আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/দশম পরিচ্ছেদ
দশম পরিচ্ছেদ।
সেই দশ সহস্র সন্তান “বন্দে মাতরং” গায়িতে গায়িতে বল্লম উন্নত করিয়া অতি দ্রুতবেগে তোপশ্রেণীর উপর গিয়া পড়িল। গোলাবৃষ্টিতে খণ্ড বিখণ্ড বিদীর্ণ উৎপতিত অত্যন্ত বিশৃঙ্খল হইয়া হইয়া গেল, তথাপি সন্তান সৈন্য ফেরে না। সেই সময়ে কাপ্তেন টমাসের আজ্ঞায় একদল সিপাহী বন্দুকে সঙ্গীন চড়াইয়া প্রবলবেগে সন্তানদিগের দক্ষিণপার্শ্বে আক্রমণ করিল। তখন দুই দিক হইতে আক্রান্ত হইয়া সন্তানেরা একেবারে নিরাশ হইল। মুহূর্ত্তে, শত শত সন্তান বিনষ্ট হইতে লাগিল। তখন জীবানন্দ বলিলেন, “ভবানন্দ তোমারই কথা ঠিক, আর বৈষ্ণবধ্বংসের প্রয়োজন নাই; ধীরে ধীরে ফিরি।”
ভব। এখন ফিরিবে কি প্রকারে? এখন যে পিছনে ফিরিবে সেই মরিবে।
জীব। সম্মুখে ও দক্ষিণপার্শ্ব হইতে আক্রমণ হইতেছে। বামপার্শ্বে কেহ নাই, চল অল্পে অল্পে ঘুরিয়া বামদিক দিয়া বেড়িয়া সরিয়া যাই।
ভব। সরিয়া কোথায় যাইবে? সেখানে যে অজয় নদী―নূতন বর্ষার অজয় যে অতি প্রবল হইয়াছে। তুমি ইংরেজের গোলা হইতে পলাইয়া এই সন্তানসেনা অজয়ের জলে ডুবাইবে?
জীব। অজয়ের উপর একটা পুল আছে আমার স্মরণ হইতেছে।
ভব। এই দশসহস্র সেনা সেই পুলের উপর দিয়া পার করিতে গেলে এত ভিড় হইবে, যে বোধ হয় একটা তোপেই অবলীলাক্রমে সমুদায় সন্তানসেনা ধ্বংস করিতে পারিবে।
জীব। এক কর্ম্ম কর, অল্পসংখ্যক সেনা তুমি সঙ্গে রাখ, এই যুদ্ধে তুমি যে সাহস ও চাতুর্য্য দেখাইলে তোমার অসাধ্য কাজ নাই। তুমি সেই অল্পসংখ্যক সন্তান লইয়া সম্মুখ রক্ষা কর। আমি তোমার সেনার অন্তরালে অবশিষ্ট সন্তানগণকে পুল পার করিয়া লইয়া যাই, তোমার সঙ্গে যাহা রহিল তাহারা নিশ্চিত বিনষ্ট হইবে, আমার সঙ্গে যা রহিল তাহা বাঁচিলে বাঁচিতে পারিবে।
ভব। আচ্ছা, আমি তাহা করিতেছি।
তখন ভবানন্দ দুই সহস্র সন্তান লইয়া পুনর্ব্বার “বন্দে মাতরং” শব্দ উত্থিত করিয়া ঘোর উৎসাহসহকারে ইংরেজের গোলন্দাজসৈন্য আক্রমণ করিলেন। সেইখানে ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল, কিন্তু তোপের মুখে সেই ক্ষুদ্র সন্তানসেনা কতক্ষণ টিকে? ধানকাটার মত তাহাদিগকে গোলন্দাজেরা ভূমিশায়ী করিতে লাগিল।
এই অবসরে জীবানন্দ অবশিষ্ট সন্তানসেনার মুখ ঈষৎ ফিরাইয়া বামভাগে কানন বেড়িয়া ধীরে ধীরে চলিল। কাপ্তেন টমাসের এক জন সহযোগী লেপ্টনাণ্ট ওয়াট্সন দূর হইতে দেখিলেন, যে এক সম্প্রদায় সন্তান ধীরে ধীরে পলাইতেছে, তখন তিনি এক দল ফৌজদারী সিপাহী, একদল রাজার সিপাহী, লইয়া জীবানন্দের অনুবর্ত্তী হইলেন।
ইহা কাপ্তেন টমাস দেখিতে পাইলেন। সন্তানসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রধান ভাগ পলাইতেছে দেখিয়া তিনি কাপ্তেন হে নামা একজন সহযোগীকে বলিলেন, যে “আমি দুই চারি শত সিপাহী লইয়া এই উপস্থিত ভগ্নবিদ্রোহীদিগকে নিহত করিতেছি, তুমি তোপগুলি ও অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া উহাদের প্রতি ধাবমান হও, বামদিক দিয়া লেপ্টনাণ্ট ওয়াটসন যাইতেছেন, দক্ষিণদিক দিয়া তুমি যাও। আর দেখ, আগে গিয়া পুলের মুখ বন্ধ করিতে হইবে; তাহা হইলে তিনদিক হইতে উহাদিগকে বেষ্টিত করিয়া জালের পাখীর মত মারিতে পারিব। উহারা দ্রুতপদ দেশী ফৌজ, সর্ব্বাপেক্ষা পলায়ানেই সুদক্ষ, অতএব তুমি উহাদিগকে সহজে ধরিতে পরিবে না, তুমি অশ্বারোহীদিগকে একটু ঘুর পথে আড়াল দিয়া গিয়া পুলের মুখে দাঁড়াইতে বল, তাহা হইলে কর্ম্মসিদ্ধ হইবে।” কাপ্তেন হে তাহাই করিল।
“অতি দর্পে হতালঙ্কা।” কপ্তেন টমাস সস্তানদিগকে অতিশয় ঘৃণা করিয়া দুইশত মাত্র পদাতিক ভবানন্দের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য রাখিয়া আর সকল হের সঙ্গে পাঠাইলেন। চতুর ভবানন্দ যখন দেখিলেন, ইংরেজের তোপ সকলই গেল, সৈন্য সব গেল, যাহা অল্পই রহিল তাহা সহজেই বধ্য, তখন তিনি নিজ হতাবশিষ্টদলকে ডাকিয়া বলিলেন যে “এই কয়জনকে নিহত করিয়া জীবানন্দের সাহায্যে আমাকে যাইতে হইবে। আর একবার তোমরা “জয় জগদীশ হরে” বল। তখন সেই অল্পসংখ্যক সন্তানসেনা “জয় জগদীশ হরে” বলিয়া ব্যাঘ্রের ন্যায় কাপ্তেন টমাসের উপর লাফাইয়া পড়িল। সেই আক্রমণের উগ্রতা অল্পসংখ্যক সিপাহী ও তৈলঙ্গীর দল সহ্য করিতে পারিল না, তাহারা বিনষ্ট হইল। ভবানন্দ তখন নিজে গিয়া কাপ্তেন টমাসের চুল ধরিলেন। কাপ্তেন শেষ পর্য্যন্ত যুদ্ধ করিতেছিল। ভবানন্দ বলিলেন, কাপ্তেন সাহেব তোমায় মারিব না, ইংরেজ আমাদিগের শত্রু নহে। কেন তুমি মুসলমানের সহায় হইয়া আসিয়াছ? আইস―তোমার প্রাণদান দিলাম। আপাততঃ তুমি বন্দী। ইংরেজের জয় হউক, আমরা তোমাদের সুহৃদ।” কাপ্তেন টমাস তখন ভবানন্দকে বধ করিবার জন্য সঙ্গীনসহিত একটা বন্দুক উঠাইবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ভবানন্দ তাহাকে বাঘের মত ধরিয়াছিল, কাপ্তেন টমাস নড়িতে পারিলেন না। তখন ভবানন্দ অনুচরবর্গকে বলিল যে “ইহাকে বাঁধ।” দুই তিন জন সন্তান আসিয়া কাপ্তেন টমাসকে বাঁধিল। ভবানন্দ বলিল “ইহাকে একটা ঘোড়ার উপর তুলিয়া লও, চল উহাকে লইয়া আমরা জীবানন্দ গোস্বামীর আনুকূল্যে যাই।”
তখন সেই অল্পসংখ্যক সন্তানগণ কাপ্তেন টমাসকে ঘোড়ায় বাঁধিয়া লইয়া “বন্দে মাতরং” গায়িতে গায়িতে লেপ্টনাণ্ট ওয়াট্সনকে লক্ষ্য করিয়া ছুটিল।
জীবানন্দের সন্তানসেনা ভগ্নোদ্যম, তাহার পলায়নে উদ্যত। জীবানন্দ ও ধীরানন্দ, তাহাদিগকে বুঝাইয়া সংযত রাখিলেন কিন্তু সকলকে পারিলেন না, কতকগুলি পলাইয়া আম্রকাননের আশ্রয় লইল। অবশিষ্ট সেনা জীবানন্দ ও ধীরানন্দ পুলের মুখে লইয়া গেলেন। কিন্তু সেই খানে হে ও ওয়াট্সন তাহাদিগকে দুই দিক হইতে ঘেরিল। আর রক্ষা নাই।