আনন্দমঠ (১৮৮৩)/প্রথম খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
চটীতে বসিয়া ভাবিয়া কোন ফলোদয় হইবে না বিবেচনা করিয়া মহেন্দ্র গাত্রোত্থান করিলেন। নগরে গিয়া রাজপুরুষদিগের সহায়তায় স্ত্রী কন্যার অনুসন্ধান করিবেন, এই বিবেচনায় সেই দিকেই চলিলেন। কিছু দূর গিয়া পথিমধ্যে দেখিলেন, কতকগুলি গোরুর গাড়ি ঘেরিয়া অনেকগুলি সিপাহী চলিয়াছে। “রাজনগর, বা নগর” কি তাহা বুঝাইতে হইতেছে।
১১৭৬ সালে বীরভূম প্রভৃতি প্রদেশ ইংরেজের শাসনাধীন হয় নাই। ইংরেজ তখন বাঙ্গালার দেওয়ান। তাঁহারা খাজনার টাকা আদায় করিয়া লন, কিন্তু তখনও বাঙ্গালীর প্রাণ সম্পত্তি প্রভৃতি রক্ষণাবেক্ষণের কোন ভার লয়েন নাই। তখন টাকা লইবার ভার ইংরেজের, আর প্রাণ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের ভার পাপিষ্ঠ নরাধম বিশ্বাসহন্তা মনুষ্যকুলকলঙ্ক মীরজাফরের উপর। মীরজাফর আত্মরক্ষায় অক্ষম, বাঙ্গালা রক্ষা করিবে কি প্রকারে? মীরজাফর গুলি খায় ও ঘুমায়। ইংরেজ টাকা আদায় করে ও ডেস্পাচ্ লেখে। বাঙ্গালী কাঁদে আর উৎসন্ন যায়।
বাঙ্গালার পক্ষে সাধারণ নিয়ম এই। কিন্তু বীরভূম প্রভৃতি প্রদেশ সম্বন্ধে একটু স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত ছিল। বীরভূম প্রদেশ বীরভূমের রাজার অধীনে। রাজনগর বা নগর—তাঁহারই রাজধানী। বীরভূমের রাজারা পূর্ব্বে স্বাধীন ছিলেন সম্প্রতি মুরসিদাবাদের অধীন হইয়াছিলেন। পূর্ব্বে বীরভূমে হিন্দু স্বাধীন রাজা ছিলেন। কিন্তু আধুনিক রাজবংশ মুসলমান। যে সময়ের কথা লিখিতেছি, তাহার পূর্ব্বের রাজা আলিনকি খাঁ বাহাদুর সিরাজ উদ্দৌলার সহায়তায় কিছু লম্বাই চৌড়াই করিয়া কলিকাতা লুটিয়া আসিয়াছিলেন। তার পর ক্লাইবের পাদুকা স্পর্শে মুসলমান জন্ম সার্থক করিয়া বেহেস্তে যাত্রা করিবার উন্মুখ হইয়াছিলেন। বাঙ্গালার অন্যান্য অংশের ন্যায় বীরভূমের কর ইংরেজের প্রাপ্য। কিন্তু শাসনের ভার বীরভূমের রাজার উপর। যেখানে যেখানে ইংরেজরা আপনাদের প্রাপ্য কর আপনারা আদায় করিতেন, সেখানে তাঁহারা এক এক কালেক্টার নিযুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু বীরভূম প্রদেশে এ পর্য্যন্তও কালেক্টার নিযুক্ত হয় নাই। রাজাই ইংরেজের কর আদায় করিয়া কলিকাতায় পাঠাইয়া দিতেন।
অতএব বীরভূমের খাজনা কলিকাতায় যায়। লোক না খাইয়া মরুক, খাজনা আদায় বন্ধ হয় না। তবে তত আদায় হইয়া উঠে নাই—কেন না মাতা বসুমতী ধন প্রসব না করিলে ধন কেহ গড়িতে পারে না। যাহা হউক, যাহা কিছু আদায় হইয়াছে, তাহা গাড়ী বোঝাই হইয়া সিপাহীর পাহারায় কলিকাতার কোম্পানির ধনাগারে যাইতেছিল। আজিকার দিনে দস্যুভীতি অতিশয় প্রবল, এজন্য পঞ্চাশ জন সশস্ত্র সিপাহী গাড়ীর অগ্রপশ্চাৎ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া সঙ্গীন খাড়া করিয়া যাইতে ছিল। তাহাদিগের অধ্যক্ষ একজন গোরা। সে কোম্পানীর চাকর নহে। দেশীয় রাজগণের সৈন্যগণমধ্যে তখন অনেক গোরা অধ্যক্ষতা করিত। গোরা সর্ব্বপশ্চাৎ ঘোড়ায় চড়িয়া চলিয়াছিল। রৌদ্রের জন্য দিনে সিপাহীরা পথ চলে না, রাত্রে চলে। চলিতে চলিতে সেই খাজনার গাড়ী ও সৈন্য সামন্তে মহেন্দ্রের গতিরোধ হইল। মহেন্দ্র সিপাহী ও গোরুর গাড়ী কর্ত্তৃক পথরুদ্ধ দেখিয়া, পাশ দিয়া দাঁড়াইলেন। তথাপি সিপাহীরা তাহার গা ঘেঁসিয়া যায়—দেখিয়া এবং এ বিবাদের সময় নয় বিবেচনা করিয়া, তিনি পথপার্শ্বস্থ জঙ্গলের ধারে গিয়া দাঁড়াইলেন।
তখন একজন সিপাহী বলিল, “এহি একঠো ডাকু ভাগতা হ্যায়।” মহেন্দ্রের হাতে বন্দুক দেখিয়া এ বিশ্বাস তাহার দৃঢ় হইল। সে তাড়াইয়া গিয়া মহেন্দ্রের গলা ধরিল। এবং “শালা—চোর—” বলিয়াই সহসা এক ঘূষা মারিল, ও বন্দুক কাড়িয়া লইল। মহেন্দ্র রিক্ত হস্তে কেবল ঘূষাটি ফিরাইয়া মারিল। মহেন্দ্রের একটু রাগ যে বেশী হইয়াছিল তাহা বলা বাহুল্য। ঘূষাটি খাইয়া সিপাহী মহাশয় ঘুরিয়া অচেতন হইয়া রাস্তায় পড়িলেন। তখন তিন চারিজন সিপাহী আসিয়া মহেন্দ্রকে ধরিয়া জোরে টানিয়া সেনাপতি সাহেবের নিকট লইয়া গেল, এবং সাহেবকে বলিল যে, এই ব্যক্তি একজন সিপাহীকে খুন করিয়াছে। সাহেব পাইপ খাইতেছিলেন, মদের ঝোঁকে একটুখানি বিহ্বল ছিলেন, বলিলেন, “শালাকো পাকড়লেকে সাদি করো।” সিপাহীরা বুঝিতে পারিল না যে, বন্দুকধারী ডাকাতকে তাহারা কি প্রকারে বিবাহ করিবে, কিন্তু নেশা ছুটিলে সাহেবের মত ফিরিবে, বিবাহ করিতে হইবে না, বিবেচনায় তিন চারিজন সিপাহী গাড়ীর গোরুর দড়ি দিয়া মন্দ্রেকে হাতে পায় বাঁধিয়া গোরুর গাড়ীতে তুলিল। মহেন্দ্র দেখিলেন, এত লোকের সঙ্গে জোর করা বৃথা, জোর করিয়া মুক্তিলাভ করিয়াই বা কি হইবে? স্ত্রী কন্যার শোকে তখন মহেন্দ্র কাতর, বাঁচিবার কোন ইচ্ছা ছিল না। সিপাহীরা মহেন্দ্রকে উত্তম করিয়া গাড়ীর চাকার সঙ্গে বাঁধিল। পরে সিপাহীরা খাজানা লইয়া যেমন চলিতেছিল, তেমনি মৃদুগম্ভীরপদে চলিল।