আদরিণী/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
নির্ম্মলসলিলা ভাগীরথী উত্তর হইতে দক্ষিণ দিকে বহিয়া যাইতেছে, নির্ম্মল-জলরাশি মৃদু বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ খেলিয়া কল্ কল রবে চলিয়া যাইতেছে; দিবা দ্বিপ্রহর হইয়াছে, তপনদেব মেঘের আড়ালে থাকিয়া ফাঁকে ফাঁকে কিরণজাল বিস্তর করিতেছেন— সেই কিরণজাল ছোট২ ঢেউ গুলির উপর পড়িয়া চিক্মিক্ চিক্মিক্ করিতেছে, বোধ হইতেছে যেন ভাগীরথি-বক্ষ অসংখ্য হীরক রাশিতে পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে।
পাঠক চলুন, একবার ভাগীরথীর নিকটবর্ত্তী গগন ভেদী ইষ্টক নির্ম্মিত এক তৃতল গৃহে প্রবেশ করি। যিনি কখন ঐ গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন, তিনিই উহার মাহাত্ম্য সম্যকরূপে অবগত অছেন। উহার ভিতরে, বাহিরে, উপরে, নীচে, অসংখ্য লোক, কেহ সিংহাসনোপরি উপবিষ্ট—কেহ তাঁহার আজ্ঞাপ্রত্যাশী হইয়া চিত্র লিখিত পুত্তলিকার মত পার্শ্ব দেশে দণ্ডায়মান, —কেহ করযোড়ে বিনীত ভাবে কুটপ্রশ্ন সকলের সাবধানে উত্তর দিতেছেন—কেহ আপন আপন গলাবাজি করিয়া প্রকোষ্ট সকল প্রতিধ্বনিত করিতেছেন; কেহ স্থিরচিত্তে, স্থিরনেত্রে, বসিয়া ঐ সকল শ্রবণ ও দর্শন করিতেছেন; কেহ লেখনী হস্তে রাখিয়া অবিশ্রান্ত লেখনী চালনা করিতেছেন, কেহ লেখনী কর্ণে রাখিয়া কপালে করার্পণ পুর্ব্বক গম্ভীর পেচক সদৃশ বসিয়া স্থিরচিত্তে আপনার অদৃষ্ট ফল ভাবিতেছেন। কেহ রাশি রাশি মিথ্যা কথা বলিয়া আগন্তুক দিগকে বঞ্চনাপূর্ব্বক আপন আপন উদরপূর্ত্তির অভিলাষে স্বকীয় নিকৃষ্টবৃত্তির পরিচয় দিতেছেন, কেহ পাগ্ড়ি বাঁধিয়া কাগজের তাড়া বগলে করিয়া বিনাকর্ম্মে অবিশ্রান্ত ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন; দেখিলে বোধ হয় যেন কত কার্য্যে ব্যস্ত— কিছু মাত্র অবকাশ নাই। এইরূপে কত লোক কত কর্ম্মে কত উদ্দ্যেশ্যে ঘুরিতেছেন, তাহার ইয়ত্তা নাই। পাঠক মহাশয় কি জানেন এটা কোন পুরী?
এটী এই কলিকাতা মহানগরীর ছোট আদালত, ইহাতে নিত্য নিত্য কত লোক দেনার দায়ে কেহ বা বিনাদায়ে) অপমানিত হইতেছেন, গরিব হইতেছেন, জেলে যাইতেছেন; কেহ বা বড়লোক হইতেছেন, অন্যের যথা সর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া লইতেছেন; কেহ বা নিকৃষ্ট পাশববৃত্তি চরিতার্থ করিবার অভিপ্রায়ে সকলের চক্ষে ধূলি দিয়া সুরূপা অসহায় স্ত্রীলোকদিগকে কপর্দ্দকশূন্যা নিপীড়িত ও পরিশেষে দেনা জালে জড়িতা করিয়া আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতেছেন।
আমরা যে, তৃতলগৃহটির কথা বলিতেছি, পাঠক চলুন, একবার ইহার মধ্যে প্রবেশ করি। গৃহে প্রবেশ করিয়া একে একে পাঁচটী প্রকোষ্ট পর্য্যবেক্ষণ করিলাম, কত কি দেখিলাম—ইচ্ছা করিয়াছিলাম, মনে রাখিব, কিন্তু ভুলিয়া গেলাম, কেন ভুলিলাম, তবে শুনুন—মধ্যে গিয়া দেখি, একটি স্ত্রীলোক গললগ্নীকৃতবানে একজন বাঙ্গালী হাকিমের সম্মুখে দণ্ডায়মান, চক্ষু দিয়া অবিরল জলস্রোত বহিতেছে, পশ্চাতে এক জন ইংরাজ প্রহরী করালমূর্ত্তি ধরিয়া তাহার পাহারায় নিযুক্ত আছে।
হাকিম স্ত্রীলোকটিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “তিনকড়ি” তুমি অম্বিকা চরণ দত্তের যে টাকা ধার, তাহা আদ্যাপি পরিশোধ কর নাই; সুতরাং তোমাকে এখানে আনা হইয়াছে; যদি এই মুহূর্ত্তেই টাকা প্রদান করিতে সমর্থ না হও, তবে তোমাকে জেলে যাইতে হইবে”। তিনকড়ি শুনিয়া অবাক্, নিম্পন্দ! পরে বহুকষ্টে অশ্রুজল মোচন করিয়া কহিল “ধর্ম্মাবতার অম্বিকা চরণ দত্ত কে? আমি তাহাকে জানি না বা চিনি না; আমি কখনও তাহার নিকট হইতে কোন টাকা কর্জ্জ করি নাই, এবং আমি কাহারও নিকট ঋণ-গ্রস্থ নহি।” এই বলিয়া পুনরায় রোদন করিতে লাগিল। হাকিম বলিলেন—“মিছা রোদন করলে কোন ফল নাই, যখন তোমার নামে নালিশ হইয়া ডিক্রি হইয়াছিল সেই সময় তোমার বলা উচিত ছিল এ আর সার শুনিবার সময় নাই। তুমি এখন টাকা দিতে পারিবে কি জেলে যাইবে বল?” তিনকড়ি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিল ‘ধর্ম্মাবতার আপনি মা, বাপ, বিশেষ হাকিম, আমাকে জেতে দেওয়া কি ছার! আপনি মনে করলে আপনার যা ইচ্ছা তাহাই করতে পারেন। কিন্তু আমার নামে কখনও কে ডিক্রী করে নাই, আমি কাহার ও টাকা ধারিনা। আমার নিকট একটা পয়লা ও নাই, কাল যে কি খাইব তাহার ও সংস্থান নাই, আমি টাকা কোথা হইতে দিব?”
হাকিম রাগান্বিত হইয়া কহিলেন, “আমি তোমার ও সকল কথা শুনতে পারিনা, ' প্রহরীকে সম্বোধন করিয়া বালিলেন “তুমি উহাকে এখনি জেলে রাখিয়া আইস।”
তিনকড়ি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল “আমি জেলে যাই তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু ধর্ম্মাবতার, আমার একটা অল্পবয়স্ক—”
বলিতে বলিতে ইংরাজ প্রহরী জর্জ যম দূতের ন্যায় তিনকড়ির হস্ত ধরিয়া বাহিরে লইয়া গেল, উহাদিগকে আর দেখা গেলনা, কেবল স্ত্রীলোকের কণ্ঠনিঃসৃত ক্রন্দন ধ্বনি শ্রবণগোচর হইতে লাগিল, তাও অল্প সময়ের নিমিত্ত; ক্রমেক্রমে উহা বাতাসে মিশিয়া গেল।