আনন্দমঠ (১৯৩৮)/প্রথম খণ্ড/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

 সে স্ত্রীলোকের বয়স প্রায় পঁচিশ বৎসর, কিন্তু দেখিলে নিমাইয়ের অপেক্ষা অধিকবয়স্কা বলিয়া বোধ হয় না। মলিন, গ্রন্থিযুক্ত বসন পরিয়া সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলে, বোধ হইল যেন, গৃহ আলো হইল। বোধ হইল, পাতায় ঢাকা কোন গাছের কত ফুলের কুঁড়ি ছিল, হঠাৎ ফুটিয়া উঠিল; বোধ হইল যেন, কোথায় গোলাপজলের কার্ব্বা মুখ আটা ছিল, কে কার্ব্বা ভাঙ্গিয়া ফেলিল। যেন কে প্রায় নিবনি আগুনে ধুপ ধুনা গুগগুল ফেলিয়া দিল। সে রূপসী গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া ইতস্ততঃ স্বামীর অন্বেষণ করিতে লাগিল, প্রথমে ত দেখিতে পাইল না। তায় পর দেখিল, গৃহপ্রাঙ্গণে একটি ক্ষুদ্র বৃক্ষ আছে, আম্রের কাণ্ডে মাথা রাখিয়া জীবানন্দ কঁদিতেছেন। সেই রূপসী তাহার নিকটে গিয়া ধীরে ধীরে তাহার হস্তধারণ করিল। বলি না যে, তাহার চক্ষে জল আসিল, জগদীশ্বর জানেন যে, তাহার চক্ষে যে স্রোতঃ আসিয়াছিল, বহিলে তাহা জীবানন্দকে ভাসাইয়া দিত; কিন্তু সে তাহা বহিতে দিল না। জীবানন্দের হাত হাতে লইয়া বলিল, “ছি, কঁদিও না; আমি জানি, তুমি আমার জন্য কঁদিতেছ, আমার জন্য তুমি কঁদিও না- তুমি যে প্রকারে আমাকে রাখিয়াছ, আমি তাহাতেই সুখী।”

 জীবানন্দ মাথা দুলিয়া চকু মুছিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “শান্তি। তোমার এ শতগ্রন্থি মলিন বস্তু কেন? তোমার ত খাইবার পরিবার অভাব নাই।”

 শান্তি বলিল, “তোমার ধন, তোমারই জন্য আছে। আমি টাকা লইয়া কি করিতে হয়, তাহা জানি না। যখন তুমি আসিবে, যখন তুমি আমাকে আবার গ্রহণ করিবে।

  জীবা। গ্রহণ করিব-শান্তি। আমি কি তোমায় ত্যাগ করিয়াছি।

 শান্তি। ত্যাগ নহে-যবে তোমার ব্রত সাঙ্গ হইবে, যবে আবার আমায় ভালবাসিকে-

 কথা শেষ না হইতেই জীবানন্দ শান্তিকে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া, তাহার কাধে মাথা রাখিয়া অনেকক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন। দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া শেষে বলিলেন,

 “কেন দেখা করিলাম।”

 শান্তি। কেন করিলে–তোমার ত ব্রত ভঙ্গ করিলে?

 জীবা। ব্রতভঙ্গ হউক-প্রায়শ্চিত্ত আছে। তাহার জন্য ভাবি না, কিন্তু তোমায় দেখিয়া ত আর ফিরিয়া যাইতে পারিতেছি না। আমি এই জন্য নিমাইকে বলিয়াছিলাম যে, দেখায় কাজ নাই। তোমায় দেখিলে আমি ফিরিতে পারি না। এক দিকে ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, জগৎসংসার; এক দিকে ব্রত, হোম, যাগ, যজ্ঞ; সবই এক দিকে আর এক দিকে তুমি। একা তুমি। আমি সকল সময় বুঝিতে পারি না যে, কোন্ দিক্‌ ভারি হয়। দেশ ত শান্তি, দেশ লইয়া আমি কি করিব? দেশের এক কাঠা ভূঁই পেলে তোমায় লইয়া আমি স্বর্গ প্রস্তুত করিতে পারি, আমার দেশে কাজ কি? দেশের লোকের দুঃখ- যে তোমা হেন স্ত্রী পাইয়া ত্যাগ করিল—তাহার অপেক্ষা দেশে আর কে দুঃখী আছে? যে তোমার অঙ্গে শতগ্রন্থি বস্ত্র দেখিল, তাহার অপেক্ষা দরিদ্র দেশে আর কে আছে? আমার সকল ধর্মের সহায় তুমি। সে সহায় যে ত্যাগ করিল, তার কাছে আবার সনাতন ধর্ম কি? আমি কোন্ ধর্মের জন্য দেশে দেশে, বনে বনে, বন্দুক ঘাড়ে করিয়া, প্রাণিহত্যা করিয়া এই পাপের ভার সংগ্রহ করি? পৃথিবী সন্তানদের আয়ত্ত হইবে কি না জানি না; কিন্তু তুমি আমার আয়, তুমি পৃথিবীর অপেক্ষা বড়, তুমি আমার স্বর্গ। চল গৃহে যাই—আর আমি ফিরিব না।

 শান্তি কিছু কাল কথা কহিতে পারিল না। তার পর বলিল, “ছি—তুমি বীর। আমার পৃথিবীতে বড় সুখ যে, আমি বীরপত্নী। তুমি অধম স্ত্রীর জন্য বীরধর্ম ত্যাগ করিবে? তুমি আমায় ভালবাসিও না—আমি সে সুখ চাহি না—কিন্তু তুমি তোমার বীরধর্ম কখন ত্যাগ করিও না। দেখ—আমাকে একটা কথা বলিয়া যাও—এ ব্রতভঙ্গের প্রায়শ্চিত্ত কি?”

 জীবানন্দ বলিলেন, “প্রায়শ্চিত্ত-দান—উপবাস—২২ কাহণ কড়ি।”

 শান্তি ঈষৎ হাসিল। বলিল, “প্রায়শ্চিত্ত কি, তা আমি জানি। এক অপরাধে যে প্রায়শ্চিত্ত-শত অপরাধে কি তাই?”

 জীবানন্দ বিস্মিত ও বিষন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ সকল কথা কেন?”

 শান্তি। এক ভিক্ষা আছে। আমার সঙ্গে আবার দেখা না হইলে প্রায়: করিও না।

 জীবানন্দ তখন হাসিয়া বলিল, “সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকিও। তোমাকে না দে প্লা আমি মরিব না। মরিবার তত তাড়াতাড়ি নাই। আর আমি এখানে থাকিব না, স্তু চোখ ভরিয়া তোমাকে দেখিতে পাইলাম না, এক দিন অবশ্য সে দেখা দেখিব। এক দিন অবশ্য আমাদের মনস্কামনা সফল হইবে। আমি এখন চলিলাম, তুমি আমার এক অনুরোধ রক্ষা করিও। এ বেশভূষা ত্যাগ কর। আমার পৈতৃক ভিটায় গিয়া বাস কর।”

 শান্তি জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এখন কোথায় যাইবে?”

 জীবা। এখন মঠে ব্রহ্মচারীর অনুসন্ধানে যাইব। তিনি যে ভাবে নগরে গিয়াছেন, তাহাতে কিছু চিন্তাযুক্ত হইয়াছি; দেউলে তাঁহার সন্ধান না পাই, নগরে যাইব। হবে?