মন্দ্র

‘মন্দ্র’ শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নৃত-প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থখানিকে আমরা সাহিত্যের আসরে সাদর অভিবাদনের সঙ্গে আহ্বান করিয়া আনিব ইহাকে আমরা মুহূর্তমাত্র দ্বারের কাছে দাঁড় করাইয়া রাখিতে পারিব না।

 গ্রন্থ-সমালোচনা সম্পাদকের কর্তব্য বলিয়াই গণ্য। অনেকেই অতি-মাত্র আগ্রহের সঙ্গেই এ কর্তব্য পালন করিতে অগ্রসর হন। কিন্তু আমাদের এ সম্বন্ধে ব্যগ্রতার যথেষ্ট অভাব আছে, সে কথা স্বীকার করি।

 মন্দ্র কাব্যখানিকে অবলম্বন করিয়া আমরা অকস্মাৎ কর্তব্য পালন করিতে আসি নাই। গ্রন্থ পাঠ করিয়া যে আনন্দ পাইয়াছি তাহাই প্রকাশ করিবার জন্য আমাদের এই উদ্যম।

 মন্দ্র কাব্যখানি বাংলার কাব্যসাহিত্যকে অপরূপ বৈচিত্র্য দান করিয়াছে। ইহা নৃতনতায় ঝম করিতেছে এবং এই কাব্যে যে ক্ষমতা প্রকাশ পাইয়াছে, তাহা অবলীলাকৃত ও তাহার মধ্যে সর্বত্রই প্রবল আত্মবিশ্বাসের একটি অবাধ সাহস বিরাজ করিতেছে।

 সে সাহস কী শব্দনির্বাচনে, কী ছন্দোবচনায়, কী ভাববিন্যাসে সর্বত্র অক্ষুন্ন। সে সাহস আমাদিগকে বারংবার চকিত করিয়া তুলিয়াছে, আমাদের মনকে শেষ পর্যন্ত তরঙ্গিত করিয়া রাখিয়াছে।

 কাব্যে যে নয় রস আছে, অনেক কবিই সেই ঈর্ষান্বিত নয় রসকে নয় মহলে পৃথক করিয়া রাখেন। দ্বিজেন্দ্রলালবাবু অকুতোভয়ে এক মহলেই একত্র তাহাদের উৎসব জমাইতে বসিয়াছেন। তাহার কাব্যে হাস্য, করুণা, মাধুর্য, বিস্ময়, কখন কে কাহার গায়ে আসিয়া পড়িতেছে, তাহার ঠিকানা নাই।

 এইরূপে মন্দ্র কাব্যের প্রায় প্রত্যেক কবিতা নব নব গতিভঙ্গে যেন নৃত্য করিতেছে, কেহ স্থির হইয়া নাই; ভাবের অভাবনীয় আবর্তনে তাহার ছন্দ ঝংকৃত হইয়া উঠিতেছে এবং তাহার অলংকারগুলি হইতে আলোক ঠিকরিয়া পড়িতেছে।

 কিন্তু নর্তনশীল নটীর সঙ্গে তুলনা করিলে মন্দ্রকাব্যের কবিতাগুলির ঠিক বর্ণনা হয় না। কারণ, ইহার কবিতাগুলির মধ্যে পৌরুষ আছে। ইহার হাস্য বিষাদ বিদ্রুপ বিস্ময় সমস্তই পুরুষের, তাহাতে চেষ্টাহীন সৌন্দর্যের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সবলতা আছে। তাহাতে হাবভাব ও সাজসজ্জার প্রতি কোনো নজর নাই। বরং উপমা দিতে হইলে শ্রাবণের পূর্ণিমারাত্রির কথা পাড়া যাইতে পারে। আলোক এবং অন্ধকার, গতি এবং স্তব্ধতা, মাধুর্য ও বিরাটভাব আকাশ জুড়িয়া অনায়াসে মিলিত হইয়াছে। আবার মাঝে মাঝে এক-এক পশলা বৃষ্টিও বাতাসকে আর্দ্র করিয়া ঝরঝর শব্দে ঝরিয়া পড়ে। মেঘেরও বিচিত্র ভঙ্গি—তাহা কখনো চাঁদকে অর্ধেক ঢাকিতেছে, কখনো পুরা ঢাকিতেছে, কখনো বা হঠাৎ একেবারে মুক্ত করিয়া দিতেছে, কখনো বা ঘোরঘটায় বিদ্যুতে স্ফুরিত ও গর্জনে স্তনিত হইয়া উঠিতেছে।

 দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলাভাষার একটা নূতন শক্তি আবিষ্কার করিয়াছেন। প্রতিভাসম্পন্ন লেখকের সেই কাজ। ভাষাবিশেষের মধ্যে যে কতটা ক্ষমতা আছে তাহা তাঁহারাই দেখাইয়া দেন; পূর্বে যাহার অস্তিত্ব কেহ সন্দেহ করে নাই তাহাই তাহারা প্রমাণ করিয়া দেন; দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলা কাব্যভাষায় একটি বিশেষ শক্তি দেখাইয়া দিলেন। তাহা ইহার গতিশক্তি। ইহা যে কেমন দ্রুতবেগে, কেমন অনায়াসে তরল হইতে গম্ভীর ভাষায়, ভাব হইতে ভাবান্তরে চলিতে পারে—ইহার গতি যে কেবলমাত্র মৃদুমন্থর আবেশভারাক্রান্ত নহে—তাহা কবি দেখাইয়াছেন। ছন্দ সম্বন্ধেও যেন স্পর্ধাভরে কবি যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রকাশ করিয়াছেন। তাহার ‘আশীর্বাদ’ ও ‘উদ্‌বোধন’ কবিতায় ছন্দকে একেবারে ভাঙিয়া-চুরিয়া উড়াইয়া দিয়া ছন্দোরচনা করা হইয়াছে। তিনি যেন সাংঘাতিক সংকটের পাশ দিয়া গেছেন—কোথাও যে কিছু বিপদ ঘটে নাই, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু এই দুঃসাহস কোনো ক্ষমতাহীন কবিকে আদৌ শোভা পাইত না।

 এইবার নমুনা উদ্ধৃত করিবার সময় আসিয়াছে। কিন্তু আমরা ফুল ছিঁড়িয়া বাগানের শোভা দেখাইবার আশা করি না। পাঠকগণ কাব্য পড়িবেন; কেবল সমালোচনা চাখিয়া ভোজের পূর্ণসুখ নষ্ট করিবেন না।

 কার্তিক ১৩০৯