আনন্দমঠ (১৯৩৮)/দ্বিতীয় খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সায়াহ্নকৃত্য সমাপনান্তে মহেন্দ্রকে ডাকিয়া সত্যানন্দ আদেশ করিলেন,
“তোমার কন্যা জীবিত আছে।”
মহে। কোথায় মহারাজ?
সত্য। তুমি আমাকে মহারাজ বলিতেছ কেন?
মহে। সকলেই বলে, তাই। মঠের অধিকারীদিগকে রাজা সম্বোধন করিতে হয়। আমার কন্যা কোথায় মহারাজ?
সত্য। তা শুনিবার আগে, একটা কথার স্বরূপ উত্তর দাও। তুমি সন্তানধর্ম্ম গ্রহণ করিবে?
মহে। তাহা নিশ্চিত মনে মনে স্থির করিয়াছি।
সত্য। তবে কন্যা কোথায় শুনিতে চাহিও না।
মহে। কেন মহারাজ? সত্য। যে এ ব্রত গ্রহণ করে, তাহার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, স্বজনবর্গ, কাহারও সঙ্গে সম্বন্ধ রাখিতে নাই। স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মুখ দেখিলেও প্রায়শ্চিত্ত আছে। যত দিন না সন্তানের মানস সিদ্ধ হয়, তত দিন তুমি কন্যার মুখ দেখিতে পাইবে না। অতএব যদি সন্তানধর্ম্ম গ্রহণ স্থির হইয়া থাকে, তবে কন্যার সন্ধান জানিয়া কি করিবে? দেখিতে ত পাইবে না।
মহে। এ কঠিন নিয়ম কেন প্রভু?
সত্য। সন্তানের কাজ অতি কঠিন কাজ। যে সর্ব্বত্যাগী, সে ভিন্ন অপর কেহ - এ কাজের উপযুক্ত নহে। মায়ারজুতে যাহার চিত্ত বদ্ধ থাকে, লকে বাধা ঘুড়ির মত সে কখন মাটি-ছাড়িয়া স্বর্গে উঠিতে পারে না। o
মহে। মহারাজ, কথা ভাল বুঝিতে পারিলাম না। যে স্ত্রীপুত্রের মুখ দর্শন করে, সে কি কোন গুরুতর কার্য্যের অধিকারী নহে?
সত্য। পুত্র কলত্রের মুখ দেখিলেই আমরা দেবতার কাজ ভুলিয়া যাই। সন্তানধর্ম্মের নিয়ম এই যে, যে দিন প্রয়োজন হইবে, সেই দিন সন্তানকে প্রাণত্যাগ করিতে হইবে। তোমার কন্যার মুখ মনে পড়িলে তুমি কি তাহাকে রাখিয়া মরিতে পরিবে? '
মহে। তাহা না দেখিলেই কি কন্যাকে ভুলিব?
সত্য। না ভুলিতে পার, এ ব্রত গ্রহণ করিও না।
মহে। সন্তানমাত্রেই কি এইরূপ পুত্র কলত্রকে বিস্মৃত হইয়া ব্রত গ্রহণ করিয়াছে? তাহা হইলে সন্তানের সংখ্যায় অতি অল্প!
সত্য। সন্তান দ্বিবিধ, দীক্ষিত আর অদীক্ষিত। যাহারা অদীক্ষিত, তাহার। সংসারী বা ভিখারী। তাহারা কেবল যুদ্ধের সময় আসিয়া উপস্থিত হয়, লুঠের ভাগ বা অন্য পুরস্কার “পুইয়া চলিয়া যায়। যাহার দীক্ষিত, তাহারা সর্ব্বত্যাগী। তাহারাই সম্প্রদায়ের কর্ম। তোমাকে অদীক্ষিত সন্তান হইতে অনুরোধ করি না, যুদ্ধের জন্য লাঠি সড়কিওয়ালা অনেক আছে। দীক্ষিত না হইলে তুমি সম্প্রদায়ের কোন গুরুতর কার্য্যে অধিকারী হইবে না।
মহে। দীক্ষা কি? দীক্ষিত হইতে হইবে কেন? আমি ত ইতিপূৰ্বেই মন্ত্র গ্রহণ করিয়াছি।
সত্য। সে মন্ত্র ত্যাগ করিতে হইবে। আমার নিকট পুনর্ব্বার মন্ত্র লইতে হইবে।
মহে। মন্ত্র ত্যাগ করিব কি প্রকারে?
সত্য। আমি সে পদ্ধতি বলিয়া দিতেছি।
মহে। নূতন মন্ত্র সইতে হইবে কেন?
সত্য। সন্তানেরা বৈষ্ণব।
মহে। ইহা বুঝিতে পারি না। সন্তানেরা বৈষ্ণব কেন? বৈষ্ণবের অহিংসাই পরম-ধর্ম্ম।
সত্য। সে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব। নাস্তিক বৌদ্ধধর্মের অনুকরণে যে অপ্রকৃত বৈষ্ণবতা উৎপন্ন হইয়াছিল, এ তাহারই লক্ষণ। প্রকৃত বৈষ্ণবধর্মের লক্ষণ দুষ্টের দমন, ধরিত্রীর উদ্ধার। কেন না, বিষ্ণুই সংসারের পালনকর্তা। দশবার শরীর ধারণ করিয়া পৃথিবী উদ্ধার করিয়াছেন। কেশী, হিরণ্যকশিপু, মধুকৈটভ, মুর, নরক প্রভৃতি দৈত্যগণকে, রাবণাদি রাক্ষসগণকে, কংস, শিশুপাল প্রভৃতি রাজগণকে তিনিই যুদ্ধে ধ্বংস করিয়াছিলেন। তিনিই জেতা, জয়দাতা, পৃথিবীর উদ্ধারকর্তা, আর সন্তানের ইষ্টদেবতা। চৈতন্যদেবের বৈষ্ণবধর্ম প্রকৃত বৈষ্ণবধর্ম নহে-উহা অর্ধেক ধর্ম্ম মাত্র। চৈতন্যদেবের বিষ্ণু প্রেমময়— কিন্তু ভগবান্ কেবল প্রেমময় নহেন—তিনি অনন্তশক্তিময়। চৈতন্যদেবের বিষ্ণু শুধু প্রেমময়-সন্তানের বিষ্ণু শুধু শক্তিময়। আমরা উভয়েই বৈষ্ণব-কিন্তু উভয়েই অর্ধেক বৈষ্ণব। কথাটা বুঝিলে?
মহে। না। এ যে কেমন নূতন নূতন কথা শুনিতেছি। কাশিমবাজারে একটা পাদরির সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছিল—সে ঐ রকম কথাসকল বলিল—অর্থাৎ ঈশ্বর প্রেমময়-তোমরা যীশুকে প্রেম কর—এ যে সেই রকম কথা।
সত্য। যে রকম কথা আমাদিগের চতুর্দশ পুরুষ বুঝিয়া আসিতেছেন, সেই রকম কথায় আমি তোমায় বুঝাইতেছি। ঈশ্বর ত্রিগুণাত্মক, তাহা শুনিয়াছ?
মহে। হাঁ। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—এই তিন গুণ।
সত্য। ভাল। এই তিনটি গুণের পৃথক পৃথক্ উপাসনা। সত্ত্বগুণ হইতে র্তাহার দয়াদীক্ষিণাদির উৎপত্তি, র্তাহার উপাসনা ভক্তির দ্বারা করিবে। চৈতন্ত্যের সম্প্রদায় তাহা করে। আর রজোগুণ হইতে র্তাহার শক্তির উৎপত্তি; ইহার উপাসনা যুদ্ধের দ্বারা —দেবদ্বেষীদিগের নিধন দ্বারা—আমরা তাহা করি। আর তমোগুণ হইতে ভগবান্ শরীরী—চতুভূজাদি রূপ ইচ্ছাক্রমে ধারণ করিয়াছেন। শ্রকৃ চন্দনাদি উপহারের দ্বারা সে গুণের পুজা করিতে হয়—সর্ব্বসাধারণে তাহ করে। এখন বুঝিলে?
মহে। বুঝিলাম। সন্তানের তবে উপাসকসম্প্রদায় মাত্র?
সত্য। তাই। আমরা রাজ্য চাহি না—কেবল মুসলমানের ভগবানের বিদ্বেষী বলিয়া তাহাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই।