাইয়াছেন যে পুরুষ, তিনিও আপন স্ত্রীকন্যাকে এই ঘোরতর লজ্জা হইতে রক্ষা করিয়াছেন।
এই রক্ষণপালনের শক্তি স্ত্রীলোকের অন্তরতম শক্তি বলিয়াই, দেশের দেশীয়ত্ব স্ত্রীলোকের মাতৃক্রোড়েই রক্ষা পায়। নূতনত্বের বন্যায় দেশের অনেক জিনিষ, যাহা পুরুষসমাজ হইতে ভাসিয়া গেছে, তাহা আজও অন্তঃপুরের নিভৃতকক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আছে। এই বন্যার উপদ্রব একদিন যখন দূর হইবে, তখন নিশ্চয়ই তাহাদের খোঁজ পড়িবে এবং দেশ রক্ষণপটু স্নেহশীল নারীদের নিকট কৃতজ্ঞ হইবে।
অতএব আজ আমরা যদি আর সমস্ত বিচার ত্যাগ করিয়া দেশের শিল্প, দেশের সামগ্রীকে অবিচলিত নিষ্ঠার সহিত রক্ষা করি, তবে তাহাতে নারীর কর্ত্তব্যপালন করা হইবে।
আমার মনে এ আশঙ্কা আছে যে, আমাদের মধ্যেও অনেকে অবজ্ঞাপূর্ণ উপহাসের সহিত বলিবেন, তোমরা কয়জনে দেশীজিনিষ ব্যবহার করিবে প্রতিজ্ঞা করিলেই অমনি নাকি ম্যাঞ্চেষ্টর্ ফতুর হইয়া যাইবে এবং লিভার্পুল্ বাসায় গিয়া মরিয়া থাকিবে!
সে কথা জানি। ম্যাঞ্চেস্টরের কল চিরদিন ফুঁসিতে থাক্, রাবণের চিতার ন্যায় লিভার্পুলের এঞ্জিনের আগুন না নিভুক্! আমাদের অনেকে আজকাল যে বিলাতির পরিবর্ত্তে দেশীজিনিষ ব্যবহার করিতে ব্যগ্র হইয়াছেন, তাহার কারণ এ নয় যে, তাঁহারা বিলাতকে দেউলে করিয়া দিতে চান। বস্তুত আমাদের এই যে চেষ্টা, ইহা কেবল আমাদের মনের ভাবকে বাহিরে মূর্ত্তিমান্ করিয়া রাখিবার চেষ্টা। আমরা সহজে না হউক্, অন্তত বারংবার আঘাতে ও অপমানে পরের বিরুদ্ধে নিজেকে যে বিশেষভাবে আপন বলিয়া জানিতে উৎসুক হইয়া উঠিয়াছি, সেই ঔৎসুক্যকে যে কায়ে-মনে-বাক্যে প্রকাশ করিতে হইবে—নতুবা দুইদিনেই তাহা যে বিস্মৃত ও ব্যর্থ হইয়া যাইবে। আমাদের মন্ত্রও চাই, চিহ্নও চাই। আমরা অন্তরে স্বদেশকে বরণ করিব এবং বাহিরে স্বদেশের চিহ্ণ ধারণ করিব।
বিদেশীয় রাজশক্তির সহিত আমাদের স্বাভাবিক পার্থক্য ও বিরোধ ক্রমশই সুস্পষ্টরূপে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। আজ আর ইহাকে ঢাকিয়া রাখিবে কে? রাজাও পারিলেন না, আমরাও পারিলাম না। এই বিরোধ যে ঈশ্বরের প্রেরিত। এই বিরোধ ব্যতীত আমরা প্রবলরূপে, যথার্থরূপে আপনাকে লাভ করিতে পারিতাম না। আমরা যতদিন প্রসাদভিক্ষার আশে একান্তভাবে এই সকল বিদেশীর মুখ চাহিয়া থাকিতাম, ততদিন আমরা উত্তরোত্তর আপনাকে নিঃশেষভাবে হারাইতেই থাকিতাম। আজ বিরোধের আঘাতে বেদনা পাইতেছি, অসুবিধা ভোগ করিতেছি, সকলই সতা, কিন্তু নিজেকে বিশেষভাবে উপলব্ধি করিবার পথে দাঁড়াইয়াছি। যতদিন পর্য্যন্ত এই লাভ সম্পূর্ণ না হইবে, ততদিন পর্য্যন্ত এই বিরোধ ঘুচিবে না; যতদিন পর্য্যস্ত আমরা নিজশক্তিকে আবিষ্কার না করিব, ততদিন পর্য্যন্ত পরশক্তির সহিত আমাদের সংঘর্ষ চলিতে থাকিবেই।
যে আপনার শক্তিকে খুঁজিয়া পায় নাই, যাহাকে নিরুপায়ভাবে পরের পশ্চাতে ফিরিতে হয়, ঈশ্বর করুন, সে যেন আরাম ভোগ না করে—সে যেন অহঙ্কার অনুভব না করে! অপমান ও ক্লেশ তাহাকে সর্ব্বদা যেন এই কথা স্মরণ করাইতে থাকে যে, তোমার নিজের শক্তি নাই, তোমাকে ধিক্! আমরা যে অপমানিত হইতেছি, ইহাতে বুঝিতে হইবে, ঈশ্বর এখনো আমাদিগকে ত্যাগ করেন নাই। কিন্তু আমরা আর বিলম্ব যেন না করি! আমরা নিজেকে ঈশ্বরের এই অভিপ্রায়কে অনুকূল যেন করিতে পারি। আমরা যেন পরের অনুকরণে আরাম এবং পরের বাজারে কেনা জিনিষে গৌরববোধ না করি। বিলাতী আস্বাব পরিত্যাগ করিয়া আমাদের যদি কিছু কষ্ট হয়, তবে সে কষ্টই আমাদের মন্ত্রকে ভুলিতে দিবে না। সেই মন্ত্রটি, এই—
সর্ব্বং পরবশং দুঃখং সর্ব্বমাত্মবশং সুখম্।
যাহা-কিছু পরবশ, তাহাই দুঃখ; যাহা-কিছু আত্মবশ, তাহাই সুখ।
আমাদের দেশের নারীগণ আত্মীয়স্বজনের আরোগ্যকামনা করিয়া দীর্ঘকালের জন্য কৃচ্ছব্রত গ্রহণ করিয়া আসিয়াছেন। নারীদের সেই তপঃসাধন বাঙালীর সংসারে যে নিষ্ফল হইয়াছে, তাহা আমি মনে করি না। আজ আমরা দেশের নারীগণ দেশের জন্য সেইরূপ ব্রতগ্রহণ করি, যদি বিদেশের বিলাস দৃঢ়নিষ্ঠার সহিত পরিত্যাগ করি, তবে আমাদের এই তপস্যায় দেশের মঙ্গল হইবে—তবে এই স্বস্ত্যয়নে আমরা পুণ্যলাভ করিব এবং আমাদের পুরুষগণ শক্তিলাভ করিবেন।
- ↑ কোন “স্ত্রীসমাজে” জনৈক-মহিলা-কর্ত্তৃক পঠিত।