আনন্দমঠ (১৯৩৮)/চতুর্থ খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
তখন দুই জনে কাণে কাণে কি পরামর্শ করিলেন। পরামর্শ করিয়া জীবানন্দ এক বনে লুকাইলেন। শান্তি আর এক বনে প্রবেশ করিয়া এক অদ্ভুত রহস্যে প্রবৃত্ত হইল।
শান্তি মরিতে যাইতেছিল, কিন্তু মৃত্যুকালে স্ত্রীবেশ ধরিবে, ইহা স্থির করিয়াছিল। তাহার এ পুরুষবেশ জুয়াচুরি, মহেন্দ্র বলিয়াছে। জুয়াচুরি করিতে করিতে মরা হইবে না। সুতরাং ঝাঁপি টেপারিটি সঙ্গে আনিয়াছিলেন। তাহাতে তাহার সজ্জাসকল থাকিত। এখন নবীনানন্দ ঝাঁপি টেপারি খুলিয়া বেশপরিবর্ত্তনে প্রবৃত্ত হইল।
চিকণ রকম রসকলির উপর খয়েরের টিপ কাটিয়া তৎকালপ্রচলিত ফুরফুরে কোঁকড়া কোঁকড়া কতকগুলি ঝাপটার গোছায় চাঁদমুখখানি ঢাকিয়া, শান্তি একটি সারঙ্গ হস্তে বৈষ্ণবীবেশে ইংরেজশিবিরে দর্শন দিল। দেখিয়া ভ্রমরকৃষ্ণশ্মশ্রুযুক্ত সিপাহীরা বড় মাতিয়া গেল। কেহ টপ্পা, কেহ গজল, কেহ শ্যামাবিষয়, কেহ কৃষ্ণবিষয়, ফরমাস করিয়া শুনিল। কেহ চাল দিল, কেহ ডাল দিল, কেহ মিষ্ট দিল, কেহ পয়সা দিল, কেহ সিকি দিল। বৈষ্ণবী তখন শিবিরের অবস্থা স্বচক্ষে সবিশেষ দেখিয়া, চলিয়া যায়; সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করিল, “আবার কবে আসিবে?” বৈষ্ণবী বলিল, “তা জানি না, আমার বাড়ী ঢের দূর।” সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করিল, “কত দুর?” বৈষ্ণবী বলিল, “আমার বাড়ী পদচিহ্নে।” এখন সেই দিন মেজর সাহেব পদচিহ্নের কিছু খবর লইতেছিলেন। এক জন সিপাহী তাহা জানিত। বৈষ্ণবীকে ডাকিয়া কাপ্তেন সাহেবের কাছে লইয়া গেল। কাপ্তেন সাহেব তাহাকে মেজর সাহেবের কাছে লইয়া গেল। মেজর সাহেবের কাছে গিয়া বৈষ্ণবী মধুর হাসি হাসিয়া, মর্ম্মভেদী কটাক্ষে সাহেবের মাথা ঘুরাইয়া দিয়া, খঞ্জনীতে আঘাত করিয়া গান ধরিল—
“ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালম্।”
সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “টোমাড় বাড়ী —কোঠা বিবি?”
বিবি বলিল, “আমি বিবি নই, বৈষ্ণবী। বাড়ী পদচিহ্নে।”
সাহেব। Well that is Padsin—Padsin is it? হুঁয়া একটো গর হ্যায়?
বৈষ্ণবী বলিল, “ঘর?—কত ঘর আছে।”
সাহেব। গর নেই,—গর নেই,—গর,—গর—
শান্তি। সাহেব, তোমার মনের কথা বুঝেছি। গড়?
সাহেব। ইয়েস্ ইয়েস্, গর! গর!—হ্যায়?
শান্তি। গড় আছে। ভারি কেল্লা।
সাহেব। কেট্টে আড্মি?
শান্তি। গড়ে কত লোক থাকে? বিশ পঞ্চাশ হাজার।
সাহেব। নন্সেন্স্। একটো কেল্লেমে ডো চার হাজার রহে শক্তা। হুঁয়া পর আবি হ্যায়? ইয়া নিকেল গিয়া?
শান্তি। আবার নেকলাবে কোথা?
সাহেব। মেলামে—টোম কব আয়া হ্যায় হুঁয়াসে?
শান্তি। কাল এসেছি সায়েব।
সাহেব। ও লোক আজ নিকেল গিয়া হোগা।
শান্তি মনে মনে ভাবিতেছিল যে, “তোমার বাপের শ্রাদ্ধের চাল যদি আমি না চড়াই, তবে আমার রসকলি কাটাই বৃথা। কতক্ষণে শিয়ালে তোমার মুণ্ড খাবে আমি দেখ্বো।” প্রকাশ্যে বলিল, “তা সাহেব, হতে পারে, আজ বেরিয়ে গেলে যেতে পারে। অত খবর আমি জানি না, বৈষ্ণবী মানুষ, গান গেয়ে ভিক্ষা শিক্ষা করে খাই, অত খবর রাখি নে। বকে বকে গলা শুকিয়ে উঠ্লো, পয়সাটা সিকেটা দাও—উঠে চলে যাই। আর ভাল করে বক্শিশ দাও ত না হয় পরশু এসে বলে যাব।”
সাহেব ঝনাৎ করিয়া একটা নগদ টাকা ফেলিয়া দিয়া বলিল, “পরশু নেহি বিবি!”
শান্তি বলিল, “দূর বেটা! বৈষ্ণবী বল্, বিবি কি?”
এডওয়ার্ডস্। পরশু নেহি, আজ রাৎকো হাম্কো খবর মিল্না চাহিয়ে।
শান্তি। বন্দুক মাথায় দিয়ে সরাপ টেনে সরষের তেল নাকে দিয়ে ঘুমো। আজ আমি দশ কোশ রাস্তা যাব—আস্বো—ওঁকে খবর এনে দেব! ছুঁচো বেটা কোথাকার।
এড্। ছুঁচো ব্যাটা কেস্কা কয়তা হ্যায়?
শান্তি। যে বড় বীর—ভারি জাঁদ্রেল।
এড্। Great General হাম হো শক্তা হ্যায়—ক্লাইবকা মাফিক। লেকেন আজ হাম্কো খবর মিল্নে চাহিয়ে। শও রূপেয়া বখসিস্ দেঙ্গে।
শান্তি। শই দাও আর হাজার দাও, বিশ ক্রোশ এ দুখানা ঠেঙ্গে হবে না।
এড্। ঘোড়ে পর।
শান্তি। ঘোড়ায় চড়্তে জান্লে আর তোমার তাঁবুতে এসে সারেঙ্গ বাজিয়ে ভিক্ষে করি?
এড্। গদী পর লে যায়েগা।
শান্তি। কোলে বসিয়ে নিয়ে যাবে? আমার লজ্জা নাই?
এড্। ক্যা মুস্কিল, পান্শো রূপেয়া দেঙ্গে।
শান্তি। কে যাবে, তুমি নিজে যাবে?
সাহেব তখন অঙ্গুলিনির্দ্দেশপূর্ব্বক সম্মুখে দণ্ডায়মান লিণ্ড্লে নামক এক জন যুবা এন্সাইনকে দেখাইয়া তাহাকে বলিলেন, “লিণ্ড্লে, তুমি যাবে?” লিণ্ড্লে শান্তির রূপযৌবন দেখিয়া বলিল, “আহ্লাদপূর্ব্বক।”
তখন ভারি একটা আরবী ঘোড়া সজ্জিত হইয়া আসিলে লিণ্ড্লেও তৈয়ার হইল। শান্তিকে ধরিয়া ঘোড়ায় তুলিতে গেল। শান্তি বলিল, “ছি, এত লোকের মাঝখানে? আমার কি আর কিছু লজ্জা নাই। আগে চল ছাউনি ছাড়াই।”
লিণ্ড্লে ঘোড়ায় চড়িল। ঘোড়া ধীরে ধীরে হাঁটাইয়া চলিল। শান্তি পশ্চাৎ পশ্চাৎ হাঁটিয়া চলিল। এইরূপে তাহারা শিবিরের বাহিরে আসি।
শিবিরের বাহিরে আসিলে নির্জ্জন প্রান্তর পাইয়া, শান্তি লিণ্ড্লের পায়ের উপর পা দিয়া এক লাফে ঘোড়ায় চড়িল। লিণ্ড্লে হাসিয়া বলিল, “তুমি যে পাকা ঘোড়্সওয়ার।”
শান্তি বলিল, “আমরা এমন পাকা ঘোড়্সওয়ার যে, তোমার সঙ্গে চড়িতে লজ্জা করে। ছি! রেকাব পায়ে দিয়ে ঘোড়ায় চড়া!”
একবার বড়াই করিবার জন্য লিণ্ড্লে রেকাব হইতে পা লইল। শান্তি অমনি নির্ব্বোধ ইংরেজের গলদেশে হস্তার্পণ করিয়া ঘোড়া হইতে ফেলিয়া দিল। শান্তি তখন অশ্বপৃষ্ঠে রীতিমত আসন গ্রহণ করিয়া, ঘোড়ার পেটে মলের ঘা মারিয়া, বায়ুবেগে আরবীকে ছুটাইয়া দিল। শান্তি চারি বৎসর সন্তানসৈন্যের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়া অশ্বারোহণবিদ্যাও শিখিয়াছিল। তা না শিখিলে জীবানন্দের সঙ্গে কি বাস করিতে পারিত? লিণ্ড্লে পা ভাঙ্গিয়া পড়িয়া রহিলেন। শান্তি বায়ুবেগে অশ্বপৃষ্ঠে চলিল।
যে বনে জীবানন্দ লুকাইয়াছিলেন, শান্তি সেইখানে গিয়া জীবানন্দকে সকল সংবাদ অবগত করাইল। জীবানন্দ বলিলেন, “তবে আমি শীঘ্র গিয়া, মহেন্দ্রকে সতর্ক করি। তুমি মেলায় গিয়া সত্যানন্দকে খবর দাও। তুমি ঘোড়ায় যাও—প্রভু যেন শীঘ্র সংবাদ পান।” তখন দুই জনে দুই দিকে ধাবিত হইল। বলা বৃথা, শান্তি আবার নবীনানন্দ হইল।