আনন্দমঠ (১৮৮৩)/প্রথম খণ্ড/বিংশ পরিচ্ছেদ
পরদিন আনন্দ মঠের ভিতর নিভৃত কক্ষে বসিয়া ভগ্নোৎসাহ সন্তাননায়ক তিন জন কথোপকথন করিতেছিলেন। জীবানন্দ সত্যানন্দকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! দেবতা আমাদিগের প্রতি এমন অপ্রসন্ন কেন? কি দোষে আমরা মুসলমানের নিকট পরাভূত হইলাম?”
সত্যানন্দ বলিলেন, “দেবতা অপ্রসন্ন নহেন। যুদ্ধে জয় পরাজয় উভয়ই আছে। সে দিন আমরা জয়ী হইয়াছিলাম, আজ পরাভূত হইয়াছি। শেষ জয়ই জয়। আমার নিশ্চিত ভরসা আছে, যে যিনি এতদিন আমাদিগকে দয়া করিয়াছেন, সেই শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বনমালী আবার পুনর্ব্বার দয়া করিবেন। তাঁহার পাদস্পর্শ করিয়া যে মহাব্রতে আমরা ব্রতী হইয়াছি, অবশ্য সে ব্রত আমাদিগকে সাধন করিতে হইবে। বিমুখ হইলে আমরা অনন্ত নরক ভোগ করিব। আমাদর দাবী মঙ্গলের বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই। কিন্তু যেমন দৈবানুগ্রহ ভিন্ন কোন কার্য্য সিদ্ধ হইতে পারে না, তেমনি পুরুষকারও চাই। আমরা যে পরাভূত হইলাম, তাহার কারণ এই, যে আমরা নিরস্ত্র। গোলাগুলি বন্দুক কামানের কাছে লাটি, সোটা বল্লমে কি হইবে। অতএব আমাদিগের পুরুষকারের লাঘব ছিল বলিয়াই এই পরাভব ইয়াছে। এক্ষণে আমাদের কর্ত্তব্য, যাতে আমাদিগেরও ঐরূপ অস্ত্রের অপ্রতুল না হয়।”
জীব। সে অতি কঠিন ব্যাপার।
সত্য। কঠিন ব্যাপার জীবানন্দ? সন্তান হইয়া তুমি এমন কথা মুখে আনিলে? সন্তানের পক্ষে কঠিন কাজ আছে কি?
জীব। কি প্রকারে তাহার সংগ্রহ করিব আজ্ঞা করুন।
সত্য। সংগ্রহের জন্য আমি আজ রাত্রে তীর্থযাত্রা করিব। যতদিন না ফিরিয়া আসি, ততদিন তোমরা কোন গুরুতর ব্যাপারে হস্তক্ষেপণ করিও না। কিন্তু সন্তানদিগের একতা রক্ষা করিও। তাহাদিগের গ্রাসাচ্ছাদন যোগাইও, এবং মার রণজয়ের জন্য অর্থভাণ্ডাব পূর্ণ করিও। এই ভার তোমাদিগের দুই জনের উপর রহিল।
ভবানন্দ বলিল, “তীর্থযাত্রা করিয়া এ সকল সংগ্রহ করিবেন কি প্রকারে? গোলাগুলি বন্দুক কামান কিনিয়া পাঠাইতে বড় গোলমাল হইবে। আর এত পাইবেন বা কোথা, বেচিবে বা কে, আনিবে বা কে?
সত্য। কিনিয়া আনিয়া আমরা কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতে পারিব না। আমি কারিগর পাঠাইয়া দিব, এইখানে প্রস্তুত করিতে হইবে।
জীব। সে কি? এই আনন্দ মঠে?
সত্য। তাও কি হয়? ইহার উপায় আমি বহুদিন হইতে চিন্তা করিতেছি। ঈশ্বর অদ্য তাহার সুযোগ করিয়া দিয়াছেন। তোমরা বলিতেছিলে, ভগবান্ প্রতিকূল। আমি দেখিতেছি তিনি অনুকূল।
ভব। কোথায় কারখানা হইবে?
সত্য। পদচিহ্ণে।
জীব। সে কি? সেখানে কি প্রকারে হইবে?
সত্য। নহিলে কি জন্য আমি মহেন্দ্র সিংহকে এ মহাব্রত গ্রহণ করাইবার জন্য এত আকিঞ্চন করিয়াছি?
ভব। মহেন্দ্র কি ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন?
সত্য। ব্রত গ্রহণ করে নাই, করিবে। আজ রাত্রে তাহাকে দীক্ষিত করিব।
জীব। কই, মহেন্দ্র সিংহকে ব্রত গ্রহণ করাইবার জন্য কি আকিঞ্চন হইয়াছে, তাহা আমরা দেখি নাই। তাহার স্ত্রী কন্যার কি অবস্থা হইয়াছে? কোথায় তাহাদিগকে রাখিল? আমি আজ একটি কন্যা নদীতীরে পাইয়া, আমার ভগিনীর নিকট রাখিয়া আসিয়াছি। সেই কন্যার নিকট একটি সুন্দরী স্ত্রীলোক মরিয়া পড়িয়াছিল। সে ত মহেন্দ্রের স্ত্রী কন্যা নয়। আমার তাই বোধ হইয়াছিল।
সত্য। সেই মহেন্দ্রের স্ত্রী কন্যা।
ভবানন্দ চমকিয়া উঠিলেন। তখন তিনি বুঝিলেন যে, যে স্ত্রীলোককে তিনি ঔষধবলে পুনর্জীবিত করিয়াছিলেন সেই মহেন্দ্রের স্ত্রী কল্যাণী। কিন্তু এক্ষণে কোন কথা প্রকাশ করা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন না।
জীবানন্দ বলিল, “মহেন্দ্রের স্ত্রী মরিল কিসে?
সত্য। বিষ পান করিয়া।
জীব। কেন সে বিষ খাইল?
সত্য। ভগবান্ তাহাকে প্রাণত্যাগ করিতে স্বপ্নাদেশ করিয়াছিলেন।
ভব। সে স্বপ্নাদেশ কি সন্তানের কার্য্যোদ্ধারের জন্যই হইয়াছিল?
সত্য। মহেন্দ্রের কাছে সেইরূপই শুনিলাম। এক্ষণে সায়াহ্ণ কাল উপস্থিত, আমি সায়ংকৃত্যাদি সমাপনে চলিলাম। তৎপরে নূতন সন্তানদিগকে দীক্ষিত করিতে প্রবৃত্ত হইব।
ভব। সন্তানদিগকে? কেন, মহেন্দ্র ব্যতীত আর কেহ আপনার নিজ শিষ্য হইবার স্পর্দ্ধা রাখে নাকি?
সত্য। হাঁ, আর একটি নূতন লোক। পূর্ব্বে আমি তাহাকে কখন দেখি নাই। আজি নূতন আমার কাছে আসিয়াছে। সে অতি তরুণ বয়স্ক যুবা পুরুষ। আমি তাহার আকারেঙ্গিতে ও কথা বার্ত্তায় অতিশয় প্রীত হইয়াছি। খাঁটী সোণা বলিয়া তাহাকে বোধ হইয়াছে। তাহাকে সন্তানের কার্য্য শিক্ষা করাইবার ভার জীবানন্দের প্রতি রহিল। কেন না জীবানন্দ, লোকের চিত্তাকর্ষণে বড় সুদক্ষ। আমি চলিলাম, তোমাদের প্রতি আমার একটী উপদেশ বাকি আছে। অতিশয় মনঃসংযোগপূর্ব্বক তাহা শ্রবণ কর।
তখন উভয়ে যুক্ত-কর হইয়া নিবেদন করিল, “আজ্ঞা করুন।”
সত্যানন্দ বলিলেন “তোমরা দুই জনে যদি কোন অপরাধ করিয়া থাক, অথবা আমি ফিরিয়া আসিবার পূর্ব্বে কর, তবে তাহার প্রায়শ্চিত্ত আমি না আসিলে করিও না। আমি আসিলে, প্রায়শ্চিত্ত অবশ্য কর্ত্তব্য হইবে।”
এই বলিয়া সত্যানন্দ স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। ভবানন্দ এবং জীবানন্দ উভয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করিল।
ভবানন্দ বলিল “তোমার উপর নাকি?”
জীব। বোধ হয়। ভগিনীর বাড়ীতে মহেন্দ্রের কন্যা রাখিতে গিয়াছিলাম।
ভব। তাতে দোষ কি, সেটা তো নিষিদ্ধ নহে। ব্রাহ্মণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া আসিয়াছ কি?
জীব। বোধ হয় গুরুদেব তাই মনে করেন।