আদরিণী/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 তিনকড়ি কলিকাতা হইতে আলিপুরের জেলে আবদ্ধ হইল—সহচর কেহ নাই, দু:খের সহচর কান্না— সুতরাং জেগে তাহারই সহচরী হইয়া দিন যাপন করিতে লাগিল, কেবা তাহার দুঃখের প্রতি কটাক্ষ পাত করে—কে তাহার ক্রন্দন ধ্বনি শ্রবণ করে— আর কেইবা তাহাকে সদুপদেশ প্রদান করে? পাঠক,—তিনকড়ির এত কান্না, এত দুঃখ কেন? তবেকি জেলে গিয়াছে, বলিয়াই অসহনীয় কষ্ট হইয়াছে? বস্তাবিক তাহা নহে; তাহার সেই সোণাৱ পুতুল হরিদাসী নিঃসহায় বলিয়াই আজ তার চক্ষে আর জলের স্থান হইতেছে না,—বর্যার বারিধারার ন্যায় দর দর করিয়া পড়িতেছে, সে নিজের জন্য যত চিন্তা না করিতেছে, হরিদাসীর জন্য তাহার চিন্তা ক্রমেই প্রবল হইতেছে, মন ব্যাকুলিত হইয়া উঠিয়াছে, —একে হরিদাসী অনাথ অসহায় বালিকা, তাহাতে এইস্থানে অপরিচিত,কে তাকে রক্ষা করিবে, কি রূপে তাহার জাতি-কুল বজায় থাকিবে—এই চিন্তা তাহার হৃদয়ে প্রবল বেগে জ্বলিয়া উঠিল। ক্রমে এক দিন, দুই দিন, তিন দিন গত হইল, কাহারও নিকট হরিদাসীর কোনও সংবাদ পাইল না। কাহারও সহিত সাক্ষাৎ নাই—যেখানে কাহারও যাইবার অধিকার নাই, সেই কারাগারের ভিতর কে যাইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করবে? বিশেষ এ নগরীতে সে অপরিচিত। অদ্য চতুর্থ দিবস; একটা নির্জ্জন গৃহে বসিয়া রোদন করিতেছে ও কি করিবে মনে মনে চিন্তা করিতেছে, এবং কে এরূপ অচিন্তনীয় অকুল-দুঃখসমুদ্রে নিক্ষেপ করিয়াছে, মাঝে মাঝে তাহারই আলোচনা করিতেছে, কিন্তু ভবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারতেছে না; মন আরও ব্যাকুল হইতেছে। এমন সময় একজন প্রহরী আসিয়া তাহকে সংবাদ দিল, দুইটী বাবু তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছে। তিনকড়ি স্বস্ব-ব্যস্তে জেলের দ্বারদেশে আগমন করিয়া তাহার পূর্ব্ব পরিচিত দুইটী বন্ধুকে দেখিতে পাইল; তাহাদিগকে দেখিয়া দুঃখ অনেক লাঘব হইল, ভাবি আশার সঞ্চার হইল। তিনকড়ি মুহর্ত্তের জন্য শোকবেগ সম্বরণ করিয়া আগন্তুক বন্ধুদ্বয়ের একজনকে সম্বোধন করিয়া বলিল ‘সুরেশ, আমার হরিদাসী কোথায়, তাহার ত কোনরূপ অনিষ্ট সংঘটন হয় নাই?” সুরেশচন্দ্র কি উত্তর দিবেন কিছুই হির করতে না পারিয়া কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন,পরে বলিলেন, “তোমাদিগের এই সংবাদ পাইয়া তোমাদিগের বাড়ীতে গিয়াছিলাম; সেখানে কেহই নাই—গৃহ শূন্য অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে, পাশ্ববর্ত্তী লোকদিগের নিকট অনুসন্ধান করিলাম, কেহই কিছু বলিতে পারল না। যাহা হউক, যে যেখানে আছে অনুসন্ধান করিলে জানতে পারিব তাহার কোন সন্দেহ নাই। এখন তাহার জন্য বিশেষ ভাবিবার কোন আবশ্যক নাই, জগদীশ্বর রক্ষাকর্ত্তা, তিনি থাকিতে কেহই হরিদাসীর অনিষ্ট করিতে সমর্থ হইবেক না। এখন আর তোমার উদ্ধারের একটী পথ অবলম্বন করিবার ইচ্ছা করিয়াছি। কেবল তোমার অভিপ্রায় জানিবার জন্য এখানে আসিয়াছি। যদি তোমার মত হয় তাহা হইলে তোমার নামে যে ডিক্রী হইয়াছে তাহা নামাঞ্জুর করিবার জন্য পুনর্ব্বিচারের প্রার্থনা করি। বিশেষ একটা নূতন ইংরাজ হাকিম আসিয়াছেন। তিনি অতিশয় দয়ালু; প্রকৃত ঘটনা জানিতে পারিলে অবশ্যই আমাদিগের প্রার্থনা মঞ্জুর করিবেন। তখন অম্বিকাচরণ দত্ত কে, তাহা ও উহার ভিতর যদি কাহারও কোন প্রকার দুরভিসন্ধি থাকে তাহাও প্রকাশ হইয়া পড়িবে! তুমি অব্যাহতি পাইবে এবং আমরা হরিদাসীর অনুসন্ধান করিতে পারিব।’ তিনকড়ি এই প্রস্তাবে সম্মত হইয়া ওকালত নামা সহি করিয়া দিল, সুরেশ ও তাহার সঙ্গী ফিরিয়া অনিয়া আনুপূর্ব্বিক অবস্থা বিবৃত করিয়া এক খানি দরখাস্ত মান্যবর শ্রীযুক্ত বীবী সাহেব বাহাদুরের সমক্ষে পেষ করিল। উক্তসাহেব মহোদয় ঐ দরখাস্ত মঞ্জুর করতঃ পুনর্ব্বিচারের দিন স্থির করলেন এবং ফরিয়াদি অম্বিকাচরণ দত্তের উপর এই মর্ম্মে এক খানি নেটিশ বাহির করিবার হুকুম দিলেন যে, ১০ই ভাদ্র তারিখে ফরিয়াদি তাহার সাক্ষী সহিত উপস্থিত হইবে, ওঐ দিবস তাহার মোকদ্দমা পুনর্ব্বিচার হইবে। নোটিশ প্যায়দার জিম্বা হইল, সে বহু অনুসন্ধান করিয়া, ফরিয়াদী ও সাক্ষী কে, কোথায় থাকে, কিছু মাত্র ঠিকানা করিতে পারল না। সুতরাং ধার্য্য দিবসে মোকদ্দমার বিচার। হইল না।

 পুনরার ২৭শে ভাদ্র তারিখে বিচারের দিন ধার্য্য করিয়া সহরের ভিতর স্থানে স্থানে নোটিশ লটকাইয়া দেওয়া হইল; চার দিকে অম্বিকাচরণের গোচরার্থে সংবাদ প্রকাশ করা হইল। কিন্তু নির্দ্দিষ্ট দিনে অম্বিকাচরণ অথবা তাহাদের সাক্ষীগণ কেহই উপস্থিত হইলনা। পাঠক! এ নামে কেহ আছে কিনা? অথবা থাকিলে ও এ অম্বিকাচরণ যে, জাল অস্বিকাচরণ তাহা অবশ্যই বুঝিতে পারেন; তাহা না হইলে ধার্য্য দিনে অবশ্যই তাঁহাকে হাজির দেখিতেন। অনুসন্ধানে হাকিম বুঝিতে পারলেন যে, প্রথমে সমন তিনকড়ির উপর জারি না করাইয়া কোন দুষ্ট লোক দুরভিসন্ধি সাধনের নিমিত্ত ইহার নামে মিথ্যা ডিক্রী করিয়াছে ও ইহাকে জেলে দিয়া আপন কোন মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়াছে; ইহা শঠের শঠতা ভিন্ন আর কিছুই নহে। হাকিম তিনকড়িকে ছাড়িয়া দিলেন, সে ঈশ্বরের নিকট এই উদারতা সাহেবের মঙ্গল প্রার্থনা করতে করিতে প্রস্থান করিল, কিন্তু কোথায় গেল কেহই বলতে পারিল না।

 মান্যবর জজ বীবী সাহেব অতিশয় সুচতুর, বিবেচক বুদ্ধিমান ও দয়ালু হকিম; তিনি মনে মনে বিবেচন করলেন, যদি এ প্রকার গর্হিত কার্য্যের বিশেষ প্রতিবিধানের কোন উপায় না করা হয় তাহা হইলে অরাজক হবে, সম্মানি ব্যক্তি অসম্মানিত হইবে, দুষ্ট লোকেরা শত শত লোকের যথাসর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া লইয়া যাকে তাকে পথের ভিকারী করিবে, দিন দিন শত শত তিনকড়ি বিনা দোষে কারাগারে প্রেরিত হইবে। অতএব যাহাতে এরূপ জুয়াচুরী আর না হইতে পারে, ও দোষীগণ ধৃত হইয়া রাজদ্বারে সমুচিত দণ্ড পায় এই অভিপ্রায়ে তিনি পুলিশে সংবাদ দিলেন। পুলিশের প্রধান কর্ত্তা এই মােকদ্দমা অনুসন্ধান করিবার ভার এক হতভাগ্য এদেশীয় কর্ম্মচারীর হস্তে অর্পণ করিলেন। তিনি ২ দিবস পর্য্যন্ত অনুসন্ধান করিলেন,কিন্তু দোষীগণ কে—কোথায় থাকে,তাহা স্থির করা দূরে থাকুক, তিনকড়ি কে কোথায় থাকে—কোথা হইতে আসিরাছিল এবং এখন কোথায়ই বা গেল, তাহাও সন্ধান করিতে পারিলেন না; অথবা এমন কোন লোকও পাইলেন না যে বাহার দ্বারা কোন রূপে ইহার কিছু মাত্র সাহায্য হইতে পারে। তিনকড়ি জেলের মধ্যে কয়েদ অবস্থায় যেরূপ বিপদে পতিত হইয়া ভাবনায় অস্থির হইয়াছিল, কর্ম্মচারী তাহার অপেক্ষা শত গুণ বিপদে পতিত ও ভাবনায় অস্থির হইলেন। দোষীগণের সন্ধান করা দূরে থাকুক, যদি তিনকড়ি, হরিদাসী প্রভৃতিরও কোন সন্ধান করিতে না পারেন, তাহা হইলে কর্ত্তৃপক্ষদিগের নিকট তাহার লজ্জা ও অপমানের সীমা থাকিবে না; কিন্তু পরিশেষে জগদীশ্বরের কৃপায় ক্রমিক ৩ মাস কাল অবিরত পরিশ্রম ও যত্ন করিয়া উহার ভিতরের সমস্ত নিগুঢ় তত্ব অবগত হইলেন। সেই কর্ম্মচারী যে উপায় অবলম্বনে, যে প্রকার অবস্থায় বিপদে পড়িয়া এই অসম্ভাবিত স্বপ্ন সদৃশ অদ্ভুত বিষয় সকল অবগত হইতে পারিয়াছিলেন তাহা সমস্ত বিবৃত করিতে হইলে এই সামান্য পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধি ও পাঠক বর্গের ধৈর্য্যচ্যুতি হইবে; এই আশঙ্কায় সে সকল অংশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক কেবল তাহার কয়েকটি সার কথাই বিবৃত করা হইল।