আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
ক্রমে সন্তানসম্প্রদায়মধ্যে সম্বাদ প্রচারিত হইল যে সত্যানন্দ আসিয়াছেন, সন্তানদিগের সঙ্গে কি কথা কহিবেন, এই বলিয়া তিনি সকলকে আহ্বান করিয়াছেন। তখন দলে দলে সন্তানসম্প্রদায় অজয়তীরে আসিয়া সমবেত হইতে লাগিল। জ্যোৎস্নারাত্রিতে অজয়সৈকতপার্শ্বে বৃহৎ কাননমধ্যে আম্র, পনস, তাল, তিন্তিড়ী, অশ্বত্থ, বেল, বট, শাল্মলী প্রভৃতি বৃক্ষাদি রঞ্জিত মহাগহনে দশ সহস্র সশস্ত্র সন্তান সমবেত হইল। তখন সকলেই পরস্পরের মুখে সত্যানন্দের আগমনবার্তা শ্রবণ করিয়া মহা কোলাহলধ্বনি করিতে লাগিল। সত্যানন্দ কি জন্য কোথায় গিয়াছিলেন, তাহা সাধারণে জানিত না। প্রবাদ এই যে তিনি সন্তানদিগের মঙ্গলকামনায় তপস্যার্থ হিমালয়ে প্রস্থান করিয়াছিলেন। আজ সকলে কাণাকাণি করিতে লাগিল “মহারাজের তপঃসিদ্ধি হইয়াছে―আমাদের রাজ্য হইবে।” তখন বড় কোলাহল হইতে লাগিল। কেহ চীৎকার করিতে লাগিল “মার, মার, নেড়ে মার!” কেহ বলিল “জয় জয়! মহারাজ কি জয়!” কেহ গায়িল “হরে মুররে মধুকৈটভারে!” কেহ গায়িল “বন্দে মাতরং!”, কেহ বলে―ভাই এমন দিন কি হইবে, তুচ্ছ বাঙ্গালি হইয়া রণক্ষেত্রে এ শরীর পাত করিব? কেহ বলে ভাই এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব? কেহ বলে ভাই এমন দিন কি হইবে, আপনার ধন আপনি খাইব? দশ সহস্র নরকণ্ঠের কলকল রব, মধু্র বায়ুসন্তাড়িত বৃক্ষপত্ররাশির মর্ম্মর, সৈকতবাহিনী তরঙ্গিণীর মৃদু মৃদু তর তর রব, নীল আকাশে চন্দ্র তারা শ্বেত মেঘরাশি, শ্যামল ধরণীতলে হরিৎ কানন, স্বচ্ছ নদী, শ্বেত সৈকত, ফুল্ল কুসুমদাম। আর মধ্যে মধ্যে সেই সর্ব্বজনমনোরম “বন্দে মাতরং।” তখন সত্যানন্দ আসিয়া সেই সমবেত সন্তানমণ্ডলীর মধ্যে দাঁড়াইলেন। তখন সেই দশ সহস্র সন্তানমন্তক বৃক্ষবিচ্ছেদপতিত চন্দ্রকিরণে প্রভাসিত হইয়া শ্যামলতৃণভূমে প্রণত হইল। অতি উচ্চৈঃস্বরে অশ্রুপূর্ণলোচনে উভয় বাহু ঊর্দ্ধে উত্তোলন করিয়া সত্যানন্দ বলিলেন,
“শঙ্খচক্র গদাপদ্মধারী, বনমালী, বৈকুণ্ঠনাথ, যিনি কেশিমথন মধুমুরনরকমর্দ্দন লোকপালন তিনি তোমাদের মঙ্গল করুন, তিনি তোমাদের বাহুতে বল দিন, মনে ভক্তি দিন, ধর্ম্মে মতি দিন, তোমরা একবার তাঁহার মহিমা গীত কর।” তখন সেই সহস্র কণ্ঠে উচ্চৈঃস্বরে গীত হইতে লাগিল।
“জয় জগদীশ হরে
প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং
বিহিত বহিত্র চরিত্র মখেদং
কেশব ধৃত মীন শরীর
জয় জগদীশ হরে।”
সত্যানন্দ তাহাদিগকে পুনরায় আশীর্ব্বাদ করিয়া বলিলেন “হে সন্তানগণ, তোমাদের সঙ্গে আজ আমার বিশেষ কথা আছে। টমাসনামা এক জন বিধর্ম্মী দুরাত্মা বহুতর সন্তান নষ্ট করিয়াছে। আজ রাত্রে আমরা তাহাকে সসৈন্যে বধ করিব। জগদীশ্বরের আজ্ঞা―তোমরা কি বল?”
ভীষণ হরিধ্বনিতে কানন বিদীর্ণ করিল। “এখনই মারিব―কোথায় তারা দেখাইয়ে দিবে চল!” “মার মার! শত্রু মার!” ইত্যাদি শব্দ দূরস্থ শৈলে প্রতিধ্বনিত হইল। তখন সত্যানন্দ বলিলেন, “সে জন্য আমাদিগকে একটু ধৈর্য্যাবলম্বন করিতে হইবে। শত্রুদের কামান আছে―কামান ব্যতীত তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধ সম্ভবে না। বিশেষ তাহারা বড় বীরজাতি। পদচিহ্নের দুর্গ হইতে ১৭টা কামান আসিতেছে―কামান পৌঁছিলে আমরা যুদ্ধে যাত্রা করিব। ঐ দেখ প্রভাত হইতেছে―বেলা চারিদণ্ড হইলেই―ও কিও―”
গুড়ুম্―গুড়ুম্―গুম্! অকস্মাৎ চারি দিকে বিশাল কাননে তোপের আওয়াজ হইতে লাগিল। তোপ ইংরেজের। জালনিবদ্ধ মীনদলবৎ কাপ্তেন টমাস সন্তানসম্প্রদায়কে এই আম্রকাননে ঘেরিয়া বধ করিবার উদ্যোগ করিয়াছে।