আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 মঠে না গিয়া, ভবানন্দ গভীর বনমধ্যে প্রবেশ করিলেন। সেই জঙ্গলমধ্যে এক স্থানে এক প্রাচীন অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ আছে। ভগ্নাবশিষ্ট ইষ্টকাদির উপর, লতাগুল্ম কণ্টকাদি অতিশয় নিবিড় ভাবে জন্মিয়াছে। সেখানে অসংখ্য সর্পের বাস। ভগ্ন প্রকোষ্ঠের মধ্যে একটি অপেক্ষাকৃত অভগ্ন ও পরিষ্কৃত ছিল ভবানন্দ গিয়া তাহার উপরে উপবেশন করিলেন। উপবেশন করিয়া ভবানন্দ চিন্তা করিতে লাগিলেন।

 রজনী অতি ঘোর তমোময়ী। তাহাতে সেই অরণ্য অতি বিস্তৃত, একেবারে জনশূন্য, অতিশয় নিবিড়, বৃক্ষলতায় দুর্ভেদ্য, বন্যপশুরও গমনাগমনের বিরোধী। বিশাল, জনশূন্য, অন্ধকার, দুর্ভেদ্য, নীরব! রবের মধ্যে দূরে ব্যাঘ্রের হুঙ্কার অথবা অন্য শ্বাপদের ক্ষুধা ভীতি বা আস্ফালনের বিকট শব্দ। কদাচিৎ কোন বৃহৎ পক্ষীর পক্ষকম্পন, কদাচিৎ তাড়িত এবং তাড়নকারী, বধ্য এবং বধকারী পশুদিগের দ্রুতগমন শব্দ। সেই বিজনে অন্ধকারে ভগ্ন অট্টালিকার উপর বসিয়া একা ভবানন্দ। তাঁহার পক্ষে তখন যেন পৃথিবী নাই, অথবা কেবল ভয়ের উপাদানময়ী হইয়া আছেন। সেই সময়ে ভবানন্দ কপালে হাত দিয়া ভাবিতেছিলেন; স্পন্দ নাই, নিশ্বাস নাই, ভয় নাই, অতি প্রগাঢ় চিন্তায় নিমগ্ন। মনে মনে বলিতেছিলেন, “যাহা ভবিতব্য তাহা অবশ্য হইবে। আমি ভাগীরথীজলতরঙ্গসমীপে ক্ষুদ্র গজের মত ইন্দ্রিয় স্রোতে ভাসিয়া গেলাম, ইহাই আমার দুঃখ। একমুহূর্ত্তে দেহের ধ্বংস হইতে পারে,―দেহের ধ্বংসেই ইন্দ্রিয়ের ধ্বংস―আমি সেই ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হইলাম? আমার মরণ শ্রেয়। ধর্ম্ম ত্যাগী? ছি! মরিব!” এমন সময়ে পেচক মাথার উপর মৃদু গম্ভীর শব্দ করিল। ভবানন্দ তখন মুক্তকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন “ও কি শব্দ? কাণে যেন গেল, যেন যম আমায় ডাকিতেছে। আমি জানি না কে শব্দ করিল, কে আমায় ডাকিল, কে আমায় বিধি দিল, কে মরিতে বলিল! পুণ্যময়ি অনন্তে! তুমি শব্দময়ী, কিন্তু তোমার শব্দের তো মর্ম্ম আমি বুঝিতে পারিতেছি না। আমায় ধর্ম্মে মতি দাও, আমার পাপ হইতে নিরত কর। ধর্ম্মে, হে গুরুদেব! ধর্ম্মে যেন আমার মতি থাকে।”

 তখন সেই ভীষণ কাননমধ্য হইতে মতি মধুর অথচ গম্ভীর, মর্ম্মভেদী মনুষ্যকণ্ঠ শ্রুত হইল; কে বলিল “ধর্ম্মে তোমার মতি থাকিবে—আশীর্ব্বাদ করিলাম।”

 ভবানন্দের শরীরে রোমাঞ্চ কইল। “একি এ? এ যে গুরুদেবের কণ্ঠ। মহারাজ কোথায় আপনি! এ সময়ে দাসকে দর্শন দিন।”

 কিন্তু কেহ দর্শন দিল না—কেহ উত্তর করিল না। ভবানন্দ পুনঃ পুনঃ ডাকিলেন—উত্তর পাইলেন না। এ দিক ওদিক খুঁজিলেন―কোথাও কেহ নাই।

 যখন রজনী প্রভাতে প্রাতঃসূর্য্য উদিত হইয়া বৃহৎ অরণ্যের শিরঃস্থ শ্যামল পত্ররাশিতে প্রতিভাসিত হইতেছিল তখন ভবানন্দ মঠে আসিয়া উপস্থিত হইলেন! কর্ণে প্রবেশ করিল—“হরে মুরারে! হরে মুরারে!” চিনিলেন সত্যানন্দের কণ্ঠ। বুঝিলেন, প্রভু প্রত্যাগমন করিয়াছেন।