আনন্দমঠ (১৯৩৮)/প্রথম খণ্ড/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যা না হইতেই সন্তানসম্প্রদায় সকলেই জানিতে পারিয়াছিল যে, সত্যানন্দ ব্রহ্মচারী আর মহেন্দ্র, দুই জনে বন্দী হইয়া নগরের কারাগারে আবদ্ধ আছে। তখন একে একে, দুয়ে দুয়ে, দশে দশে, শতে শতে, সন্তানসম্প্রদায় আসিয়া সেই দেবালয়বেষ্টনকারী অরণ্য পরিপূর্ণ করিতে লাগিল। সকলেই সশস্ত্র। নয়নে রোষাগ্নি, মুখে দম্ভ, অধরে প্রতিজ্ঞা। প্রথমে শত, পরে সহস্র, পরে দ্বিসহস্র। এইরূপে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তখন মঠের দ্বারে দাঁড়াইয়া তরবারিহস্তে জ্ঞানানন্দ উচ্চৈঃস্বরে বলিত লাগিলেন, “আমরা অনেক দিন হইতে মনে করিয়াছি যে, এই বাবুইয়ের বাসা ভাঙ্গিয়া, এই যবনপুরী ছারখার করিয়া, নদীর জলে ফেলিয়া দিব। এই শুয়রের খোয়াড় আগুনে পোড়াইয়া মাতা বসুমতীকে আবার পবিত্র করিব। ভাই, আজ সেই দিন আসিয়াছে। আমাদের গুরুর গুরু, পরম গুরু, যিনি অনন্তজ্ঞানময়, সর্ব্বদা শুদ্ধাচার, যিনি লোকহিতৈষী, যিনি দেশহিতৈষী, যিনি সনাতন ধর্মের পুনঃ প্রচার জন্য শরীরপাতন প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন —যাহাকে বিষ্ণুর অবতারস্বরূপ মনে করি, যিনি আমাদের মুক্তির উপায়, তিনি আজ মুসলমানের কারাগারে বন্দী। আমাদের তরবারে কি ধার নাই?” হস্ত প্রসারণ করিয়া জ্ঞানানন্দ বলিলেন, “এ বাহুতে কি বল নাই?”বক্ষে করাঘাত করিয়া বলিলেন, “এ হৃদয়ে কি সাহস নাই?—ভাই, ডাক, হরে মুরারে মধুকৈটভারে—যিনি মধুকৈটভ বিনাশ করিয়াছেন—যিনি হিরণ্যকশিপু, কংস, দন্তবক, শিশুপাল প্রভৃতি দুর্জয় অসুরগণের নিধন সাধন করিয়াছেন—যাহার চক্রের ঘর্ঘরনির্ঘোষে মৃত্যুঞ্জয় শ্যুও ভীত হইয়াছিলেন- যিনি অজেয়, রণে জয়দাতা, আমরা তার উপাসক, তাঁর বলে আমাদের বাহুতে অনন্ত বল—তিনি ইচ্ছাময়, ইচ্ছা করিলেই আমাদের রণজয় হইবে। চল, আমরা সেই যবনপুরী ভাঙ্গিয়া ধূলিগুড়ি করি। সেই শূকরনিবাস অগ্নিসংস্কৃত করিয়া নদীর জলে ফেলিয়া দিই। সেই বাবুইয়ের বাসা ভাঙ্গিয়া খড় কুটা বাতাসে উড়াইয়া দিই। বল—হরে মুরারে মধুকৈটভারে।”
তখন সেই কানন হইতে অতি ভীষণ নাদে সহস্র সহস্র কণ্ঠে একেবারে শব্দ হইল, “হরে মুরারে মধুকৈটভারে।” সহস্র অসি একেবারে ঝনৎকার শব্দ করিল। সহস্র বল্লম ফলক সহিত উদ্ধে উখিত হইল। সহস্র বাহুর আস্ফোটে বজ্রনিনাদ হইতে লাগিল। সহস্র ঢাল যোদ্ধ বর্গের কর্কশ পৃষ্ঠে তড়বড় শব্দ করিতে লাগিল। মহাকোলাহলে পশুসকল ভীত হইয়া কানন হইতে পলাইল। পক্ষিসকল ভয়ে উচ্চ রব করিয়া গগনে উঠিয়া গগন আচ্ছন্ন করিল। সেই সময়ে শত শত জয়টা একেবারে নিনাদিত হইল। তখন “হরে মুরারে মধুকৈটভারে” বলিয়া কানন হইতে শ্রেণীবদ্ধ সন্তানের দল নির্গত হইতে লাগিল। ধীর, গম্ভীর পদবিক্ষেপে মুখে উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম করিতে করিতে তাহারা সেই অন্ধকার রাত্রে নগরাভিমুখে চলিল। বস্ত্রের মর্মর শব্দ, অস্ত্রের ঝনঝন শব্দ, কণ্ঠের অস্ফুট নিনাদ, মধ্যে মধ্যে তুমুল রবে হরিবোল। ধীরে, গম্ভীরে, সবোষে, সতেজে, সেই সন্তানবাহিনী নগরে আসিয়া নগর বিস্ত করিয়া ফেলিল। অকস্মাৎ এই বজ্রাঘাত দেখিয়া নাগরিকেরা কে কোথায় পলাইল, তাহার ঠিকানা নাই। নগররক্ষীরা হতবুদ্ধি হইয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল।
এদিকে সন্তানের প্রথমেই রাজকারাগারে গিয়া, কারাগার ভাঙ্গিয়া রক্ষিবর্গকে মারিয়া ফেলিল। এবং সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে মুক্ত করিয়া মস্তকে তুলিয়া নৃত্য আরম্ভ করিল। তখন অতিশয় হরিবোলের গেলযোগ পড়িয়া গেল। সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে মুক্ত করিয়াই, তাহারা যেখানে মুসলমানের গৃহ দেখিল, আগুন ধরাইয়া দিল। তখন সত্যানন্দ বলিলেন, “ফিরিয়া চল, অনর্থক অনিষ্ট সাধনে প্রয়োজন নাই।” সন্তানদিগের এই সকল দৌরাত্ম্যের সম্বাদ পাইয়া, দেশের কর্তৃপক্ষগণ তাহাদিগের দমনার্থ এক দল “পরগণা সিপাহী” পাঠাইলেন। তাহাদের কেবল বন্দুক ছিল, এমত নহে, একটা কামানও ছিল। সন্তানেরা তাহাদের আগমন-সংবাদ পাইয়া আনন্দকানন হইতে নির্গত হইয়া, যুদ্ধার্থ অগ্রসর হইলেন। কিন্তু লাঠি সড়কি বা বিশ পঁচিশটা বন্দুক কামানের কাছে কি করিবে? সন্তানগণ পরাজিত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল।