বঙ্কিম-শতবার্ষিক সংস্করণ

আনন্দমঠ
বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়
সম্পাদকঃ
শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রীসজনীকান্ত দাস
বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ
২৪৩।১। অপার সারকুলার রোড
কলিকাতা

বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ হইতে
শ্রীমন্মথমোহন বসু কর্ত্তৃক
প্রকাশিত

মূল্য এক টাকা বারো আনা
আষাঢ়, ১৩৪৫

শনিরঞ্জন প্রেস
২৫৭২ মোহনবাগান রো
কলিকাতা হইতে
শ্রীপ্রবোধ নান কর্ত্তৃক
মুদ্রিত

ভূমিকা
(সম্পাদকীয়)

 ‘আনন্দমঠে’র ঐতিহাসিকত্ব সম্বন্ধে স্যার যদুনাথ সরকার লিখিত একটি ভূমিকা এই গ্রন্থমধ্যে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। ইতিহাসের দিক্ দিয়া ‘আনন্দমঠ'-সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞাতব্য তথ্য ঐ ভূমিকায় দেওয়া হইয়াছে। 'দেবী চৌধুরাণী’র' “বিজ্ঞাপনে” (১৮৮৪ খ্রীঃ) স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠে’র ঐতিহাসিকত্ব সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন তাহাও স্মরণীয়।

 “আনন্দমঠ” প্রকাশিত হইলে পর, অনেকে জানিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, ঐ গ্রন্থের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি না। সন্ন্যাসী-বিদ্রোহ ঐতিহাসিক বটে, কিন্তু পাঠককে সে কথা জানাইবার বিশেষ প্রয়োজনের অভাব। এই বিবেচনায় আমি সে পরিচয় কিছুই দিই নাই। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভাণ করি নাই। এক্ষণে দেখিয়া শুনিয়া ইচ্ছা হইয়াছে, আনন্দমঠের ভবিষ্যৎ সংস্করণে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কিঞ্চিৎ ঐতিহাসিক পরিচয় দিব।—পাঠক মহাশয়, অনুগ্রহ-পূর্ব্বক আনন্দমঠকে—"ঐতিহাসিক উপন্যাস” বিবেচনা না করিলে বড় বাধিত হইব।

 ‘আনন্দমঠে’র তৃতীয় সংস্করণের (১৮৮৬ খ্রীঃ) দুইটি Appendix-এ Gleig's Memoirs of the Life of Warren Hastings এবং Hunters Annals of Rural Bengal হইতে বঙ্কিমচন্দ্র সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের কিঞ্চিৎ “ঐতিহাসিক পরিচয়” দিয়াছেন।

 ইতিহাস ছাড়াও অন্য নানা কারণে ‘আনন্দমঠে'র প্রসিদ্ধি। এই উপন্যাস এবং ইহার অন্তর্গত 'বন্দে মাতরম্' সঙ্গীত সম্বন্ধে স্বদেশে ও বিদেশে যত আলোচনা হইয়াছে, বঙ্কিমচন্দ্রের অন্য কোনও রচনা লইয়া তত আলোচনা হয় নাই। পরবর্ত্তী কালে বঙ্গদেশে এবং পরে সমগ্র ভারতবর্ষে যে স্বদেশী-আন্দোলনের বন্যা দেশের আপামরসাধারণকে চঞ্চল এবং শাসক-সম্প্রদায়কে ব্যতিব্যস্ত করিয়াছিল, সরকারী এবং বেসরকারী সকল সমালোচক, সন্তান-বিদ্রোহের সহিত তাহার যোগসূত্র খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন; এই কারণে ‘আনন্দমঠ' ও 'বন্দে মাতরমে’র কম দুর্গতি হয় নাই। ক্ষুব্ধ মুসলমানসম্প্রদায় এই পুস্তকে ইসলাম-বিবোধিতা এবং উক্ত সঙ্গীতে পৌত্তলিকতা প্রত্যক্ষ করিয়া বিরুদ্ধ আন্দোলন করিয়াছেন; এই আন্দোলনের শেষ এখনও হয় নাই।

 সাহিত্য ও সমাজের দিক দিয়াও বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার পূর্ববর্ত্তী উপন্যাসের ধারা ত্যাগ করিয়া 'আনন্দমঠে’ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ ধরিয়াছেন; এখানে তাঁহার সৃষ্টি উদ্দেশ্যমূলক হইয়া। উঠিয়াছে। তাঁহার পরবর্ত্তী দুইটি উপন্যাসে-'দেবী চৌধুরাণী’ ও ‘সীতারাম’-এই শেষোক্ত ধারারই পরিণতি; বস্তুত, তাঁহার এই শেষ উপন্যাস তিনটি উদ্দেশ্য ও প্রচারদোষ-দুষ্ট বলিয়া বহু সাহিত্যিকের নিন্দভাজন হইয়াছে; আবার অনেকে এই “উপন্যাস-ত্রয়ী"কে তাঁহার পরিণত বয়সের মহোত্তম কীর্ত্তি বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। প্রথমোক্ত দলে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং শেষোক্ত দলে শ্রীঅরবিন্দ, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়মোহিতলাল মজুমদার

 ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাস হইতে সঞ্জীবচন্দ্র-সম্পাদিত 'বঙ্গদর্শনে' ‘আনন্দমঠ' ধারাবাহিক ভাবে বাহির হইতে থাকে; ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে উহা সমাপ্ত হয়। ১২৮৯ সালেই (ইংরেজী ১৮৮২ খ্রীঃ) পুস্তকাকারে ‘আনন্দমঠে’র প্রথম সংস্করণ “কলিকাতা জন্‌সন্‌ প্রেসে শ্রীরাধানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্ত্তৃক” মুদ্রিত হইয়াছিল। এই পুস্তক স্বর্গীয় দীনবন্ধু মিত্রকে উৎসর্গীকৃত হয়। প্রথম সংস্করণ-উপক্রমণিকা ১, প্রথম খণ্ড ২৫ ও দ্বিতীয় খণ্ড ২০,—মোট ৪৬ পরিচ্ছেদে ১৯১ পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ হইয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালের শেষ সংস্করণে (৫ম সং.) ইহা উপক্রমণিকা ১, প্রথম খণ্ড ১৮, দ্বিতীয় খণ্ড ৮, তৃতীয় খণ্ড ১২ ও চতুর্থ খণ্ড ৮- মোট ৪৭ পরিচ্ছেদে ২১১ পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ হয়। এখনকার দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদটি চতুর্থ সংস্করণের পর ও পরিশিষ্ট দুইটি দ্বিতীয় সংস্করণের পর নূতন সংযোজন। 'বঙ্গদর্শনে’ প্রকাশিত “উপকুমণিকা”র সহিত গ্রন্থাকারে প্রকাশিত “উপক্রমণিকা”র বিশেষ পার্থক্য আছে—

প্রতিশব্দ হইল, “এ পণে-হইবে না।”
“আর কি আছে? আর কি দিব।”
তধন উত্তর হইল, “তোমার প্রিয়জনের প্রাণসৰ্বস্ব।”

—‘বঙ্গদর্শন', চৈত্র ১২৮৭, পৃ. ৫৩৯।

পুস্তকে “এ পণে হইবে না” স্থলে “জীবন তুচ্ছ; সকলেই ত্যাগ করিতে পারে” এবং “তোমার প্রিয়জনের প্রাণসর্বস্ব” স্থলে “ভক্তি” লিখিত হইয়াছে। এই সামান্য পরিবর্ত্তনেই পুস্তকের মূল আদর্শের সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে।

 ১২৮১ সালের কার্ত্তিক সংখ্যা 'বঙ্গদর্শনে’ “কমলাকান্তের দপ্তর। একাদশ সংখ্যা। আমার দুর্গোৎসব” প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র সেই প্রথম জন্মভূমির মাতৃরূপ দর্শন করিলেন। আনন্দমঠে’র মূল আদর্শ এই পরিকল্পনারই পরিণতি। এই পরিণতি বুঝিতে হইলে আমাদিগকে গোড়ার কথাগুলিও স্মরণ করিতে হইবে—

 দেখিলাম—অকস্মাৎ কালের স্রোত, দিগন্ত ব্যাপিয়া প্রবলবেগে ছুটিতেছে-আমি ভেলায় চড়িয়া ভাসিয়া যাইতেছি। দেখিলাম-অনন্ত, অকূল, অন্ধকারে, বাত্যাবিক্ষুব্ধ তরঙ্গসঙ্কুল সেই স্রোত—মধ্যে মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রগণ উদয় হইতেছে, নিবিতেছে—আবার উঠিতেছে। আমি নিতান্ত একা-একা বলিয়া ভয় করিতে লাগিল-নিতান্ত একা-মাতৃহীন-মা! মা! করিয়া ডাকিতেছি। আমি এই কাল-সমুদ্রে মাতৃসন্ধানে আসিয়াছি। কোথা মা! কই আমার মা? কোথায় কমলাকান্ত-প্রসূতি বঙ্গভূমি। এ ঘোর কাল-সমুদ্রে কোথায় তুমি? ...চিনিলাম, এই- আমার জননী জন্মভূমি—এই মৃন্ময়ী—মৃত্তিকারূপিণী—অনন্তরত্নভূষিতা-এক্ষণে কালগর্ভে নিহিতা। রত্নমণ্ডিত দশভুজ—দশ দিক্-দশ দিকে প্রসারিত; তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত; পদতলে শত্রু বিমর্দ্দিত, পদাশ্রিত বীরজন কেশরী শত্রুনিষ্পীড়নে নিযুক্ত! এ মূর্ত্তি এখন দেখিব না-আজি দেখিব না, কাল দেখিব না— কালস্রোত পার না হইলে দেখিব না—কিন্তু এক দিন দেখিব—দিগ্‌ভুজা, নানাপ্রহরণপ্রহারিণী, শত্রুমর্দ্দিনী, বীরেন্দ্রপৃষ্ঠবিহারিণী-দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরূপিণী, বামে বাণী বিদ্যাবিজ্ঞানমূর্তিময়ী, সঙ্গে বলরূপী কার্ত্তিকেয়, কার্য্যসিদ্ধরূপী গণেশ, আমি সেই কালস্রোতোমধ্যে দেখিলাম এই সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা!

 ...তোমায় কি বলিয়া ডাকিব মা? এই ছয় কোটি মুণ্ড ঐ পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত করিব-এই ছয় কোটি কণ্ঠে ঐ নাম করিয়া হুঙ্কার করিব,—এই ছয় কোটি দেহ তোমার জন্য পতন করিব—না পারি, এই দ্বাদশ কোটি চক্ষে তোমার জন্য কাঁদিব। এসো মা, গৃহে এসো-যাঁহার ছয় কোটি সন্তান—তাঁহার ভাবনা কি?

 এস, ভাই সকল! আমরা এই অন্ধকার কালস্রোতে ঝাঁপ দিই। এস, আমরা দ্বাদশ কোটি ভুজে ঐ প্রতিমা তুলিয়া, ছয় কোটি মাথায় বহিয়া, ঘরে আনি। এস, অন্ধকারে ভয় কি?...সেই স্বর্ণপ্রতিমা মাথায় করিয়া আনি। ভয় কি? না হয় ডুবিব; মাতৃহীনের জীবনে কাজ কি?

 ‘আনন্দমঠের মূলমন্ত্র ‘বন্দে মাতরম্' সঙ্গীতের অন্তর্নিহিত তথ্য ইহাই—“মাতৃহীনের জীবনে কাজ কি?” ছয় কোটি বৃদ্ধি পাইয়া সপ্তকোটি হইয়াছে, তফাৎ এই মাত্র। আর তফাৎ, “বন্দে মাতরম্‌” আশাবাদীর সঙ্গীত।

 এই মাতৃপূজার সহিত ‘আনন্দমঠে’ অন্য যে একটি প্রবৃত্তি মাখামাখি হইয়া আছে, ১২৮১ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যা 'বঙ্গদর্শনে’র কমলাকান্তের দপ্তরের “একটি গীতে” তাহার প্রথম দর্শন পাই; ‘আনন্দমঠ’ ঠিক ইহার আট বৎসর পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। হিন্দু জাতিকে স্বাধীন দেখিবার আকাঙ্ক্ষা বঙ্কিমের মনে কখনও নির্ব্বাপিত হয় নাই; যদিচ পরিণত বুদ্ধির সহায়তায় তিনি ভাল করিয়াই বুঝিয়াছিলেন, বর্ত্তমান অবস্থায় এই স্বাধীনতা হিন্দুর লক্ষ্য নয়। তাঁহার ‘আনন্দমঠে’র শেষ দৃশ্যে বিসর্জ্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে লইয়া গিয়াছে। তথাপি স্বাধীন হইবার এই প্রবৃত্তি তিনি কখনও পরিত্যাগ করেন নাই, এবং এই কারণেই ‘আনন্দমঠে’র সন্তানেরা মৃত্যু পণ করিয়াছিল। “একটি গীতে” দেখিতে পাই—

 গণিব। আমার এক দুঃখ, এক সন্তাপ, এক ভরসা আছে। ১২০৩ শাল হইতে দিবস গণি। যে দিন বলে হিন্দুনাম লোপ পাইয়াছে, সেই দিন হইতে দিন গণি। যে দিন সপ্তদশ অশ্বারোহী বঙ্গজয় করিয়াছিল, সেই দিন হইতে দিন গণি! হায়! কত গণিব। দিন গণিতে গণিতে মাস হয়, মাস গণিতে গণিতে বৎসর হয়, বৎসর গণিতে গণিতে শতাব্দী হয়, শতাব্দীও ফিরিয়া ফিরিয়া সাত বার গণি।

 ...মনে মনে আমি সেই দিন কল্পনা করিয়া কাঁদি। মনে মনে দেখিতে পাই, মার্জ্জিত বর্শাফলক উন্নত করিয়া, অশ্বপদশব্দমাত্রে নৈশ নীরব বিঘ্নিত করিয়া, যবনসেনা নবদ্বীপে আসিতেছে। কালপূর্ণ দেখিয়া নবদ্বীপ হইতে বাঙ্গালার লক্ষ্মী অন্তর্হিতা হইতেছেন।

 ‘আনন্দমঠে’র সন্তানসম্প্রদায় বঙ্গজননীর এই লুপ্ত স্বাধীনতা ফিরাইয়া আনিবার সাধনা করিয়াছিলেন, কিন্তু বঙ্কিম স্বীয় অপরিসীম প্রবৃত্তি সত্ত্বেও তাঁহাদিগকে বিজয়-গৌরব দিতে পারেন নাই। 'আনন্দমঠের' ট্র্যাজেডি ইহাই।

 ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দের প্রারম্ভেই বঙ্কিমচন্দ্র হুগলী হইতে হাওড়ায় বদলি হন; হাওড়াতে আসিয়াই স্থানীয় কলেক্টর সি.ই. বাক্‌লণ্ডের সহিত তাঁহার বিবাদ বাধে, এবং ইহার অব্যবহিত পরেই তাঁহার পিতা যাদবচন্দ্রের মৃত্যু হয়। 'আনন্দমঠ’ এই সময়ের রচনা। কেহ কেহ উপরি-উক্ত দুই ঘটনার সহিত ‘আনন্দমঠে’র কিছু সম্পর্ক খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন।[১]

 ‘আনন্দমঠ' রচনা সম্পর্কে বঙ্কিম-সহোদর পূর্ণচন্দ্র লিখিয়াছেন,

 বর্ষীয়ান্ খুল্লপিতামহের নিকট আমরা কয় ভ্রাতা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা প্রথম শুনি। ইঁহার গল্প করিবার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল।..কি প্রকারে তিল তিল করিয়া মন্বন্তর ভীষণ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া বঙ্গদেশ ছারখার করিল, তাহা বিবৃত করিলেন।...এইরূপ অবস্থাতে বঙ্গে নানা প্রকার পীড়ার অবির্ভাব হইয়া, অবশেষে চুরি ডাকাতি আরম্ভ হইল।...এই গল্পটি আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম, কিন্তু আমার অগ্রজের উহা মনে ছিল; কেন না, ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষের সময়ে ঐ গল্পটি আবার তাঁহার মুখে শুনিলাম। আমার বোধ হয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অবলম্বনে কোন উপন্যাস লিখিবার তাঁহার অনেক দিন ইচ্ছা ছিল, কিন্তু যৌবনে লেখেন নাই, কিঞ্চিৎ পরিণত বয়সে ‘আনন্দমঠ' লিখিলেন।—বঙ্কিম-প্রসঙ্গ’, পৃ. ৫১-৫২।

 জয়দেবের “ধীয়সমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী” কবিতাটা তাঁহার বড় প্রিয় ছিল। কি বাল্যে, কি কৈশোরে, কি যৌবনে, এই কবিতাটা তাঁহার মুখে শুনিতাম; যখন নিষ্কর্মা হইয়া বসিতেন, বাহিরের লোক কেহ ঘরে থাকিত না, তখন উহা আওড়াইতেন। ঐ কবিতাটা যে তাঁহার প্রিয় ছিল, তাহার স্মৃতি ‘আনন্দমঠে’ রাখিয়া গিয়াছেন,...

 আর একটা গীত তাঁহার বড় প্রিয় ছিল। বাল্যকালে আপনি এই গীতটীতে মাতিয়াছিলেন, পরে আনন্দমঠের সন্তানদিগকেও এই গীতে মাতাইয়াছিলেন। একদিন মাঘ মাসের রাত্রিশেষে এই গীত তিনি প্রথম শুনিলেন।...এক বৈষ্ণব খঞ্জনী বাজাইয়া সদর রাস্তায় এই গানটা গাহিতেছিল, আমি তখন জাগ্রৎ- মধুর কণ্ঠে এই রাত্রে কে গীত গাহিতেছে শুনিয়া অগ্রজকে উঠাইলাম; গান শুনা যাইতেছিল না, অগ্রজ একটা জানালা খুলিয়া দিলে গীতটা শুনিতে পাইলাম—“হরে মুরারে মধুকৈটভারে গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দসৌরে।” বৈষ্ণব এই গীতটী গাহিতে গাহিতে ঠাকুর বাটীর দিকে চলিয়া গেল। বঙ্কিমচন্দ্র “হরে মুরারে মধুকৈটভারে” আওড়াইতে আওড়াইতে জানালা বন্ধ করিলেন।

—পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম-প্রস’, পৃ. ৩৯-৪০।

 ‘আনন্দমঠ' রচনার সময় বঙ্কিমচন্দ্র কিছু কাল কলিকাতায় বাসা ভাড়া করিয়া অবস্থান করিতেছিলেন। চন্দ্রনাথ বসু মহাশয় লিখিয়াছেন,

বউবাজার ষ্ট্রীটের যে বাড়ীর সম্মুখের খণ্ডে এক্ষণে মুখুৰ্জী কোম্পানির হোমিওপেথিক ঔষধের দোকান দেখিতে পাওয়া যায় দিন কতক তিনি সেই বাড়ীতে ছিলেন।...এক দিন বৈকালে সেই বাড়ীতে গেলাম। বঙ্কিমবাবু আনন্দমঠের পাণ্ডুলিপি পড়িয়া শুনাইতে আরম্ভ করিলেন।[২]

 অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত লিখিয়াছেন,

বঙ্কিমের পিতৃগৃহ বর্ত্তমানসময়ে নিতান্ত ভগ্নাবস্থাগ্রস্ত। তাহার নিজ নির্ম্মিত বৈঠকখানাও ঘোরতর দুর্দশাগ্রস্ত। ...ঐ গৃহে বসিয়া বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দে মাতরম্‌” সঙ্গীত ও 'কৃষ্ণকান্তের উইল’ রচিত হইয়াছিল।

-বঙ্কিমচন্দ্র’ পৃ. ৩২-৩৩।

  হুগলীতে অবস্থানকালে যে ‘আনন্দমঠে’র গোড়াপত্তন হইয়াছিল, অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাহার সাক্ষ্য দিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন,

যখন আনন্দমঠ সূতিকাগারে, তখন ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায়, এখানকার আর একজন ডেপুটি ছিলেন, বঙ্কিমবাবু ত একজন ছিলেন; উভয়ের পাশাপাশি বাসা। সন্ধ্যার পর তিনি আসেন, আমিও যাই। তিনি সুরজ্ঞ, বড় টেবল হারমোনিয়ম্ লইয়া তিনি বন্দে মাতরম্‌’ গানে মল্লারের স্বর বসান। বঙ্কিম বাবুকে সুরের খাতিরে যৎসামান্য অদল বদল করিতে হয়। একদিন ক্ষেত্রবাবু আসেন নাই, বঙ্কিম বাবু আনন্দমঠের শেষে যুদ্ধের ভাগ তাঁহার হাতের লেখা খাতায় আমাকে পড়িতে দিলেন। আমি দেখিলাম, অজয় নদের উভয় পার্শ্বে স্থান, আমি 'সন্তান’ শব্দ বুঝিতে না পারিয়া 'সন্তাল' পড়িতেছিলাম—মনে মনে। খানিক পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এবার কি Santal Insurrection theme হইল না কি”। তিনি বলিলেন, “না Sanyasi Insurrection.” আমি বলিলাম এই যে, “আপনি লিখিয়াছেন অজয়ের ধারে আর বার বার বলিতেছেন, সন্তাল, সস্তালগণ”। তিনি তখন হো হো করিয়া হাসিয়া বলিলেন, “একটা তোমার অনিচ্ছাকৃত ভুল—সস্তাল নয়, ‘সন্তান'। আর একটা আমার নিজের ইচ্ছাকৃত ভুল—অজয় নদ ও বীরভূমি।” তখন হো হো করিয়া দুই জনে হাসিতে লাগিলাম।[৩]

 “বন্দে মাতরম্‌” গান রচনা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই বহু কিম্বদন্তী প্রচলিত হইয়াছে। অনেকের ধারণা ইহা 'আনন্দমঠ' লেখার পূর্বে রচিত; কেহ কেহ মনে করেন বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুরে ডফিন্‌ সাহেব কর্ত্তিক অপমানিত হইয়া প্রতিহিংসাপরবশচিত্তে ইহা রচনা করিয়াছিলেন। “বন্দে মাতরম্‌” গানের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের যে উচ্চ ধারণা ছিল, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার এবং বঙ্কিম-কন্যা প্রমুখ অনেকে তাহা বিবৃত করিয়াছেন।

 ‘আনন্দমঠ’, ‘আনন্দমঠে’র বিভিন্ন চরিত্র, দেশমাতৃকার পূজা ও “বন্দে মাতরম্‌” সম্পর্কে এদেশে এবং বিদেশে অসংখ্য আলোচনা হইয়াছে। নিম্নলিখিত আলোচনা উল্লেখযোগ্য-

 The Encyclopedia Britannica, 11th Edition, Vol. VI, pp. 9-10; Dr. G. A. Grierson—The Times, Sept 12, 1906; Sir Henry Cottor—The Times, Sept, 13, 1906; J. D. Anderson—The Times, Sept. 24, 1906; গিরিজাপ্রসন্ন রায় চৌধুরী—‘বঙ্কিমচন্দ্র। আনন্দমঠ’; S. M. Mitra—Indian Problems, London, 1908; Lord Ronaldshay—The Heart of Aryavarta, Chapter X; Verney Lovett—History of the Indian Nationalist Movement, pp. 62-63; G. T. Garratt—An Indian Commentary, p. 136; J. D. Anderson—The Modern Review, Jan. 1919; হারাণচন্দ্র রক্ষিত—‘বঙ্গ-সাহিত্যে বঙ্কিম’; Sir Surendranath Banerjee—A Nation in Making; Count Keyserling—The Book of Marriage; কালীপ্রসন্ন ঘোষ—“আনন্দমঠের মূলমন্ত্র”, ‘বান্ধব’, ৭ম বর্ষ; বিষ্ণুচরণ চট্টোপাধ্যায়—‘নব্যভারত’, ১ম খণ্ড; পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়—“বঙ্কিমচন্দ্রের ত্রয়ী”, ‘নারায়ণ’, বৈশাখ, ১৩২২; কিরণশঙ্কর রায়—“আনন্দমঠ”, ‘সবুজপত্র’, ১৩২৬; ললিতচন্দ্র মিত্র—‘স্বদেশ প্রতিমা’; Sri Aurobindo—Rishi Bunkim Chandra; অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত—‘বঙ্কিমচন্দ্র’ পৃ. ৩০৮-৩৩৮; নবীনচন্দ্র সেন ‘আমার জীবন’ ২য়-৩য় খণ্ড; Jayanta Kumar Das Gupta—Life and Novels of Bankim Candra, pp. 102-111; শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—‘বঙ্কিম-জীবনী’, ৩য় সংস্করণ, পৃ. ২৮৬-৩০৩; পূর্ণচন্দ্র বসু—‘কাব্যসুন্দরী’, পৃ. ২০০-২২৩; যতীন্দ্রমোহন গুপ্ত—“বাঙ্গালার মাতৃমূর্ত্তি”, ‘বঙ্গদর্শন’, অগ্রহায়ণ, ১৩১৭; ইত্যাদি

 এতদ্‌ব্যতীত উপাধ্যায় ব্রহ্মবান্ধব, শ্রীঅরবিন্দ, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি প্রভৃতি স্বদেশী-যুগে নানা ইংরেজী ও বাংলা সাময়িক পত্রে ‘আনন্দমঠ’ ও “বন্দে মাতরম্” লইয়া অসংখ্য আলোচনা করিয়াছেন। ‘আনন্দমঠ’-সম্পর্কে অন্য অনেকের লেখাও সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছে, যাহার উল্লেখ সম্ভবপর নহে।

 ললিতচন্দ্র মিত্র মহাশয় ১৩১৮ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণের ‘সাহিত্যে’ ‘আনন্দমঠ’-সম্পর্কে বঙ্কিমের একটি উক্তি প্রচার করিয়াছেন; বঙ্কিমচন্দ্র নাকি বলিয়াছিলেন As a patriotic work ‘আনন্দমঠ’ খুব ভাল বটে, কিন্তু উহাতে আর্ট কম। কালীপ্রসন্ন ঘোষকে লিখিত একটি পত্রে বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’-সম্পর্কে এই ভাবে উল্লেখ করিয়াছেন—

 আমি বা আনন্দমঠ লিখিয়া কি করিব আর আপনি বা তাহার মূলমন্ত্র বুঝাইয়া কি করিবেন? এ ঈর্ষ্যাপরবশ আত্মোদরপরায়ণ জাতির উন্নতি নাই। বল “বন্দে উদরং।”

 শ্রীযুক্ত নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে Abbey of Bliss নাম দিয়া ‘আনন্দমঠে’র ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করেন। শ্রীঅরবিন্দ ইংরেজী গদ্যে ও পদ্যে ‘বন্দে মাতরম’ গান অনুবাদ করিয়াছিলেন। অন্য অনুবাদও আছে। হিন্দী, মারাঠী, তামিল, তেলুগু, কানারিজ ভাষায়ও অনুদিত হইয়াছে।

 এনসাইক্লোপীডিয়ার সমালোচনা কৌতুহলোদ্দীপক বলিয়া আমরা তাহা হইতে উদ্ধৃত করিয়া ভূমিকা শেষ করিতেছি।...

Of all his works, however, by far the most important from its astonishing political consequences was the Ananda Math, which was published in 1882, about the time of the agitation arising out of the Ilbart Bill. The story deals with the Sannyasi (i. e. fakir or hermit) rebellion of 1772 near Purnea, Tirhut and Dinapur, aud its culminating episode is a crushing victory won by the rebels over the united British and Mussulman forces, a success which was not, however, followed- up, owing to the advice of a mysterious “physician” who, speaking as a divinely inspired prophet, advises Satyananda, the leader of “the children of the Mother,” to abandon further resistance, since a temporary submission to British rule is a necessity; for Hinduism has become too speculative and unpractical, and the mission of the English in India is to teach Hindus how to reconcile theory and speculation with the facts of science. The general moral of the Ananda Math, then, is that British rule and British education are to be accepted as the only alternative to Mussulman oppression, a moral which Bankim Chandra developed also in his Dharmatattwa, an elaborate religious treatise in which he explained his views as to the changes necessary in the moral and religious condition of his follow-countrymen before they could hope to compete on equal terms with the British and Mahommedans. But though the Ananda Math is in form an apology for the loyal acceptance of British rule, it is none the less inspired by the ideal of the restoration, sooner or later, of a Hindu kingdom in India. This is especially evident in the occasional versen in the book, of which the Bande Mataram is the most famous.
*

 As to the exact significance of this poem a considerable controversy has raged. Bande Mataram is the Sanskrit for “Hail to thee, Mother!” or more literally “I reverence thee, Mother!"”, and according to Dr. G. A. Grierson (Tlie Times, Sept. 12, 1906) it can have no other possible meaning than an invocation of one of the “mother” goddesses of Hinduism, in his opinion Kali “the goddess of death and destruction.” Sir Henry Cotter, on the other hand (ib. Sept. 13. 1906), sees in it merely an invocation of the “mother-land” Bengal, and quotes in support of this view the free translation of the poem by, the late W. H. Lee, a proof which, it may be at once said, is far from convincing. But though, as Dr. Grierson points out, the idea of a “mother-land” is wholly alien to Hindu ideas, it is quite possible that Bankim Chandra may have assimilated it with his European culture, and the true explanation is probably that given by Mr. J. D. Anderson in The Times of September 24, 1906. He points out that in the 11th ehapter of the 1st book of the Ananda Math the Sannyasi rebels are represented as having erected, in addition to the image of Kali, “the mother who Has Been,” a white marble statue of “the Mother that Shall Be,” which “is apparently a representation of the mother-land. The Bande Mataram hymn is apparently addressed to both idols.”

 The poem, then, is the work of a Hindu idealist who personified Bengal under the form of a purified and spiritualised Kali. Of its thirty-six lines, partly written in Sanskrit, partly in Bengali, the greater number are harmless enough. But if the poet sings the praise of the “Mother”

 “As Lachmi, bowered in the flower
That in the water grows.”

he also praises her as “Durga, bearing ten weapons,” and lines 10, 11 and 12 are capable of very dangerous meanings in the mouths of unscrupulous agitators. Literally translated these run, “She has seventy millions of throats to sing her praise, twice seventy millions of hands to fight for her, how then is Bengal powerless?” As S. M. Mitra points out (Indian Problems, London, 1908), this language is the more significant as the Bande Mataram in the novel was the hymn by singing which the Sannyasis gained strength when attacking the British foroes.

 During Bankim Chandra Chatterji's lifetime the Bande Mataram, though its dangerous tendency was reoognized, was not used as a party warcry; it was not raised, for instance, during the Ilbert Bill agitation, nor by the students who flocked round the oourt during the trial of Surendra Nath Banerji in 1883. It has, however, obtained an evil notoriety in the agitations that followed the partition of Bengal. That Bankim Chandra himself foresaw or desired any such use of it is impossible to believe. According to S. M. Mitra, he composed it “in a fit of patriotic excitement after a good hearty dinner, which he always enjoyed. It was set to Hindu music, known as the Mallar-Kawali-Tal. The extraordinarily stirring character of the air, and its ingenious assimilation of Bengali passages with Sanskrit, served to make it popular.”

 Circumstances have made the Bande Mataram the most famous and the most widespread in its effects of Bankim Chandra's literary works.

বিজ্ঞপ্তি

 ১২৪৫ বঙ্গাব্দের ১৩ই আষাঢ়, রবিবার, (১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দ, ২৭এ জুন) রাত্রি ১টায় কাঁটালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্য-পঞ্জীতে সেটি স্মরণীয় দিন— ঐ দিন আকাশে কিন্নর-গন্ধর্বেরা নিশ্চয়ই দুন্দুভিধ্বনি করিয়াছিল—দেববালারা অলক্ষ্যে পুষ্পবৃষ্টি করিয়াছিল—স্বর্গে মহোৎসব নিষ্পন্ন হইয়াছিল। এই বৎসরের ১৩ই আষাঢ় বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম-শতবার্ষিকী। এই শতবার্ষিকী সুসম্পন্ন করিবার জন্য বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ নানা উদ্‌যোগ-আয়োজন করিতেছেন—দেশের প্রত্যেক সাহিত্য-প্রতিষ্ঠানকে এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিকদিগকে উৎসবের অংশভাগী হইবার জন্য আমন্ত্রণ করা হইতেছে। সারা বাংলা দেশে বেশ সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। বঙ্গের বাহিরেও নানা স্থান হইতে সহযোগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাইতেছে।

 পরিষদের নানাবিধ আয়োজনের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য—বঙ্কিমচন্দ্রের যাবতীয় রচনার একটি প্রামাণিক ‘শতবার্ষিক সংস্করণ’-প্রকাশ। বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র রচনা—বাংলা ইংরেজী, গদ্য পদ্য, প্রকাশিত অপ্রকাশিত, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, চিঠিপত্রের একটি নির্ভুল ও Scholarly সংস্করণ প্রকাশের উদ্যম এই প্রথম—১৩০০ বঙ্গাব্দের ২৬এ চৈত্র তাঁহার লোকান্তরপ্রাপ্তির দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বৎসর পরে—করা হইতেছে; এবং বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ যে এই সুমহৎ কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, তজ্জন্য পরিষদের সভাপতি হিসাবে আমি গৌরব বোধ করিতেছি।

 পরিষদের এই উদ্যোগে বিশেষভাবে সহায়ক হুইয়াছেন, মেদিনীপুর ঝাড়গ্রামের ভূম্যধিকারী কুমার নরসিংহ মল্লদেব বাহাদুর। তাঁহার বরণীয় বদান্যতায় বঙ্কিমের রচনা প্রকাশ সহজসাধ্য হইয়াছে। তিনি সমগ্র বাঙালী জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হইলেন। এই প্রসঙ্গে মেদিনীপুরের জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট শ্রীযুক্ত বিনয়রঞ্জন সেন মহাশয়ের উদ্যমও উল্লেখযোগ্য।

 শতবার্ষিক সংস্করণের সম্পাদন-ভার ন্যস্ত হইয়াছে শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত দাসের উপর। বাংলা সাহিত্যের লুপ্ত কীর্তি পুনরুদ্ধারের কার্যে তাঁহারা ইতিমধ্যেই যশস্বী হইয়াছেন। বর্তমান সংস্করণ সম্পাদনেও তাঁহাদের প্রভুত নিষ্ঠা, অক্লান্ত অধ্যবসায় এবং প্রশংসনীয় সাহিত্য-বুদ্ধির পরিচয় মিলিবে। তাঁহারা বহু অসুবিধার মধ্যে এই বিরাট্ দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত বঙ্গীয়-সাহিত্যপরিষদের পক্ষ হইতে আমি উভয়কে ধন্যবাদ ও আশীর্বাদ জানাইতেছি।

 যাঁহারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সম্পাদকদ্বয়কে বঙ্কিমের সাহিত্য-সৃষ্টি ও জীবনীর উপকরণ দিয়া সাহায্য করিতেছেন, তাঁহাদের সকলের নামোল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। আমি এই সুযোগে সমবেতভাবে তাঁহাদিগকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি।

 গ্রন্থপ্রকাশ সম্বন্ধে সংক্ষেপে এই মাত্র বক্তব্য যে, বঙ্কিমের জীবিতকালে প্রকাশিত যাবতীয় গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণ হইতে পূর্ব পূর্ব সংস্করণের পাঠভেদ নির্দেশ করিয়া ও স্বতন্ত্র ভূমিকা দিয়া এই সংস্করণ প্রস্তুত হইতেছে। বঙ্কিমের যে সকল ইংরেজী-বাংলা রচনা আজিও গ্রেন্থাকারে সংকলিত হয় নাই, অথবা এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত আছে, এবং বঙ্কিমের চিঠিপত্রাদি—এই সংস্করণে সন্নিবিষ্ট হইতেছে। সর্বশেষ খণ্ডে মল্লিখিত সাধারণ ভূমিকা, শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার লিখিত ঐতিহাসিক উপন্যাসের ভূমিকা, শ্রীযুক্ত মোহিতলাল মজুমদার লিখিত বঙ্কিমের সাহিত্যপ্রতিভা বিষয়ক ভূমিকা, শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্কলিত বঙ্কিমের রচনাপঞ্জী ও রাজকার্যের ইতিহাস এবং শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত দাস সঙ্কলিত বঙ্কিমের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও বঙ্কিম সম্পর্কে গ্রন্থ ও প্রবন্ধের তালিকা থাকিবে। শ্রীযুক্ত কালিদাস নাগ এই খণ্ডে বিভিন্ন ভাষায় বঙ্কিমের গ্রন্থাদির অনুবাদ সম্বন্ধে বিবৃতি দিবেন।

 বিজ্ঞপ্তি এই পর্যন্ত। বঙ্কিমের স্মৃতি বাঙ্গালীর নিকট চিরোজ্জ্বল থাকুক।

১৩ই আষাঢ়, ১৩৪৫
কলিকাতা

শ্রীহীরেন্দ্রনাথ দত্ত
সভাপতি, বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ

ভূমিকা

 বঙ্কিমচন্দ্র নিজে লিখিয়া গিয়াছেন, “দুর্গেশনন্দিনী বা চন্দ্রশেখর বা সীতারামকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাইতে পারে না। পাঠক মহাশয় অনুগ্রহপূর্ব্বক আনন্দমঠ বা দেবী চৌধুরাণীকে ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ বিবেচনা না করিলে বড়ই বাধিত হইব। এই রাজসিংহ প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম।”

 এই কথাগুলিতে তাঁহার অভিপ্রায় কি? ঐতিহাসিক উপন্যাস বলিতে আমরা কি বুঝিব? তাহাতে কি কি উপাদান থাকা চাই? এ বিষয়ে পণ্ডিতেরা একমত হইতে পারেন নাই। অল্প দিন হইল, গত ২৫ ডিসেম্বরের বিলাতী ‘টাইম্‌স্‌’ পত্রিকায় পড়িলাম:—

 “It is not easy to define a historical novel. Professor Nield's definition, ‘A novel is rendered historical by the introduction of dates, personages or events to which identification can be given,’ seems too severe....Scribner's [of New York] have, justifiably, interpreted the subject more liberally by the inclusion of novels the background of which is laid in a recognizable historical period, even though no single character in the book may have a genuine historical prototype.”

 এই দ্বিতীয় কথাটি যদি আমরা স্বীকার করি, তবে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ হইতে ‘সীতারাম' পর্য্যন্ত ঐ শ্রেণীর উপন্যাস সাতখানিকে নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক উপন্যাস নাম দিতে হয়। তাহাদের কোনটায় কল্পিত চরিত্র বেশী, কোনটায় ইতিহাসে পরিচিত চরিত্র বেশী (যেমন ‘রাজসিংহে’), কিন্তু সবগুলিতেই সেই অতীত যুগের সমাজের, ঘর-বাড়ীর, মানবচিন্তার, আচার-ব্যবহারের অনেকাংশে সত্য চিত্র প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। কিন্তু এগুলিতে পদে পদে খাঁটি ঐতিহাসিক সত্য রক্ষা করা হয় নাই, কারণ এরূপ সত্যের চিত্রের উপর বঙ্কিম ইচ্ছা করিয়া এক 'অলোক আলোকের' রং ফলাইয়া দিয়াছেন, তাহার কথা পরে বলিব।

 বঙ্কিম নিজে এই শ্রেণীর সাহিত্যকে একটি বড়ই সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করিয়াছিলেন। বোধ হয়, (তাঁহার বিশ্বাস এইরূপ ছিল যে, ইতিহাসের সত্য ঘটনা মাত্র উপন্যাসের ভাষায় বিবৃত করিলে তবেই তাহা ঐতিহাসিক উপন্যাস নামের যোগ্য; অর্থাৎ তাহাতে অধিকাংশ পুরুষগুলি ইতিহাসে পরিচিত ব্যক্তি হইবে, এবং অতি কম সংখ্যায় কাল্পনিক চরিত্র থাকিবে; কথাবার্তাগুলি প্রায়শঃ তাঁহার নিজের রচিত, কিন্তু বর্ণিত ঘটনা এবং বিষয়-পরিকল্পনা (প্লট) একেবারে নিছক সত্য, ইতিহাস হইতে তোলা।

 তাঁহার এই সঙ্কীর্ণ সংজ্ঞায় ‘রাজসিংহ’ ভিন্ন ঐ অপর ছয়টি গ্রন্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস হইতে পারে না। তবে, তিনি এগুলি লিখিলেন কেন? তাঁহার গার্হস্থ্য উপন্যাসগুলিই তো তাঁহার অতুলনীয় প্রতিভা, প্লট গাঁথিবার, চরিত্র সৃষ্টির, কথোপকথন রচিবার শক্তি প্রমাণ করিয়াছিল। সেই শ্রেণীর আরও নভেল লিখিয়া গেলে তাঁহার যশের কিছুমাত্র হ্রাস হইত না। তাঁহার মস্তিষ্ক তো জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত অটুট তেজ দেখাইয়া গিয়াছিল।

 এই প্রশ্নের উত্তর তাঁহার নিকট হইতেই পাইয়াছি। বঙ্কিম মর্ম্মে মর্ম্মে, শরীরের সূক্ষ্মতম স্নায়ুতে পর্য্যন্ত, স্বদেশ-প্রেমী স্বজাতি-ভক্ত। 'বঙ্গদর্শনে’র সর্ব্বপ্রথম সংখ্যায় নবীন বঙ্কিম, ‘প্রচারে’র সর্ব্বপ্রথম সংখ্যায় প্রবীণ বঙ্কিম, সেই একই কথা বলিতেছেন:— “অহঙ্কার অনেক স্থলে মনুষ্যের উপকারী।... জাতীয় গর্ব্বের কারণ লৌকিক ইতিহাসের সৃষ্টি বা উন্নতি। ইতিহাস-বিহীন জাতির দুঃখ অসীম।... বাঙ্গালীর ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালী কখন মানুষ হইবে না। যাহার মনে থাকে যে, এ বংশ হইতে কখন মানুষের কাজ হয় নাই, তাহা হইতে কখন মানুষের কাজ হয় না।” “যে বলে যে,... বাঙ্গালী চিরকাল দুর্ব্বল, চিরকাল ভীরু, স্ত্রীস্বভাব,... তাহার কথা মিথ্যা।... বাঙ্গালী যে পূর্ব্বকালে বাহুবলশালী, তেজস্বী, বিজয়ী ছিল, তাহার অনেক ঐতিহাসিক প্রমাণ পাই। অধিক নয়, আমরা এক শত বৎসর পূর্ব্বের বাঙ্গালী পহলয়ানের, বাঙ্গালী লাঠি শড়কওয়ালার... বলবীর্য্যের কথা বিশ্বস্তসূত্রে শুনিয়াছি।”

 পরদেশের নানা উৎকৃষ্ট ইতিহাস পড়িয়া যেমন তাঁহার মনের বিকাশ ও উপরতা জম্মিল, তেমনি দুঃখ হইল যে, “হায়! ভারতের অতীত কাহিনী তো এমন সুন্দর এমন বিপুল করিয়া লেখা হয় নাই; বিশেষতঃ আমাদের নিজস্ব বঙ্গজননীর ইতিহাস নাই বলিলেই হয়, আর যাহা ইতিহাস বলিয়া চলিতেছে তাহা লজ্জা ও হীনতার কারণ মাত্র।” ‘আনন্দমঠে’র ভাব অন্তঃসলিলা গঙ্গার মত ‘আনন্দমঠে’র স্রষ্টাকে আদি যৌবন হইতেই অনুপ্রাণিত করিয়াছিল, যদিও এই ভাব তাঁহার লেখনীমুখে প্রকাশ পাইতে অনেক বৎসর বিলম্ব ঘটে। তাই, তিনি প্রথম হইতেই বাঙ্গলার ইতিহাস খুঁজিতে লাগিলেন, অনেক গ্রন্থ পড়িলেন, কিন্তু ইতিহাস গড়িতে পারিলেন না, কারণ সে সময়ে উহার উপাদানগুলি হাতে পাওয়া যাইত না, তাহার মধ্যে অনেকগুলির অস্তিত্ব, এমন কি নাম পর্য্যন্ত, তখন  ভিন্‌সেণ্ট স্মিথ (নিতান্ত নেটিভ-প্রেমী নহেন) লিখিতেছেন—“The revenue affairs were solely in charge of Md. Raza Khan, who did not worry sbout the sufferings of the people. He collected the revenue almost in full and added 10 per cent for 1771.”—(Oxford History, p. 508.)

 ভারতে মুসলমান-শাসনের সেই অবনতির যুগে রাজকর্ম্মচারীদের অসহ্য অত্যাচারের ফলে হিন্দু প্রজারা ক্ষেপিয়া বিদ্রোহী ও দলবদ্ধ হইয়া উঠিল, এটা ঐতিহাসিক সত্য। বিখ্যাত লেখক সৈয়দ ঘুলাম হুসেন তবাতবাই (সিয়র্-উল্-মুতাখ্‌খরীন-রচয়িতা) তাঁহার সেই সর্ব্বজন-আদৃত ইতিহাসে ইহার আর একটি দৃষ্টান্ত দিয়াছেন; তিনি লিখিয়াছেন— “আজ্‌ আহদ্-ই মুইন্-উল্‌-মুল্‌ক্‌” হইতে “বহম্ রসীদ্” পর্য্যন্ত (ঐ মূল ফারসী গ্রন্থ, ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে মুদ্রিত আদি সংস্করণ, ৩য় ভাগ, ৫০-৫১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য); অর্থাৎ “মুইন্-উল্‌-মুল্‌ক্‌ (পঞ্জাবের সুবাদার)এর সময় হইতে...এই সুবাগুলির আয়ে ব্যয় পোষাইত না। সে জন্য প্রজাদের উপর অত্যাচার চলিতে লাগিল। তাহারা দুর্ব্বল, কোন আশ্রয় বা পলাইবার স্থান পাইল না। শিখ সম্প্রদায় মধ্যে পরস্পরকে সাহায্য করা কর্ত্তব্য— এমন কি, ধর্ম্মের অংশ বলিয়া গণ্য হইত। সুতরাং যেখানেই অত্যাচার হইত, সেই বাড়ীর লোক মাথার চুল লম্বা রাখিয়া, ‘[শ্রী] অকাল, অকাল!’ এই রব করিয়া গুরুগোবিন্দের পন্থ গ্রহণ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিত, এবং অপর শিখগণ তাহাদের সমর্থন করিতে প্রবৃত্ত হইত।”

 ঠিক সেই কারণে, সেই শতাব্দীতে, বাঙ্গলায়ও জোট বাঁধিয়া “সন্তানেরা” বিদ্রোহী হয়, ইহা বঙ্কিম দেখাইয়াছেন।

 সত্য বটে, লোক তারিখ ও ঘটনার খুঁটিনাটি দেখিতে গেলে তাঁহার এই শ্রেণীর উপন্যাসে অনেক অভাব অনেক স্বকপোলকল্পনা ধরা পড়িবে, এমন কি বর্ত্তমান সময়ে চলিত স্কুলপাঠ্য ইতিহাস হইতেও এগুলি অনেক স্থলে ভুল বা ফাঁকা ফাঁকা বলিয়া মনে হইবে। কিন্তু ইহাতে আছে মানুষের জীবন্ত ছবি। বঙ্কিমের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় সেই অতীত ভারতের স্থলে স্থলে কল্পিত ব্যক্তিগণ নিজ প্রকৃত চরিত্র দেখাইয়া আমাদের নিকট অতি ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হইতেছেন; আমরা সেই সেই যুগের ভারতের গ্রাম-নগর, নর-নারী, অবিস্মরণীয় কোন কোন মহাপুরুষদের চাক্ষুষ সাক্ষাৎ পাইতেছি; তাঁহাদের এবং তাঁহাদের সময়কে নিজ পাড়াপ্রতিবাসীর, নিজ ঘরের লোকের মত চিনিতে পারিতেছি। তাঁহার এই উপন্যাস কয়টিতে ইতিহাস হইতে জানা পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং নিখুঁত সব সত্য নাই কেন? তাহার এক কারণ বঙ্কিমচন্দ্র সেই সেই যুগের ফোটোগ্রাফ দিতে আদৌ চান নাই; তিনি এগুলিকে গদ্য-কার্য্য আকারে সৃষ্টি করিবেন, লোকশিক্ষার যন্ত্র করিবেন বলিয়া কলম ধরিয়াছিলেন। কিছু কিছু বাস্তব সত্য ইতিহাস হইতে লইয়া, তাহাতে তাঁহার অদ্বিতীয় চরিত্রসৃষ্টির কল্পনা যোগ করিয়া, সবটার মধ্যে নিজ ঊর্দ্ধপ্রবাহিণী ভাবধারা[৪] ঢালিায়া দিয়া এই গ্রন্থগুলির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিলেন, এক অপূর্ব্ব সামগ্রী বাঙ্গলা সাহিত্যকে দান করিলেন।

 দ্বিতীয় কারণ এই যে, আমাদের দেশ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক মসলার অভাবে উপন্যাস লেখক—অনেক স্থলে পেশাদার ঐতিহাসিকও—কল্পনার সাহায্যে ফাঁক পুরাইতে বাধ্য হন। এ কথাটা অতি পরিষ্কার বুঝা যাইবে, যদি আমরা তাঁহার ‘আনন্দমঠে’র সহিত স্কটের ‘ওল্‌ড্‌ মর্টালিটি’র তুলনা করি। দুইটি গ্রন্থই বিদ্রোহী সন্ন্যাসী বা ধর্ম্মোন্মাদ যোদ্ধাদের রাজশক্তির সহিত সংঘর্ষের কাহিনী। কিন্তু স্কটের গ্রন্থে কভেনাণ্টারদের বাক্য ও কার্য্যগুলির প্রায় সমস্তই ইতিহাসে পাওয়া যায়, কারণ তাহাদের কথাবার্ত্তার রিপোর্ট এবং তাহাদের লিখিত পুস্তিকা ও অসংখ্য চিঠি বর্ত্তমান আছে; ইতিহাস-লেখক বিদ্রোহীদের ঘরের কথা তাহাদের মুখ হইতেই শুনিতে পাইতেছেন; তাহার উপর প্রতিপক্ষের অর্থাৎ গবর্ণমেণ্টের কাগজপত্র কাহিনী তো আছেই। কিন্তু বিদ্রোহী সন্তানগণ নিরক্ষর; তাহারা বা তাহাদের দলের ভিতরে প্রবেশ করিয়া অন্য কেহ সে সময়ে কোন বিবরণ লিখিয়া যায় নাই; তাই আজ আমাদের একমাত্র পুঁজি হেষ্টিংস লাটের কয়খানা চিঠি এবং রেকর্ড অফিসে রক্ষিত নিম্ন ইংরেজ কর্ম্মচারীর কয়খানা রিপোর্ট, সুতরাং এখানে একতরফা অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যানের উপর নির্ভর করিয়া ঐ যুগের ঘটনার বিবরণ ও মানবচরিত সৃষ্টি করা ভিন্ন আমাদের আর উপায় নাই।

 কিন্তু এটা সত্যসত্যই ক্ষতির কারণ নহে। বঙ্কিমের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিতে এমন পদার্থ আছে যাহা “পাথুরে, বিজ্ঞানসম্মত” ইতিহাসে কখন পাওয়া যায় না। সেটি সেই যুগের প্রাণ। ইহার একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি। লীটন যখন তাঁহার “লাষ্ট্‌ ডেজ্‌ অব পম্পি” লেখেন, তাহার পূর্ব্বে অনেক দিন ধরিয়া পম্পি-নগরী ধ্বংস হইবার সময় যে সব গ্রীক ও রোমান লোক তথায় বাস করিত তাহাদের ঘরকন্না, হাটবাজার নাট্যশালা, কাছারি, দৈনিক জীবন ও চিন্তা, মন্দির ও গৃহ নির্ম্মাণ প্রভৃতি বিষয়ে পণ্ডিতদের লেখা অনেক অনেক পুস্তক পড়িয়া এগুলির বিস্তৃত অতি নিখুঁৎ চিত্র আঁকিয়াছিলেন, যেন সেই যুগে সেই শহরের কতকগুলি ফোটোগ্রাফ দিয়াছেন। লীটনের নভেলখানিতে বাহ্য পরিচ্ছদ ঠিক আছে, অবিকল সত্য; কিন্তু উহার মধ্যে প্রাণ কই? উহার মধ্যকার মানবচরিত্রগুলি চিরস্মরণীয় হইয়া থাকে নাই কেন? সমালোচক মেকলে ঠিক বলিয়াছেন যে, এডিসনের মত পণ্ডিত ক্লাসিকালু স্কলারের রচিত কেটো নাটকের মহাসম্ভ্রান্ত রোমান্ সিনেটর অপেক্ষা স্কটের উপন্যাসে বর্ণিত বর্ব্বর দরিদ্র ডাকাত মস্টরুপার্ অনেক বড় কারণ অধিকতর জীবন্ত, অধিকতর বাস্তব। এই পরীক্ষায় বঙ্কিমের ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি অপরাজিত, সাহিত্য সর্ব্বপ্রথম পদ অধিকার করিয়াছে।

 বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র প্রথা লীটনের পন্থার বিপরীত। প্রথমেই তো গোড়ায় গলদ; তাহার ‘সন্তানেরা’ বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ কায়স্থের ছেলে, গীতা যোগশাস্ত্র প্রভৃতিতে পণ্ডিত; কিন্তু যে সব “সন্ন্যাসী ফকিরেরা” সত্য ইতিহাসের লোক, এবং উত্তরবঙ্গে (বীরভূম নহে) ঐ সব অত্যাচার করে তাহারা এলাহাবাদ কাশী ভোজপুর প্রভৃতি জেলার পশ্চিমে লোক এবং প্রায় সকলেই নিরক্ষর, ভগবদ্গীতার নাম পর্য্যন্ত জানিত না। বঙ্কিমের সন্তানসেনা বৈষ্ণব, আর আসল “সন্ন্যাসী”রা ছিল শৈব, আজ পর্যন্ত তাহাদের নাগা-সম্প্রদায় চলিয়া আসিতেছে, যদিও ইংরেজের ভয়ে তাহারা এখন অস্ত্র রাখিতে বা লুঠ করিতে পারে না। এই সব সন্ন্যাসী গোঁসাই যোদ্ধাদের প্রকৃত ইতিহাস “রাজেন্দ্রগিরি গোঁসাই” (মৃত্যু দিল্লীর বাহিরে যুদ্ধে, ১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দে) এবং তাহার চেলা “হিম্মৎ বাহাদুর” সম্বন্ধে রচিত ফারসী গ্রন্থ এবং হিন্দী “হিম্মৎ বাহাদুর বিরুদাবলী” প্রভৃতিতে পাওয়া যায়। বাঙ্গলার বিপ্লবকারী সন্ন্যাসীদের অতি মূল্যবান সত্য বিবরণ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার Dawn of New India (1927)তে এবং রায় সাহেব যামিনীমোহন ঘোষ তাঁহার Sannyasi Fakir Raiders of Bengal গ্রন্থে (Bengal Secretariat Book Depot, 1930) দিয়াছেন। পাঠক উৎসুক হইলে এ দুইখানি ইতিহাস পড়িবেন।

 সত্যকার সন্ন্যাসী ফকিরেরা অর্থাৎ পশ্চিমে গিরিপুরীর দল, একেবারে লুঠেড়া ছিল, কেহ কেহ অযোধ্যা সুবায় জমিদারিও করিত; মাতৃভূমির উদ্ধার, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন উহাদের স্বপ্নেরও অতীত ছিল, এই মহাব্রত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের কল্পনায় সৃষ্ট কুয়াশা মাত্র। সুতরাং ইতিহাসের দিক্ দিয়া দেখিতে গেলে ‘আনন্দমঠে’ বর্ণিত নরনারী এবং তাহাদের কার্য্য ও কথা (ইংরেজ সৈন্যের সহিত দুইটা খণ্ডযুদ্ধ বাদে) অনেকাংশে অসত্য এবং এ বইখানি কোন মতেই ঐতিহাসিক এই বিশেষণ পাইতে পারে না।

 সে কথা মানিলাম। কিন্তু ‘আনন্দমঠ,’ ‘দেবী চৌধুরাণী’ ও ‘সীতারামে’র মধ্যে যে অমৃতরস আছে তাহা এ তিনখানি গ্রন্থ অপেক্ষা শতগুণ বেশী “সত্য” ঐতিহাসিক কোন উপন্যাসে পাওয়া যায় না। সেই রস বঙ্কিমচন্দ্রের হৃদয়ের ঊর্দ্ধপ্রবাহিণী ভাবধারা-রূপ উৎস হইতে অবিরাম ঝরিতেছে। এই গ্রন্থগুলিতে তিনি দৃষ্টান্ত দিয়া দেখাইয়াছেন যে, আত্মসংযম ও ধর্ম্ম-অনুশীলনের ফলে মানব-চিত্ত ক্রমেই উচ্চ হইতে উচ্চতর নৈতিক সোপানে উঠিতে থাকে, অবশেষে এই সব কর্ম্মযোগীরা আর পার্থিব রক্তমাংসের নরনারী থাকে না, নরদেহে দেবতা বা বোধিসত্ত্বে পরিণত হইয়া যায়। এই যোগসাধনা বড় কঠিন, এই ক্রমোন্নতির পথ যেন ফুরায় না; যেমন ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ রামানন্দ ভক্তির ভাবগুলি ব্যাখ্যা করিতেছেন, কিন্তু মহাপ্রভু সন্তুষ্ট হইতে পারিতেছেন না, তিনি ক্রমাগত দাবি করিতেছেন “আরও কহ” অর্থাৎ আরও উঁচুতে উঠ, আরও গভীরতর হৃদয় স্তরে পৌঁছাও। বঙ্কিমের বর্ণিত আদর্শ ঠিক সেই মত কঠোর সাধনার ফল, ইহাতে সিদ্ধি অতি কম কয় জন পাইয়াছেন; ভবানন্দ জীবানন্দের মত লোক পর্যন্ত ব্রতভঙ্গ করিলেন। দেবী চৌধুরাণী “দশ বৎসর ধরিয়া বাঁধ বাঁধিয়াছিল,” কিন্তু তাহাকেও নিশি ঠাকুরাণী বলিতে বাধ্য হইলেন, “এই কি তোমার নিষ্কাম ধর্ম্ম? এই কি সন্ন্যাস? তুমি সন্ন্যাস ত্যাগ করিয়া ঘরে যাও।”

 এই নিষ্কাম ধর্ম্মের অনুশীলনের যে জীবন্ত দৃষ্টান্তগুলি বঙ্কিম অতুলনীয় তুলি দিয়া আঁকিয়াছেন, তাহা পড়িতে পড়িতে আমাদের মন এক অনির্ব্বচনীয় স্ফূর্ত্তিতে সতেজ হইয়া উঠে; আমরাও যেন ইহাদের সঙ্গে সঙ্গে উঁচু হইতেছি; নিজ জীবনে কৃচ্ছ্র সাধনা করিবার, নৈতিক উন্নতির চরমে উঠিবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মনেও জাগিয়া উঠে; আবার পরক্ষণেই হতাশা ও অবসাদ আসিয়া আমাদিগকে মর্ত্ত্যে নামাইয়া দেয়। আগুনে পোড়াইয়া হাতুড়ি পিটিয়া লোহাকে যেমন ইস্পাত করা হয়, তেমনই বড় দৈন্য, বড় দুঃখ, বড় কঠোর সংযমের ভিতর দিয়া শান্তি ও জীবানন্দ, দেবী ও শ্রী গড়িয়া উঠিয়াছিল। এই মহান্ আদর্শ আকাশের রামধনুর মত চিরদিন দূর হইতে মানবকে আহ্বান করিতে থাকিবে—বিশ্বমানবকে, আমাদের জাতিকে, মৃতসঞ্জীবনী সুধা দিতে থাকিবে। এই গ্রন্থগুলি পড়িতে পড়িতে মনে হয় যেন এই মর্ত্ত্যলোকের অতীত এক নূতন জগতের প্রবেশদ্বার হঠাৎ খুলিয়া গেল, তাহার ভিতর দিয়া ‘অলোক আলোকে’ উদ্ভাসিত এক কল্পনার মায়াপুরী অল্প অল্প দেখা দিতেছে। ইহাই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কাব্যের চিহ্ন; ইহার জন্যই ‘আনন্দমঠ,’ ‘দেবী চৌধুরাণী,’ ‘সীতারামে’র অমরত্ব।

 একখানা প্রাচীন প্রস্তরে এই বৌদ্ধ মন্ত্রটি খোদা আছে (সহজ সংস্কৃত আকারে দিলাম):—

ত্রিণি অমৃত-পদানি সু-অনুষ্ঠিতানি
নিয়ন্তি স্বর্গম্—দম ত্যাগ অপ্রমাদঃ।

“তিনটি অমৃত-পদ মানুষকে স্বর্গে পৌছাইয়া দেয়; সে তিনটি—আত্মসংযম, স্বার্থত্যাগ, এবং স্থির সত্য বুদ্ধি।” ইহাতে গীতার শিক্ষা এক কথায় ব্যক্ত হইয়াছে; ইহাই বঙ্কিমের ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতিপাদ্য বিষয়; এই জন্যই সেগুলি পাঠকচিত্ত উদ্বেলিত করিয়া দেয়, সুখ দেয় না।

 আর এক শ্রেণীর উপন্যাস আছে, অতি প্রতিভাশালী কথাশিল্পীর রচনা; তাহাতে জ্বলন্ত বর্ণে প্রবৃত্তিমার্গ চিত্রিত হইয়াছে; তাহার নায়িকা শ্রীমতী গাভী (মাদাম্ বোভারি), যেদিকে বাসনা সেই দিকে গা ঢালিয়া দিয়া যান এমন সহজে এমন সুন্দররূপে যে পাঠক-পাঠিকা তাহাতে অজ্ঞাতসারে প্রলুব্ধ হয়। বিশ্ব-সাহিত্যে এগুলি হয়তো চিরদিন পড়িবার লোক পাইবে, কিন্তু ইহারা পাঠককে স্বর্গে লইয়া যাইতে পারিবে না, এগুলি

নিয়স্তি স্বপ্নম্—

অর্থাৎ পড়িয়া আরামে ঘুম পায়, একেবারে মনে ভাবনা-চিন্তার উদ্রেক হয় না, ইহারা বিবেককে নাড়া দেয় না। বঙ্কিম সে পথে যান নাই।

 আজ ৪৪ বৎসর হইল বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের গগন হইতে অপসৃত। কিন্তু তাঁহার মহাকাব্য ‘আনন্দমঠে’র নিভৃত রস যে পান করিয়াছে, সেই যেন দিব্যচক্ষে দেখিতেছে যে, আমাদের জাতীয়তায় দীক্ষার ঋষি জ্যোতিমণ্ডিত দেহে হিমাচলের শিখরে দাঁড়াইয়া সমগ্র ভারতবাসীকে ডাকিতেছেন—

স্বার্থ হ’তে জাগ, দৈন্য হ’তে জাগ,
সব জড়তা হ’তে জাগ, জাগ রে,
সতেজ উন্নত শোভাতে।

 মুক্তি কোন্ পথে, এ প্রশ্নের উত্তর ইহাই।

  1. অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত। 'বঙ্কিমচন্দ্র' পৃ. ২৭৩।
  2. 'প্রদীপ’—আষাঢ়, ১৩০৫, পৃ. ২১৮-১৯।
  3. বঙ্গদর্শন-ভাদ্র, ১৩১৯
  4. আইডিয়ালিজম্ কথাটাকে যদি ‘আদর্শবাদ’ বলি, তবে এ অনুবাদে ইংরাজীর গন্ধ থাকিয়া যাইবে তাই উপরের কথাটি ব্যবহার করিব। তেমনি “শিক্ষার বাহন” (vehicle) এই অদ্ভুত শব্দটা শুনা মা শ্রীশ্রীশীতলা দেবীর বাহনকেই প্রথমে মনে পড়ে।

আনন্দমঠ
[ ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে মুদ্রিত পঞ্চম সংস্করণ হইতে ]



উৎসর্গ পত্র।

* * *

ক্ব নু মাং ত্বদধীনজীবিতং
বিনিকীর্য্য ক্ষণভিন্নসৌহৃদঃ।
নলিনীং ক্ষতসেতুবন্ধনো
জলসংঘাত ইবাসি বিদ্রুতঃ॥

* * *

 স্বর্গে মর্ত্ত্যে সম্বন্ধ আছে। সেই সম্বন্ধ রাখিবার নিমিত্ত এই গ্রন্থের এইরূপ উৎসর্গ হইল।


যে তু সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি ময়ি সংনস্যে মৎপরাঃ
অনন্যেনৈব যোগেন মাং ধ্যায়ন্ত উপাসতে।
তেষামহং সমুদ্ধর্ত্তা মৃত্যুসংসারসাগরাৎ
ভবামি ন চিরাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাং।
ময্যেব মন আধৎস্ব ময়ি বুদ্ধিং নিবেশয়
নিবসিষ্যসি ময্যেব অত ঊর্দ্ধং ন সংশয়ঃ।
অথ চিত্তং সমাধাতুং ন শক্নোষি ময়ি স্থিরং
অভ্যাসযোগেন ততো মামিচ্ছাপ্তুং ধনঞ্জয়।

শ্রীমদ্ভগ্‌বদ্গীতা। ১২। অধ্যায়।

প্রথম বারের বিজ্ঞাপন

বাঙ্গালীর স্ত্রী অনেক অবস্থাতেই বাঙ্গালীর প্রধান সহায়। অনেক সময় নয়।
সমাজবিপ্লব অনেক সময় আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী।
ইংরেজরা বাঙ্গালা দেশ অরাজকতা হইতে উদ্ধার করিয়াছেন।
এই সকল কথা এই গ্রন্থে বুঝান গেল।

দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন

 প্রথম বারের বিজ্ঞাপনে যাহা লিখিয়াছিলাম, তাহার টীকাস্বরূপ কোন বিজ্ঞ সমালোচকের কথা অপর পৃষ্ঠে উদ্ধৃত করিলাম।


 The leading idea of the plot is this—should the national mind feel justified in harbouring violent thoughts against the British Government? or to present the question in another form, is the establishment of English supremacy providential in any sense? or to put it in a still more final and conclusive form, with what purpose and with what immediate end in view did providence send the British to this conntry? The immediate object is thus briefly described in the preface — To put an end to Moslem tyranny and anarchy in Bengal; and the mission is thus strikingly pictured in the last chapter: — “The Physician said, Satyanand, be not crest fallen. Whatever is, is for the best. It is so written that the English should first rule over the country before there could be a revival of the Aryan faith. Harken unto the counsels of Providence. The faith of the Aryas consisteth not in the worship of three hundred and thirty millions of gods and goddesses; as a matter of faot that is a popular degradation of religion — that whioh has brought about the death of the true Arya faith, the so-called Hinduism of the Mlechhas. True Hinduism is grounded on knowledge, and not on works. Knowledge is of two kinds — external and internal. The internal knowledge constitutes the chief part of Hinduism. But internal knowledge oannot grow unless there is a development of the external knowledge. The spiritual cannot be known unless you know the material. External knowledge has for a long time disappeared from the country, and with it has vanished the Arya faith. To bring about a revival, we should first of all disseminate physical or external knowledge. Now there is none to teach that; we ourselves oannot teach it. We must needs get it from other countries. The English are profound masters of physical knowledge, and they are apt teachers too. Let us then make them kings. English education will give our men a knowledge of physical science, and this will enable them to grapple with the problems of their inner nature. Thus the chief obstacles to the dissemination of Arya faith will be removed, and true religion will sparkle into life spontaneously and of its own accord. The British Government shall remain indestructible so long as the Hindus do not once more become great in knowledge, virtue and power. Hence, O Wise man, refrain from fighting and follow me.” This passage embodies the most recent and the most enlightened views of the educated Hindus, and happening as it does in a novel powerfully conceived and wisely executed, it will influence the whole race for good. The author's dictum we heartily accept as it is one which already forms the creed of English education. We may state it in this form: India is bound to accept the scientific method of the west and apply it to the elucidation of all truth. This idea beautifully expressed, forms a silver thread as it were, and runs through the tissue of the whole work.

The Liberal,
8th April, 1882.

তৃতীয় বারের বিজ্ঞাপন

 এবার পরিশিষ্টে বাঙ্গালার সন্ন্যাসী বিদ্রোহের যথার্থ ইতিহাস ইংরেজি গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত করিয়া দেওয়া গেল। পাঠক দেখিবেন, ব্যাপার বড় গুরুতর হইয়াছিল।

 আরও দেখিবেন যে, দুইটি ঘটনা সম্বন্ধে উপন্যাসে ও ইতিহাসে বিশেষ অনৈক্য আছে। যে যুদ্ধগুলি উপন্যাসে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা বীরভূম প্রদেশে ঘটে নাই, উত্তর বাঙ্গালায় হইয়াছিল। আর Captain Edwardes নামের পরিবর্তে Major Wood নাম উপন্যাসে ব্যবহৃত হইয়াছিল। এ অনৈক্য আমি মারাত্মক বিবেচনা করি না কেন না, উপন্যাস উপন্যাস, ইতিহাস নহে।

পঞ্চম বারের বিজ্ঞাপন

তৃতীয় বারের বিজ্ঞাপনে যে অনৈক্যের কথা লেখা গিয়াছে, তাহা রাখিবার প্রয়োজন নাই, ইহাই বিবেচনা করিয়া, এই সংস্করণে আবশ্যকীয় পরিবর্ত্তন করা গেল। অন্যান্য বিষয়েও কিছু কিছু পরিবর্ত্তন করা গিয়াছে। শান্তিকে অপেক্ষাকৃত শান্ত করা গিয়াছে। এবং তৎসম্বন্ধে যে কথাটা অনুভবে বুঝিবার ভার পাঠকের উপর ছিল, তাহা এবার একটা নূতন পরিচ্ছেদে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া দেওয়া গেল। মুদ্রাক্ষণ কার্য্যও পূর্ব্বাপেক্ষা সুসম্পাদিত করা গেল।

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।