আদরিণী/প্রথম পরিচ্ছেদ
আদরিণী
সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত
(উপন্যাস)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
৩১ শে শ্রাবণ শনিবার, রাখি-পূর্ণিমা, শ্রী শ্রীকৃষ্ণ দবের ঝুলন যাত্রার শেষ দিবস আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, গত ৫ দিবস হইতে সূর্যের মুখ দেখা যায় নাই, রাত্রিদিন টিপ টপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে, রাস্তা কর্দ্দমময়— পথিকগণের কষ্টের শেষ নাই, কিন্তু কলকাতা নগরীর রাজপথ লোকে লোকারণ্য এক যাইতে না যাইতে আবার আসিতেছে—জনস্রোতের মত জনস্রোত চলিতেছে, বিরাম নাই। গাড়ী ঘোড়ার এত ভিড় যে, রাস্তার এক পার্শ্ব হইতে সহজে অপর পার্শ্বে যাইবার যো নাই; এমন সময় রাস্তার পার্শ্বে দূরস্থিত এক ঘড়িতে টং টং করিয়া ১২টা বাজিয়া গেল। বরুণদেব ন জানি মনে মনে কি ভাবিয়া আপনার বেগ সম্বরণ করলেন; এমন সময় একখানি গাড়ী ঘড় ঘড় করিয়া আসিয়া শ্যামবাজার গোপীমোহন দত্তের লেন, একটা ইষ্টক নির্ম্মিত দ্বিতল গৃহের দ্বার দেশে খামিল।
গৃহের ভিতর কেবল ৩টী মাত্র স্ত্রীলোক, অদ্য ১৮ দিবস হইল এখানে আসিয়াছে; কোথা হইতে আসিয়াছে, কি অভিপ্রায়ে আসিয়াছে, —তাহারা কে, এবং কত দিবসইবা এখানে থাকিবে—কেহই জানে না। ইহাদিগের মধ্যে একটা বালিকা, বয়ঃক্রম ১৩ বৎসর, ইহার মুখশ্রী অতীব রমণীয়, দাঁতগুলি যেন বিধাতাপুরুষ আপনার হাতে বাছিয়া বাছিয়া দুই শ্রেণীতে মুক্ত-শ্রেণী বসাইয়া রাখিয়াছেন; ইহার সুনীল আয়ত চক্ষুদ্বয় সেই মনোহর মুখখানির মধ্যে যেন আল্গা বসাইয়া দিয়াছেন, যেন সরোবরে দুইটি নীল পদ্ম ভাসিতেছে। দৃষ্টির চাঞ্চল্য নাইদেখিয়া বোধ হয় যেন, এই চোক্ আর কিছুই দেখিতে চায় না, অথবা দেখিয়া ত্যক্ত বিরক্ত হইয়াছে, আর দেখিতে সাধ করে না! চক্ষু সততই টল্ টল্ করিতেছে বোধ হয় যেন জল পড়িতেছে—কিন্তু পড়ে না। বালিকার মুখখানি দেখিবামাত্রই বোধ হয় যে ইহাকে দু:খে এবং গাম্ভীর্য্যে ঢাকিয়া রাখিয়াছে। মাথার কেশগুচ্ছ মৃত্তিকাস্পর্শ করিয়া ধরণীকে চুম্বন করতেছে। যিনিই এই বালিকাকে দেখিয়াছেন, তিনিই স্বীকার করিবেন—বালিকা সুন্দরী। এরূপ রূপে স্বর্গীয় আভা আছে, ইহা মানবে কখনও সম্ভবে না? অবশ্যই কোন দেবকন্যা শাপভ্রষ্ট হইয়া পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন; ইহাঁর নাম হরিদাসী; বালিকা একচী নিভৃত কক্ষে বসিয়া একখানি পুস্তক পাঠ করিতেছেন। অন্য একটা বৃদ্ধা, বয়ঃক্রম ৬০ বৎসর হইবে, কৃষ্ণবর্ণ, চর্ম্ম ঝুলিয়া পড়িয়াছে, চক্ষু কোটরে প্রবিষ্ট হইয়াছে, শ্রবণশক্তি একবারে অন্তর্হিত হইয়াছে। উহাকে দেখিয়া কোন নীচবংশসম্ভূত বলিয়া বোধ হয়। উহার নাম আহ্লাদী—সে গৃহকার্য্যে ব্যস্ত আছ।
অপরটী প্রবীণ বিধবা—বয়ঃক্রম ৫০ বৎসরের ন্যূন হইবে না, শ্যামবর্ণা, স্থূলকলেবরা; ম্রিয়মাণ্য, ইহার মুখ দেখিয়াই বোধ হয় যেন উহার হৃদয় চিন্তায় পরিপূর্ণ। ইহার নাম তিনকড়ি। তিনকড়ি ভোজন করিতে বসিয়াছেন।
গাড়ী থামিলে একজন সইস আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল, একজন শ্বেতকায় পুরুষ ও দুইটি এদেশীয় যুবক বাহির হইয়া দ্রুতপাদবিক্ষেপে গৃহে প্রবেশ করিলেন। তিনকড়ি যে স্থানে উপবিষ্ট হইয়া আহার করিতেছিল, সেই স্থানে উপনীত হইলে যুবকদ্বয় তিনকড়ির প্রতি লক্ষ্য করতঃ ঐ শ্বেতকায় পুরুষকে বলিলেন “এই তিনকড়ি”। এই কথা শ্রবণ মাত্র শ্বেতকায় মহাপুরুষ উহার হস্ত ধারণ করিলেন। যমদূতের হস্ত ছড়াইয়া লয় কাহার সাধ্য? বিশেষ স্ত্রীলোক। উহার মুখের গ্রাস মুখেই রহিল—হস্তের অন্ন পড়িয়া গেল। চীৎকার করিয়া দিয়া উঠিল। উহার কে, কোথা হইতে আসিল—হঠাৎ কেনইবা তাহাকে একজন অপরিচিত, বিশেষ বিদেশীয় ইংরাজ আসিয়া হস্তধারণ করল, তাহা কিছুই করিতে পারিল না। স্ত্রীলোকের সম্বল রোদন— তখন তিনকড়ি তাহারই আশ্রয় লইল। আহ্লাদী ও হরিদাসী আসিয়া উহাতে যোণ দিন। কিন্তু উহাদের ক্রন্দন কে শুনে? উহাদের রোদন অরণ্যে রোদন হইল, পাষাণ হৃদয় ইংরেজের মন কিছুতেই দ্রব হইল না। উহাকে সেই এক বসনে আনিয়া আপনার গাড়ীর ভিতর পুরিয়া কোচম্যানকে বলিল “গাড়ীচালাও”। অমনি গাড়ী চলিল। গাড়ী যত দূরবর্ত্তী হইতে লাগিল, উহার ক্রন্দন ধ্বনি তত বাড়িতে লাগিল; ক্রমে গাড়ী দৃষ্টিপথের অতীত হইয়া দক্ষিণ মুখে চলিয়া গেল। হরিদাসী বা আহ্লাদী। কেহই কোন কারণ জানতে পারল না; তাহারাও কাঁদিতে কাঁদিতে সদর দরজা বন্ধ করিয়া বাটির ভিতর প্রবেশ করল। ইহার পর আর ২৷৩ দিবস ঐ বাড়ীর দরজা কেহ খোলা দেখিতে পাইল না। পরে যখন দরজা খোলা হইল, তখন দেখা গেল হরিদাসী বা আহ্লাদী সে স্থানে নাই; শূণ্য ঘর পড়িয়া রহিয়াছে,— উহারা কোথায় গেল, কে লইয়া গেল, কেহই বলিতে পারিল না।