আধুনিক সাহিত্য/শুভবিবাহ
রাস্কিন এক জায়গায় বলিয়াছেন, ‘মহং আর্ট্, মাত্রই স্তব। সেই সঙ্গেই তাহাকে বলিতে হইয়াছে, কোনাে বড়াে জিনিসকে সংজ্ঞার দ্বারা বাধা সহজ নহে। অতএব, আর্ট্ ব্যাপারটা যে স্তব, সেটা খােলসা করিয়া বােঝানাে আবশ্যক।
মানুষ বিশ্বসংসারে যাহা ভালােবাসে আর্টের দ্বারা তাহার স্তব করে। সুন্দর গড়ন দিয়া মানুষ যখন একটা সামান্য ঘট প্রস্তুত করে তখন সে কী করে? না, রেখার যে মনােহর রহস্য আমরা ফুলের পাপড়ির মধ্যে, ফলের পূর্ণতার মধ্যে, পাতার ভঙ্গিমায়, জীবশরীরের লাবণ্যে দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি, মানুষ ঘটের গঠনে বিশ্বের সেই রেখাবিন্যাস-চাতুরীর প্রশংসা করে। বলে যে ‘জগতে চোখ মেলিয়া এই সকল বিচিত্র সুষমা আমার ভালাে লাগিয়াছে।’
এইখানে একটা কথা ভাবিবার আছে। বিশ্বপ্রকৃতি বা মানবপ্রকৃতির মধ্যে যাহা-কিছু মহৎ বা সুন্দর, তাহাই আমাদের স্তবের যােগ্য, সুতরাং তাহাই আর্টের বিষয়, এ কথা বলিলে সমস্ত কথা বলা হয় না।
প্রাণের প্রতি প্রাণের, মনের প্রতি মনের, হৃদয়ের প্রতি হৃদয়ের একটা স্বাভাবিক টান আছে। ইহাকে বিশেষভাবে সৌন্দর্য বা ঔদার্যের আকর্ষণ বলিতে পারি না। ইহাকে ঐক্যের আকর্ষণ বলা যাইতে পারে। আমি মানুষ, কেবল এইজন্যই মানুষের সকল বিষয়েই আমার মনের একটা ঔৎসুক্য আছে। আমি বাঙালি, এইজন্য বাঙালির তুচ্ছ বিষয়টিতেও আমার মনের মধ্যে একটা সাড়া পাওয়া যায়। গ্রামের দিঘির ভাঙা ঘাটটি আমার ভালাে লাগে সুন্দর বলিয়া নয়, গ্রামকে ভালােবাসি বলিয়া। গ্রামকে কেন ভালােবাসি? না, গ্রামের লােজনদের প্রতি আমার মনের একটা টান আছে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা যে রামচন্দ্র-যুধিষ্ঠির সীতা-সাবিত্রীর দল তাহা নহে; তাহারা নিতান্তই সাধারণ লোক; তাহাদের মধ্যে স্তব করিবার যোগ্য কোনো বিশেষত্বই দেখা যায় না।
যদি কোনো কবি এই ঘাটটির প্রতি তাহার অনুরাগ ঠিকমত ব্যক্ত করিয়া কবিতা লিখিতে পারেন তবে সেই কবিতা কেবল যে এই গ্রামের লোকেরই মনে লাগিবে তাহা নহে, সকল দেশেরই সহৃদয় পাঠক এই কবিতার রস উপভোগ করিতে পারিবে। কারণ, যে ভাবটি লইয়া এই কবিতা রচিত তাহা সকল দেশের মানুষের পক্ষেই সমান।
এ কথা সত্য যে, অনেক আর্টই, যাহা উদার, যাহা সুন্দর, তাহার প্রতি আমাদের ভক্তি বা প্রীতির প্রকাশ। কিন্তু যাহা সুন্দর নহে, যাহা সাধারণ, তাহার প্রতি আমাদের মনের সহজ আনন্দ—ইহাও আর্টের বিষয়। যদি তাহা না হইত তবে আর্ট আমাদের ক্ষতিই করিত।
কারণ, কেবলমাত্র বাছাই করিয়া, জগতের যাহা-কিছু বিশেষভাবে, সুন্দর, বিশেষভাবে মহৎ, তাহারই প্রতি আমাদের রুচিকে বারংবার প্রবতিত করিতে থাকিলে আমাদের একটা রসের বিলাসিতা জন্মায়। যাহা প্রতিদিনের, যাহা চারি দিকের, যাহা হাতের কাছে আছে, তাহা আমাদের কাছে বিস্বাদ হইয়া আসে; ইহাতে সংকীর্ণ সীমার মধ্যে আমাদের অনুভবশক্তির আতিশয্য ঘটাইয়া আর-সর্বত্র তাহার জড়ত্ব উৎপাদন করা হয়। এইরূপ আর্টসম্বন্ধীয় বাবুয়ানার দুর্গতির কথা টেনিসন তাহার কোনো কাব্যে বর্ণনা করিয়াছেন, সকলেই তাহা জানেন।
আমরা যে-গ্রন্থখানির সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি, পাঠকের সহিত তাহার পরিচয়-সাধন করাইবার আরম্ভে ভূমিকাস্বরূপ উপরের কয়েকটি কথা বলা গেল।
রাঙ্কিনের সংজ্ঞা অনুসারে ‘শুভবিবাহ' বইখানি কিসের স্তব? ইহার মধ্যে সৌন্দর্যের ছবি, মহত্ত্বের আদর্শ, কী প্রকাশ পাইয়াছে? ইহার উত্তরে বলিব, এমন করিয়া হিসাব খইয়া দেখা চলে না। আপিস হইতে ফিরিয়া আসিলে ঘরের লোক জিজ্ঞাসা করিতে পারে, আজ তুমি কী রোজগার করিয়া আনিলে? লাভের পরিমাণ তখনই তাহাকে গুনিয়া দেখানো যাইতে পারে। কিন্তু বন্ধুবান্ধবের বাড়ি ঘুরিয়া আসিলে যদি প্রশ্ন ওঠে ‘আজ তুমি কী লাভ করিলে’ তবে থলি ঝাড়িয়া তাহা হাতে হাতে দেখানো সম্ভবপর হইতে পারে না।
সাহিত্যেও কোনো কোনো বিশেষ গ্রন্থে কী পাওয়া গেল তাহা বেশ স্পষ্ট করিয়া দেখানো যাইতে পারে। কিন্তু এমন গ্রন্থও আছে যাহার লাভ এমন করিয়া হিসাবের মধ্যে আনা যায় না যাহা নূতন শিক্ষা নহে, যাহা মহান্ উপদেশ নহে, যাহা অপরূপ সৃষ্টি নহে যাহা কেবল পরিচিতের সঙ্গে পরিচয়, আলাপীর সঙ্গে আলাপ, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্ব মাত্র।
কিন্তু জীবনের আনন্দের অধিকাংশই এইরূপ অত্যন্ত সহজ এবং সামান্য জিনিস লইয়াই তৈরি। আকস্মিক, অদ্ভুত, অপূর্ব আমাদের জীবনের পথে দৈবাৎ আসিয়া জোটে, তাহার জন্য যে বসিয়া থাকে বা খুঁজিয়া বেড়ায় তাহাকে প্রায়ই বঞ্চিত হইতে হয়।
‘শুভবিবাহ’ একটি গল্পের বই; স্ত্রীলোকের লেখা। ইহার গল্পের ক্ষেত্রটি কলিকাতা-কায়স্থসমাজের অন্তঃপুর। এটুকু বলিতে পারি, মেয়ের কথা মেয়েতে যেমন করিয়া লিখিয়াছে এমন কোন পুরুষ গ্রন্থকার লিখিতে পারিত না।
পরিচয় থাকিলেই তাহার বিষয়ে যে সহজে লেখা যায় এ কথা ঠিক নহে। নিত্যপরিচয়ে আমাদের দৃষ্টিশক্তির জড়তা আনে; মনকে যাহা নূতন করিয়া, বিশেষ করিয়া আঘাত না করে, মন তাহাকে জানিয়াও জানে না। যাহা সুপরিচিত তাহার প্রতিও মনের নবীন ঔৎসুক্য থাকা একটি দুর্লভ ক্ষমতা। শুভবিবাহে লেখিকা সেই ক্ষমতা প্রচুর পরিমাণে প্রকাশ করিয়াছেন। এমন সজীব সত্য চিত্র বাংলা কোনো গল্পের বইয়ে আমরা দেখি নাই। গ্রন্থে বর্ণিত অন্তঃপুর ও অন্তঃপুরিকাগণ যে লেখিকার বানানো, এ কথা আমরা কোনো জায়গাতেই মনে করিতে পারি নাই। তাহারাই দেদীপ্যমান সত্য এবং লেখিকা উপলক্ষমাত্র।
এই বইখানির মধ্যে সামান্য একটুখানিমাত্র গল্প আছে এবং নায়ক-নায়িকার উপসর্গ একেবারেই নাই; তবু প্রথম খান-ত্রিশেক পাতা পড়া হইয়া গেলেই মনের ঔৎসুক্য শেষ ছত্র পর্যন্ত সমান সজাগ হইয়া থাকে। অথচ সমস্ত গ্রন্থে কলাকৌশল বা ভাষার ছটা একেবারেই নাই, কেবল জীবন এবং সত্য আছে। যাহা কিছু আছে সমস্তই সহজেই প্রত্যক্ষ এবং অনায়াসেই প্রত্যয়যোগ্য।
গ্রন্থে বর্ণিত নারীগুলিকে অসামান্য ভাবে চিত্র করিবার চেষ্টামাত্র করা হয় নাই, অথচ তাহাদের চরিত্রে আমাদের মনকে পাইয়া বসিয়াছে, তাহাদের সুখদুঃখে আমরা কিছুমাত্র উদাসীন নই। যিনি ঘরের গৃহিণী, এই গ্রন্থের যিনি ‘দিদি', তিনি মোটাসোটা, সাদাসিধা প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক; ছেলের উপার্জিত নৃতনলব্ধ ঐশ্বর্যে অহংকৃত; অথচ তাঁহার অন্তঃকরণে যে স্বাভাবিক স্নেহরস সঞ্চিত আছে তাহা বিকৃত হইতে পারে নাই—তিনি উপরে ধনীঘরের কর্তী, ভিতরে সরলহৃদয় সহজ স্ত্রীলোক। তাহার বিধবা কন্যা ‘রাণী’ কল্যাণের প্রতিমা, অথচ ইহার চিত্রে সচেষ্টভাবে বেশি করিয়া রঙ ফলাইবার প্রয়াস কোনো জায়গাতেই দেখা যায় না; অতি সহজেই ইনি ইহার স্থান লইয়া আছেন, নিতান্ত সামান্য ব্যাপারের মধ্যেই ইনি আপনার অসামান্যতাকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিয়াছেন। লেখিকা ইহাকে আমাদের সম্মুখে খাড়া করিয়া দিয়া বাহবা লইবার জন্য কোথাও আমাদের মুখের দিকে তাকান নাই। আর সেই ‘পিসিমা, অনাথা, সন্তানহীনা—জনশূন্য বৃহৎ ঘরে অনাবশ্যক ঐশ্বর্যের মধ্যে শ্যামসুন্দরের বিগ্রহটিকে লইয়া যিনি নারীহৃদয়ের সমস্ত অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা প্রশান্ত ধৈর্যের সহিত মিটাইতেছেন, তাঁহার চরিত্র শুভ্র পবিত্রতার সহিত স্নিগ্ধ করুণার, বঞ্চিত মেহবৃত্তির সহিত সংযত নিষ্ঠার সুন্দর সমবায় যেন অনায়াসে ফুটিয়া উঠিয়াছে। হঠাৎ পিতৃহীন ভ্রাতুস্পুত্রটিকে কাছে পাইয়া যখন এই তপস্বিনীর স্ত্রীপ্রকৃতি সুধারসে উচ্ছ্বসিত হইয়া তাহার দেবসেবার নিত্যকর্মকেও যেন ক্ষণকালের জন্য ভুলিয়া গেল, তখন আন্তরিক অশ্রুজলে পাঠকের হৃদয় যেন সুস্নিগ্ধ হইয়া যায়।
রোমাণ্টিক উপন্যাস বাংলাসাহিত্যে আছে; কিন্তু বাস্তব চিত্রের অত্যন্ত অভাব। এজন্যও এই গ্রন্থকে আমরা সাহিত্যের একটি বিশেষ লাভ বলিয়া গণ্য করিলাম। য়ুরোপীয় সাহিত্য কোথাও কোথাও দেখিতে পাই, মানবচরিত্রের দীনতা ও জঘন্যতাকেই বাস্তবিকতা বলিয়া স্থির করা হইয়াছে। আমাদের আলোচ্য বাংলা গ্রন্থটিতে পঙ্কিলতার নামগন্ধমাত্র নাই, অথচ বইটির আগাগোড়ায় এমন কিছু নাই, যাহা সাধারণ নহে, স্বাভাবিক নহে, বাস্তব নহে।
আষাঢ় ১৩১৩